খ্রিস্টীয় বিশ্বাসীদের উদ্বেগ

মিথুশিলাক মুরমু

১.

২০১৬ খ্রিস্টাব্দে ২২ মার্চ দুর্বৃত্তদের অস্ত্রের আঘাতে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যু হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ধর্মান্তরিত হোসেন আলীর। সেদিন প্রাতঃভ্রমণে বের হওয়া হোসেন আলীকে দুর্বৃত্তরা মোটরসাইকেলযোগে এসে কুপিয়ে হত্যা করে এবং নিশ্চিন্তে চলেও যান। এ ঘটনায় একটি হত্যা ও একটি বিস্ফোরক আইনে মামলা করা হয়। পরবর্তীকালে ওই বছরের ৭ নভেম্বর কুড়িগ্রাম সদর থানা পুলিশ ১০ জেএমবি সদস্যকে আসামি করে কুড়িগ্রাম মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

দীর্ঘ ৬ বছর পর গত ২২ জুন, ২০২২ খ্রিস্টাব্দে কুড়িগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্দুল মান্নান আসামিদের রায় পড়ে শোনান। পি. পি. আব্রাহাম লিংকন জানান, ‘রায়ে হত্যার দায়ে ছয় আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া একই আদালত বিস্ফোরক আইনের ৩ ধারায় জাহাঙ্গীর ওরফে রাজিব গান্ধী, রিয়াজুল ইসলাম মেহেদী ও গোলাম রব্বানীকে যাবজ্জীবন কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা; অনাদায়ে এক বছরের জেল এবং একই আইনের ৪ ধারায় ওই তিন আসামিকে ২০ বছর কারাদ- ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানা; অনাদায়ে ৬ মাসের কারাবাসের আদেশ দেয়।’ দ-িতরা হলেন জাহাঙ্গীর ওরফে রাজিব ওরফে রাজিব গান্ধী, রিয়াজুল ইসলাম মেহেনী, গোলাম রব্বানী, হাসান ফিরোজ ওরফে মোখলেছ মাহবুব হাসান মিলন ওরফে হাসান ওরফে মিলন ও আবু নাসির ওরফে রুবেল। রায় ঘোষণার সময় রিয়াজুল ইসলাম মেহেদী ছাড়া বাকিরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। খ্রিস্ট বিশ^াসী হোসেন আলীর বিচার নিষ্পত্তি আমাদের আশান্বিত করে করেছে, অন্যদিকে তার নিকটজনদের প্রতি মুহুর্মুহু হুমকি উদ্বিগ্ন ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তার পরিবার এবং খ্রিস্টীয় সমাজ।

২.

জুলাই ৮ তারিখ সন্ধ্যায় কথা হচ্ছিল পাষ্টর তিমথী বাড়ৈয়ের সঙ্গে। রুদ্ধ কণ্ঠস্বরেই জানাচ্ছিলেন ঘটে যাওয়া একটি কালো অধ্যায়। বিগত ৫ জুলাই, ২০২২ খ্রি. গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া বাগদা বাজারে পাষ্টর তিমথী বাড়ৈ পূর্ব নির্ধারিত ব্যক্তি বাজারের দোকানদার মোর্শেদের সঙ্গে প্রভু যিশুর বিষয়ে আলাপের লক্ষ্যে উপস্থিত হলে দোকানদার মোর্শেদ স্থানীয় দুজন মসজিদের ইমাম সাহেবকে বিষয়টি অবগত করেন। অবশ্য ইতিপূর্বে ১ জুলাই শুক্রবার তিনি দোকানদার মোর্শেদ ও স্থানীয় সাবেক ইউপি পরিষদ সদস্যের উপস্থিতিতে প্রভু যিশুর ভালোবাসা ও তার কাছে যাবার পথ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করেছিলেন। সেদিন বাজারের দোকানদার মোর্শেদের দোকানে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজন জড়ো হতে থাকে। অতঃপর ইমাম সাহেব আসার পরই কথা বলার সুযোগ না দিয়েই পাষ্টর তিমথী বাড়ৈকে স্যা-েল খুলে উত্তম-মধ্যম দিতে শুরু করেন। ইমাম সাহেবের দেখাদেখি উৎসুক জনতা কর্তৃকও চরমভাবে শারীরিকভাবে হেনস্তা ও অপদস্তের শিকার হন। ইমাম সাহেবের উপস্থিতিতেই জুতার মালা তৈরি করে পাষ্টর তিমথী বাড়ৈয়ের গলায় পরিয়ে দেয়া হয়।

পাশর্^বর্তী গ্রামের বাসিন্দা পাষ্টর তিমথী বাড়ৈয়ের গলায় জুতার মালা পরানো যেন তাদের বিজয় কিন্তু মানবতার যে অপমৃত্যু হলো; সেটির দিকে কারও কোন খেয়াল ছিল না। সেই জায়গায় অপর একজন খ্রিস্ট বিশ^াসী বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তিনি অত্র এলাকার পালকপ্রধানকে অবহিত করলে দ্রুততার সঙ্গে স্থানীয় থানাকে অবহিত করা হয়। পুলিশ এসে পাষ্টর তিমথীকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। থানাতে মুচলেকাতে লিখতে হয়েছে ভিন্ন কথা, যা পাষ্টর তিমথী বাড়ৈ মেনে নিতে পারেননি। সত্যিই কেন তাকে এমন অপমানিত হতে হলো? একজন ব্যক্তি যদি ধর্ম কথা শ্রবণে অপারগতা প্রকাশ করে, সে ক্ষেত্রে কেউই তাকে শোনাতে পারে না; কিন্তু আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে এরূপ সাম্প্রদায়িকতা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তাহলে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। দোকানদার মোর্শেদ তো সোজাসাপটা বলতে পারতেন, আমাকে প্রভু যিশু সম্পর্কে না বললেই খুশি হবো! নিশ্চয়ই পাষ্টর তিমথী বাড়ৈ জোরপূর্বক বলার সাহস রাখেন না! এটি নিঃসন্দেহে একটি চক্রান্ত এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য স্থানীয় ব্যক্তিবর্গরাই দোষী। বর্তমানে পাষ্টর তিমথী বাড়ৈ ও তার পরিবার বেশ আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। আমরা দোষী ব্যক্তিদের স্যাবস্ত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি করি।

৩.

পল্লীচিকিৎসক ফজল সরকার ফিলিপ ও তার পরিবার বিগত ৩ জুন, ২০২২ খ্রিস্টাব্দের সকাল ৮টায় স্থানীয় মো. হাসেম আলী তার দলবল নিয়ে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ডা. ফজল সরকার ফিলিপের বাড়িতে হামলা চালায়। ঘটনাটি ঘটেছে, কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলায়। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী ডা. ফজল সরকার ফিলিপ ও তার পরিবারে দেশীয় লাঠিসোঠা এবং অন্যান্য অস্ত্রাধি নিয়ে হামলায় পরিবারের সদস্যগণ সেলিম সরকার, সুমি সরকার, লাবণী সরকার, শিল্পী সরকার, ইমরান আলী, রফিকুল ইসলাম গুরুত্বর আহত হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। জানা যায়, খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ফজল সরকার ফিলিপের বাড়ি ও জমি দীর্ঘদিন থেকে দখলের পাঁয়তারা করে আসছিল মো. হাসেম আলী।

কিন্তু কেন, এই কেন কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ বিষয়টি নিয়ে ভুরুঙ্গামারী থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করা হলে জানান, ‘আমরা ভিকটিমের কাছ থেকে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জেনেছি কিন্তু লিখিত অভিযোগ না পাওয়া পর্যন্ত ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং কোন ধরনের সহায়তা করতে পারছি না।’

ফিলিপ বলেছেন, পরিবারের সবাই চিকিৎসাধীন থাকায় পরিবারের পক্ষে কেউই থানায় উপস্থিত হয়ে অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারে নাই। বরং বিবাদীর পক্ষ থেকে সুবিধাদি নিয়েছেন বলে পুলিশ প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছেন, এমনই মনে করছেন ভুক্তভোগীরা। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, একজন আক্রান্ত ব্যক্তি প্রশাসনের সহায়তা চেয়েছে, সে ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কীভাবে নিশ্চিন্তে বসে আছেন সেটি বোধগম্য নয়! তাহলে কী প্রশাসনের মধ্যেও দৃষ্টিভঙ্গির দৈন্যতা রয়েছে, রয়েছে বৈষম্যের সূক্ষ্ম রেখাপাত! প্রশাসনের এহেন নীরবতা ও পক্ষপাতমূলক আচরণ সমগ্র খ্রিস্ট সমাজকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

৪.

মি. জেবান আলী, শেরপুর, দৌলতপুর, কুষ্টিয়ার একজন খ্রিস্ট বিশ^াসী। স্থানীয় চার্চ দ্বারা প্রভু যিশুকে মুক্তিদাতা ও উদ্ধারকর্তা হিসেবে গ্রহণ ও স্বীকার করে। বিগত ৬ জুন, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের বিতর্কিত রাজনৈতিক নেত্রী নুপুর শর্মার বিষয়ে ফেসবুকে লাইক করলে এ দিনে স্থানীয় মুসল্লিরা সদলবলে মি. জেবান আলীর পরিবার, ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে। আমাদের কথা হচ্ছে, একজন ব্যক্তি তার স্বীয় কর্মকা-ের জন্য শাস্তি, জেল জরিমানা হতে পারে কিন্তু তার পরিবার-পরিজন, আবাসস্থল এবং এটিকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটে থাকে; সেটি কখনোই কাম্য হতে পারে না। দেশের আইনকানুন অনুযায়ী নিশ্চয়ই তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হবে; তাহলে আমরা কেন আইনকে নিজের হাতে তুলে নিচ্ছি! এদিকটিই খ্রিস্ট বিশ^াসীদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আমরা মনে করি, শতসহস্র বছরের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের যে বন্ধন রয়েছে; সেখানে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা যেন ফিকে হয়ে যেতে বসেছে। এ জাতীয় অনেক ঘটনা সম্প্রতিককালে ঘটে চলেছে এবং খ্রিস্টানুসারীদের কাছে যেন অশনী সংকেত হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে।

আমরা প্রায়শই অবলোকন করছি, ধর্মীয় সৌহার্দ্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে এবং এক শ্রেণির লোকেরা ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকারে খুবই সিদ্ধহস্ত। মানুষ মাত্রই ভুল করে থাকে, আমরা কেউই স্বর্গীয় দূত না যে, ভুল থাকবে না। ভুলভ্রান্তি আছে বলেই সংশোধনের সুযোগ আছে, দেশে আইনকানুন আছে, বিচারালয় আছে; কিন্তু যখন আমরা নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিই, সেখানেই, ধর্মের, মানবতার মৃত্যু ঘটে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পবিত্র সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালে স্পষ্টই ঘোষণা করেছেন, ‘...মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারও বাধা দেয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।’

২০২২ খ্রিস্টাব্দে জুন পর্যন্ত প্রায় ডজন খানেক খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের ওপর নির্যাতন, অত্যাচার, হামলা, মামলা-মোকাদ্দমা ইত্যাদি ঘটেই চলেছে। ক্রমশই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে বিশেষত খ্রিস্টিয়ান জনগোষ্ঠী এবং সচেতন দেশবাসীও ধর্মীয় উগ্রবাদিতার বিষয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে চলেছেন। এখনই অস্থিতিশীল পরিবেশকে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিমূলক ক্ষেত্রে পরিণত করতে ব্যর্থ হলে আকাশ-বাতাস বিষবাষ্পে পরিণত হবে; পুরো দেশকে এটির দায়ভার নিতে হবে।

[লেখক : কলামিস্ট]

রবিবার, ২৪ জুলাই ২০২২ , ০৯ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৫ জিলহজ ১৪৪৩

খ্রিস্টীয় বিশ্বাসীদের উদ্বেগ

মিথুশিলাক মুরমু

১.

২০১৬ খ্রিস্টাব্দে ২২ মার্চ দুর্বৃত্তদের অস্ত্রের আঘাতে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যু হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ধর্মান্তরিত হোসেন আলীর। সেদিন প্রাতঃভ্রমণে বের হওয়া হোসেন আলীকে দুর্বৃত্তরা মোটরসাইকেলযোগে এসে কুপিয়ে হত্যা করে এবং নিশ্চিন্তে চলেও যান। এ ঘটনায় একটি হত্যা ও একটি বিস্ফোরক আইনে মামলা করা হয়। পরবর্তীকালে ওই বছরের ৭ নভেম্বর কুড়িগ্রাম সদর থানা পুলিশ ১০ জেএমবি সদস্যকে আসামি করে কুড়িগ্রাম মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

দীর্ঘ ৬ বছর পর গত ২২ জুন, ২০২২ খ্রিস্টাব্দে কুড়িগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্দুল মান্নান আসামিদের রায় পড়ে শোনান। পি. পি. আব্রাহাম লিংকন জানান, ‘রায়ে হত্যার দায়ে ছয় আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া একই আদালত বিস্ফোরক আইনের ৩ ধারায় জাহাঙ্গীর ওরফে রাজিব গান্ধী, রিয়াজুল ইসলাম মেহেদী ও গোলাম রব্বানীকে যাবজ্জীবন কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা; অনাদায়ে এক বছরের জেল এবং একই আইনের ৪ ধারায় ওই তিন আসামিকে ২০ বছর কারাদ- ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানা; অনাদায়ে ৬ মাসের কারাবাসের আদেশ দেয়।’ দ-িতরা হলেন জাহাঙ্গীর ওরফে রাজিব ওরফে রাজিব গান্ধী, রিয়াজুল ইসলাম মেহেনী, গোলাম রব্বানী, হাসান ফিরোজ ওরফে মোখলেছ মাহবুব হাসান মিলন ওরফে হাসান ওরফে মিলন ও আবু নাসির ওরফে রুবেল। রায় ঘোষণার সময় রিয়াজুল ইসলাম মেহেদী ছাড়া বাকিরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। খ্রিস্ট বিশ^াসী হোসেন আলীর বিচার নিষ্পত্তি আমাদের আশান্বিত করে করেছে, অন্যদিকে তার নিকটজনদের প্রতি মুহুর্মুহু হুমকি উদ্বিগ্ন ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তার পরিবার এবং খ্রিস্টীয় সমাজ।

২.

জুলাই ৮ তারিখ সন্ধ্যায় কথা হচ্ছিল পাষ্টর তিমথী বাড়ৈয়ের সঙ্গে। রুদ্ধ কণ্ঠস্বরেই জানাচ্ছিলেন ঘটে যাওয়া একটি কালো অধ্যায়। বিগত ৫ জুলাই, ২০২২ খ্রি. গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া বাগদা বাজারে পাষ্টর তিমথী বাড়ৈ পূর্ব নির্ধারিত ব্যক্তি বাজারের দোকানদার মোর্শেদের সঙ্গে প্রভু যিশুর বিষয়ে আলাপের লক্ষ্যে উপস্থিত হলে দোকানদার মোর্শেদ স্থানীয় দুজন মসজিদের ইমাম সাহেবকে বিষয়টি অবগত করেন। অবশ্য ইতিপূর্বে ১ জুলাই শুক্রবার তিনি দোকানদার মোর্শেদ ও স্থানীয় সাবেক ইউপি পরিষদ সদস্যের উপস্থিতিতে প্রভু যিশুর ভালোবাসা ও তার কাছে যাবার পথ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করেছিলেন। সেদিন বাজারের দোকানদার মোর্শেদের দোকানে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজন জড়ো হতে থাকে। অতঃপর ইমাম সাহেব আসার পরই কথা বলার সুযোগ না দিয়েই পাষ্টর তিমথী বাড়ৈকে স্যা-েল খুলে উত্তম-মধ্যম দিতে শুরু করেন। ইমাম সাহেবের দেখাদেখি উৎসুক জনতা কর্তৃকও চরমভাবে শারীরিকভাবে হেনস্তা ও অপদস্তের শিকার হন। ইমাম সাহেবের উপস্থিতিতেই জুতার মালা তৈরি করে পাষ্টর তিমথী বাড়ৈয়ের গলায় পরিয়ে দেয়া হয়।

পাশর্^বর্তী গ্রামের বাসিন্দা পাষ্টর তিমথী বাড়ৈয়ের গলায় জুতার মালা পরানো যেন তাদের বিজয় কিন্তু মানবতার যে অপমৃত্যু হলো; সেটির দিকে কারও কোন খেয়াল ছিল না। সেই জায়গায় অপর একজন খ্রিস্ট বিশ^াসী বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তিনি অত্র এলাকার পালকপ্রধানকে অবহিত করলে দ্রুততার সঙ্গে স্থানীয় থানাকে অবহিত করা হয়। পুলিশ এসে পাষ্টর তিমথীকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। থানাতে মুচলেকাতে লিখতে হয়েছে ভিন্ন কথা, যা পাষ্টর তিমথী বাড়ৈ মেনে নিতে পারেননি। সত্যিই কেন তাকে এমন অপমানিত হতে হলো? একজন ব্যক্তি যদি ধর্ম কথা শ্রবণে অপারগতা প্রকাশ করে, সে ক্ষেত্রে কেউই তাকে শোনাতে পারে না; কিন্তু আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে এরূপ সাম্প্রদায়িকতা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তাহলে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। দোকানদার মোর্শেদ তো সোজাসাপটা বলতে পারতেন, আমাকে প্রভু যিশু সম্পর্কে না বললেই খুশি হবো! নিশ্চয়ই পাষ্টর তিমথী বাড়ৈ জোরপূর্বক বলার সাহস রাখেন না! এটি নিঃসন্দেহে একটি চক্রান্ত এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য স্থানীয় ব্যক্তিবর্গরাই দোষী। বর্তমানে পাষ্টর তিমথী বাড়ৈ ও তার পরিবার বেশ আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। আমরা দোষী ব্যক্তিদের স্যাবস্ত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি করি।

৩.

পল্লীচিকিৎসক ফজল সরকার ফিলিপ ও তার পরিবার বিগত ৩ জুন, ২০২২ খ্রিস্টাব্দের সকাল ৮টায় স্থানীয় মো. হাসেম আলী তার দলবল নিয়ে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ডা. ফজল সরকার ফিলিপের বাড়িতে হামলা চালায়। ঘটনাটি ঘটেছে, কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলায়। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী ডা. ফজল সরকার ফিলিপ ও তার পরিবারে দেশীয় লাঠিসোঠা এবং অন্যান্য অস্ত্রাধি নিয়ে হামলায় পরিবারের সদস্যগণ সেলিম সরকার, সুমি সরকার, লাবণী সরকার, শিল্পী সরকার, ইমরান আলী, রফিকুল ইসলাম গুরুত্বর আহত হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। জানা যায়, খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ফজল সরকার ফিলিপের বাড়ি ও জমি দীর্ঘদিন থেকে দখলের পাঁয়তারা করে আসছিল মো. হাসেম আলী।

কিন্তু কেন, এই কেন কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ বিষয়টি নিয়ে ভুরুঙ্গামারী থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করা হলে জানান, ‘আমরা ভিকটিমের কাছ থেকে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জেনেছি কিন্তু লিখিত অভিযোগ না পাওয়া পর্যন্ত ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং কোন ধরনের সহায়তা করতে পারছি না।’

ফিলিপ বলেছেন, পরিবারের সবাই চিকিৎসাধীন থাকায় পরিবারের পক্ষে কেউই থানায় উপস্থিত হয়ে অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারে নাই। বরং বিবাদীর পক্ষ থেকে সুবিধাদি নিয়েছেন বলে পুলিশ প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছেন, এমনই মনে করছেন ভুক্তভোগীরা। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, একজন আক্রান্ত ব্যক্তি প্রশাসনের সহায়তা চেয়েছে, সে ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কীভাবে নিশ্চিন্তে বসে আছেন সেটি বোধগম্য নয়! তাহলে কী প্রশাসনের মধ্যেও দৃষ্টিভঙ্গির দৈন্যতা রয়েছে, রয়েছে বৈষম্যের সূক্ষ্ম রেখাপাত! প্রশাসনের এহেন নীরবতা ও পক্ষপাতমূলক আচরণ সমগ্র খ্রিস্ট সমাজকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

৪.

মি. জেবান আলী, শেরপুর, দৌলতপুর, কুষ্টিয়ার একজন খ্রিস্ট বিশ^াসী। স্থানীয় চার্চ দ্বারা প্রভু যিশুকে মুক্তিদাতা ও উদ্ধারকর্তা হিসেবে গ্রহণ ও স্বীকার করে। বিগত ৬ জুন, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের বিতর্কিত রাজনৈতিক নেত্রী নুপুর শর্মার বিষয়ে ফেসবুকে লাইক করলে এ দিনে স্থানীয় মুসল্লিরা সদলবলে মি. জেবান আলীর পরিবার, ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে। আমাদের কথা হচ্ছে, একজন ব্যক্তি তার স্বীয় কর্মকা-ের জন্য শাস্তি, জেল জরিমানা হতে পারে কিন্তু তার পরিবার-পরিজন, আবাসস্থল এবং এটিকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটে থাকে; সেটি কখনোই কাম্য হতে পারে না। দেশের আইনকানুন অনুযায়ী নিশ্চয়ই তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হবে; তাহলে আমরা কেন আইনকে নিজের হাতে তুলে নিচ্ছি! এদিকটিই খ্রিস্ট বিশ^াসীদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আমরা মনে করি, শতসহস্র বছরের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের যে বন্ধন রয়েছে; সেখানে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা যেন ফিকে হয়ে যেতে বসেছে। এ জাতীয় অনেক ঘটনা সম্প্রতিককালে ঘটে চলেছে এবং খ্রিস্টানুসারীদের কাছে যেন অশনী সংকেত হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে।

আমরা প্রায়শই অবলোকন করছি, ধর্মীয় সৌহার্দ্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে এবং এক শ্রেণির লোকেরা ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকারে খুবই সিদ্ধহস্ত। মানুষ মাত্রই ভুল করে থাকে, আমরা কেউই স্বর্গীয় দূত না যে, ভুল থাকবে না। ভুলভ্রান্তি আছে বলেই সংশোধনের সুযোগ আছে, দেশে আইনকানুন আছে, বিচারালয় আছে; কিন্তু যখন আমরা নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিই, সেখানেই, ধর্মের, মানবতার মৃত্যু ঘটে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পবিত্র সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালে স্পষ্টই ঘোষণা করেছেন, ‘...মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারও বাধা দেয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।’

২০২২ খ্রিস্টাব্দে জুন পর্যন্ত প্রায় ডজন খানেক খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের ওপর নির্যাতন, অত্যাচার, হামলা, মামলা-মোকাদ্দমা ইত্যাদি ঘটেই চলেছে। ক্রমশই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে বিশেষত খ্রিস্টিয়ান জনগোষ্ঠী এবং সচেতন দেশবাসীও ধর্মীয় উগ্রবাদিতার বিষয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে চলেছেন। এখনই অস্থিতিশীল পরিবেশকে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিমূলক ক্ষেত্রে পরিণত করতে ব্যর্থ হলে আকাশ-বাতাস বিষবাষ্পে পরিণত হবে; পুরো দেশকে এটির দায়ভার নিতে হবে।

[লেখক : কলামিস্ট]