নাজিরপুর যুদ্ধ দিবস

শহীদ স্মরণে মুক্তিযোদ্ধাদের পদযাত্রা

গতকাল ২৬ জুলাই ছিল নেত্রকোনার কলমাকান্দায় ঐতিহাসিক নাজিরপুর যুদ্ধ দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সরকারিভাবে নেয়া হয়েছে নানা কমৃসূচী। ১৯৭১ এই দিনে জেলার কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুরে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে প্রাণ হারান সাত জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এদিনে শহীদ হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নেত্রকোনার আবদুল আজিজ ও মো. ফজলুল হক, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মো. ইয়ার মামুদ, ভবতোষ চন্দ্র দাস, মো. নূরুজ্জামান, দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস ও জামালপুরের মো. জামাল উদ্দিন।

শহীদদের স্মরনেই দিনটি ঘিরে প্রতি বছরের ন্যায় এবারো জেলা প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় জেলা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ড বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। সকাল ১১ টায় সাত শহীদের মাজারে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধা, জনপ্রতিনিধি সহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষের অংশ গ্রহনে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে এবার সাত শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মানে পদযাত্রা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল। নেত্রকোনা শহরের স্থানীয় শহীদ মিনারেগত সোমবার সন্ধ্যায় পদযাত্রার উদ্বোধন করেন নেত্রকোনা পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম খান। পদযাত্রার আয়োজন করে মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল ট্রাস্টি। গতকাল মঙ্গলবার ভোর রাত চারটায় লেঙ্গুরা সাত শহীদের মাজারের দিকে রওয়ানা দিয়ে বড়ওয়ারি হয়ে সিধলী দিয়ে আনন্দপুর হয়ে নাজিরপুর এবং পরে লেঙ্গুরা ৪০ কিলোমিটার হেঁেট সমাধিস্থলে পৌছান । এসময় আয়োজকদের বেশ কজন সদস্যও এই কর্মসূচিতে যোগ দেন।

বিমল পাল জানান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিছন্ন মানসিকতাসম্পন্ন তরুণ প্রজন্ম বিনর্মিানে এবং আদর্শবান দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরীতে এই পদযাত্রা। তিনি এর আগে প্রখম পদযাত্রা করেছিলেন মেঘালয়ের হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহ সদর পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার। দ্বিতীয়টি করেছেন গত ২১ শে ফেব্রুয়ারী ভাষা শহীদদের স্মরণে ময়মনসিংহ থেকে ২১ শে পদকপ্রাপ্তদের স্মরণে ময়মনসিংহ থেকে ভালুকা ৫২ কিলোমিটার বিজয় পদযাত্রা।

এদিকে সরকারি ভাবে প্রতি বছরের ন্যায় এবারের আয়োজন নিয়ে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ জানান, দিনটি উপলক্ষে শহীদদের স্মরণে সাত শহীদের সমাধিস্থলে এবং যুদ্ধ স্মৃতি সৌধে পুস্পস্তবক অর্পন করা হয়েছে।

এবার সম্প্রতি বন্যায় ক্ষতি হওয়া কলমাকান্দা উপজেলার আশ্রয়হীন ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে।

সেইসাথে এই উপজেলার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া দুইশত পরিবারের মাঝে ত্রাণ সহায়তা বিতরণ করা হয়।

যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরে যুদ্ধে অংশ নেয়া কনিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিমসহ অন্যরা বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই সকালে দূর্গাপুরের বিরিশিরি থেকে কলমাকান্দায় পাকহানাদার ক্যাম্পে রসদ যাবার খবর পান মুক্তিযোদ্ধারা। খবর পেয়েই নেত্রকোনা অঞ্চলের কোম্পানি’র কমান্ডার নাজমুল হক তারার নেতৃত্বে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল পরিকল্পনা অনুযায়ী অবস্থান নেয় নাজিরপুরে। দলটি ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে বাজারের সব কয়টি প্রবেশ পথে অ্যাম্বুস করেন। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর পাকহানাদার বাহিনী না আসায় তাদের অ্যাম্বুস প্রত্যাহার করে নিজ ক্যাম্পে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধারা। পথে নাজিরপুর ভূমি অফিসের সামনে বসে দলের সকল সদস্যদের নিয়ে চা মুড়ি খেতে বসেন কোম্পানি’র কমান্ডার। এদিকে নাজিরপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়ে বাজারে নাস্তা খেতে বসলে এ খবর স্থানীয় রাজাকাররা পাকবাহিনীদের জানায়। এই সুযোগে পথিমধ্যে নাজিরপুর কাচারির কাছে পাকহানাদার বাহিনী নৌকায় করে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অতর্কিতে গুলি বর্ষণ শুরু করে। এসময় মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি করতে থাকেন।

এই সুযোগে পথিমধ্যে নাজিরপুর কাচারির কাছে পাকহানাদার বাহিনী নৌকায় করে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অতর্কিতে গুলি বর্ষণ শুরু করে। এক পর্যায়ে সম্মুখ যুদ্ধে ঘটনা স্থালেই সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এসময় ঘাড়ে গুলি লেগে আহত হন কোম্পানি’র কমান্ডার নাজমুল হক তারা সহ অনেকেই।

স্থানীয়দের সহযোগিতায় আহত কোম্পানি’র কমান্ডার নাজমুল হক তারা শহীদদের মরদেহ উদ্ধার করে কলমাকান্দার লেংঙ্গুরার পাহাড়ি নদী গণেশ্বরী পাড়ের ফুলবাড়ীর নামক ভারত সীমান্তে ১১৭২ নং পিলার সংলগ্ন সমাহিত করা হয়। এদিকে আহত কোম্পানি’র কমান্ডারকে চিকিৎসার জন্য ভারত নিয়ে যাওয়া হয়।

পরবর্তীতে নেত্রকোনা জেলা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবছর দিনটিকে ঐতিহাসিক নাজিরপুর যুদ্ধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন।

বুধবার, ২৭ জুলাই ২০২২ , ১২ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৮ জিলহজ ১৪৪৩

নাজিরপুর যুদ্ধ দিবস

শহীদ স্মরণে মুক্তিযোদ্ধাদের পদযাত্রা

প্রতিনিধি, নেত্রকোনা

image

নেত্রকোনা : গতকাল নাজিরপুর যুদ্ধ দিবস উপলক্ষে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধারা -সংবাদ

গতকাল ২৬ জুলাই ছিল নেত্রকোনার কলমাকান্দায় ঐতিহাসিক নাজিরপুর যুদ্ধ দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সরকারিভাবে নেয়া হয়েছে নানা কমৃসূচী। ১৯৭১ এই দিনে জেলার কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুরে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে প্রাণ হারান সাত জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এদিনে শহীদ হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নেত্রকোনার আবদুল আজিজ ও মো. ফজলুল হক, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মো. ইয়ার মামুদ, ভবতোষ চন্দ্র দাস, মো. নূরুজ্জামান, দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস ও জামালপুরের মো. জামাল উদ্দিন।

শহীদদের স্মরনেই দিনটি ঘিরে প্রতি বছরের ন্যায় এবারো জেলা প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় জেলা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ড বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। সকাল ১১ টায় সাত শহীদের মাজারে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধা, জনপ্রতিনিধি সহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষের অংশ গ্রহনে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে এবার সাত শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মানে পদযাত্রা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল। নেত্রকোনা শহরের স্থানীয় শহীদ মিনারেগত সোমবার সন্ধ্যায় পদযাত্রার উদ্বোধন করেন নেত্রকোনা পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম খান। পদযাত্রার আয়োজন করে মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল ট্রাস্টি। গতকাল মঙ্গলবার ভোর রাত চারটায় লেঙ্গুরা সাত শহীদের মাজারের দিকে রওয়ানা দিয়ে বড়ওয়ারি হয়ে সিধলী দিয়ে আনন্দপুর হয়ে নাজিরপুর এবং পরে লেঙ্গুরা ৪০ কিলোমিটার হেঁেট সমাধিস্থলে পৌছান । এসময় আয়োজকদের বেশ কজন সদস্যও এই কর্মসূচিতে যোগ দেন।

বিমল পাল জানান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিছন্ন মানসিকতাসম্পন্ন তরুণ প্রজন্ম বিনর্মিানে এবং আদর্শবান দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরীতে এই পদযাত্রা। তিনি এর আগে প্রখম পদযাত্রা করেছিলেন মেঘালয়ের হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহ সদর পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার। দ্বিতীয়টি করেছেন গত ২১ শে ফেব্রুয়ারী ভাষা শহীদদের স্মরণে ময়মনসিংহ থেকে ২১ শে পদকপ্রাপ্তদের স্মরণে ময়মনসিংহ থেকে ভালুকা ৫২ কিলোমিটার বিজয় পদযাত্রা।

এদিকে সরকারি ভাবে প্রতি বছরের ন্যায় এবারের আয়োজন নিয়ে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ জানান, দিনটি উপলক্ষে শহীদদের স্মরণে সাত শহীদের সমাধিস্থলে এবং যুদ্ধ স্মৃতি সৌধে পুস্পস্তবক অর্পন করা হয়েছে।

এবার সম্প্রতি বন্যায় ক্ষতি হওয়া কলমাকান্দা উপজেলার আশ্রয়হীন ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে।

সেইসাথে এই উপজেলার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া দুইশত পরিবারের মাঝে ত্রাণ সহায়তা বিতরণ করা হয়।

যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরে যুদ্ধে অংশ নেয়া কনিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিমসহ অন্যরা বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই সকালে দূর্গাপুরের বিরিশিরি থেকে কলমাকান্দায় পাকহানাদার ক্যাম্পে রসদ যাবার খবর পান মুক্তিযোদ্ধারা। খবর পেয়েই নেত্রকোনা অঞ্চলের কোম্পানি’র কমান্ডার নাজমুল হক তারার নেতৃত্বে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল পরিকল্পনা অনুযায়ী অবস্থান নেয় নাজিরপুরে। দলটি ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে বাজারের সব কয়টি প্রবেশ পথে অ্যাম্বুস করেন। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর পাকহানাদার বাহিনী না আসায় তাদের অ্যাম্বুস প্রত্যাহার করে নিজ ক্যাম্পে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধারা। পথে নাজিরপুর ভূমি অফিসের সামনে বসে দলের সকল সদস্যদের নিয়ে চা মুড়ি খেতে বসেন কোম্পানি’র কমান্ডার। এদিকে নাজিরপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়ে বাজারে নাস্তা খেতে বসলে এ খবর স্থানীয় রাজাকাররা পাকবাহিনীদের জানায়। এই সুযোগে পথিমধ্যে নাজিরপুর কাচারির কাছে পাকহানাদার বাহিনী নৌকায় করে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অতর্কিতে গুলি বর্ষণ শুরু করে। এসময় মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি করতে থাকেন।

এই সুযোগে পথিমধ্যে নাজিরপুর কাচারির কাছে পাকহানাদার বাহিনী নৌকায় করে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অতর্কিতে গুলি বর্ষণ শুরু করে। এক পর্যায়ে সম্মুখ যুদ্ধে ঘটনা স্থালেই সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এসময় ঘাড়ে গুলি লেগে আহত হন কোম্পানি’র কমান্ডার নাজমুল হক তারা সহ অনেকেই।

স্থানীয়দের সহযোগিতায় আহত কোম্পানি’র কমান্ডার নাজমুল হক তারা শহীদদের মরদেহ উদ্ধার করে কলমাকান্দার লেংঙ্গুরার পাহাড়ি নদী গণেশ্বরী পাড়ের ফুলবাড়ীর নামক ভারত সীমান্তে ১১৭২ নং পিলার সংলগ্ন সমাহিত করা হয়। এদিকে আহত কোম্পানি’র কমান্ডারকে চিকিৎসার জন্য ভারত নিয়ে যাওয়া হয়।

পরবর্তীতে নেত্রকোনা জেলা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবছর দিনটিকে ঐতিহাসিক নাজিরপুর যুদ্ধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন।