জলবায়ু পরিবর্তন : প্রত্যক্ষ ফল ভোগ করছে মানুষ

জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের জীবন যে দুরবস্থায় পড়বে তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা সতর্কবার্তা দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু তা নিয়ে খুব একটা কাজ হয়নি। এখন মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ভোগ করছে জলবায়ূ পরিবর্তনের কুফল। গত কিছু দিন ধরে পৃথিবী জুড়ে চলছে জলবায়ু বদলের বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বিশ্বের বহু দেশের মানুষ দাবদাহের কবলে পড়ে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে। আবার অন্যদিকে বন্যাও দুর্ভোগে ফেলছে মানুষকে।

এ মুহূর্তে যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের একটি বড় অংশে তাপমাত্রা সব রেকর্ড ভেঙে উঠে গেছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে। যানবাহন চলাচলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তৈরি হয়েছে পানির সংকট। এর সবই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল। শিল্প যুগের গোড়া থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে আসা মানুষ বায়ুম-লে কার্বন গ্যাসের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলেছে, বদলে যাওয়া বায়ুম-ল ধরে রাখছে অতিরিক্ত উত্তাপ।

সেই উত্তাপ আবার বিশ্বের সব জয়গায় সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ছে না, যার পরিণতি হচ্ছে আবহাওয়ার এই অস্বাভাবিক, চরম রূপ। এই বিরূপ আবহাওয়া এবং এর প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে মানুষকে তা নিয়ে সংবাদ মাধ্যম বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে, বিশ্লেষন করা হয়েছে কারন ।

গত ১৯ জুলাই যুক্তরাজ্যের তাপমাত্রা ইতিহাসে প্রথমবারের মত ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়। দেশটির আবহাওয়া দপ্তর বলছে, এরকম তীব্র দাবদাহের প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত দশগুণ বেড়েছে এবং আগামীতে অবস্থা এর চেয়েও বাজে হতে পারে।

লন্ডন ইমপেরিয়াল কলেজের জলবায়ু বিজ্ঞানী অধ্যাপক ফ্রিডরিকে অটো বলছেন, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে গ্রীষ্মকাল ভীষণ দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। তাপদাহ যে শুধু আরও উষ্ণ হয়ে উঠছে- তা নয়, এর স্থায়িত্বও বাড়ছে। গত ৫০ বছরে তাপদাহের স্থায়িত্ব দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

কোনো একটি অঞ্চলের বাতাস যখন গরম হয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে, তখন সেখানে বায়ুম-লে উচ্চ চাপ বলয় তৈরি হলে সেই চাপে গরম বাতাস আবার নিচে নেমে আসে। এক এলাকায় আটকা পড়ে গিয়ে সেই গরম বাতাস ঘনীভূত হয় এবং আরও তপ্ত হয়ে ওঠে। এরকম পরিস্থিতিতে আস্ত একটা মহাদেশজুড়ে তীব্র তাপদাহ দেখা দিতে পারে।

আবহাওয়া এরকম হলে সব কিছু হঠাৎ থমকে যায়। তাতে ওই চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া একটি অঞ্চলে আটকে থাকতে পারে কয়েক দিন; গত বছর ভারতে এমন অবস্থা দেখা গিয়েছিল।

দাবদাহ, বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন : ভারত ও পাকিস্তান এ বছর এরই মধ্যে পাঁচবার তাপদাহের মুখে পড়েছে। গত মে মাসে পাকিস্তানের জেকোবাবাদে তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। আর দক্ষিণ গোলার্ধের আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে ও ব্রাজিল গত জানুয়ারিতে টের পেয়েছিলো - গরম কাকে বলে। একই মাসে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার অনস্লো এলাকায় গরমের পারদ চড়েছিল ৫০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। পুরো দক্ষিণ গোলার্ধে এটা স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।

গত বছর টানা তাপ প্রবাহে ভুগেছিল উত্তর আমেরিকাও। পশ্চিম কানাডীয় শহর লিটনে তাপমাত্রা ছড়েছিলো ৪৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ওই তাপমাত্রা ছিল আগের রেকর্ডের চেয়ে ৫ ডিগ্রি বেশি।

আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিজ্ঞানীদের সংগঠন ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক বলছে, জলবায়ুর পরিবর্তন ছাড়া আবহাওয়ার এমন উত্তপ্ত হয়ে ওঠার কোনো কারণ নেই।

ডব্লিউএইচও’র আঞ্চলিক পরিচালক হ্যান্স ক্লুগে জানেিয়ছেন, চলতি বছরে তাপপ্রবাহে পর্তুগাল ও স্পেনে ১ হাজার ৭০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্পেনে তাপপ্রবাহ আজ সোমবার শেষ হওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হলেও দেশের বড় অংশে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর উপরে রয়েছে। পর্তুগালের লেইরিয়া শহরে গত ১৩ জুলাই তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল।

স্পেন বনের দাবানলের জন্য সবচেয়ে খারাপ বছর রেকর্ড করেছে একে অভূতপূর্ব এবং ভীতিকর অ্যাখা দিয়েছেন হ্যান্স ক্লুগ। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে হবে। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য এবং মানবতার অস্তিত্ব উভয়কেই হুমকির মুখে ফেলেছে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দাবানল। ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, গ্রিস, ক্রোয়েশিয়া, আলবেনিয়ায় ভয়াবহ দাবানল দেখা গেছে গত কিছুদিনে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ইয়োসেমিটি ন্যাশনাল পার্কের কাছে দ্রুত দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে অঙ্গরাজ্যটিতে আংশিকভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।

খরা বাড়ছে : দাবদাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খরা। তীব্র গরমে যখন বৃষ্টির দেখা মেলে না, মাটি হারায় আর্দ্রতা, দেখা দেয় পানির অভাব। এর অর্থ মাটি হল, ওই পরিস্থিতিতে মাটি আরও বেশি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। তারপর উপরের বাতাসকে উষ্ণ করে গরম আরও বাড়িয়ে তুলবে।

এদিকে মানুষের পানির চাহিদার পাশাপাশি রয়েছে জলসেচের কাজ, গরম সেই পানি সংকটকে তীব্র করবে।

সোমবার, ২৫ জুলাই ২০২২ , ১০ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৬ জিলহজ ১৪৪৩

জলবায়ু পরিবর্তন : প্রত্যক্ষ ফল ভোগ করছে মানুষ

image

জলবায়ু পরিবর্তনে কারণে হঠাৎ করেই বেড়ে গিয়েছে তাপমাত্রা যার জন্য সৃষ্টি হচ্ছে দাবানল -এএফপি

জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের জীবন যে দুরবস্থায় পড়বে তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা সতর্কবার্তা দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু তা নিয়ে খুব একটা কাজ হয়নি। এখন মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ভোগ করছে জলবায়ূ পরিবর্তনের কুফল। গত কিছু দিন ধরে পৃথিবী জুড়ে চলছে জলবায়ু বদলের বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বিশ্বের বহু দেশের মানুষ দাবদাহের কবলে পড়ে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে। আবার অন্যদিকে বন্যাও দুর্ভোগে ফেলছে মানুষকে।

এ মুহূর্তে যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের একটি বড় অংশে তাপমাত্রা সব রেকর্ড ভেঙে উঠে গেছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে। যানবাহন চলাচলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তৈরি হয়েছে পানির সংকট। এর সবই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল। শিল্প যুগের গোড়া থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে আসা মানুষ বায়ুম-লে কার্বন গ্যাসের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলেছে, বদলে যাওয়া বায়ুম-ল ধরে রাখছে অতিরিক্ত উত্তাপ।

সেই উত্তাপ আবার বিশ্বের সব জয়গায় সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ছে না, যার পরিণতি হচ্ছে আবহাওয়ার এই অস্বাভাবিক, চরম রূপ। এই বিরূপ আবহাওয়া এবং এর প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে মানুষকে তা নিয়ে সংবাদ মাধ্যম বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে, বিশ্লেষন করা হয়েছে কারন ।

গত ১৯ জুলাই যুক্তরাজ্যের তাপমাত্রা ইতিহাসে প্রথমবারের মত ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়। দেশটির আবহাওয়া দপ্তর বলছে, এরকম তীব্র দাবদাহের প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত দশগুণ বেড়েছে এবং আগামীতে অবস্থা এর চেয়েও বাজে হতে পারে।

লন্ডন ইমপেরিয়াল কলেজের জলবায়ু বিজ্ঞানী অধ্যাপক ফ্রিডরিকে অটো বলছেন, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে গ্রীষ্মকাল ভীষণ দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। তাপদাহ যে শুধু আরও উষ্ণ হয়ে উঠছে- তা নয়, এর স্থায়িত্বও বাড়ছে। গত ৫০ বছরে তাপদাহের স্থায়িত্ব দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

কোনো একটি অঞ্চলের বাতাস যখন গরম হয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে, তখন সেখানে বায়ুম-লে উচ্চ চাপ বলয় তৈরি হলে সেই চাপে গরম বাতাস আবার নিচে নেমে আসে। এক এলাকায় আটকা পড়ে গিয়ে সেই গরম বাতাস ঘনীভূত হয় এবং আরও তপ্ত হয়ে ওঠে। এরকম পরিস্থিতিতে আস্ত একটা মহাদেশজুড়ে তীব্র তাপদাহ দেখা দিতে পারে।

আবহাওয়া এরকম হলে সব কিছু হঠাৎ থমকে যায়। তাতে ওই চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া একটি অঞ্চলে আটকে থাকতে পারে কয়েক দিন; গত বছর ভারতে এমন অবস্থা দেখা গিয়েছিল।

দাবদাহ, বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন : ভারত ও পাকিস্তান এ বছর এরই মধ্যে পাঁচবার তাপদাহের মুখে পড়েছে। গত মে মাসে পাকিস্তানের জেকোবাবাদে তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। আর দক্ষিণ গোলার্ধের আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে ও ব্রাজিল গত জানুয়ারিতে টের পেয়েছিলো - গরম কাকে বলে। একই মাসে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার অনস্লো এলাকায় গরমের পারদ চড়েছিল ৫০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। পুরো দক্ষিণ গোলার্ধে এটা স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।

গত বছর টানা তাপ প্রবাহে ভুগেছিল উত্তর আমেরিকাও। পশ্চিম কানাডীয় শহর লিটনে তাপমাত্রা ছড়েছিলো ৪৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ওই তাপমাত্রা ছিল আগের রেকর্ডের চেয়ে ৫ ডিগ্রি বেশি।

আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিজ্ঞানীদের সংগঠন ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক বলছে, জলবায়ুর পরিবর্তন ছাড়া আবহাওয়ার এমন উত্তপ্ত হয়ে ওঠার কোনো কারণ নেই।

ডব্লিউএইচও’র আঞ্চলিক পরিচালক হ্যান্স ক্লুগে জানেিয়ছেন, চলতি বছরে তাপপ্রবাহে পর্তুগাল ও স্পেনে ১ হাজার ৭০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্পেনে তাপপ্রবাহ আজ সোমবার শেষ হওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হলেও দেশের বড় অংশে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর উপরে রয়েছে। পর্তুগালের লেইরিয়া শহরে গত ১৩ জুলাই তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল।

স্পেন বনের দাবানলের জন্য সবচেয়ে খারাপ বছর রেকর্ড করেছে একে অভূতপূর্ব এবং ভীতিকর অ্যাখা দিয়েছেন হ্যান্স ক্লুগ। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে হবে। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য এবং মানবতার অস্তিত্ব উভয়কেই হুমকির মুখে ফেলেছে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দাবানল। ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, গ্রিস, ক্রোয়েশিয়া, আলবেনিয়ায় ভয়াবহ দাবানল দেখা গেছে গত কিছুদিনে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ইয়োসেমিটি ন্যাশনাল পার্কের কাছে দ্রুত দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে অঙ্গরাজ্যটিতে আংশিকভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।

খরা বাড়ছে : দাবদাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খরা। তীব্র গরমে যখন বৃষ্টির দেখা মেলে না, মাটি হারায় আর্দ্রতা, দেখা দেয় পানির অভাব। এর অর্থ মাটি হল, ওই পরিস্থিতিতে মাটি আরও বেশি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। তারপর উপরের বাতাসকে উষ্ণ করে গরম আরও বাড়িয়ে তুলবে।

এদিকে মানুষের পানির চাহিদার পাশাপাশি রয়েছে জলসেচের কাজ, গরম সেই পানি সংকটকে তীব্র করবে।