চিকিৎসা নিয়ে লব্ধ অভিজ্ঞতা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালটি (বিএসএমএমইউ) একসময় পিজি হাসপাতাল নামে সমধিক পরিচিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এমডি, এমএস, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে থাকে। এই হাসপাতালে বাংলাদেশের সেরা ডাক্তারদের অবস্থান। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট পাঁচটি বহুতল ভবন আছেÑ ব্লক এ, বি, সি, ডি এবং কেবিন ব্লক। শুক্রবার এবং সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সকাল আটটা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত প্রশাসনিক দপ্তর খোলা থাকে। প্রতিদিন বাংলাদেশের সব প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের চিকিৎসা নেয়ার জন্য এই হাসপাতালে আসেন এবং এই হাসপাতালে সেবা নেয়া বেশির ভাগই দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তবে কেবিনে যারা চিকিৎসা নেন তারা কমবেশী ধনী এবং প্রভাবশালী।

অতি সম্প্রতি আমার মেজো ভাই মহিউদ্দিন আহমদের প্রায় একমাস এই হাসপাতালে চিকিৎসা হয়েছে। আমার মেজো ভাইয়ের ছিল লিভার সিরোসিস। এই রোগের শুরুতে চিকিৎসা করেছিলেন উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালের ডা. রোকনুজ্জামান; পেটে প্রচুর পানি এসে গেল ডা. রোকনুজ্জামান তাকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের লিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সেলিমুর রহমানের কাছে পাঠালেন। পাকিস্তান সুপেরিয়র সার্ভিসে মেজো ভাইয়ের ব্যাচমেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রমের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের আরেক লিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসানও কোনরূপ ফি না নিয়ে মেজো ভাইয়ের চিকিৎসায় নিয়োজিত হলেন। তারা আমার আরেক ভাই ডা. জহির উদ্দিন আহমেদকে জানিয়ে দিলেন, মহিউদ্দিন আহমদের শেষ সময় এসে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর ২০ হাজার ডলার অনুদান নিয়ে তিনি সিঙ্গাপুরের এক হাসপাতাল থেকে শুধু পেটের পানি বের করে দেশে ফেরত আসলেন। তিনি আরও ১০ বছর বেঁচে ছিলেন, এই সময়ে তিনি রিকশা, বাস, ট্রেনে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

চলতি বছরের প্রথমদিকে তার লিভারে টিউমার হয়েছে বলে সন্দেহ পোষণ করা হয়। কারণ, তার এএফপি বা আলফা ফেটো প্রোটেইন নরমাল ০.৬ থেকে বেড়ে হয়ে যায় ৬০ হাজার। কিন্তু কোন টেস্ট হতে ডাক্তার টিউমার বা ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারলেন না। এই অবস্থায় মহিউদ্দিন আহমদ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের সঙ্গে ল্যাবএইডে দেখা করলেন, ডা. স্বপ্নীল কীভাবে যেন নিশ্চিত হলেন যে, মেজো ভাইয়ের লিভারে টিউমার আছে এবং তা ক্যান্সারযুক্ত।

হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি হলেও মেজো ভাই আর্থিক কারণে ল্যাবএইডে বা কোন ক্লিনিকে ভর্তি হতে সম্মত হলেন না। আমি আর আমার ভাবী বিলকিস মহিউদ্দিন বিএসএমএমইউ হাসপাতালে গিয়ে উপাচার্যের অফিস শাখায় তার পিএসের সঙ্গে দেখা করলাম; গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমদের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা শুনে তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের একটি কেবিনের ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু চিকিৎসা নিতে হলে অনলাইন বা বহির্বিভাগ থেকে একটা টিকিট নিতে হয়। আউটডোরে টিকিট করতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম, বিরাট লাইন। ফেরত এসে হাসপাতালের এক কর্মীকে টিকিটের ফি এবং কিছু বকশিশ দিলে তিনি ১০ মিনিটের মধ্যে টিকিট এনে হাতে দিলেন।

এই হাসপাতালে সব ডাক্তারই কমবেশী স্ব-স্ব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। কিন্তু অব্যবস্থাপনা সর্বত্র। নার্সেরা একটি টেবিলের চারপাশে বসে ফেসবুকে মশগুল থাকেন, প্রয়োজনে ডাকতে গেলে প্রায় সবাই একটি কথা বলেন, ‘আপনি যান আমি আসছি’। যত জরুরিই হোক না কেন, কোন নার্স ডাকার সঙ্গে সঙ্গে আসেন না। কোন নার্স রোগীর নথি দেখার গরজ বোধ করেন না, রোগীকে ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টাও করেন না, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কোন নির্দেশনা দিয়ে গেলে তাও রোগী বা তার এটেন্ডেন্টকে অবহিত করেন না। আমি যতবার শান্তিনগর কোয়ান্টাম থেকে রক্ত নিয়ে গেছি ততবার তা প্রয়োগের নির্দেশনা ডিউটি ডাক্তার থেকে আমাকে নিতে বলা হয়েছে। রোগীর এটেনডেন্টকে কেন ডিউটি ডাক্তার থেকে নির্দেশনা গ্রহণ করতে হবে, জিজ্ঞেস করে উত্তর পেয়েছি, ‘রক্ত এনেছেন আপনি, নির্দেশনা আপনাকেই নিতে হবে’। আজব ব্যবস্থা! এই হাসপাতালে ইনজেকশান দেয়ার জন্য তুলা এবং স্যানেটাইজারও রোগীকে কিনতে হয়, এমন কি ডাক্তার-নার্স রোগীর কেনা স্যানেটাইজার ব্যবহার করে থাকেন।

এই হাসপাতালে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ না থাকায় রোগী এবং তার এটেনডেন্টকে সর্বক্ষেত্রে হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। রক্ত পরীক্ষার জন্য ডাক্তারের রিকুজিশন সিøপ নিয়ে অন্য ভবনে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টাখানেক ব্যয় করে বিল করাতে হয়, আরেক ভবনে গিয়ে বিলের টাকা জমা দেয়ার জন্য ব্যাংক কাউন্টারে কমপক্ষে দেড়-দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ব্যাংকের সম্মুখে সব সময় লোকে লোকারণ্য। বিল দেয়ার পর আরেক শাখায় গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে খালি টিউব নিয়ে রোগীর কাছে ছুটতে হয়, নার্সের সহায়তায় রোগীর শরীর থেকে রক্ত নিয়ে আবার দৌড় আরেক ভবনের ল্যাবরেটরি পর্যন্ত, এখানেও বিরাট লাইন। রিপোর্ট নিতে হয় রাত ৯টার পর, সেখানেও লাইনে দাঁড়িয়ে রিপোর্ট নিতে ঘণ্টা খানেক লাগে। সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নিয়ে অহঙ্কার করে থাকে; অথচ এই হাসপাতালের আদিম যুগের ব্যবস্থাপনা কারো নজরে পড়ে না। রিপোর্ট অনলাইনে সরাসরি ডাক্তার এবং রোগীর স্বজনদের কাছে কেন পাঠানোর ব্যবস্থা নেই, ডিজিটাল বাংলাদেশে এখনো কেন রোগীর স্বজনদের লাইনে দাঁড়িয়ে রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হয়, তা আমাদের বিস্মিত করে।

সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হয় রোগী মুক্তিযোদ্ধা হলে। রোগী মুক্তিযোদ্ধা হলে সরকারি হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা এবং সিট ভাড়ার ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ মওকুফ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিটি পরীক্ষায় প্রশাসনিক অনুমোদন নিতে গিয়ে হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। বড় কর্মকর্তার নির্দেশ হচ্ছে, অনেকগুলো সিøপ জমা না পড়লে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা যাবে না। অন্যদিকে হাসপাতালের অফিস সময় দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত, আড়াইটার পর মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেখে অনুমোদন দেয়ার কোন লোক থাকেন না। পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিসে এমন নির্ধারিত অফিস সময়সূচি পালন করা হলে পৃথিবী আর শিঙ্গা ফুঁকে ধ্বংস করার প্রয়োজন হবে না। এই সব হয়রানি মুক্তি পেতে রোগীর বড় মেয়ে অরু মহিউদ্দিন হাসপাতালের এক নিম্ন বেতনভুক কর্মচারীর সহায়তা নিল, ওই কর্মচারী দ্রুত সব কাজের সমাধা করে ফেলত।

হাসপাতালের বেতনভুক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ তাদের খেয়ালখুশি মতো হাসপাতালে আসেন। প্রায় দিন তারা হাসপাতালে আসেন না, শিক্ষার্থী বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। সিনিয়র ডাক্তারগণ বিভিন্ন ক্লিনিকে ব্যস্ত থাকেন। রোগী মহিউদ্দিন আহমদের ক্যান্সারযুক্ত টিউমারটির আধুনিক পদ্ধতিতে অপারেশনের প্রস্তাব দিলেন ডা. স্বপ্নীল। এই পদ্ধতিটি হচ্ছে ‘টেস অপারেশন’- এই পদ্ধতিতে শরীর কাটতে হয় না, এনজিওগ্রামের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় টিউমারের মুখ বন্ধ করে দিয়ে কেমো প্রয়োগ করা হয়। এই অপারেশনের জন্য যে যন্ত্রপাতির প্রয়োজন, তা বিএসএমএমইউ হাসপাতালে থাকলেও তা সচল না থাকায় ডা. স্বপ্নীলের প্রস্তাব মতো ইমপালস হাসপাতালে ৩ লাখ ৬ হাজার টাকার চুক্তির বিনিময়ে এই অপারেশন করা হয়। ইমপালস হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে আবার বিএসএমএমইউ হাসপাতালে রোগীকে আনার পর কেবিন ব্লকের নিচে কোন হুইলচেয়ার ছিল না, চাকা ভাঙা একটি হুইলচেয়ার শিকলে বাঁধা ছিল।

দলমত নির্বিশেষে সব ডাক্তারের একটি সংগঠন রয়েছে, নাম বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। কিন্তু বিএনপি সমর্থিত ড্যাব বা ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বাচিপ বা স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ গঠিত হওয়ার পর জাতীয় পর্যায়ের বিএমএ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। জাতীয় রাজনীতির প্রশ্নে এই দুটি সংগঠনের সম্পর্ক সাপে-নেউলে; কিন্তু অনৈতিক কর্মকা-ে উভয় সংগঠনের ডাক্তারগণ একতাবদ্ধ। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, সেই দল শর্তহীনভাবে তাদের দলীয় চিকিৎসক সংগঠনের অনৈতিক কর্মকা-কে প্রশ্রয় দিয়েছে। এর ফলে দেশে পেশাজীবী চিকিৎসক সমাজ তৈরি হয়নি, হয়েছে স্বাচিপ চিকিৎসক এবং ড্যাব চিকিৎসক। সরকার এদের ভয়ও করে, স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা অচল করে দিতে এদের এক মিনিট সময়ও লাগে না। বিরোধী দল গণতন্ত্র চায়, সুশাসন চায়, জবাবদিহি চায়, কিন্তু ডাক্তারদের অনৈতিক কাজের বিরোধিতা সরকারও করে না, বিরোধী দলও করে না। তাই চিকিৎসা সেবা পাওয়ার প্রত্যাশায় আমাদের দেশের হতদরিদ্র মানুষগুলোও তাদের সহায়-সম্বল সব বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

রবিবার, ২৪ জুলাই ২০২২ , ০৯ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৫ জিলহজ ১৪৪৩

চিকিৎসা নিয়ে লব্ধ অভিজ্ঞতা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালটি (বিএসএমএমইউ) একসময় পিজি হাসপাতাল নামে সমধিক পরিচিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এমডি, এমএস, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে থাকে। এই হাসপাতালে বাংলাদেশের সেরা ডাক্তারদের অবস্থান। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট পাঁচটি বহুতল ভবন আছেÑ ব্লক এ, বি, সি, ডি এবং কেবিন ব্লক। শুক্রবার এবং সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সকাল আটটা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত প্রশাসনিক দপ্তর খোলা থাকে। প্রতিদিন বাংলাদেশের সব প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের চিকিৎসা নেয়ার জন্য এই হাসপাতালে আসেন এবং এই হাসপাতালে সেবা নেয়া বেশির ভাগই দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তবে কেবিনে যারা চিকিৎসা নেন তারা কমবেশী ধনী এবং প্রভাবশালী।

অতি সম্প্রতি আমার মেজো ভাই মহিউদ্দিন আহমদের প্রায় একমাস এই হাসপাতালে চিকিৎসা হয়েছে। আমার মেজো ভাইয়ের ছিল লিভার সিরোসিস। এই রোগের শুরুতে চিকিৎসা করেছিলেন উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালের ডা. রোকনুজ্জামান; পেটে প্রচুর পানি এসে গেল ডা. রোকনুজ্জামান তাকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের লিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সেলিমুর রহমানের কাছে পাঠালেন। পাকিস্তান সুপেরিয়র সার্ভিসে মেজো ভাইয়ের ব্যাচমেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রমের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের আরেক লিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসানও কোনরূপ ফি না নিয়ে মেজো ভাইয়ের চিকিৎসায় নিয়োজিত হলেন। তারা আমার আরেক ভাই ডা. জহির উদ্দিন আহমেদকে জানিয়ে দিলেন, মহিউদ্দিন আহমদের শেষ সময় এসে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর ২০ হাজার ডলার অনুদান নিয়ে তিনি সিঙ্গাপুরের এক হাসপাতাল থেকে শুধু পেটের পানি বের করে দেশে ফেরত আসলেন। তিনি আরও ১০ বছর বেঁচে ছিলেন, এই সময়ে তিনি রিকশা, বাস, ট্রেনে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

চলতি বছরের প্রথমদিকে তার লিভারে টিউমার হয়েছে বলে সন্দেহ পোষণ করা হয়। কারণ, তার এএফপি বা আলফা ফেটো প্রোটেইন নরমাল ০.৬ থেকে বেড়ে হয়ে যায় ৬০ হাজার। কিন্তু কোন টেস্ট হতে ডাক্তার টিউমার বা ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারলেন না। এই অবস্থায় মহিউদ্দিন আহমদ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের সঙ্গে ল্যাবএইডে দেখা করলেন, ডা. স্বপ্নীল কীভাবে যেন নিশ্চিত হলেন যে, মেজো ভাইয়ের লিভারে টিউমার আছে এবং তা ক্যান্সারযুক্ত।

হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি হলেও মেজো ভাই আর্থিক কারণে ল্যাবএইডে বা কোন ক্লিনিকে ভর্তি হতে সম্মত হলেন না। আমি আর আমার ভাবী বিলকিস মহিউদ্দিন বিএসএমএমইউ হাসপাতালে গিয়ে উপাচার্যের অফিস শাখায় তার পিএসের সঙ্গে দেখা করলাম; গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমদের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা শুনে তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের একটি কেবিনের ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু চিকিৎসা নিতে হলে অনলাইন বা বহির্বিভাগ থেকে একটা টিকিট নিতে হয়। আউটডোরে টিকিট করতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম, বিরাট লাইন। ফেরত এসে হাসপাতালের এক কর্মীকে টিকিটের ফি এবং কিছু বকশিশ দিলে তিনি ১০ মিনিটের মধ্যে টিকিট এনে হাতে দিলেন।

এই হাসপাতালে সব ডাক্তারই কমবেশী স্ব-স্ব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। কিন্তু অব্যবস্থাপনা সর্বত্র। নার্সেরা একটি টেবিলের চারপাশে বসে ফেসবুকে মশগুল থাকেন, প্রয়োজনে ডাকতে গেলে প্রায় সবাই একটি কথা বলেন, ‘আপনি যান আমি আসছি’। যত জরুরিই হোক না কেন, কোন নার্স ডাকার সঙ্গে সঙ্গে আসেন না। কোন নার্স রোগীর নথি দেখার গরজ বোধ করেন না, রোগীকে ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টাও করেন না, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কোন নির্দেশনা দিয়ে গেলে তাও রোগী বা তার এটেন্ডেন্টকে অবহিত করেন না। আমি যতবার শান্তিনগর কোয়ান্টাম থেকে রক্ত নিয়ে গেছি ততবার তা প্রয়োগের নির্দেশনা ডিউটি ডাক্তার থেকে আমাকে নিতে বলা হয়েছে। রোগীর এটেনডেন্টকে কেন ডিউটি ডাক্তার থেকে নির্দেশনা গ্রহণ করতে হবে, জিজ্ঞেস করে উত্তর পেয়েছি, ‘রক্ত এনেছেন আপনি, নির্দেশনা আপনাকেই নিতে হবে’। আজব ব্যবস্থা! এই হাসপাতালে ইনজেকশান দেয়ার জন্য তুলা এবং স্যানেটাইজারও রোগীকে কিনতে হয়, এমন কি ডাক্তার-নার্স রোগীর কেনা স্যানেটাইজার ব্যবহার করে থাকেন।

এই হাসপাতালে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ না থাকায় রোগী এবং তার এটেনডেন্টকে সর্বক্ষেত্রে হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। রক্ত পরীক্ষার জন্য ডাক্তারের রিকুজিশন সিøপ নিয়ে অন্য ভবনে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টাখানেক ব্যয় করে বিল করাতে হয়, আরেক ভবনে গিয়ে বিলের টাকা জমা দেয়ার জন্য ব্যাংক কাউন্টারে কমপক্ষে দেড়-দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ব্যাংকের সম্মুখে সব সময় লোকে লোকারণ্য। বিল দেয়ার পর আরেক শাখায় গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে খালি টিউব নিয়ে রোগীর কাছে ছুটতে হয়, নার্সের সহায়তায় রোগীর শরীর থেকে রক্ত নিয়ে আবার দৌড় আরেক ভবনের ল্যাবরেটরি পর্যন্ত, এখানেও বিরাট লাইন। রিপোর্ট নিতে হয় রাত ৯টার পর, সেখানেও লাইনে দাঁড়িয়ে রিপোর্ট নিতে ঘণ্টা খানেক লাগে। সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নিয়ে অহঙ্কার করে থাকে; অথচ এই হাসপাতালের আদিম যুগের ব্যবস্থাপনা কারো নজরে পড়ে না। রিপোর্ট অনলাইনে সরাসরি ডাক্তার এবং রোগীর স্বজনদের কাছে কেন পাঠানোর ব্যবস্থা নেই, ডিজিটাল বাংলাদেশে এখনো কেন রোগীর স্বজনদের লাইনে দাঁড়িয়ে রিপোর্ট সংগ্রহ করতে হয়, তা আমাদের বিস্মিত করে।

সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হয় রোগী মুক্তিযোদ্ধা হলে। রোগী মুক্তিযোদ্ধা হলে সরকারি হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা এবং সিট ভাড়ার ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ মওকুফ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিটি পরীক্ষায় প্রশাসনিক অনুমোদন নিতে গিয়ে হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। বড় কর্মকর্তার নির্দেশ হচ্ছে, অনেকগুলো সিøপ জমা না পড়লে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা যাবে না। অন্যদিকে হাসপাতালের অফিস সময় দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত, আড়াইটার পর মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেখে অনুমোদন দেয়ার কোন লোক থাকেন না। পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিসে এমন নির্ধারিত অফিস সময়সূচি পালন করা হলে পৃথিবী আর শিঙ্গা ফুঁকে ধ্বংস করার প্রয়োজন হবে না। এই সব হয়রানি মুক্তি পেতে রোগীর বড় মেয়ে অরু মহিউদ্দিন হাসপাতালের এক নিম্ন বেতনভুক কর্মচারীর সহায়তা নিল, ওই কর্মচারী দ্রুত সব কাজের সমাধা করে ফেলত।

হাসপাতালের বেতনভুক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ তাদের খেয়ালখুশি মতো হাসপাতালে আসেন। প্রায় দিন তারা হাসপাতালে আসেন না, শিক্ষার্থী বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। সিনিয়র ডাক্তারগণ বিভিন্ন ক্লিনিকে ব্যস্ত থাকেন। রোগী মহিউদ্দিন আহমদের ক্যান্সারযুক্ত টিউমারটির আধুনিক পদ্ধতিতে অপারেশনের প্রস্তাব দিলেন ডা. স্বপ্নীল। এই পদ্ধতিটি হচ্ছে ‘টেস অপারেশন’- এই পদ্ধতিতে শরীর কাটতে হয় না, এনজিওগ্রামের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় টিউমারের মুখ বন্ধ করে দিয়ে কেমো প্রয়োগ করা হয়। এই অপারেশনের জন্য যে যন্ত্রপাতির প্রয়োজন, তা বিএসএমএমইউ হাসপাতালে থাকলেও তা সচল না থাকায় ডা. স্বপ্নীলের প্রস্তাব মতো ইমপালস হাসপাতালে ৩ লাখ ৬ হাজার টাকার চুক্তির বিনিময়ে এই অপারেশন করা হয়। ইমপালস হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে আবার বিএসএমএমইউ হাসপাতালে রোগীকে আনার পর কেবিন ব্লকের নিচে কোন হুইলচেয়ার ছিল না, চাকা ভাঙা একটি হুইলচেয়ার শিকলে বাঁধা ছিল।

দলমত নির্বিশেষে সব ডাক্তারের একটি সংগঠন রয়েছে, নাম বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। কিন্তু বিএনপি সমর্থিত ড্যাব বা ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বাচিপ বা স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ গঠিত হওয়ার পর জাতীয় পর্যায়ের বিএমএ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। জাতীয় রাজনীতির প্রশ্নে এই দুটি সংগঠনের সম্পর্ক সাপে-নেউলে; কিন্তু অনৈতিক কর্মকা-ে উভয় সংগঠনের ডাক্তারগণ একতাবদ্ধ। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, সেই দল শর্তহীনভাবে তাদের দলীয় চিকিৎসক সংগঠনের অনৈতিক কর্মকা-কে প্রশ্রয় দিয়েছে। এর ফলে দেশে পেশাজীবী চিকিৎসক সমাজ তৈরি হয়নি, হয়েছে স্বাচিপ চিকিৎসক এবং ড্যাব চিকিৎসক। সরকার এদের ভয়ও করে, স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা অচল করে দিতে এদের এক মিনিট সময়ও লাগে না। বিরোধী দল গণতন্ত্র চায়, সুশাসন চায়, জবাবদিহি চায়, কিন্তু ডাক্তারদের অনৈতিক কাজের বিরোধিতা সরকারও করে না, বিরোধী দলও করে না। তাই চিকিৎসা সেবা পাওয়ার প্রত্যাশায় আমাদের দেশের হতদরিদ্র মানুষগুলোও তাদের সহায়-সম্বল সব বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]