জামাল উদ্দিন হত্যার ১৯ বছর আজ বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছে স্বজনেরা

৮৪ জনের মধ্যে মাত্র দুইজনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন

চট্টগ্রামের ধণাঢ্য ব্যবসায়ী ও বিএনপির নেতা জামাল উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণের পর হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণে একের পর এক কালক্ষেপণ হচ্ছে। সর্বশেষ সাড়ে তিন বছর আগে এ মামলায় একজনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছিল। মামলায় মোট সাক্ষী ৮৪ জন। তাদের মধ্যে মাত্র দু’জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর নগরের চকবাজার এলাকার এক দোকানদার সর্বশেষ এ মামলায় সাক্ষ্য দেন চট্টগ্রাম দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। ১৩৫ কার্যদিবস শেষ হয়ে যাওয়ায় মামলাটি বিচারের জন্য ২০১৯ সালের মে মাসে পঞ্চম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে আসে। সাড়ে তিন বছরে এখানে ১৮টি তারিখ পড়ে। জানা গেছে, নগরের চকবাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৩ সালের ২৪ জুলাই রাতে বাসায় ফেরার পথে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি জামাল উদ্দিন অপহৃত হন। পরে তার কঙ্কাল উদ্ধার হয়। সংসদ নির্বাচনে আনোয়ারা থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন জামাল উদ্দিন। জানা যায়, এই মনোনয়ন ঠেকাতে ও কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। টাকা পেতে দেরি হওয়ায় খুন করা হয় তাকে। চট্টগ্রাম আদালত সূত্রে জানা গেছে, জামাল উদ্দিন হত্যা মামলা এখন চট্টগ্রাম মহানগর পঞ্চম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। ২৫ জুলাই পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। এদিকে মামলায় বিচার পাওয়া নিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন খোদ বাদী নিহত ব্যবসায়ীর ছেলে চৌধুরী ফরমান রেজা লিটন। তিনিও হাজির হচ্ছেন না সাক্ষ্য দিতে। সরকারি কৌঁসুলিরা বলছেন, আদালত সমন, পরোয়ানা দিয়েও বাদীকে হাজির করতে পারেননি। গত সাত বছরে মামলার খোঁজ নিতেও আসেননি তিনি। তদন্তে পুলিশ মূল আসামিদের বাদ দেয়ায় বাদী নারাজি আবেদন করেছিলেন। এটি শুনানি হতেই আইনি মারপ্যাঁচে কেটে গেছে ১২ বছর।

নিহত জামাল উদ্দিনের কয়েকজন স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকৃত আসামিদের আইনের আওতায় আনতে বছরের পর বছর আইনি লড়াই চালিয়েছেন তারা। কিন্তু তা না হওয়ায় এখন বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। বাদী হাল ছেড়ে দিলেও দীর্ঘদিন বিদেশে পালিয়ে থাকা আসামি ফটিকছড়ির কাঞ্চন নগরের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কাশেম দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন মামলায় বিচার পাওয়া নিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন খোদ বাদী নিহত ব্যবসায়ীর ছেলে চৌধুরী ফরমান রেজা লিটন। তিনিও হাজির হচ্ছেন না সাক্ষ্য দিতে।

সরকারি কৌঁসুলি তছলিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সাড়ে তিন বছরে মামলার খোঁজ নিতে বাদী একবারও আসেননি আদালতে। বাদীর সাক্ষ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আদালত সমন ও পরোয়ানা জারি করেন। কিন্তু বাদীকে পাওয়া যাচ্ছে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাকি সাক্ষীদের হাজির করার চেষ্টা চলছে।

দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন থাকাকালেও বাদীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানান এই ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি মো. আইয়ুব খান। তিনি বলেন, অনেক চেষ্টা করেও বাদীকে হাজির করা যায়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাদী জামাল উদ্দিনের ছেলে বছরের বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে থাকেন। সূত্র জানায়, তদন্তে পুলিশ মূল আসামিদের বাদ দেয়ায় তারা নারাজি আবেদন করেছিলেন। এটি শুনানি হতেই আইনি মারপ্যাঁচে কেটে গেছে ১২ বছর। মূল আসামিরা আইনের আওতায় না আসায় এখন তারা কী বিচার চাইবেন।

পরিবারের সদস্য ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, জামাল উদ্দিন অপহরণের ঘটনা সাজানো নাটক বলে মন্তব্য করে পুলিশ প্রথমে মামলা নেয়নি। পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে দুই বছর পর অপহরণের ‘অন্যতম হোতা’ আনোয়ারা সদরের সাবেক ইউপি সদস্য মো. শহীদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জেলার ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর পাহাড়ি এলাকা থেকে ২০০৫ সালের ২৪ আগস্ট জামাল উদ্দিনের কঙ্কাল উদ্ধার করে র?্যাব। সিঙ্গাপুরে ডিএনএ পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া যায়, কঙ্কালটি তার। এর আগে প্রশাসনের পরামর্শ অনুযায়ী অপহরণকারী চক্রকে মুক্তিপণের ২৫ লাখ টাকাও দেয় পরিবার। কিন্তু জামাল উদ্দিনকে মুক্তি দেয়া হয়নি।

ওই ঘটনা তদন্ত করেন পুলিশের ৯ কর্মকর্তা। তদন্ত শেষ হতে লাগে সাড়ে তিন বছর। এরপর ২০০৬ সালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আনোয়ারার সাবেক সংসদ সদস্য সরওয়ার জামাল নিজাম, তার ছোট ভাই মারুফ নিজামসহ ২৪ জনকে অব্যাহতি দিয়ে ও ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেয়। এটির বিরুদ্ধে নারাজি দেন বাদী। মামলার আসামি কালা মাহবুবকে রাজসাক্ষী করায় আপত্তি জানিয়ে মারুফ নিজাম উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নেন ২০০৭ সালে। ২০১১ সালে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে লিভ টু আপিল করেন আসামিরা। এটি খারিজের আদেশ চট্টগ্রাম আদালতে এসে পৌঁছায় ২০১৬ সালে।

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদালত সিআইডির দেয়া (২০০৬ সালে) অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। এরপর বাদীর নারাজি আবেদন খারিজ করে দেন। ইতোমধ্যে মারা যান দুই আসামি। পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১৪ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে এই মামলার বিচার শুরু হয়। বর্তমানে ১৪ আসামির মধ্যে কারাগারে আছেন শুধু মো. আলমগীর নামের এক আসামি। জামিনে আছেন ছয়জন। বাকিরা পলাতক।

রবিবার, ২৪ জুলাই ২০২২ , ০৯ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৫ জিলহজ ১৪৪৩

জামাল উদ্দিন হত্যার ১৯ বছর আজ বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছে স্বজনেরা

৮৪ জনের মধ্যে মাত্র দুইজনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন

নিরুপম দাশগুপ্ত, চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রামের ধণাঢ্য ব্যবসায়ী ও বিএনপির নেতা জামাল উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণের পর হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণে একের পর এক কালক্ষেপণ হচ্ছে। সর্বশেষ সাড়ে তিন বছর আগে এ মামলায় একজনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছিল। মামলায় মোট সাক্ষী ৮৪ জন। তাদের মধ্যে মাত্র দু’জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর নগরের চকবাজার এলাকার এক দোকানদার সর্বশেষ এ মামলায় সাক্ষ্য দেন চট্টগ্রাম দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। ১৩৫ কার্যদিবস শেষ হয়ে যাওয়ায় মামলাটি বিচারের জন্য ২০১৯ সালের মে মাসে পঞ্চম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে আসে। সাড়ে তিন বছরে এখানে ১৮টি তারিখ পড়ে। জানা গেছে, নগরের চকবাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৩ সালের ২৪ জুলাই রাতে বাসায় ফেরার পথে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি জামাল উদ্দিন অপহৃত হন। পরে তার কঙ্কাল উদ্ধার হয়। সংসদ নির্বাচনে আনোয়ারা থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন জামাল উদ্দিন। জানা যায়, এই মনোনয়ন ঠেকাতে ও কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। টাকা পেতে দেরি হওয়ায় খুন করা হয় তাকে। চট্টগ্রাম আদালত সূত্রে জানা গেছে, জামাল উদ্দিন হত্যা মামলা এখন চট্টগ্রাম মহানগর পঞ্চম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। ২৫ জুলাই পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। এদিকে মামলায় বিচার পাওয়া নিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন খোদ বাদী নিহত ব্যবসায়ীর ছেলে চৌধুরী ফরমান রেজা লিটন। তিনিও হাজির হচ্ছেন না সাক্ষ্য দিতে। সরকারি কৌঁসুলিরা বলছেন, আদালত সমন, পরোয়ানা দিয়েও বাদীকে হাজির করতে পারেননি। গত সাত বছরে মামলার খোঁজ নিতেও আসেননি তিনি। তদন্তে পুলিশ মূল আসামিদের বাদ দেয়ায় বাদী নারাজি আবেদন করেছিলেন। এটি শুনানি হতেই আইনি মারপ্যাঁচে কেটে গেছে ১২ বছর।

নিহত জামাল উদ্দিনের কয়েকজন স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকৃত আসামিদের আইনের আওতায় আনতে বছরের পর বছর আইনি লড়াই চালিয়েছেন তারা। কিন্তু তা না হওয়ায় এখন বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। বাদী হাল ছেড়ে দিলেও দীর্ঘদিন বিদেশে পালিয়ে থাকা আসামি ফটিকছড়ির কাঞ্চন নগরের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কাশেম দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন মামলায় বিচার পাওয়া নিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন খোদ বাদী নিহত ব্যবসায়ীর ছেলে চৌধুরী ফরমান রেজা লিটন। তিনিও হাজির হচ্ছেন না সাক্ষ্য দিতে।

সরকারি কৌঁসুলি তছলিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সাড়ে তিন বছরে মামলার খোঁজ নিতে বাদী একবারও আসেননি আদালতে। বাদীর সাক্ষ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আদালত সমন ও পরোয়ানা জারি করেন। কিন্তু বাদীকে পাওয়া যাচ্ছে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাকি সাক্ষীদের হাজির করার চেষ্টা চলছে।

দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন থাকাকালেও বাদীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানান এই ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি মো. আইয়ুব খান। তিনি বলেন, অনেক চেষ্টা করেও বাদীকে হাজির করা যায়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাদী জামাল উদ্দিনের ছেলে বছরের বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে থাকেন। সূত্র জানায়, তদন্তে পুলিশ মূল আসামিদের বাদ দেয়ায় তারা নারাজি আবেদন করেছিলেন। এটি শুনানি হতেই আইনি মারপ্যাঁচে কেটে গেছে ১২ বছর। মূল আসামিরা আইনের আওতায় না আসায় এখন তারা কী বিচার চাইবেন।

পরিবারের সদস্য ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, জামাল উদ্দিন অপহরণের ঘটনা সাজানো নাটক বলে মন্তব্য করে পুলিশ প্রথমে মামলা নেয়নি। পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে দুই বছর পর অপহরণের ‘অন্যতম হোতা’ আনোয়ারা সদরের সাবেক ইউপি সদস্য মো. শহীদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জেলার ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর পাহাড়ি এলাকা থেকে ২০০৫ সালের ২৪ আগস্ট জামাল উদ্দিনের কঙ্কাল উদ্ধার করে র?্যাব। সিঙ্গাপুরে ডিএনএ পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া যায়, কঙ্কালটি তার। এর আগে প্রশাসনের পরামর্শ অনুযায়ী অপহরণকারী চক্রকে মুক্তিপণের ২৫ লাখ টাকাও দেয় পরিবার। কিন্তু জামাল উদ্দিনকে মুক্তি দেয়া হয়নি।

ওই ঘটনা তদন্ত করেন পুলিশের ৯ কর্মকর্তা। তদন্ত শেষ হতে লাগে সাড়ে তিন বছর। এরপর ২০০৬ সালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আনোয়ারার সাবেক সংসদ সদস্য সরওয়ার জামাল নিজাম, তার ছোট ভাই মারুফ নিজামসহ ২৪ জনকে অব্যাহতি দিয়ে ও ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেয়। এটির বিরুদ্ধে নারাজি দেন বাদী। মামলার আসামি কালা মাহবুবকে রাজসাক্ষী করায় আপত্তি জানিয়ে মারুফ নিজাম উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নেন ২০০৭ সালে। ২০১১ সালে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে লিভ টু আপিল করেন আসামিরা। এটি খারিজের আদেশ চট্টগ্রাম আদালতে এসে পৌঁছায় ২০১৬ সালে।

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদালত সিআইডির দেয়া (২০০৬ সালে) অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। এরপর বাদীর নারাজি আবেদন খারিজ করে দেন। ইতোমধ্যে মারা যান দুই আসামি। পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১৪ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে এই মামলার বিচার শুরু হয়। বর্তমানে ১৪ আসামির মধ্যে কারাগারে আছেন শুধু মো. আলমগীর নামের এক আসামি। জামিনে আছেন ছয়জন। বাকিরা পলাতক।