ছয় মামলার বিচার ৫ বছরেও শুরু হয়নি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় অবমাননাকর স্ট্যাটাস দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রংপুরের সদর উপজেলার ঠাকুরদাস গ্রামে ও পীরগঞ্জ উপজেলার মাঝিপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা অগ্নিসংযোগ মালামাল লুটপাটসহ তা-বের ঘটনায় ৬টি মামলা দায়ের করা হলেও গত ৫ বছরে কোন মামলার বিচার শুরু হয়নি। মূলত পুলিশের দায়িত্বহীনতা গোজামিলের তদন্ত প্রকৃত আসামিদের বাদ দিয়ে গায়েবি আসামিদের নাম দিয়ে জোড়াতালির চার্জশিট দাখিল দুর্নীতি আর ঘুষবাণিজ্য মূল কারণ বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে মামলাগুলো বিচার শুরু করা আগামী ৫ বছরেও সম্ভব হবে না বলে আইনজীবীসহ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অভিযোগ।

এদিকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর দ্রুত বিচার শেষ করে মামলা নিষ্পত্তি করার আদেশ এবং মামলাগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ার নির্দেশনা বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলে রংপুরের সরকারি আইনজীবীদের অভিযোগ।

রংপুরের প্রধান সরকারি আইনজীবী পিপি আবদুল মালেক জানান, রংপুরে দুটি স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে তা-বের ঘটনায় পুলিশ একটি ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলায় ৫০০ জনের বেশি আসামির নামে চার্জশিট দাখিল করেছে। মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের অনেককে এলাকার লোক চেনে না, এ ক্ষেত্রে বার বার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রকৃত আসামিদের নামে চার্জশিট দাখিলের জন্য বলা হলেও তা করা হয়নি। ফলে মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার অথবা তারা আদালতে হাজির না হলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশসহ নানা ফরমালিটি ও আইনের বাধ্যবাধকতা আছে সেসব শেষ করার পরেই বিচার শুরু হবে যেটা সুদূরপরাহত। অথচ প্রধান বিচারপতির সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার। বিষয়গুলো পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে বলেও কাজ হয়নি।

প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর। ফেসইবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয়াকে কেন্দ্র করে সদর উপজেলার ঠাকুরপাড়া হিন্দুপাড়ায় হামলা চালিয়ে অর্ধ শতাধিক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও মালামাল লুট করা হয়। এ ঘটনায় রংপুর সদর ও পার্শ্ববর্তী গঙ্গচড়া থানায় দুটি মামলা হয়। দুটি মামলাতেই ২৬৮ জনকে আসামি করে চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ। গঙ্গাচড়া থানায় দায়ের করা মামলার বাদী ছিল এসআই মোহাম্মদ আলী। পরে তদন্তকালে ২৬৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্তকারী এসআই মকবুল হোসেন।

অন্যদিকে রংপুর সদর থানার মামলার বাদী ছিলেন এসআই ফেরদৌস আলী। তদন্ত শেষে ২৬৮ জনের নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। দুটি মামলাতেই ২৬৮ জন করে আসামির নাম উল্লেখ করে আদালতে ২০১৯ সালের প্রথম দিকে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়।

মামলায় বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের জেলা সভাপতি এনামুল হক মাজেদিসহ বেশ কয়েকজন স্থানীয় জামায়াত শিবিরের নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। ঘটনার পর অর্ধশতাধিক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। পরে লোক দেখানো তদন্ত করে সাড়ে ৫০০ জনের নামে চার্জশিট দাখিল করা হয়। কিন্তু আসামিদের মধ্যে অন্তত শতাধিক আসামি রয়েছে যাদের নামে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। ওই নামে আসামিদের এলাকার কেউ চেনে না। ফলে বার বার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পরও পুলিশ তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। ফলে মামলা দুটি বিচার কাজ আদৌ কবে শুরু হবে তা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

এ ব্যাপারে রংপুরের সিনিয়র আইনজীবী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, যেকোন অপরাধের বিচার করতে মামলার বাদীকে সন্দেহাতীতভাবে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে মামলা প্রমাণ দিতে হয়। কিন্তু ঠাকুরপাড়ার হিন্দুপাড়ায় তা-বের ঘটনায় পুলিশের তদন্ত ত্রুটি, যাকে তাকে আসামি করে আসামির সংখ্যা বেশি দেখিয়ে মামলার বারোটা বাজানো হয়েছে। তারপরও আলোচিত মামলা দুটি পুলিশ প্রমাণ করতে পারলে ভালো হবে তবে। কতদিন মামলা বিচার শুরু হতে লাগবে সেটাই এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

এ ব্যাপারে ঠাকুরপাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত মনোবালা ও সাধন চন্দ্র বললেন, চার বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও এখনও মামলার আসামিরাই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। ফলে এ মামলা কবে শেষ হবে তা নিয়ে তারা সন্দিহান।

একইভাবে ফেইসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর স্ট্যাটাস দেয়ার ঘটনায় ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বড় করিমপুর কসবা মাঝিপাড়া ও দক্ষিণ মাঝিপাড়ায় সন্ত্রাসীদের হামলা অন্তত ৩০টি বাড়িঘরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া মালামাল ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ৩টি আইসিটি আইনে ও একটি হিন্দুপাড়ায় তা-বের ঘটনায় ৪টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। ঘটনার পর পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে অন্তত ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের সবাইকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু ঘটনার নেপথ্যের গডফাদার কারা ছিল পুলিশ তাদের চিহ্নিত করতে পারেনি। অবশেষে জোড়াতালি দিয়ে ৪টি মামলাতেই চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে বলে পীরগঞ্জ থানার ওসি আবদুল আউয়াল জানিয়েছেন।

বুধবার, ২৭ জুলাই ২০২২ , ১২ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৮ জিলহজ ১৪৪৩

রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা-আগুন

ছয় মামলার বিচার ৫ বছরেও শুরু হয়নি

লিয়াকত আলী বাদল, রংপুর

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় অবমাননাকর স্ট্যাটাস দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রংপুরের সদর উপজেলার ঠাকুরদাস গ্রামে ও পীরগঞ্জ উপজেলার মাঝিপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা অগ্নিসংযোগ মালামাল লুটপাটসহ তা-বের ঘটনায় ৬টি মামলা দায়ের করা হলেও গত ৫ বছরে কোন মামলার বিচার শুরু হয়নি। মূলত পুলিশের দায়িত্বহীনতা গোজামিলের তদন্ত প্রকৃত আসামিদের বাদ দিয়ে গায়েবি আসামিদের নাম দিয়ে জোড়াতালির চার্জশিট দাখিল দুর্নীতি আর ঘুষবাণিজ্য মূল কারণ বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে মামলাগুলো বিচার শুরু করা আগামী ৫ বছরেও সম্ভব হবে না বলে আইনজীবীসহ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অভিযোগ।

এদিকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর দ্রুত বিচার শেষ করে মামলা নিষ্পত্তি করার আদেশ এবং মামলাগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ার নির্দেশনা বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলে রংপুরের সরকারি আইনজীবীদের অভিযোগ।

রংপুরের প্রধান সরকারি আইনজীবী পিপি আবদুল মালেক জানান, রংপুরে দুটি স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে তা-বের ঘটনায় পুলিশ একটি ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলায় ৫০০ জনের বেশি আসামির নামে চার্জশিট দাখিল করেছে। মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের অনেককে এলাকার লোক চেনে না, এ ক্ষেত্রে বার বার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রকৃত আসামিদের নামে চার্জশিট দাখিলের জন্য বলা হলেও তা করা হয়নি। ফলে মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার অথবা তারা আদালতে হাজির না হলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশসহ নানা ফরমালিটি ও আইনের বাধ্যবাধকতা আছে সেসব শেষ করার পরেই বিচার শুরু হবে যেটা সুদূরপরাহত। অথচ প্রধান বিচারপতির সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার। বিষয়গুলো পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে বলেও কাজ হয়নি।

প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর। ফেসইবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয়াকে কেন্দ্র করে সদর উপজেলার ঠাকুরপাড়া হিন্দুপাড়ায় হামলা চালিয়ে অর্ধ শতাধিক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও মালামাল লুট করা হয়। এ ঘটনায় রংপুর সদর ও পার্শ্ববর্তী গঙ্গচড়া থানায় দুটি মামলা হয়। দুটি মামলাতেই ২৬৮ জনকে আসামি করে চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ। গঙ্গাচড়া থানায় দায়ের করা মামলার বাদী ছিল এসআই মোহাম্মদ আলী। পরে তদন্তকালে ২৬৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্তকারী এসআই মকবুল হোসেন।

অন্যদিকে রংপুর সদর থানার মামলার বাদী ছিলেন এসআই ফেরদৌস আলী। তদন্ত শেষে ২৬৮ জনের নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। দুটি মামলাতেই ২৬৮ জন করে আসামির নাম উল্লেখ করে আদালতে ২০১৯ সালের প্রথম দিকে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়।

মামলায় বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের জেলা সভাপতি এনামুল হক মাজেদিসহ বেশ কয়েকজন স্থানীয় জামায়াত শিবিরের নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। ঘটনার পর অর্ধশতাধিক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। পরে লোক দেখানো তদন্ত করে সাড়ে ৫০০ জনের নামে চার্জশিট দাখিল করা হয়। কিন্তু আসামিদের মধ্যে অন্তত শতাধিক আসামি রয়েছে যাদের নামে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। ওই নামে আসামিদের এলাকার কেউ চেনে না। ফলে বার বার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পরও পুলিশ তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। ফলে মামলা দুটি বিচার কাজ আদৌ কবে শুরু হবে তা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

এ ব্যাপারে রংপুরের সিনিয়র আইনজীবী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, যেকোন অপরাধের বিচার করতে মামলার বাদীকে সন্দেহাতীতভাবে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে মামলা প্রমাণ দিতে হয়। কিন্তু ঠাকুরপাড়ার হিন্দুপাড়ায় তা-বের ঘটনায় পুলিশের তদন্ত ত্রুটি, যাকে তাকে আসামি করে আসামির সংখ্যা বেশি দেখিয়ে মামলার বারোটা বাজানো হয়েছে। তারপরও আলোচিত মামলা দুটি পুলিশ প্রমাণ করতে পারলে ভালো হবে তবে। কতদিন মামলা বিচার শুরু হতে লাগবে সেটাই এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

এ ব্যাপারে ঠাকুরপাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত মনোবালা ও সাধন চন্দ্র বললেন, চার বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও এখনও মামলার আসামিরাই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। ফলে এ মামলা কবে শেষ হবে তা নিয়ে তারা সন্দিহান।

একইভাবে ফেইসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর স্ট্যাটাস দেয়ার ঘটনায় ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বড় করিমপুর কসবা মাঝিপাড়া ও দক্ষিণ মাঝিপাড়ায় সন্ত্রাসীদের হামলা অন্তত ৩০টি বাড়িঘরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া মালামাল ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ৩টি আইসিটি আইনে ও একটি হিন্দুপাড়ায় তা-বের ঘটনায় ৪টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। ঘটনার পর পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে অন্তত ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের সবাইকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু ঘটনার নেপথ্যের গডফাদার কারা ছিল পুলিশ তাদের চিহ্নিত করতে পারেনি। অবশেষে জোড়াতালি দিয়ে ৪টি মামলাতেই চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে বলে পীরগঞ্জ থানার ওসি আবদুল আউয়াল জানিয়েছেন।