পদ্মা সেতু : যাত্রাবাড়ীতে দীর্ঘ যানজট

পদ্মা সেতু দিয়ে প্রতিদিন ২০-৩০ হাজার যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ করে। এসব গাড়িগুলো ৫-৬ মিনিটে পদ্মা সেতু পার হলেও ঢাকা প্রবেশমুখে দীর্ঘ সময় আটকে থাকতে হয় যানজটে। আগে যেখানে ফেরিতে পদ্মা নদী পার হতে সময় লাগতো দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। এখন সেখানে ঢাকার প্রবেশমুখে ২-৩ ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয় বলে যাত্রীরা জানান।

শওকত ওসমান নামের বরিশালের এক যাত্রী সংবাদকে বলেন, ‘ঢাকায় ঢুকতেই পদ্মা সেতুর সুবিধা ভেস্তে গেছে। আগে ফেরিতে পার হতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগতো। সব মিলে বরিশাল যেতে ৫-৬ ঘণ্টা লাগতো। কিন্তু এখন পদ্মা সেতুর কারণে সময় কম লাগার কথা। তবে ঢাকায় ঢুকতে যানজটে শিকার হয়ে সেই আগের সময় চলে যায়। বরিশাল থেকে সকাল ১০টায় বাসে উঠেছি, এখন ২টা বাজে কিন্তু সায়েদাবাদে পৌঁছাতে পারিনি। ধোলাইপাড়ে আটকে আছি প্রায় আধঘণ্টা যাবত। মিরপুর বাসায় যেতে প্রায় আরও ২-৩ ঘণ্টা লাগবে।’ তাই বাস থেকে লঞ্চে আসাই ভালো বলে জানান তিনি।

২-৩ ঘণ্টা যানজটে আটকে ভোগান্তিতে যাত্রীরা

সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায়। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যানজট লেগেই থাকে। যাত্রাবাড়ীর যানজটের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এই তিন মহাসড়কের যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। পদ্মা সেতু দিয়ে বরিশালসহ ১৯ জেলার প্রায় ২০-৩০ হাজার গাড়ি যাত্রীবাড়ী চৌরাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় অতিরিক্ত গাড়ির চাপে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় প্রতিদিন ২-৩ ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয় বলে বাস চালকরা জানান।

আজিজ নামের শ্যামলী পরিবহনের এক চালক সংবাদকে বলেন, ‘পদ্মা ব্রিজ চালুর আগে সায়েদাবাদ থেইক্যা পেসেনজার লইয়্যা যাত্রাবাড়ী পার হইতে বড়জোর ১৫-২০ মিনিট লাগছে। এহন তা ১ থেকে দেড় ঘণ্টায়ও পারা যায় না। টিটিপাড়া মোড় থেইক্যা সায়েদাবাদের আইতেই ১ ঘণ্টা লাইগা যায়। আগের থেইক্যা গাড়ি বাড়ছে। পদ্মা ব্রিজের গাড়িগুলো সব এহেনদা যায়। এলাইগ্যা এ জ্যাম লাইগ্যাই থাহে এহানে।’

আন্তঃজেলা বাসের চাপে শহরতলী বাসের যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। যাত্রাবাড়ী চারটি সড়কের প্রতিটি সড়কে ২-৩ কিলোমিটারজুড়ে যানজট আটকে থাকতে হয় যাত্রীদের। এর মধ্যে জুরাইন রেলগেট-যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা ২-৩ কিলোমিটার, শনিরআখড়া-যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা ২ কিলোমিটার, ডেমরা সড়কের কাজলারপাড় থেকে যাত্রীবাড়ী চৌরাস্তা, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা-সায়েদাবাদ-রাজধানীর সুপার মার্কেট পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার ও সায়েদাবাদ জনপথ মোড়-মানিকনগর-মুগদার টিটিপাড়া মোড় পর্যন্ত ২ কিলোমিটার সড়কে যানজট সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।

মশিউর নামের মতিঝিলের এক যাত্রী জানান, যাত্রাবাড়ী এলাকার অবস্থা খুব খারাপ। ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এখন পদ্মা সেতু চালুর পর দুর্ভোগ আরও বেড়ে গেছে। পদ্মা সেতুর সব গাড়ি ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে যাতায়াত করে। এর কারণে যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ পর্যন্ত প্রতিদিন যানজট লেগে থাকে। এক কিলোমিটারের কম সড়ক অতিক্রম করতেই এক থেকে দেড় ঘণ্টা গেলে যায়। পদ্মা সেতুর গাড়িগুলো ফ্লাইওভার দিয়ে যাতায়াত করলে এই যানজট হতো না।

যানজটের কারণ

অতিরিক্ত গাড়ির চাপ, সড়কের দুই পাশে আন্তঃজেলা বাসের অবৈধ পার্কিং, সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন বাস কোম্পানির একাধিক কাউন্টার, চৌরাস্তায় সড়ক বন্ধ করে বাজার ও দোকান বসানো, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা, সড়কের মাঝখান দিয়ে গাড়ি ঘোরাানো, পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তানদের চাঁদাবাজি, যাত্রাবাড়ী থানার সামনের সড়কে বাসে যাত্রী উঠা-নামানো, ফুটপাতের দোকান ও খানা-খন্দর সড়কের কারণে যানজট লেগেই থাকে বলে স্থানীয়রা জানান।

সরেজমিন যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও এসব এলাকায় যানজটমুক্ত থাকে না। যানজটে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দেখা গেছে যাত্রাবাড়ী থেকে সায়েদাবাদ রেলগেট সড়কে। এই সড়কের দুই পাশে ঢাকা-গাজীপুরের বলাকা পরিবহনের বাসগুলো অবৈধ পার্কিং সড়ক দখল করে রাখা হয়েছে।

মিলন নামের বলাকা পরিবহনের এক চালক বলেন, ‘দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা বলাকা বাস চলে। সায়েদাবাদ থেইক্যা গাজীপুর চৌরাস্তা পৌজন্ত যায়। গাজীপুরে বাস রাহনের জায়গা আছে। কিন্তু সায়েদাবাদে কোন জায়গা নাই। এলাইগ্যা রাস্তায় বাস রাহন লাগে। এলাইগ্যা পুলিশরে ৫০ টাহা করে দেয়া লাগে।’

যানজটের সূত্রপাত সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের অব্যবস্থাপনা

রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালটি প্রায় সাড়ে ১৪ একর জমির ওপর নির্মিত টার্মিনাল। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালটি আন্তঃজেলা টার্মিনাল ও সিটি টার্মিনাল এ দুই ভাগে বিভক্ত। টার্মিনালটি প্রায় ২০০ বাস ধারণে সক্ষম।

কিন্তু প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার গাড়ি টার্মিনাল ব্যবহার করছে। পদ্মা সেতুর চালু হওয়ার পর তা আরও দ্বিগুণ হয়েছে। তাই সব বাস টার্মিনালে ব্যবহার না করে সড়কে পার্কিং রাখা হচ্ছে হচ্ছে। এতে যানজট তৈরি হয় বলে বাস চালকরা জানান।

এ বিষয়ে নজরুল নামের ঢাকা-কুমিল্লা রুটের চলাচল করা তিশা পরিবহনের চালক সংবাদকে বলেন, ‘সাইদাবাদে জ্যাম বাড়ছে পদ্মা ব্রিজের লাইগ্যা। আমগো লাইগ্যা জ্যাম বাড়ে নাই। পদ্মা ব্রিজ চালুর পরেতেই প্রায় ৪০-৫০ নতুন কোম্পানির গাড়ি নামছে। হেগোলা সব সাইদাবাদ থেইক্যা যায়। আর টার্মিনালে জায়গা না পাইলে তো রাস্তায়ই রাকমু।’

জানা গেছে, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের কেন্দ্র যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ জনপথ, গোলাপবাগ, মানিকনগর, টিটিপাড়াসহ আশপাশের এলাকায় শতাধিক অবৈধ বাস কাউন্টার তৈরি হয়েছে। এক-একটি বাস কোম্পানি একাধিক কাউন্টার হয়েছে। এসব কাউন্টার থেকে যাত্রী উঠা-নামানোর জন্য সড়ক বন্ধ করে গাড়ি পার্কিং করা হয়। এতে অন্য গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়েছে যায় বলে বাস চালকরা জানান।

এছাড়া যাত্রাবাড়ী মোড় এবং ডেমরাগামী সড়কের মুখেই অবৈধ টেম্পোস্ট্যান্ড। ফলে সড়কটি সংকুচিত হয়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয় বলে যাত্রীরা জানান। অবৈধ বাস কাউন্টারের কারণে রাজধানীর সুপার মার্কেট থেকে শুরু করে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার এলাকায় প্রচ- যানজটে আটকে থাকতে হয় যাত্রীদের।

ফ্লাইওভার ব্যবহার করে না অধিকাংশ বাস

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের ভেতর থেকে ফ্লাইওভারের ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও তা ব্যবহার করে না বাসচালক। টার্মিনালের প্রবেশের মুখে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা বাসগুলোকে। এতে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের পাশেই রেলক্রসিং থাকায় যানজটের কারণে যেকোন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।

বাসচালকরা জানান, উড়ালসড়ক থাকলেও অতিরিক্ত টোলের জন্য বাসসহ বেশিরভাগ যানবাহন নিচের দুই পাশের সড়কই ব্যবহার করে। তাই এই সড়কের ওপর চাপ পড়ে বেশি। এই অবৈধ টার্মিনালের কারণে বর্তমানে সায়েদাবাদ-যাতায়াতে সব ধরনের যানবাহনেরই দুঃসহ যানজটে পড়তে হয়।

তানভীর নামের যাত্রাবাড়ী এলাকায় এক ট্রাফিক সার্জেন্ট সংবাদকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর পর ৪০-৫০টি নতুন কোম্পানির প্রায় ৪০০-৫০০টি বড় বাস নামানো হয়েছে। এসব গাড়ি সব যাত্রীবাড়ী মোড় ব্যবহার করে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে উঠে।’ আন্তঃজেলার বেশীরভাগ গাড়ি ফ্লাইওভার ব্যবহার না করে নিচের সড়ক দিয়ে চলাচল করে। তাই নিচের সড়কের চাপ আরও বেশি বেড়ে গেছে বলে জানান তিনি।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার ৮টি মহাসড়কের প্রবেশমুখে যানজট দূর করতে লিংক রোড নির্মাণ করতে হবে। তা না হলে উন্নয়নের সফলতা পাওয়া যাবে না।

বুয়েটের অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ডা. সামছুল হক সংবাদকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু ও মাওয়া মহাসড়ক নির্মাণের ফলে ঢাকার বাইরের খ-িত যানজটগুলো সব ঢাকার প্রবেশমুখে নিয়ে আসা হয়েছে। সময় বাঁচানোর জন্য বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করা হলেও সমন্বিত উন্নয়ন না করার কারণে বেশি সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। পদ্মা সেতুর সব যানবাহন এখন ঢাকা প্রবেশমুখে আটকে যাচ্ছে। অথচ আগেই এসটিপিতে বলা হয়েছিল ঢাকার ৮টি মহাসড়কে প্রবেশের জন্য লিংক রোড নির্মাণ করতে হবে।’ তা না হলে ঢাকার প্রবেশমুখের এই যানজট দূর হবে না বলে জানান তিনি।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. মো. হাদীউজ্জামান বলেন, ‘আরএসটিপিতে ইনার সার্কুলার রুট ছিল অগ্রাধিকার প্রকল্প। সেখানে ৮টি রেডিয়াল সড়কের কথা আছে, যার একটি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। এ সড়ক তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতুর ‘ফরওয়ার্ড লিঙ্ক’ হিসেবে। ‘ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্ক’ হিসেবে ইনার সার্কুলার রোড হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি। ইনার সার্কুলার রুটের গাবতলী সোয়ারীঘাট হয়ে কেরানীগঞ্জের সাড়ে ১২ কিলোমিটার অংশ অগ্রাধিকার দিয়ে করে ফেলা উচিত। বিদেশি অর্থায়ন না পেলে প্রয়োজনে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে করতে হবে, এটা করা জরুরি।’

মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই ২০২২ , ১১ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৭ জিলহজ ১৪৪৩

পদ্মা সেতু : যাত্রাবাড়ীতে দীর্ঘ যানজট

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

image

পদ্মা সেতু দিয়ে প্রতিদিন ২০-৩০ হাজার যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ করে। এসব গাড়িগুলো ৫-৬ মিনিটে পদ্মা সেতু পার হলেও ঢাকা প্রবেশমুখে দীর্ঘ সময় আটকে থাকতে হয় যানজটে। আগে যেখানে ফেরিতে পদ্মা নদী পার হতে সময় লাগতো দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। এখন সেখানে ঢাকার প্রবেশমুখে ২-৩ ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয় বলে যাত্রীরা জানান।

শওকত ওসমান নামের বরিশালের এক যাত্রী সংবাদকে বলেন, ‘ঢাকায় ঢুকতেই পদ্মা সেতুর সুবিধা ভেস্তে গেছে। আগে ফেরিতে পার হতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগতো। সব মিলে বরিশাল যেতে ৫-৬ ঘণ্টা লাগতো। কিন্তু এখন পদ্মা সেতুর কারণে সময় কম লাগার কথা। তবে ঢাকায় ঢুকতে যানজটে শিকার হয়ে সেই আগের সময় চলে যায়। বরিশাল থেকে সকাল ১০টায় বাসে উঠেছি, এখন ২টা বাজে কিন্তু সায়েদাবাদে পৌঁছাতে পারিনি। ধোলাইপাড়ে আটকে আছি প্রায় আধঘণ্টা যাবত। মিরপুর বাসায় যেতে প্রায় আরও ২-৩ ঘণ্টা লাগবে।’ তাই বাস থেকে লঞ্চে আসাই ভালো বলে জানান তিনি।

২-৩ ঘণ্টা যানজটে আটকে ভোগান্তিতে যাত্রীরা

সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায়। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যানজট লেগেই থাকে। যাত্রাবাড়ীর যানজটের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এই তিন মহাসড়কের যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। পদ্মা সেতু দিয়ে বরিশালসহ ১৯ জেলার প্রায় ২০-৩০ হাজার গাড়ি যাত্রীবাড়ী চৌরাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় অতিরিক্ত গাড়ির চাপে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় প্রতিদিন ২-৩ ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয় বলে বাস চালকরা জানান।

আজিজ নামের শ্যামলী পরিবহনের এক চালক সংবাদকে বলেন, ‘পদ্মা ব্রিজ চালুর আগে সায়েদাবাদ থেইক্যা পেসেনজার লইয়্যা যাত্রাবাড়ী পার হইতে বড়জোর ১৫-২০ মিনিট লাগছে। এহন তা ১ থেকে দেড় ঘণ্টায়ও পারা যায় না। টিটিপাড়া মোড় থেইক্যা সায়েদাবাদের আইতেই ১ ঘণ্টা লাইগা যায়। আগের থেইক্যা গাড়ি বাড়ছে। পদ্মা ব্রিজের গাড়িগুলো সব এহেনদা যায়। এলাইগ্যা এ জ্যাম লাইগ্যাই থাহে এহানে।’

আন্তঃজেলা বাসের চাপে শহরতলী বাসের যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। যাত্রাবাড়ী চারটি সড়কের প্রতিটি সড়কে ২-৩ কিলোমিটারজুড়ে যানজট আটকে থাকতে হয় যাত্রীদের। এর মধ্যে জুরাইন রেলগেট-যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা ২-৩ কিলোমিটার, শনিরআখড়া-যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা ২ কিলোমিটার, ডেমরা সড়কের কাজলারপাড় থেকে যাত্রীবাড়ী চৌরাস্তা, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা-সায়েদাবাদ-রাজধানীর সুপার মার্কেট পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার ও সায়েদাবাদ জনপথ মোড়-মানিকনগর-মুগদার টিটিপাড়া মোড় পর্যন্ত ২ কিলোমিটার সড়কে যানজট সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।

মশিউর নামের মতিঝিলের এক যাত্রী জানান, যাত্রাবাড়ী এলাকার অবস্থা খুব খারাপ। ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এখন পদ্মা সেতু চালুর পর দুর্ভোগ আরও বেড়ে গেছে। পদ্মা সেতুর সব গাড়ি ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে যাতায়াত করে। এর কারণে যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ পর্যন্ত প্রতিদিন যানজট লেগে থাকে। এক কিলোমিটারের কম সড়ক অতিক্রম করতেই এক থেকে দেড় ঘণ্টা গেলে যায়। পদ্মা সেতুর গাড়িগুলো ফ্লাইওভার দিয়ে যাতায়াত করলে এই যানজট হতো না।

যানজটের কারণ

অতিরিক্ত গাড়ির চাপ, সড়কের দুই পাশে আন্তঃজেলা বাসের অবৈধ পার্কিং, সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন বাস কোম্পানির একাধিক কাউন্টার, চৌরাস্তায় সড়ক বন্ধ করে বাজার ও দোকান বসানো, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা, সড়কের মাঝখান দিয়ে গাড়ি ঘোরাানো, পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তানদের চাঁদাবাজি, যাত্রাবাড়ী থানার সামনের সড়কে বাসে যাত্রী উঠা-নামানো, ফুটপাতের দোকান ও খানা-খন্দর সড়কের কারণে যানজট লেগেই থাকে বলে স্থানীয়রা জানান।

সরেজমিন যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও এসব এলাকায় যানজটমুক্ত থাকে না। যানজটে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দেখা গেছে যাত্রাবাড়ী থেকে সায়েদাবাদ রেলগেট সড়কে। এই সড়কের দুই পাশে ঢাকা-গাজীপুরের বলাকা পরিবহনের বাসগুলো অবৈধ পার্কিং সড়ক দখল করে রাখা হয়েছে।

মিলন নামের বলাকা পরিবহনের এক চালক বলেন, ‘দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা বলাকা বাস চলে। সায়েদাবাদ থেইক্যা গাজীপুর চৌরাস্তা পৌজন্ত যায়। গাজীপুরে বাস রাহনের জায়গা আছে। কিন্তু সায়েদাবাদে কোন জায়গা নাই। এলাইগ্যা রাস্তায় বাস রাহন লাগে। এলাইগ্যা পুলিশরে ৫০ টাহা করে দেয়া লাগে।’

যানজটের সূত্রপাত সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের অব্যবস্থাপনা

রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালটি প্রায় সাড়ে ১৪ একর জমির ওপর নির্মিত টার্মিনাল। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালটি আন্তঃজেলা টার্মিনাল ও সিটি টার্মিনাল এ দুই ভাগে বিভক্ত। টার্মিনালটি প্রায় ২০০ বাস ধারণে সক্ষম।

কিন্তু প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার গাড়ি টার্মিনাল ব্যবহার করছে। পদ্মা সেতুর চালু হওয়ার পর তা আরও দ্বিগুণ হয়েছে। তাই সব বাস টার্মিনালে ব্যবহার না করে সড়কে পার্কিং রাখা হচ্ছে হচ্ছে। এতে যানজট তৈরি হয় বলে বাস চালকরা জানান।

এ বিষয়ে নজরুল নামের ঢাকা-কুমিল্লা রুটের চলাচল করা তিশা পরিবহনের চালক সংবাদকে বলেন, ‘সাইদাবাদে জ্যাম বাড়ছে পদ্মা ব্রিজের লাইগ্যা। আমগো লাইগ্যা জ্যাম বাড়ে নাই। পদ্মা ব্রিজ চালুর পরেতেই প্রায় ৪০-৫০ নতুন কোম্পানির গাড়ি নামছে। হেগোলা সব সাইদাবাদ থেইক্যা যায়। আর টার্মিনালে জায়গা না পাইলে তো রাস্তায়ই রাকমু।’

জানা গেছে, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের কেন্দ্র যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ জনপথ, গোলাপবাগ, মানিকনগর, টিটিপাড়াসহ আশপাশের এলাকায় শতাধিক অবৈধ বাস কাউন্টার তৈরি হয়েছে। এক-একটি বাস কোম্পানি একাধিক কাউন্টার হয়েছে। এসব কাউন্টার থেকে যাত্রী উঠা-নামানোর জন্য সড়ক বন্ধ করে গাড়ি পার্কিং করা হয়। এতে অন্য গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়েছে যায় বলে বাস চালকরা জানান।

এছাড়া যাত্রাবাড়ী মোড় এবং ডেমরাগামী সড়কের মুখেই অবৈধ টেম্পোস্ট্যান্ড। ফলে সড়কটি সংকুচিত হয়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয় বলে যাত্রীরা জানান। অবৈধ বাস কাউন্টারের কারণে রাজধানীর সুপার মার্কেট থেকে শুরু করে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার এলাকায় প্রচ- যানজটে আটকে থাকতে হয় যাত্রীদের।

ফ্লাইওভার ব্যবহার করে না অধিকাংশ বাস

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের ভেতর থেকে ফ্লাইওভারের ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও তা ব্যবহার করে না বাসচালক। টার্মিনালের প্রবেশের মুখে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা বাসগুলোকে। এতে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের পাশেই রেলক্রসিং থাকায় যানজটের কারণে যেকোন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।

বাসচালকরা জানান, উড়ালসড়ক থাকলেও অতিরিক্ত টোলের জন্য বাসসহ বেশিরভাগ যানবাহন নিচের দুই পাশের সড়কই ব্যবহার করে। তাই এই সড়কের ওপর চাপ পড়ে বেশি। এই অবৈধ টার্মিনালের কারণে বর্তমানে সায়েদাবাদ-যাতায়াতে সব ধরনের যানবাহনেরই দুঃসহ যানজটে পড়তে হয়।

তানভীর নামের যাত্রাবাড়ী এলাকায় এক ট্রাফিক সার্জেন্ট সংবাদকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর পর ৪০-৫০টি নতুন কোম্পানির প্রায় ৪০০-৫০০টি বড় বাস নামানো হয়েছে। এসব গাড়ি সব যাত্রীবাড়ী মোড় ব্যবহার করে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে উঠে।’ আন্তঃজেলার বেশীরভাগ গাড়ি ফ্লাইওভার ব্যবহার না করে নিচের সড়ক দিয়ে চলাচল করে। তাই নিচের সড়কের চাপ আরও বেশি বেড়ে গেছে বলে জানান তিনি।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার ৮টি মহাসড়কের প্রবেশমুখে যানজট দূর করতে লিংক রোড নির্মাণ করতে হবে। তা না হলে উন্নয়নের সফলতা পাওয়া যাবে না।

বুয়েটের অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ডা. সামছুল হক সংবাদকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু ও মাওয়া মহাসড়ক নির্মাণের ফলে ঢাকার বাইরের খ-িত যানজটগুলো সব ঢাকার প্রবেশমুখে নিয়ে আসা হয়েছে। সময় বাঁচানোর জন্য বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করা হলেও সমন্বিত উন্নয়ন না করার কারণে বেশি সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। পদ্মা সেতুর সব যানবাহন এখন ঢাকা প্রবেশমুখে আটকে যাচ্ছে। অথচ আগেই এসটিপিতে বলা হয়েছিল ঢাকার ৮টি মহাসড়কে প্রবেশের জন্য লিংক রোড নির্মাণ করতে হবে।’ তা না হলে ঢাকার প্রবেশমুখের এই যানজট দূর হবে না বলে জানান তিনি।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. মো. হাদীউজ্জামান বলেন, ‘আরএসটিপিতে ইনার সার্কুলার রুট ছিল অগ্রাধিকার প্রকল্প। সেখানে ৮টি রেডিয়াল সড়কের কথা আছে, যার একটি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। এ সড়ক তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতুর ‘ফরওয়ার্ড লিঙ্ক’ হিসেবে। ‘ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্ক’ হিসেবে ইনার সার্কুলার রোড হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি। ইনার সার্কুলার রুটের গাবতলী সোয়ারীঘাট হয়ে কেরানীগঞ্জের সাড়ে ১২ কিলোমিটার অংশ অগ্রাধিকার দিয়ে করে ফেলা উচিত। বিদেশি অর্থায়ন না পেলে প্রয়োজনে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে করতে হবে, এটা করা জরুরি।’