গণহারে ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা

রেজাউল করিম খোকন

গত ১৩-১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। রাজস্ব আয়ে ঘাটতির পাশাপাশি নতুন করে যোগ হয়েছে বিশ্বসংকট। বিশেষ করে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স আয়ে ঘাটতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে। টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অসহনীয় হয়ে উঠছে জিনিসপত্রের দাম। মনে হচ্ছে, আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও বেসামাল হয়ে উঠবে।

করোনায় ক্ষতিতে ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়াতে ঋণ পরিশোধে ছাড় দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ব্যবসায়ীরা ঋণ শোধ না করেও দুই বছর ব্যাংকের খাতায় ছিলেন ভালো গ্রাহক। এখন ওই সুবিধা উঠে গেছে, তবে অনেক ব্যবসায়ী আগের মতোই ঋণ শোধ করেছেন না। ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ ঠেকাতে বড় ছাড় দিয়ে নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ঋণ আদায় না বাড়লেও সাময়িকভাবে কমবে খেলাপি ঋণ। আর বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এই নীতিমালা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত। গণহারে এমন সুবিধা কখনোই ভালো ফল দেয় না। খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। নতুন নীতিমালার ফলে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। পাশাপাশি এসব ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধ করা যাবে। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। আবার নতুন করে ঋণও পাওয়া যাবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণে কী সুবিধা দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করার পুরো ক্ষমতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যাংক মালিকেরাই ঠিক করবেন, কী সুবিধা পাবেন ঋণখেলাপিরা।

আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। যা স্বয়ং গভর্নর অনুমোদন করতেন। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে সেই ক্ষমতার পুরোটাই ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দিয়েছেন। নতুন নীতিমালার ফলে ব্যাংকের ঋণ আদায় আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এর ফলে তারল্য ব্যবস্থাপনায় হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি দেখা দেবে। এতে বাড়াতে হবে আমানতের সুদ। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যাংকগুলো অন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে। নতুন ঋণ বিতরণ মন্থর হয়ে পড়বে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর হাতে ক্ষমতা দেয়ায় অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। এর ফলে ঋণ আদায় না বাড়লেও সাময়িকভাবে কমবে খেলাপি ঋণ। আর বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা।

নতুন নীতিমালার মাধ্যমে জাল-জালিয়াতি ও অনিয়ম-প্রতারণার ঋণ এই সুবিধার আওতায় নিয়মিত করা যাবে না। পাশাপাশি কোন ঋণ চারবারের পর আরও একবার নিয়মিত করা যাবে বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে। আর ডাউনপেমেন্টের টাকা জমা দেওয়ার তিন মাসের মধ্যে তা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। ঋণ নিয়মিত করার আগে গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই ও খেলাপি হওয়ার কারণ পরীক্ষা করতে হবে। কেউ অভ্যাসগত খেলাপি হলে তার ঋণ নিয়মিত করা যাবে না। এসব গ্রাহকের ঋণ আদায়ে ব্যাংককে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবসায়ীদের চাপে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাই ব্যবসায়ীরা এতে লাভবান হবেন। তবে ব্যাংকের জন্য বড় চাপ তৈরি করবে। ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়বে। এতে নতুন ঋণ কমে যাবে, নতুন উদ্যোক্তারাও ঋণ পাবেন না।

বিদেশি ব্যাংক ও ঋণদাতা সংস্থাগুলো এসব ছাড় ভালোভাবে নেয় না। এর ফলে দেশীয় ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক ব্যবসায় কোন প্রভাব পড়ে কি না, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিল করতে বিভিন্ন তদবির আসত। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর সেই সুবিধা দেয়ার ক্ষমতা ব্যাংকগুলোকে দিয়েছেন। পাশাপাশি করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্ষতিতে পড়া অর্থনীতি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ঋণ পুনঃ তফসিলে ছাড় দিয়েছেন। না হলে বড় অঙ্কের ঋণখেলাপি হয়ে পুরো আর্থিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, করোনার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব, বহির্বিশ্বে সাম্প্রতিক যুদ্ধাবস্থা প্রলম্বিত হওয়ার কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলছে। নতুনভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও শ্রেণীকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ঋণ পুনঃ তফসিলিকরণ সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা জারি করা হলো।

আগে যে কোন পরিমাণ মেয়াদি খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ এককালীন অর্থ জমা দিতে হতো। এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই হবে। আগে চলমান ও তলবি খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ এককালীন অর্থ জমা দিতে হতো, এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগের নিয়মে খেলাপি মেয়াদি ঋণ নিয়মিত হলে তা পরিশোধে ৯ থেকে ২৪ মাস সময় দেয়া হতো। নতুন নীতিমালায় ১০০ কোটি টাকার কম ঋণে ৬ বছর, ৫০০ কোটি টাকার কম ঋণে ৭ বছর ও ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পরিশোধে ৮ বছর পর্যন্ত সময় দেওয়া যাবে। আগে চলমান ও তলবি ঋণ নিয়মিত হলে তা পরিশোধ করতে ৬ থেকে ১৮ মাস সময় দেওয়া হতো। এখন ৫০ কোটি টাকার কম ঋণ পরিশোধে ৫ বছর, ৩০০ কোটি টাকার কম পরিশোধে ৬ বছর ও ৩০০ কোটি টাকার বেশি ঋণে ৭ বছর পর্যন্ত সময় দেয়া যাবে। বিশেষ সুবিধা নিয়ে যেসব খেলাপি গ্রাহক নিয়মিত হয়েছেন, তাঁরা ব্যাংক থেকে আবারও ঋণ নিতে পারবেন। এ জন্য সাধারণ গ্রাহকদের বকেয়া ঋণের ৩ শতাংশ জমা দিতে হবে, তবে রপ্তানিকারকদের জন্য তা ২ শতাংশ।

আগে নতুন ঋণ নিতে সাধারণ গ্রাহকদের ১৫ শতাংশ ও রপ্তানিকারকদের সাড়ে ৭ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হতো। এদিকে যেসব মেয়াদি ঋণ নিয়মিত রয়েছে, তা-ও নতুন করে পুনর্গঠন করা যাবে । এতে বিদ্যমান মেয়াদের অবশিষ্টের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সময় বাড়ানো যাবে। আগে যা ছিল ২৫ শতাংশ। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমবে। আর ব্যাংকগুলোকে ক্ষমতা দেয়ায় দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ঋণখেলাপিদের জন্য যেসব সুবিধা দিয়েছেন, তা নজিরবিহীন। এতে যাঁরা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেননি, সামান্য কিস্তি শোধ করে তাঁরা নিজেদের শুধু নিষ্কলুষ প্রমাণ করতে পারবেন না, নতুন করে ঋণও নিতে পারবেন। আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও শ্রেণিকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপিদের আবার বড় ছাড় দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নীতি আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা আনবে না; বরং ব্যাংকিং খাতকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলবে। বাংলাদেশ খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। করোনার ক্ষতিতে ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়াতে ঋণ পরিশোধে ছাড় দিয়েছিলেন সাবেক গভর্নর। ব্যবসায়ীরা ঋণ শোধ না করেও দুই বছর ব্যাংকের খাতায় ভালো গ্রাহক ছিলেন। নতুন গভর্নর সেই অনিয়মেরই ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন। যারা ভালো গ্রাহক এবং ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা, তাদের এ সুযোগ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু বড় ঋণখেলাপিদের বড় সুবিধা দিয়ে কাগজে-কলমে তালিকার বাইরে রাখার চেষ্টা কোন সুফল দেবে না। বরং এতে ভালো গ্রাহকেরা নিরুৎসাহিত হবেন। নতুন গভর্নরের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল, তিনি ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ও খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্ত পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিপত্র উল্টো বার্তাই দিল।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

সোমবার, ২৫ জুলাই ২০২২ , ১০ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৬ জিলহজ ১৪৪৩

গণহারে ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা

রেজাউল করিম খোকন

গত ১৩-১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। রাজস্ব আয়ে ঘাটতির পাশাপাশি নতুন করে যোগ হয়েছে বিশ্বসংকট। বিশেষ করে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স আয়ে ঘাটতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে। টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অসহনীয় হয়ে উঠছে জিনিসপত্রের দাম। মনে হচ্ছে, আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও বেসামাল হয়ে উঠবে।

করোনায় ক্ষতিতে ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়াতে ঋণ পরিশোধে ছাড় দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ব্যবসায়ীরা ঋণ শোধ না করেও দুই বছর ব্যাংকের খাতায় ছিলেন ভালো গ্রাহক। এখন ওই সুবিধা উঠে গেছে, তবে অনেক ব্যবসায়ী আগের মতোই ঋণ শোধ করেছেন না। ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ ঠেকাতে বড় ছাড় দিয়ে নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ঋণ আদায় না বাড়লেও সাময়িকভাবে কমবে খেলাপি ঋণ। আর বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এই নীতিমালা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত। গণহারে এমন সুবিধা কখনোই ভালো ফল দেয় না। খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। নতুন নীতিমালার ফলে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। পাশাপাশি এসব ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধ করা যাবে। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। আবার নতুন করে ঋণও পাওয়া যাবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণে কী সুবিধা দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করার পুরো ক্ষমতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যাংক মালিকেরাই ঠিক করবেন, কী সুবিধা পাবেন ঋণখেলাপিরা।

আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। যা স্বয়ং গভর্নর অনুমোদন করতেন। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে সেই ক্ষমতার পুরোটাই ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দিয়েছেন। নতুন নীতিমালার ফলে ব্যাংকের ঋণ আদায় আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এর ফলে তারল্য ব্যবস্থাপনায় হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি দেখা দেবে। এতে বাড়াতে হবে আমানতের সুদ। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যাংকগুলো অন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে। নতুন ঋণ বিতরণ মন্থর হয়ে পড়বে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর হাতে ক্ষমতা দেয়ায় অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। এর ফলে ঋণ আদায় না বাড়লেও সাময়িকভাবে কমবে খেলাপি ঋণ। আর বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা।

নতুন নীতিমালার মাধ্যমে জাল-জালিয়াতি ও অনিয়ম-প্রতারণার ঋণ এই সুবিধার আওতায় নিয়মিত করা যাবে না। পাশাপাশি কোন ঋণ চারবারের পর আরও একবার নিয়মিত করা যাবে বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে। আর ডাউনপেমেন্টের টাকা জমা দেওয়ার তিন মাসের মধ্যে তা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। ঋণ নিয়মিত করার আগে গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই ও খেলাপি হওয়ার কারণ পরীক্ষা করতে হবে। কেউ অভ্যাসগত খেলাপি হলে তার ঋণ নিয়মিত করা যাবে না। এসব গ্রাহকের ঋণ আদায়ে ব্যাংককে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবসায়ীদের চাপে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাই ব্যবসায়ীরা এতে লাভবান হবেন। তবে ব্যাংকের জন্য বড় চাপ তৈরি করবে। ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়বে। এতে নতুন ঋণ কমে যাবে, নতুন উদ্যোক্তারাও ঋণ পাবেন না।

বিদেশি ব্যাংক ও ঋণদাতা সংস্থাগুলো এসব ছাড় ভালোভাবে নেয় না। এর ফলে দেশীয় ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক ব্যবসায় কোন প্রভাব পড়ে কি না, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিল করতে বিভিন্ন তদবির আসত। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর সেই সুবিধা দেয়ার ক্ষমতা ব্যাংকগুলোকে দিয়েছেন। পাশাপাশি করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্ষতিতে পড়া অর্থনীতি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ঋণ পুনঃ তফসিলে ছাড় দিয়েছেন। না হলে বড় অঙ্কের ঋণখেলাপি হয়ে পুরো আর্থিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, করোনার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব, বহির্বিশ্বে সাম্প্রতিক যুদ্ধাবস্থা প্রলম্বিত হওয়ার কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলছে। নতুনভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও শ্রেণীকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ঋণ পুনঃ তফসিলিকরণ সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা জারি করা হলো।

আগে যে কোন পরিমাণ মেয়াদি খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ এককালীন অর্থ জমা দিতে হতো। এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই হবে। আগে চলমান ও তলবি খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ এককালীন অর্থ জমা দিতে হতো, এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগের নিয়মে খেলাপি মেয়াদি ঋণ নিয়মিত হলে তা পরিশোধে ৯ থেকে ২৪ মাস সময় দেয়া হতো। নতুন নীতিমালায় ১০০ কোটি টাকার কম ঋণে ৬ বছর, ৫০০ কোটি টাকার কম ঋণে ৭ বছর ও ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পরিশোধে ৮ বছর পর্যন্ত সময় দেওয়া যাবে। আগে চলমান ও তলবি ঋণ নিয়মিত হলে তা পরিশোধ করতে ৬ থেকে ১৮ মাস সময় দেওয়া হতো। এখন ৫০ কোটি টাকার কম ঋণ পরিশোধে ৫ বছর, ৩০০ কোটি টাকার কম পরিশোধে ৬ বছর ও ৩০০ কোটি টাকার বেশি ঋণে ৭ বছর পর্যন্ত সময় দেয়া যাবে। বিশেষ সুবিধা নিয়ে যেসব খেলাপি গ্রাহক নিয়মিত হয়েছেন, তাঁরা ব্যাংক থেকে আবারও ঋণ নিতে পারবেন। এ জন্য সাধারণ গ্রাহকদের বকেয়া ঋণের ৩ শতাংশ জমা দিতে হবে, তবে রপ্তানিকারকদের জন্য তা ২ শতাংশ।

আগে নতুন ঋণ নিতে সাধারণ গ্রাহকদের ১৫ শতাংশ ও রপ্তানিকারকদের সাড়ে ৭ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হতো। এদিকে যেসব মেয়াদি ঋণ নিয়মিত রয়েছে, তা-ও নতুন করে পুনর্গঠন করা যাবে । এতে বিদ্যমান মেয়াদের অবশিষ্টের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সময় বাড়ানো যাবে। আগে যা ছিল ২৫ শতাংশ। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমবে। আর ব্যাংকগুলোকে ক্ষমতা দেয়ায় দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ঋণখেলাপিদের জন্য যেসব সুবিধা দিয়েছেন, তা নজিরবিহীন। এতে যাঁরা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেননি, সামান্য কিস্তি শোধ করে তাঁরা নিজেদের শুধু নিষ্কলুষ প্রমাণ করতে পারবেন না, নতুন করে ঋণও নিতে পারবেন। আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও শ্রেণিকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপিদের আবার বড় ছাড় দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নীতি আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা আনবে না; বরং ব্যাংকিং খাতকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলবে। বাংলাদেশ খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। করোনার ক্ষতিতে ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়াতে ঋণ পরিশোধে ছাড় দিয়েছিলেন সাবেক গভর্নর। ব্যবসায়ীরা ঋণ শোধ না করেও দুই বছর ব্যাংকের খাতায় ভালো গ্রাহক ছিলেন। নতুন গভর্নর সেই অনিয়মেরই ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন। যারা ভালো গ্রাহক এবং ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা, তাদের এ সুযোগ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু বড় ঋণখেলাপিদের বড় সুবিধা দিয়ে কাগজে-কলমে তালিকার বাইরে রাখার চেষ্টা কোন সুফল দেবে না। বরং এতে ভালো গ্রাহকেরা নিরুৎসাহিত হবেন। নতুন গভর্নরের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল, তিনি ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ও খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্ত পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিপত্র উল্টো বার্তাই দিল।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]