বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা : স্থপতি স্বর্ণকন্যা শেখ হাসিনা

মোস্তাফা জব্বার

দুই ॥

স্মরণে রাখুন পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে সপরিবারে ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার পর আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনসমূহ একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ার ৬ বছর পর শেখ হাসিনা পোড়ামাটিতে চারাগাছ রোপণের কাজ শুরু করা দিয়ে তার বর্তমান রাজনৈতিক জীবনের শুরু করেন। যদিও তিনি ছাত্রজীবন থেকেই নিজে রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পরিবারেরই যুক্ত তথাপি আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের হাল ধরাটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিলো। ৮১ সাল থেকে সুদীর্ঘ পনেরো বছর লড়াই করে ৯৬ সালে জাতির পিতার দেশটি পরিচালনার প্রথম পিতৃ-মাতৃ-ভাতৃ হত্যার বদলা নিতে পারার ঘটনাটি বিরল ঘটনা ও বিশ্বের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তখনই তিনি বুঝতে পারেন দেশটিকে পাকিস্তান বানানোর সকল আয়োজন সম্পন্ন করে রাখা হয়েছে। একদিকে উল্টা করা পার্টিকে সোজা করা, নোংরা আবর্জনা পরিষ্কার করা ও অন্যদিকে ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশটিকে উদ্ধার করার কঠিন লড়াইয়ে তিনি জাতির পিতার স্বপ্নপূরণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করেন। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে তার একটি সুমহান কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই যে তিনি পিতা, মাতা, ভাই, ভাবি ও আত্মীয়স্বজনসহ পঁচাত্তরের ঘাতকদের বিচারসহ একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার করেন। ইতিহাসে এটি এক অনন্য নজির।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে তার শিক্ষক প্রয়াত প্রফেসর রফিকুল ইসলাম বলেছেনÑ ‘শেখ হাসিনার মধ্যে কোনো অহমিকা নেই এখনও সে আমার ছাত্রী।’ প্রয়াত আনিস স্যারও এ কথা বলতেন। মনে হচ্ছে আমাদের এই দুই স্যারই তাদের ছাত্রী শেখ হাসিনার বাংলা বিভাগের জীবনটাকে একদমই ভুলতে পারেননি। একটি বহুল প্রচারিত ভিডিও সবারই নজরে পড়ার কথা যেখানে প্রফেসর আনিসুজ্জামান স্যার লাল কার্পেটের ওপর দিয়ে হাঁটছেন আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্বা ঘাস দিয়ে হাঁটছেন এবং তিনিই তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের চাদরটা ঠিক করে দিচ্ছেন। একটি ছোট ঘটনার কথা মনে করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একটি ক্লাশে সৈয়দ আকরম হোসেন স্যার ক্লাশ নিচ্ছিলেন। সেই ক্লাশে শেখ হাসিনা একটি ছুটি চান। আকরম স্যার ছাত্রীটির নাম জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, শেখ হাসিনা। স্যার কৌতূহলবশত ছাত্রীর পিতার নাম জানতে চাইলেন। ছাত্রীটি বললেন, শেখ মুজিবুর রহমান। স্যার অবাক হলেন। বললেন তুমি এই বিভাগের ছাত্রী সেটি আমিই জানলাম না। এটিই শেখ হাসিনা। আমরা ছাত্রলীগ কর্মীরা ও তার সহপাঠী বা বিভাগের কিছু ছাত্র-ছাত্রী ছাড়া কারও বোঝার উপায় ছিলো না যে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে। এসব ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে আপনারা হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন যে, শেখ হাসিনা তার শিক্ষকদের কি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। তার বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন, সরকার পরিচালনা, দল চালানো, পরিবার ইত্যাদি নানা বিষয়ে বইয়ের পর বই লেখা যায়। লেখা হয়েছেও। এই নিবন্ধ লেখার সময় আমি অন্তত ২৫০ বইয়ের তালিকা পেলাম। খুব সঙ্গত কারণেই বলা যায় যে, একজন শেখ হাসিনা যিনি বাংলাদেশ নামক দেশটির সবচেয়ে দীর্ঘতম সময়ের প্রধানমন্ত্রী ও সুদীর্ঘতম সময়ের রাজনীতিবিদকে নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠার একটি নিবন্ধে তাকে অতি সামান্যটাও তুলে ধরা সম্ভব নয়। সেই প্রত্যাশাটিও করা উচিত হবে না। আমি এই আলোচনায় খুব ছোট করে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে তার অসাধারণ অবদানের খ-চিত্র একেবারেই ব্যক্তিগত প্রেক্ষিত থেকে লিখছি। তবে প্রত্যাশা করছি এই হৎ মানুষটিকে নিয়ে আমি বিস্তারিত লিখবো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৬৮ সালে। যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে প্রথম ক্লাশ করি সেদিনই কাঁদানে গ্যাস খেয়েছিলাম। এরপর আইয়ূব খানের পতন পর্যন্ত সময়টা কেমন কেটেছে সেটি ঊনসত্তরের গণআন্দোলন বিষয়ে যারা ছোটখাটো খবর রাখেন তারা সবাই জানেন। আইয়ূববিরোধী সেই আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের ভিতটিকে আরও শক্ত করে তুলে। আর এই আন্দোলনে শরিক আমরা সেই এক প্রজন্ম যাদের হাত ধরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এজন্য রাজপথ আমাদের স্থায়ী বসবাসের জায়গা হয়ে যায়। তবে এমন নয় যে আমরা ক্লাশে একেবারেই ঢুকিনি। বিশেষ করে আমরা সেইসব শিক্ষকদের পেয়েছিলাম যাদের ক্লাস করার জন্য অন্য বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা আমাদের ক্লাসে চলে আসতেন। স্মরণ করুন প্রফেসর মুনির চৌধুরী, ড. আহমদ শরিফ, ড. নিলীমা ইব্রাহিম, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বা আনোয়ার পাশাদের কথা। আরও ভাবুন ড. রফিকুল ইসলাম, সৈয়দ আকরাম হোসেন, আহমদ কবির স্যারদের কথা। এমনকি ড. আনিসুজ্জমানও আমাদের বিভাগে পড়িয়েছেন। অন্যদিকে তোফায়েল আহমেদ, আ স ম রব, শাজাহান সিরাজ বা আব্দুল কুদ্দুস মাখন তখন ডাকসু ও ছাত্রলীগের রাজনীতির নেতৃত্ব দিতেন। পেছনে ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মনি। সবার ওপরে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এজন্যই হয়তো রাজপথ কাঁপানো থেকে বটতলা-কলাভবনের দোতালা কাপানোর কোনটাতেই আমরা পেছনে ছিলাম না। বিশেষ করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজপথ অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠলে আমরা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পাশাপাশি লেখাপড়ায়ও মনযোগী হই। তবে লেখাপড়া গৌন এবং রাজনীতিটা তখন মুখ্য হয়েই থাকে। বরং খুব সহজেই একথা বলা যায় যে ৬৮-৬৯-৭০ সালটা আমাদেরকে পুরোই একটি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে। তখন ছাত্রলীগ সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের সৈনিক গড়ে তুলতে সমর্থকদের প্রস্তুত করে তুলে। একই সঙ্গে ছাত্রলীগই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সত্তুরের ঐতিহাসিক নির্বাচনের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে প্রস্তুত হয়। এমন উত্তপ্ত রাজনৈতিক অবস্থাতেই ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতক সম্মান শ্রেণির তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস করা শুরু করি।

১৯৬৮ সালের জুলাইতে অনার্সের ক্লাশ শুরু করে ৬৯ সালের আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে তখন আমরা কিছুটা স্বস্তিতে ছিলাম। চারদিক থেকে প্রস্তুতি চলছিলো সত্তরের নির্বাচনের জন্য গ্রামের বাড়িতে অনেক কাজ করতে হবে। বাংলা বিভাগের ৬৮ সালের ব্যাচের দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা নামক কেউ আমাদের ক্লাসে ছিলেন না। আমরা কেবল জানতাম শেখ হাসিনা বাংলা বিভাগেই পড়েন এবং তিনি আমাদের এক বছরের সিনিয়র। তার ক্লাসমেটরা ছিলেন বেবী মওদুদ, কবি অসীম সাহা, কবি নির্মলেন্দু গুণ, শফিকুর রহমান এমপি প্রমুখরা। আমি বঙ্গবন্ধু পরিবারের বড় ছেলে শেখ কামালের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম ৬৭ সাল থেকে যখন ঢাকা কলেজে পড়ি। ৬৬ সাল থেকেই আমরা আইয়ূবী স্বৈরাচারের মাঝে ঢাকা কলেজে লেখাপড়া করতাম। কলেজে মিটিং করা তো দূরের কথা আমরা লিফলেট বিলাতাম কলেজের বাইরে এসে। আমাদের এক বছর পরে ঢাকা কলেজে এসে পুরো কলেজটাকে ছাত্রলীগের ঘাটি বানিয়ে ছিলেন শেখ কামাল। অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা ছিলো শেখ কামালের। যে কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিলো সেই কলেজ হয়ে ওঠেছিলো ছাত্রলীগের দুর্গ। সেখানেই শেখ কামালের সঙ্গে রাজনীতি করি। যথানিয়মে আমাদের এক বছর পর ৬৯ সালে শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে আবার পরিচয়টা গাঢ় হয়। অবশ্য এই গাঢ়ত্বের জন্য শেখ কামালের রাজনীতির বাইরের বাড়তি গুণের কথা উল্লেখ করতে হবে। শেখ কামাল কেবল রাজনীতি পাগল ছিলেন না। তার রক্তের নেশা ছিলো খেলাধুলা এবং সংস্কৃতি। অনেকেই হয়তো জানেন না যে, আমার লেখা এক নদী রক্ত নাটকে তিনি অভিনয় করেন। নাটকটি ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে মঞ্চস্থ হয়েছিলো। সেই নাটকেই প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করার ধারাবাহিক কাহিনী বিধৃত হয়। সেই ৫২ সাল থেকে ৭১ পর্যন্ত পুরো সময়টাতে বাঙালি জাতির লড়াইয়ের ইতিহাস ছিলো সেই নাটকে। তবে আমরা বাংলা বিভাগের এই ব্যাচ ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার খবরই রাখতাম না। তখন শুনেছিলাম যে, তিনি সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ভিপি নির্বাচন করে জিতেছিলেন। এটি আমাদের জন্য অবিশ্বাস্য ছিলো। কারণ মেয়েরা তখন ছাত্রলীগ করতো না-ছাত্র ইউনিয়ন করতো। ওদের ধারণা ছিলো ছাত্র ইউনিয়ন সংস্কৃতি চর্চা করে আর ছাত্রলীগের পোলাপান গু-ামি করে। আমরা ঠিকই বুঝেছিলাম যে, শেখ হাসিনা দলের গুণে নয়, নিজগুণে জয়ী হন।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক]

মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই ২০২২ , ১১ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৭ জিলহজ ১৪৪৩

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা : স্থপতি স্বর্ণকন্যা শেখ হাসিনা

মোস্তাফা জব্বার

দুই ॥

স্মরণে রাখুন পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে সপরিবারে ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার পর আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনসমূহ একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ার ৬ বছর পর শেখ হাসিনা পোড়ামাটিতে চারাগাছ রোপণের কাজ শুরু করা দিয়ে তার বর্তমান রাজনৈতিক জীবনের শুরু করেন। যদিও তিনি ছাত্রজীবন থেকেই নিজে রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পরিবারেরই যুক্ত তথাপি আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের হাল ধরাটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিলো। ৮১ সাল থেকে সুদীর্ঘ পনেরো বছর লড়াই করে ৯৬ সালে জাতির পিতার দেশটি পরিচালনার প্রথম পিতৃ-মাতৃ-ভাতৃ হত্যার বদলা নিতে পারার ঘটনাটি বিরল ঘটনা ও বিশ্বের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তখনই তিনি বুঝতে পারেন দেশটিকে পাকিস্তান বানানোর সকল আয়োজন সম্পন্ন করে রাখা হয়েছে। একদিকে উল্টা করা পার্টিকে সোজা করা, নোংরা আবর্জনা পরিষ্কার করা ও অন্যদিকে ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশটিকে উদ্ধার করার কঠিন লড়াইয়ে তিনি জাতির পিতার স্বপ্নপূরণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করেন। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে তার একটি সুমহান কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই যে তিনি পিতা, মাতা, ভাই, ভাবি ও আত্মীয়স্বজনসহ পঁচাত্তরের ঘাতকদের বিচারসহ একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার করেন। ইতিহাসে এটি এক অনন্য নজির।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে তার শিক্ষক প্রয়াত প্রফেসর রফিকুল ইসলাম বলেছেনÑ ‘শেখ হাসিনার মধ্যে কোনো অহমিকা নেই এখনও সে আমার ছাত্রী।’ প্রয়াত আনিস স্যারও এ কথা বলতেন। মনে হচ্ছে আমাদের এই দুই স্যারই তাদের ছাত্রী শেখ হাসিনার বাংলা বিভাগের জীবনটাকে একদমই ভুলতে পারেননি। একটি বহুল প্রচারিত ভিডিও সবারই নজরে পড়ার কথা যেখানে প্রফেসর আনিসুজ্জামান স্যার লাল কার্পেটের ওপর দিয়ে হাঁটছেন আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্বা ঘাস দিয়ে হাঁটছেন এবং তিনিই তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের চাদরটা ঠিক করে দিচ্ছেন। একটি ছোট ঘটনার কথা মনে করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একটি ক্লাশে সৈয়দ আকরম হোসেন স্যার ক্লাশ নিচ্ছিলেন। সেই ক্লাশে শেখ হাসিনা একটি ছুটি চান। আকরম স্যার ছাত্রীটির নাম জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, শেখ হাসিনা। স্যার কৌতূহলবশত ছাত্রীর পিতার নাম জানতে চাইলেন। ছাত্রীটি বললেন, শেখ মুজিবুর রহমান। স্যার অবাক হলেন। বললেন তুমি এই বিভাগের ছাত্রী সেটি আমিই জানলাম না। এটিই শেখ হাসিনা। আমরা ছাত্রলীগ কর্মীরা ও তার সহপাঠী বা বিভাগের কিছু ছাত্র-ছাত্রী ছাড়া কারও বোঝার উপায় ছিলো না যে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে। এসব ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে আপনারা হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন যে, শেখ হাসিনা তার শিক্ষকদের কি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। তার বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন, সরকার পরিচালনা, দল চালানো, পরিবার ইত্যাদি নানা বিষয়ে বইয়ের পর বই লেখা যায়। লেখা হয়েছেও। এই নিবন্ধ লেখার সময় আমি অন্তত ২৫০ বইয়ের তালিকা পেলাম। খুব সঙ্গত কারণেই বলা যায় যে, একজন শেখ হাসিনা যিনি বাংলাদেশ নামক দেশটির সবচেয়ে দীর্ঘতম সময়ের প্রধানমন্ত্রী ও সুদীর্ঘতম সময়ের রাজনীতিবিদকে নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠার একটি নিবন্ধে তাকে অতি সামান্যটাও তুলে ধরা সম্ভব নয়। সেই প্রত্যাশাটিও করা উচিত হবে না। আমি এই আলোচনায় খুব ছোট করে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে তার অসাধারণ অবদানের খ-চিত্র একেবারেই ব্যক্তিগত প্রেক্ষিত থেকে লিখছি। তবে প্রত্যাশা করছি এই হৎ মানুষটিকে নিয়ে আমি বিস্তারিত লিখবো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৬৮ সালে। যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে প্রথম ক্লাশ করি সেদিনই কাঁদানে গ্যাস খেয়েছিলাম। এরপর আইয়ূব খানের পতন পর্যন্ত সময়টা কেমন কেটেছে সেটি ঊনসত্তরের গণআন্দোলন বিষয়ে যারা ছোটখাটো খবর রাখেন তারা সবাই জানেন। আইয়ূববিরোধী সেই আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের ভিতটিকে আরও শক্ত করে তুলে। আর এই আন্দোলনে শরিক আমরা সেই এক প্রজন্ম যাদের হাত ধরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এজন্য রাজপথ আমাদের স্থায়ী বসবাসের জায়গা হয়ে যায়। তবে এমন নয় যে আমরা ক্লাশে একেবারেই ঢুকিনি। বিশেষ করে আমরা সেইসব শিক্ষকদের পেয়েছিলাম যাদের ক্লাস করার জন্য অন্য বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা আমাদের ক্লাসে চলে আসতেন। স্মরণ করুন প্রফেসর মুনির চৌধুরী, ড. আহমদ শরিফ, ড. নিলীমা ইব্রাহিম, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বা আনোয়ার পাশাদের কথা। আরও ভাবুন ড. রফিকুল ইসলাম, সৈয়দ আকরাম হোসেন, আহমদ কবির স্যারদের কথা। এমনকি ড. আনিসুজ্জমানও আমাদের বিভাগে পড়িয়েছেন। অন্যদিকে তোফায়েল আহমেদ, আ স ম রব, শাজাহান সিরাজ বা আব্দুল কুদ্দুস মাখন তখন ডাকসু ও ছাত্রলীগের রাজনীতির নেতৃত্ব দিতেন। পেছনে ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মনি। সবার ওপরে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এজন্যই হয়তো রাজপথ কাঁপানো থেকে বটতলা-কলাভবনের দোতালা কাপানোর কোনটাতেই আমরা পেছনে ছিলাম না। বিশেষ করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজপথ অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠলে আমরা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পাশাপাশি লেখাপড়ায়ও মনযোগী হই। তবে লেখাপড়া গৌন এবং রাজনীতিটা তখন মুখ্য হয়েই থাকে। বরং খুব সহজেই একথা বলা যায় যে ৬৮-৬৯-৭০ সালটা আমাদেরকে পুরোই একটি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে। তখন ছাত্রলীগ সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের সৈনিক গড়ে তুলতে সমর্থকদের প্রস্তুত করে তুলে। একই সঙ্গে ছাত্রলীগই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সত্তুরের ঐতিহাসিক নির্বাচনের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে প্রস্তুত হয়। এমন উত্তপ্ত রাজনৈতিক অবস্থাতেই ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতক সম্মান শ্রেণির তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস করা শুরু করি।

১৯৬৮ সালের জুলাইতে অনার্সের ক্লাশ শুরু করে ৬৯ সালের আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে তখন আমরা কিছুটা স্বস্তিতে ছিলাম। চারদিক থেকে প্রস্তুতি চলছিলো সত্তরের নির্বাচনের জন্য গ্রামের বাড়িতে অনেক কাজ করতে হবে। বাংলা বিভাগের ৬৮ সালের ব্যাচের দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা নামক কেউ আমাদের ক্লাসে ছিলেন না। আমরা কেবল জানতাম শেখ হাসিনা বাংলা বিভাগেই পড়েন এবং তিনি আমাদের এক বছরের সিনিয়র। তার ক্লাসমেটরা ছিলেন বেবী মওদুদ, কবি অসীম সাহা, কবি নির্মলেন্দু গুণ, শফিকুর রহমান এমপি প্রমুখরা। আমি বঙ্গবন্ধু পরিবারের বড় ছেলে শেখ কামালের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম ৬৭ সাল থেকে যখন ঢাকা কলেজে পড়ি। ৬৬ সাল থেকেই আমরা আইয়ূবী স্বৈরাচারের মাঝে ঢাকা কলেজে লেখাপড়া করতাম। কলেজে মিটিং করা তো দূরের কথা আমরা লিফলেট বিলাতাম কলেজের বাইরে এসে। আমাদের এক বছর পরে ঢাকা কলেজে এসে পুরো কলেজটাকে ছাত্রলীগের ঘাটি বানিয়ে ছিলেন শেখ কামাল। অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা ছিলো শেখ কামালের। যে কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিলো সেই কলেজ হয়ে ওঠেছিলো ছাত্রলীগের দুর্গ। সেখানেই শেখ কামালের সঙ্গে রাজনীতি করি। যথানিয়মে আমাদের এক বছর পর ৬৯ সালে শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে আবার পরিচয়টা গাঢ় হয়। অবশ্য এই গাঢ়ত্বের জন্য শেখ কামালের রাজনীতির বাইরের বাড়তি গুণের কথা উল্লেখ করতে হবে। শেখ কামাল কেবল রাজনীতি পাগল ছিলেন না। তার রক্তের নেশা ছিলো খেলাধুলা এবং সংস্কৃতি। অনেকেই হয়তো জানেন না যে, আমার লেখা এক নদী রক্ত নাটকে তিনি অভিনয় করেন। নাটকটি ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে মঞ্চস্থ হয়েছিলো। সেই নাটকেই প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করার ধারাবাহিক কাহিনী বিধৃত হয়। সেই ৫২ সাল থেকে ৭১ পর্যন্ত পুরো সময়টাতে বাঙালি জাতির লড়াইয়ের ইতিহাস ছিলো সেই নাটকে। তবে আমরা বাংলা বিভাগের এই ব্যাচ ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার খবরই রাখতাম না। তখন শুনেছিলাম যে, তিনি সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ভিপি নির্বাচন করে জিতেছিলেন। এটি আমাদের জন্য অবিশ্বাস্য ছিলো। কারণ মেয়েরা তখন ছাত্রলীগ করতো না-ছাত্র ইউনিয়ন করতো। ওদের ধারণা ছিলো ছাত্র ইউনিয়ন সংস্কৃতি চর্চা করে আর ছাত্রলীগের পোলাপান গু-ামি করে। আমরা ঠিকই বুঝেছিলাম যে, শেখ হাসিনা দলের গুণে নয়, নিজগুণে জয়ী হন।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক]