প্রসঙ্গ শিক্ষক

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে তারই ছাত্র ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। হত্যাকারী ছাত্রের নাম জিতু। জিতু প্রকাশ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠঅনের মাঠে উৎপল কুমারকে পিটায়, তারপর মুমূর্ষু অবস্থায় শিক্ষককে হাসপাতাল নিলে তিনি মারা যান। বিদ্যালয় মাঠে একজন শিক্ষককে হত্যা করা হলো, তা কি কেউ দেখল না?

নড়াইলে কলেজশিক্ষক স্বপন বিশ্বাসকে জুতার মালা পড়িয়ে রাস্তায় ঘুরানো হয়। শিক্ষক স্বপন বিশ্বাস নাকি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছিলেন, তাই তাকে পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করা হয়। স্বপন বিশ্বাসকে অপদস্ত করার পেছনে নাকি বিজেপি নেত্রীর নুপুর শর্মার নবীকে কেন্দ্র করে মন্তব্য করার বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। ফেসবুক পোস্টে জনৈক ছাত্রর স্ট্যাটাসটিও নাকি স্বপন বিশ্বাসকে অপদস্ত করার বিষয়ে প্ররোচিত করেছে।

রাজশাহীতে শিক্ষক পেটানোর ঘটনাটি নিয়েছে নানা ধরনের নাটকীয় মোড়। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি উপজেলার রাজাবাড়ী হাট ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজা এমপি কর্তৃক প্রহৃত হন। এই খবর দেশের সব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। খবরটি প্রকাশ পাওয়ার পর এমপি সংবাদ সম্মেলন করেন। এমপি সাহেব দাবি করেন তিনি অধ্যক্ষ পেটাননি। এমপির সংবাদ সম্মেলনে অধ্যক্ষ সেলিম রেজাও বলেন এমপি তাকে মারেনি। তারপর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আসাদুজ্জামান আসাদ এক সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি সংবাদ সম্মেলনে এমপি কর্তৃক অধ্যক্ষ প্রহৃত হওয়ার তথ্যাদি উপস্থাপন করেন। তার উপস্থাপিত তথ্যাদির সত্যতা ও যথার্থতা পাওয়া যায়। এবং উক্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে প্রমাণ হয় যে, এমপি সাহেব অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে পিটিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো কেন সেলিম রেজা তাকে পেটানো হয়নি বলে এমপির সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন? অধ্যক্ষ সেলিম রেজা কিসের ভয়ে এমন কাজটি করলেন? বর্তমানে সারা দেশে শিক্ষক নিগ্রহের বিষয়টি বেড়েই চলেছে। এর অন্তর্ধান রহস্য কি?

সেলিম রেজার বিষয়ে বাংলাদেশে শিক্ষকদের যে সংগঠনগুলো আছে সবাই নিশ্চুপ। শিক্ষক সংগঠনগুলো কেন কিছু বলছেন না, তা জানা দরকার। যদি সেলিম রেজা কোন অন্যায় করে থাকেন, তাহলে তাও সংগঠনগুলোর বলা উচিত। আর এমপি যদি নিরাপদ সেলিম রেজাকে পিটিয়ে থাকেন, সারা দেশব্যাপী শিক্ষক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ করা দরকার। সারা দেশে পেশাভিত্তিক সংগঠনগুলো এখন রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি চর্চায় লিপ্ত। আর এই সংগঠনোর মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষক সংগঠনগুলো। যার জন্য শিক্ষকরা তাদের ন্যায্যতা এবং মৌলিক অধিকারটুকু প্রায় সময় ভোগ করতে পারে না।

এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভাপতি নিয়োগের যে নিয়মটা আছে, তা বাতিল করা খুবই জরুরি। কারণ, যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে, সেই রাজনৈতিক দলের চামচারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হয়। এদের শতকরা ৯০ ভাগেরই শিক্ষা সম্পর্কিত কোন জ্ঞান নাই। তা ছাড়া এ ধরনের সভাপতিদের কারও কাছে জবাবদিহি নেই। শিক্ষকরা নিজের বাকস্বাধীনতা টুকুও শিক্ষকরা পায় না প্রতিষ্ঠান পরিচালনায়। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিভাবক প্রতিনিধি যেভাবে নির্বাচিত হন, ঠিক সেইভাবেই অভিভাবকদের ভোটে সভাপতি নির্বাচন করা দরকার, তাহলে ন্যূনতম জবাবদিহির জায়গা তৈরি হবে। কারণ, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট হলে নিজের কার্যকলাপের প্রতি সভাপতি খেয়াল রাখবেন। কারণ, পরবর্তী সময় নির্বাচনে তাকে অভিভাবকদের মুখোমুখি হতে হবে।

দেশে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, আর এই প্রতিষ্ঠানসমূহে যারা কর্মরত শিক্ষক তাদের মধ্যে বিরাজ করছে ইগো প্রবলেম। সারা বিশ্বের শ্রমিকরা সেøøাগান তুলতে পারে দুনিয়ার মজদুর একহও। বাংলাদেশের শিক্ষকরা কিন্তু এই ধরনের সেøøাগান তুলতে পারেন না। দেশের শিক্ষকরা এ কথা বলতে পারেন না, সারা দেশের শিক্ষকরা এক হও। কারণ, তারা নিজেদের কেউ বাহ্মণ, কেউ কায়স্থ, কেউ শুদ্র বলে মনে করেন। সম্প্রতি সরকার দেশের উপজেলা সদরের এমপিওভুক্ত কলেজগুলোকে সরকারি ঘোষণা করেছেন। এ রকম একটি উপজেলা সদরের সহকারী অধ্যাপক পদমর্যাদার প্রিন্সিপাল নিজেকে ওই উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ নিজে নিজে মনে করেন। অথচ তিনি একটি কলেজ থেকে কোন রকমে স্নাতকোত্তর শেষ করে এমপিওভুক্ত কলেজে এনআরটিসির পরীক্ষায় না বসেই শিক্ষক হয়েছিলেন (ওই সময় নিবন্ধন পরীক্ষার নিয়ম ছিল না)। অথচ ওই উপজেলায় ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন।

এ রকম অহমবোধ অনেকে শিক্ষকের মধ্যে আছে, ফলে নিজেদের মধ্যে ঐক্য, সৌহার্দ্যরে বন্ধন তৈরি হয় না। তাই বহিঃআক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেন না। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষকতা করেন, তারা নিজেদের বাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত মনে করেন। এরা প্রাথমিক বিদ্যালয়, কলেজ বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের শিক্ষকই অনেক সময় মনে করেন না। অথচ শিক্ষাগত যোগ্যতা মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, বা কলেজসমূহে কর্মরত শিক্ষক ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত শিক্ষকদের সমপর্যায়ে। এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্নাতক সম্মানসহ স্নœাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক ইর্ষান্বিতবোধটাই আজ শিক্ষকদের নিগ্রহের মূল কারণ। এমপি সাহেব কর্তৃক অধ্যক্ষ প্রহৃত হওয়ার সময় নাকি ১০-১৫ অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তাদের মুখ থেকে কিন্তু অধ্যক্ষ সেলিম রেজা প্রহৃত হয়েছিল কি না, এতদ সম্পর্কিত কোন মন্তব্যও শোনা যায়নি। বিষয়টা অনেকটা গ্রামের ওই প্রবাদটির মত, দাদাকে মারতেছিল আমি লুকিয়েছিলাম খড়ের গাদার ভেতর।

এই ধরনের মেরুদ-হীন শিক্ষক দিয়ে কতটা দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হতে পারে, তা ভাববার সময়ও এসেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক সেলিম রেজার বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন না। কেন বলছেন না, তা জানাও দরকার। সেলিম রেজা কি শিক্ষক গোত্রভুক্ত নন। যদি সেলিম রেজা অন্যায় করে তাহলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচিত সেলিম রেজাকে গোত্র থেকে বের করে দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা এবং এমপি সাহেবের সঙ্গে এতদ বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসা। কতিপয় অসৎ ও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিধারী কথিত শিক্ষক নেতাদের কারণে এ দেশের শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এমনকি শিক্ষকদের হারাতে হচ্ছে নিজের প্রাণ।

শিক্ষক শিক্ষক যদি এক না হয়, তাদের মধ্যে যদি প্রতিষ্ঠানগত, পদমর্যাদাগত অহংবোধ বিরাজ করে তাহলে দেশের শিক্ষার কোন ধরনের উন্নতি সাধিত হবে না। সারা দেশের সব শিক্ষকদের রাজনৈতিক বাতাবরণ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এবং একই ছাতার নিচে সমবেত হয়ে নিজেদের অধিকারের কথা সমস্বরে বলতে হবে, নইলে এ ধরনের নানা নির্যাতন শিক্ষকদের ওপর নেমে আসবে। সুতরাং এটা শিক্ষক সমাজকে বুঝতে হবে। দেশের সমগ্র শিক্ষকদের মধ্যে ঐক্য না হলে শিক্ষার মূল আদর্শিক জায়গাটা তৈরি হবে না।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

রবিবার, ২৪ জুলাই ২০২২ , ০৯ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৫ জিলহজ ১৪৪৩

প্রসঙ্গ শিক্ষক

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে তারই ছাত্র ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। হত্যাকারী ছাত্রের নাম জিতু। জিতু প্রকাশ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠঅনের মাঠে উৎপল কুমারকে পিটায়, তারপর মুমূর্ষু অবস্থায় শিক্ষককে হাসপাতাল নিলে তিনি মারা যান। বিদ্যালয় মাঠে একজন শিক্ষককে হত্যা করা হলো, তা কি কেউ দেখল না?

নড়াইলে কলেজশিক্ষক স্বপন বিশ্বাসকে জুতার মালা পড়িয়ে রাস্তায় ঘুরানো হয়। শিক্ষক স্বপন বিশ্বাস নাকি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছিলেন, তাই তাকে পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করা হয়। স্বপন বিশ্বাসকে অপদস্ত করার পেছনে নাকি বিজেপি নেত্রীর নুপুর শর্মার নবীকে কেন্দ্র করে মন্তব্য করার বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। ফেসবুক পোস্টে জনৈক ছাত্রর স্ট্যাটাসটিও নাকি স্বপন বিশ্বাসকে অপদস্ত করার বিষয়ে প্ররোচিত করেছে।

রাজশাহীতে শিক্ষক পেটানোর ঘটনাটি নিয়েছে নানা ধরনের নাটকীয় মোড়। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি উপজেলার রাজাবাড়ী হাট ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজা এমপি কর্তৃক প্রহৃত হন। এই খবর দেশের সব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। খবরটি প্রকাশ পাওয়ার পর এমপি সংবাদ সম্মেলন করেন। এমপি সাহেব দাবি করেন তিনি অধ্যক্ষ পেটাননি। এমপির সংবাদ সম্মেলনে অধ্যক্ষ সেলিম রেজাও বলেন এমপি তাকে মারেনি। তারপর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আসাদুজ্জামান আসাদ এক সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি সংবাদ সম্মেলনে এমপি কর্তৃক অধ্যক্ষ প্রহৃত হওয়ার তথ্যাদি উপস্থাপন করেন। তার উপস্থাপিত তথ্যাদির সত্যতা ও যথার্থতা পাওয়া যায়। এবং উক্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে প্রমাণ হয় যে, এমপি সাহেব অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে পিটিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো কেন সেলিম রেজা তাকে পেটানো হয়নি বলে এমপির সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন? অধ্যক্ষ সেলিম রেজা কিসের ভয়ে এমন কাজটি করলেন? বর্তমানে সারা দেশে শিক্ষক নিগ্রহের বিষয়টি বেড়েই চলেছে। এর অন্তর্ধান রহস্য কি?

সেলিম রেজার বিষয়ে বাংলাদেশে শিক্ষকদের যে সংগঠনগুলো আছে সবাই নিশ্চুপ। শিক্ষক সংগঠনগুলো কেন কিছু বলছেন না, তা জানা দরকার। যদি সেলিম রেজা কোন অন্যায় করে থাকেন, তাহলে তাও সংগঠনগুলোর বলা উচিত। আর এমপি যদি নিরাপদ সেলিম রেজাকে পিটিয়ে থাকেন, সারা দেশব্যাপী শিক্ষক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ করা দরকার। সারা দেশে পেশাভিত্তিক সংগঠনগুলো এখন রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি চর্চায় লিপ্ত। আর এই সংগঠনোর মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষক সংগঠনগুলো। যার জন্য শিক্ষকরা তাদের ন্যায্যতা এবং মৌলিক অধিকারটুকু প্রায় সময় ভোগ করতে পারে না।

এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভাপতি নিয়োগের যে নিয়মটা আছে, তা বাতিল করা খুবই জরুরি। কারণ, যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে, সেই রাজনৈতিক দলের চামচারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হয়। এদের শতকরা ৯০ ভাগেরই শিক্ষা সম্পর্কিত কোন জ্ঞান নাই। তা ছাড়া এ ধরনের সভাপতিদের কারও কাছে জবাবদিহি নেই। শিক্ষকরা নিজের বাকস্বাধীনতা টুকুও শিক্ষকরা পায় না প্রতিষ্ঠান পরিচালনায়। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিভাবক প্রতিনিধি যেভাবে নির্বাচিত হন, ঠিক সেইভাবেই অভিভাবকদের ভোটে সভাপতি নির্বাচন করা দরকার, তাহলে ন্যূনতম জবাবদিহির জায়গা তৈরি হবে। কারণ, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট হলে নিজের কার্যকলাপের প্রতি সভাপতি খেয়াল রাখবেন। কারণ, পরবর্তী সময় নির্বাচনে তাকে অভিভাবকদের মুখোমুখি হতে হবে।

দেশে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, আর এই প্রতিষ্ঠানসমূহে যারা কর্মরত শিক্ষক তাদের মধ্যে বিরাজ করছে ইগো প্রবলেম। সারা বিশ্বের শ্রমিকরা সেøøাগান তুলতে পারে দুনিয়ার মজদুর একহও। বাংলাদেশের শিক্ষকরা কিন্তু এই ধরনের সেøøাগান তুলতে পারেন না। দেশের শিক্ষকরা এ কথা বলতে পারেন না, সারা দেশের শিক্ষকরা এক হও। কারণ, তারা নিজেদের কেউ বাহ্মণ, কেউ কায়স্থ, কেউ শুদ্র বলে মনে করেন। সম্প্রতি সরকার দেশের উপজেলা সদরের এমপিওভুক্ত কলেজগুলোকে সরকারি ঘোষণা করেছেন। এ রকম একটি উপজেলা সদরের সহকারী অধ্যাপক পদমর্যাদার প্রিন্সিপাল নিজেকে ওই উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ নিজে নিজে মনে করেন। অথচ তিনি একটি কলেজ থেকে কোন রকমে স্নাতকোত্তর শেষ করে এমপিওভুক্ত কলেজে এনআরটিসির পরীক্ষায় না বসেই শিক্ষক হয়েছিলেন (ওই সময় নিবন্ধন পরীক্ষার নিয়ম ছিল না)। অথচ ওই উপজেলায় ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন।

এ রকম অহমবোধ অনেকে শিক্ষকের মধ্যে আছে, ফলে নিজেদের মধ্যে ঐক্য, সৌহার্দ্যরে বন্ধন তৈরি হয় না। তাই বহিঃআক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেন না। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষকতা করেন, তারা নিজেদের বাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত মনে করেন। এরা প্রাথমিক বিদ্যালয়, কলেজ বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের শিক্ষকই অনেক সময় মনে করেন না। অথচ শিক্ষাগত যোগ্যতা মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, বা কলেজসমূহে কর্মরত শিক্ষক ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত শিক্ষকদের সমপর্যায়ে। এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্নাতক সম্মানসহ স্নœাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক ইর্ষান্বিতবোধটাই আজ শিক্ষকদের নিগ্রহের মূল কারণ। এমপি সাহেব কর্তৃক অধ্যক্ষ প্রহৃত হওয়ার সময় নাকি ১০-১৫ অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তাদের মুখ থেকে কিন্তু অধ্যক্ষ সেলিম রেজা প্রহৃত হয়েছিল কি না, এতদ সম্পর্কিত কোন মন্তব্যও শোনা যায়নি। বিষয়টা অনেকটা গ্রামের ওই প্রবাদটির মত, দাদাকে মারতেছিল আমি লুকিয়েছিলাম খড়ের গাদার ভেতর।

এই ধরনের মেরুদ-হীন শিক্ষক দিয়ে কতটা দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হতে পারে, তা ভাববার সময়ও এসেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক সেলিম রেজার বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন না। কেন বলছেন না, তা জানাও দরকার। সেলিম রেজা কি শিক্ষক গোত্রভুক্ত নন। যদি সেলিম রেজা অন্যায় করে তাহলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচিত সেলিম রেজাকে গোত্র থেকে বের করে দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা এবং এমপি সাহেবের সঙ্গে এতদ বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসা। কতিপয় অসৎ ও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিধারী কথিত শিক্ষক নেতাদের কারণে এ দেশের শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এমনকি শিক্ষকদের হারাতে হচ্ছে নিজের প্রাণ।

শিক্ষক শিক্ষক যদি এক না হয়, তাদের মধ্যে যদি প্রতিষ্ঠানগত, পদমর্যাদাগত অহংবোধ বিরাজ করে তাহলে দেশের শিক্ষার কোন ধরনের উন্নতি সাধিত হবে না। সারা দেশের সব শিক্ষকদের রাজনৈতিক বাতাবরণ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এবং একই ছাতার নিচে সমবেত হয়ে নিজেদের অধিকারের কথা সমস্বরে বলতে হবে, নইলে এ ধরনের নানা নির্যাতন শিক্ষকদের ওপর নেমে আসবে। সুতরাং এটা শিক্ষক সমাজকে বুঝতে হবে। দেশের সমগ্র শিক্ষকদের মধ্যে ঐক্য না হলে শিক্ষার মূল আদর্শিক জায়গাটা তৈরি হবে না।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]