দৃশ্যপট ফরিদপুর ১৯৭০-৭২

একজন কিশোরের চোখে দেখা সেই সময়

মিনহাজ আহমেদ

যে সময়টার কথা বলছি সেটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কিছু আগে থেকে ১৯৭০-৭২। আমার এখনও ঝাপসা মনে পড়ে, ছেলেবেলায় মা আমাকে কাজল পরিয়ে দিত। দিত আমার কপালে কালো ফোঁটা। আমি ছিলাম না নয়ন কাড়া সুন্দর; বরং অসুন্দরের মাঝেই ছিল স্থান। মার মনে খুউব আশা ছিল বড় ছেলের পরে এবারে হবে মেয়ে সন্তান। কিন্তু হলো এক জীর্ণ-শীর্ণ মৃতপ্রায় শিশু; এই আমি। মায়ের কাছে শুনেছি ছোটবেলায় আমি ছিলাম খুবই রুগ্ন। মা বড়াই করে বলতেন পাশের বাড়ির খালাম্মা নাকি বলতেন- “এছেলে বাঁচলে সেদ্ধ বীজে ধান গজাবে”। সেদ্ধ বীজে ধান হয় কিনা জানি না; আমি ঠিকই বেঁচে উঠেছি।

কিন্তু মায়ের মেয়ে সন্তানের আশা অপূর্ণ থেকে যায়।

মেয়ের বদলে ছেলে; মা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। তাই মা আমাকে চোখে কাজল পরাতেন। মেয়েদের ফ্রক পরিয়ে রাখতেন; দীর্ঘদিন পর্যন্ত।

চোখে কাজল দেয়াতে যে জ্বালাপোড়া করতো তা এখনও আমার মনে আছে।

আমরা যে এলাকায় থাকতাম সেটা ফরিদপুর শহরের ছোট একটা এলাকা; লক্ষ্মীপুর; না পুরো গ্রাম না পুরো শহর; যাকে বলে মফঃস্বল। আমাদের বাসাটা ছিল রেলস্টেশনের কাছে। যে বাড়িটায় থাকতাম সেটা ছিল বড় একটা একতলা লম্বা বিল্ডিং। বাসায় ছিল একটা লম্বা বারান্দা। পাশাপাশি তিনটা একই ধরনের বাড়ি। বাড়িগুলো ছিল Enemies property; ব্রিটিশ ভারত বিভাজনের পর; তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার বাড়িগুলোর দখল নেয় এবং ব্যবহার করে সরকারি বাসভবন হিসেবে।

আমার বাবা ছিলেন সরকারি স্কুলের শিক্ষক। আমাদের পাশের বাসায় ছিলেন হক সাহেব; উনি ডিসি অফিসের নাজির। তার পাশের বাসায় ছিলেন একজন রিটায়ার্ড ডিএসপি; তার পাশের বাড়িটাও ডিএসপি সাহেবের। ভাড়া দিয়েছেন; থাকতেন পুলিশের এক সাবেক কর্মকর্তা। তার পাশেই থাকতেন হাশেম স্যার; উনি স্থানীয় সরকারি কলেজের দর্শনের অধ্যাপক। হাশেম স্যারের বাসার পরেই পৌরসভার রাস্তা। হাশেম স্যারের বাসা থেকে আমাদের বাসা অবধি মাটির রাস্তা। রাস্তাটা মূলত আমাদের বাসা অবধি এসে থেমে গেছে। আমাদের বাসার পুবে থাকতো মন্তাজ মিয়া। উনি প্রধানত ছিলেন কৃষিজীবী আর বাকি সময়ে করতেন গরুর হাটে দালালি।

মফস্বল শহরের বাসিন্দা হিসেবে আমরা একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকতাম। এই মিলেমিশাটা ছিল অন্যরকমের। সুখ-দুঃখের পাশাপাশি আমরা আত্মীয়তাও ভাগাভাগি করতাম। যেমন আমার মামা হতো সবার মামা। আবার আমার চাচা সবার চাচা। ঠিক তেমনি পাশের বাড়ির হক সাহেবের বড় মেয়ে আমাদের সবারই বড় আপা; মেজ আপা আমাদের সবারই মেজ আপা।

আমাদের বাসার সামনে যে লম্বা রাস্তা ছিল আমরা সারাক্ষণ সেই রাস্তায় খেলতাম। কত ধরনের খেলা; কখনও ডাংগুলি কখনও ক্রিকেট কখনও ফুটবল।

ডিএসপি সাহেব ছিলেন বুড়ো। আমরা সবাই উনাকে নানা বলে ডাকতাম। আমার মাও বলতো নানা; আমরাও বলতাম নানা। একটা ইজি চেয়ারে লম্বা বারান্দায় বসে থাকতেন নানা। আমরা খেলতে খেলতে একটু হৈচৈ করলেই বকা দিতেন। এলাকার সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে সবাই উনাকে খুব সম্মান করতেন। আমাদের পাড়ার আপারা দলবেঁধে খেলতেন গোল্লাছুট; ছি বুড়ি এসব খেলা। মাঝে মাঝে দল ভারি করার জন্য আমাদেরও সংগে নিতেন।

আমি যে স্কুলটায় পড়া শুরু করি ওটা ছিল ক্রিশ্চিয়ান মিশন স্কুল। স্কুলটা চালাতো ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি। মিশনারির ছিল নিজস্ব প্রাইমারি স্কুল; church; লাইব্রেরি; কারখানা; পুকুর; টিচারদের বাড়ি; গোরস্থান। যেন একটা উপ-শহর। স্কুলের স্থাপত্য ছিল পশ্চিমা ধাঁচে গড়া। লম্বা লম্বা ভবন; slanted টালির ছাদ। সুন্দর পরিপাটি; কোলাহলমুক্ত কুহেলিকাময় এক অনুপম পরিবেশ। বিদ্যা শিক্ষার জন্য যেন এক আদর্শ স্থান।

স্কুলটা ছিল প্রাইমারি পর্যন্ত। স্কুলে কোনো পুরুষ শিক্ষক বা স্টাফ ছিল না। একশ ভাগ টিচারই ছিল ক্রিশ্চিয়ান আর সবাই এই ক্যাম্পাসেই থাকতেন। টিচারদের আমরা দিদি বলে ডাকতাম।

বড়দিদির বাসাটা ছিল বাংলো প্যাটার্নের। বাসায় ছিল সুন্দর বাগান। সবসময়ই ফুটে থাকতো বড় বড় হলুদ গাদা ফুল; জবা ফুল; রজনিগন্ধা; বেলি; টগর; হাসনা হেনা; বাহারি রঙের পাতা বাহার। বাড়ির গেটে ছিল লাল কৃষ্ণচূড়া। বাড়ির ভেতরে ছিল একটা বড় আমগাছ। গাছটায় প্রায় দেখা যেত বড় মৌচাক। মাঝে মাঝে ভর দুপুরে বড়দি আমাদের পুরো ক্লাসের ছেলে মেয়েদের উনার বাসায় নিয়ে যেতেন। গল্প বলার ক্লাসটা উনার বাসাতেই বসতো। একদিন বিকেল বেলায় আপাদের সাথে গোল্লাছুট খেলছি; এমন সময় আমার স্কুলের এক সহপাঠী নাম তুষার কী কারণে আমাদের এলাকায় এসেছিল জানি না; আমাকে মেয়েদের সাথে খেলতে দেখে ফেলে। সেই থেকেই আমাকে দেখলেই ক্ষ্যাপাতো মেয়েদের সাথে খেলেছি বলে।

আসলে আমি তখনও ছেলেমেয়ের মধ্যে পার্থক্য তুষারের মতো করে বুঝতে শিখিনি। পরে বুঝেছিলাম তুষার আসলেই ছিল ইঁচড়েপাকা।

ছোটবেলায় আমি ছিলাম চরম মেধাবি; বিশেষ করে মার্বেল খেলায়। অথচ মার্বল খেলাটা কেন যেন আমাদের সভ্য সমাজে স্বীকৃত ছিল না। অথচ মার্বেল খেলায় ছিল আমার চরম প্রতিভা। তাই এই প্রতিভার বিকাশে আমি সভ্য সমাজকে পাশ কাটিয়ে বস্তির ছেলেদের সাথে মিশতে থাকি। হক সাহেবের বড় ছেলের নাম আনোয়ার। উনি আমাদের অনেক বড়। হক সাহেবের ছেলেমেয়েরা উনাকে দাদা বলে ডাকতো; তাই আমরাও উনাকে দাদা বলে ডাকতাম। দাদার কাজই ছিল কাউকে মার্বেল খেলতে দেখলে বাধা দেওয়া। মার্বেলগুলো কেড়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া। বিষয়টা আমার মোটেও পছন্দ হতো না। আমি মার্বেল খেলার মাঝে খারাপ কিছু খুঁজে পাইনি। তাইতো মার্বেল খেলতে আমাকে যেতে হতো রেলওয়ের বস্তিতে।

একদিন রেল বস্তিতে মার্বেল খেলছি। মন ফুরফুরে। অনেক মার্বেল জিতেছি। হঠাৎ করেই আমার পাড়ার এক বন্ধু এসে আমাকে বললো “সাজন, তোমাকে বাসায় ডাকছে।’ আমিতো ফুরফুরে মেজাজে বাসায় ফিরেছি। বাসায় আসা মাত্র মা আমাকে একটা কাঠের লাকড়ি দিয়ে প্রচণ্ড জোরে মারতে লাগলো। অন্যান্য সময় মা মারলে আব্বা সেভ করতেন। এবারে আব্বার কাছে এগুতেই আমাকে উপরে তুলে নিচে ফেলে দিলো। অর্থাৎ আছাড় দিলো। আমার বাবা হয়তো বুঝতেই পারে নাই কি হয়েছিল আরো কত ভয়ানক পরিণতি হতে পারতো। আমি যখন চোখ খুললাম দেখলাম আমার কপাল ভেজা। শুয়ে আছি মেজো আপার কোলে। আছাড় খেয়ে ংবহংব হারিয়েছিলাম। মেজোপা আমাকে কোলে তুলে দৌড়ে উনাদের বাসায় নিয়ে এসেছেন। বাবা মার জয়েন্ট ভেনচারে দেওয়া শাজা এই প্রথম।

আমাদের মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে শাসন শোষণ মায়ের পক্ষ থেকেই আসতো। আমার মায়ের জল্লাদপনা আমার মোটেই পছন্দ হতো না।

পরে বুঝেছিলাম আমার আদর্শলিপি পড়া বন্ধু বাসায় নালিশ করেছিল। “সাজন বস্তির ছেলেদের সাথে মার্বেল খেলছে।” কথাটা শুনে বাবা-মা দুজনেরই মাথায় আগুন জেলে উঠেছিল।

সেই থেকে থেমে গেল আমার জীবনের প্রথম প্রতিভা বিকাশ; “মার্বেল খেলা”।

পেলাম প্রথম পারিবারিক শিক্ষা “বস্তির ছেলেদের সাথে মেশা যাবে না। বেছে নিতে হবে আমার নিজস্ব ক্লাস “মধ্যবিত্তের ক্লাস”।

তখন বুঝিনি। আজ বুঝি। আসলে মধ্যবিত্তের নেই কোন ক্লাস। এরা শুধুই আপোসকামী। কখনও আপোস করে উচ্চবিত্তের সাথে কখনও নিম্নবিত্তের সাথে। কেবলই খুজে বেড়ায় নিরাপত্তা। আমি সেই মধ্যবত্তিদেরই দলে।

পর্ব-২

আমার মার্বেল খেলা প্রতিভার মৃত্যু হলো। ছোটবেলা থেকেই আমার স্বভাবের মাঝে ছিল এক দুরন্তপনা। সব সময় আদর্শ লিপির আদর্শ কথা মানতে মন সায় দিত না। নিয়ম ভাঙার মাঝে যে অনাবিল আনন্দ লুকিয়ে আছে আমি সেই আনন্দ রসের সন্ধানে ব্যস্ত থাকতাম। মধ্যবিত্তের গদবাধা শাসনের বেড়াজাল আমার কৈশরের বাধাহীন উচ্ছলতায় বাধ সাধতো।

সেইযে বৃষ্টিতে ভিজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাদা-মাটিতে ফুটবল খেলা; চোখ লাল করে গলাডুব জলে গোসল করা; ভেজা কাপড়ে থরথরিয়ে কাপতে কাপতে বাড়ি ফেরা; আর সব শেষে মার হাতে চেলা কাঠের বাড়ি খাওয়া; এটা ছিল আমাদের কৈশোর কালের খুবই পরিচিত গল্প।

আমার ছিল লিকলিকে অস্থিসার ছোট্ট শরীর; বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চকচকে চোখ; মায়াবি একখানি মুখ আর ধারালো চোখা নাক। পাড়ার আপুরা আমাকে ডেকে ছড়া কাটতে বলতো। আপুদের ছড়া শুনিয়ে চমকে দেয়ার মত মিষ্টি গলা ছিল আমার। আপুরা আমার নাক টেনে দিত।

একবার এক আপু আমার নাক টেনে বলেছিল “তোর নাক দুটো আমায় দিয়ে দে।” সেই আলো আপা; কি মিষ্টি ছিল দেখতে । এখন কোথায় আছে কেমন আছে; কে জানে।

পাড়ার ছেলে মেয়েরা দল বেঁধে পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম। যাওয়া আসার পুরো পথ জুড়ে রয়েছে কত বিচিত্র অনুভূতি; আনন্দ স্মৃতি। তবে রয়েছে কিছু ভয়ার্ত অনুভতিও। স্কুলে যাওয়ার কিয়দংশ পথ যেতে হতো সুশীলা মাসির বাড়ির উপর দিয়ে। সুশীলা মাসি ছিল পুরো ফরিদপুর শহরের একটি জনপ্রিয় নাম। পেশায় একজন নার্স-কাম ধাত্রী। আমাদের প্রজন্ম এমনকি তারও অনেক আগের প্রজন্মের অধিকাংশেরই জন্ম সুশিলা মাসির হাতে। অত্যন্ত বিচক্ষণ এই মহিলা ছিলেন সবার মাসিমা। সাদা ধবধবে আইরন করা শাড়ি; চোখে রুপালি ফ্রেমের চশমা; সাদা হাইহিল জুতো; মাথায় সাদা কালো চুল আর হাতে ডাক্তারি ব্যাগ; এই বেশে সুশিলা মাসি যখন হেঁটে যেত তখন দূর থেকে লোকজন চিৎকার করে জানতে চাইতো “মাসিমা কেমন আছো? কোথায় যাচ্ছো”। মাসিমার ছিল দরাজ কন্ঠ আর ছিল তার প্রান খোলা অট্টহাসি।

মাসিমার ছিল মাছ ধরার নেশা। মাঝে মাঝে আমাদের বাসার সামনের পুকুরটায় সারা দিন মোড়ায় বসে বড়শি পেতে বসে থাকতো।

মাসিমার বাড়িতে ছিল বেশ কয়েকটা কুকুর। কুকুরগুলো যাওয়া আসার পথে বেশ জালাতন করতো। কাছে কেউ না থাকলে ঘেউ ঘেউ করে ঝাপিয়ে পড়তো। মাসিমার বাড়ির কেউ যখনই ডাকতো কুকুরগুলো সংগে সংগে থেমে যেত। ওই অল্প একটু রাস্তা পেরুতে পিলে শুকিয়ে যেত। যদিও ওরা আমার জানামতে কাউকে কখনও কামড়ায় নি। এভাবই কাটছিল আমার কৈশোর কাল।

হঠাৎ একদিন ঘুম ভাংলো প্রচণ্ড শব্দের মাঝে। আমাদের বাসার সবাই জেগে গেছি। মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার বাজি ফুটছে। বাড়ির বেড় হলাম সবাই। দেখলাম হক সাহেব; মোন্তাজ মিয়া; হাশেম স্যার সবাই জড়ো হয়েছে আমাদের বাসার সামনে। বলাবলি করছে পাকিস্তানি আর্মি গোলাগুলি করতে করতে পদ্মা পাড়ি দিয়ে গোয়ালন্দ দিয়ে শহরে ঢুকছে। আমাদের বাসা থেকে পদ্মা নদী খুব দূরে নয়। বাসার মাইল দুই উত্তরেই শুরু পদ্মার চর। তারপর মাইলকে মাইল চর। এর পর নদী। এর মাঝে ছিল না তেমন কোন বসতি। গুলির আওয়াজ গুলো তাই খুব বিকটই মনে হচ্ছিল। তখনও দেশ-রাজনীতি এসব শুনিনি। তবে বড়দের পাশাপাশি আমরাও ভয় পাচ্ছিলাম। শুনছিলাম পাকিস্থানি আর্মিরা সামনে যা পাচ্ছে তাই উড়িয়ে দিচ্ছে; মানুষ ঘরবাড়ি সব। হাতে সময় খুবই অল্প। খুব শীঘ্রই আর্মিরা শহরে ঢুকে পড়বে। যা কিছু ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। যদিও আমাদের এলাকাটা মেইন শহর থেকে মাইল দুয়েক দূরে; কিন্তু মেইন রেলস্টেশনের কাছে।

মন্তাজ মিয়া ঠিক করলেন উনি ছেলে মেয়ে নিয়ে উনার শ্বশুর বাড়ি যাবেন। রিক্সাও ঠিক করে ফেললেন। প্রায় বিশ মাইল পথ। আমাদের সামনে দিয়ে উনারা আল্লার নামে রওয়ানা হলেন।

হক সাহেব ঠিক করলেন উনারা যাবেন পদ্মার কোন এক চরে উনার অফিসের পিউনের বাসায়। উনারা কিছু লেপ কাথা বালিশ গুছিয়ে পায়ে হেঁটেই বেরিয়ে পড়লেন। হাশেম স্যারও তাই করলেন। রওয়ানা হলেন কোন এক গ্রামে উনার ভাইয়ের বাড়িতে। ডি এস পি সাহেব মানে বৃদ্ধ নানাও চলে গেলেন; তবে ঠিক কোথায় গিয়েছিলেন মনে নেই।

দেখতে দেখতে আমাদের পাঁচটা বাড়ির সবাই যে যেখানে পেরেছে সরে পড়েছে। এলাকাটা খুব অল্প সময়েই জন-বিচ্ছিন্ন এক পল্লীতে পরিণত হলো। বাকি রয়ে গেলাম শুধু আমরা। আমরা তিন ভাই তখন সবাই এত ছোটযে বাবা-মা কে কোন সাহায্য করা আমাদের সাধ্যের বাইরে।

আব্বার কথা মনে পড়ে। উনি শুধু চুলে হাত বুলাচ্ছিলেন আর পায়চারি করছিলেন।

গুলাগুলির আওয়াজটা ততক্ষণে থেমে গিয়েছে। তড়িঘড়ি করে মা আমাদের খাইয়ে দিল। ঠিক কিছুক্ষণ পরে আমাদের বাসায় দৌড়ে এসে পৌঁছালো ফুয়াদ ভাই আর তাদের বাড়ির রাখাল (নাম মনে নেই)।

ফুয়াদ ভাই সম্পর্কে আমাদের চাচাত ভাই। উনারা থাকেন পদ্মার চর এলাকায়; এলাকাটার নাম চরমাধবপুর। ফুয়াদ ভাইয়ের বাবা আমার বাবার ফুপাতো ভাই। আমার এই চাচা জেলা জজ কোর্টের পেশকার ছিলেন। খুবই নিরীহ স্বভাবের একজন সৎ মানুষ ছিলেন। উনি বয়সে আব্বার বড় ছিলেন; তবুও আব্বাকে খুব ভক্তি করতেন। ফুয়াদ ভাইয়ের বয়স তখন ষোল-সতের হবে। জেলা স্কুলে পড়তেন। চাচা জজ কোর্ট থেকে রিটায়ার্ড করে চরে বাড়ি করেন। জমি-জমা কিনে নিজের তালুক গড়ে তুলেন। ফুয়াদ ভাই এই চর এলাকা থেকে প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতেন। ফুয়াদ ভাই প্রায়শই আমাদের বাসায় আসতেন। উনাদের সাথে আমাদের আত্মীয়তা তাই রয়ে গিয়েছিল।

হাজার হাজার লোক শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটছে। যে যেভাবে পারে যতটুকু পারে তাই নিয়ে জীবন বাচাতে ছুটে চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়।

ফুয়াদ ভাইরা দীর্ঘ অপেক্ষা করে আমাদের কোনো খোঁজ না পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে এসেছেন।

শুধু আমার এটুকু মনে আছে উনাদের কে বলতে “আপনারা এখনও বের হননি”।

এতক্ষনে আব্বা-মা যেন প্রানে পানি পেল। নিমিষেই আমাদেরকে তৈরি করে; লেপ-বালিশ আর মাঝারি সাইজের একটা কালো ট্রাংকে যা ধরে তাই ভরে রওয়ানা হই আমরা আমাদের রেডক্রস বাহিনির সাথে। সত্যিই; সেদিন গ্রামের এই সকল আত্মীয়রাই ছিল আমাদের উদ্ধার কর্মি; আমাদের আন্তর্জাতিক রেডক্রস। সেদিন যদি এই লোকগুলি আমাদের সাহায্যে না এগিয়ে আসতো; তাহলে আরো কত লক্ষ প্রাণ যে পাক হানাদার বাহিনীর স্বীকার হতো তা একমাত্র স্রষ্টাই জানে। রাখাল ভায়ের বয়স আর ফুয়াদ ভায়ের বয়স ছিল কাছাকাছি।

রাখাল ভায়ের মাথায় লেপ বালিশ; ফুয়াদ ভাইয়ের মাথায় ট্রাংক তুলে দিয়ে আমরা তিন ভাই মার সাথে পায়ে হেটে রওয়ানা দিলাম। আব্বা রয়ে গেল বাড়ি পাহাড়ার জন্য। আব্বা একা না; পাশের বাসায় মোন্তাজ মিয়ার মেয়ের জামাই জলিল ভাইও ছিল।

অতটুকু বয়সে এতটা পথ কখনও হাটিনি। তারপর এ শুধু হাটা নয়; জীবন বাচাতে ছুটে চলা। হাজার হাজার মানুষ শুধু ছুটছে; এদের অনেকেই জানেনা কোথায় থামবে; কোথায় উঠবে; কোথায় পাবে একটু নিরাপদ আশ্রয়?

পর্ব : ৩

ফুয়াদ ভাইদের বাড়িতে এটাই ছিল আমাদের প্রথম যাওয়া। অনেক কষ্ট হয়েছিল হাঁটতে; আবার অনেক মজাও হয়েছিল। মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। রাস্তার দুই ধারে শুধুই ধুধু মাঠ আর মাঠ। দূরে দূরে বিচ্ছিন্ন বাড়ি ঘর। দলে দলে লোক হাঁটছে। যদ্দুর মনে পড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। পরে জেনেছি এটাই হচ্ছে ইলশেগুঁড়ি। হয়ত এই বৃষ্টিতে অনেক ইলিশ ধরা পড়ে; তাই বুঝি নাম হয়েছে ইলশেগুড়ি। রাস্তার কিছুদূর পর পর গ্রামের লোকেরা মুড়ি-গুড়; চিড়া পানি নিয়ে বসে ছিল। হেঁটে চলা পৌর বাসীদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল গ্রামের এই মানুষগুলি। কেউ কেউ একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটছিল। মনে হচ্ছিল যেন এই হাঁটা পথ আর শেষ হবে না।

মাটির রাস্তার জায়গায় জায়গায় কাদা জমে ছিল। আমাদের পা কাদায় ভরে গিয়েছিল; মনে হচ্ছিল কাদার বুট পড়ে মার্চ করছি। যেতে যেতে অনেকে গল্প করছিল। এদের মধ্যে অনেক পরিবার ছিল যারা তিন দিন ধরে হাঁটছে; চোখে মুখে ক্লান্তি আর ভীতি নিয়ে।

আমরা যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধা হয় হয়। বাড়ির সামনে মাটির রাস্তা থেকে বাড়িটা বেশ খানিকটা উঁচুতে। অনেকটা ছোট্ট টিলার মতো। ক্ষেতের পাশে মাটির রাস্তা থেকে খাড়া উঠে গেছে সরু পথ বাড়ির আঙিনা পর্যন্ত। আমরা যখন বাড়িতে উঠছিলাম মনে হচ্ছিল পাহাড়ে উঠছি। এটাই চর এলাকার অধিকাংশ বাড়ির স্থাপত্য। বাড়ির আঙিনা থেকে ঢাল বেয়ে নেমে গেছে সরু পথ। তারপর মাটির রাস্তা; এর পর বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেত। বাড়ির আঙিনাটা বেশ প্রশস্ত। উনারা এজায়গাটা কে ব্যবহার করেন ধান মাড়াইয়ের কাজে। ধান মাড়াই মানে ধান গাছ থেকে ধানের বীজগুলোকে আলাদা করা। আঙিনার একপাশে গোয়াল ঘর আর অন্য পাশে কাচারি ঘর। বাড়িতে যখন এলাম মনে আছে সবাই বাড়ির আঙিনায় উদগ্রিব হয়ে অপেক্ষা করছিল আমাদের আসার।

বাড়িতে ঢোকার পর আমাদের নিয়ে গেল ভেতরে। চাপ কল চিপে আমরা কাদা-মাটি ছাড়িয়ে হাত পা ধুলাম। দেখলাম আমাদের আগে আরো দুটি ফ্যামেলি এসে উঠেছে উনাদের বাসায়। ওনাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কেউই নয়। ফুয়াদ ভাইদের বাড়িতে ছিল বেশ কতগুলো বড় বড় ঘর। ঘরগুলো ছিল টিনের; কিন্তু মেঝেটা ছিল মাটির। এই চর এলাকায় তখনও সিমেন্ট কংক্রিটের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়নি। আমাদেরকে থাকার জন্য একটা ঘর দিল।

রাতে সবাই বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে দেখলাম দূরে আকাশ গাঢ় লাল। বড়রা বলাবলি করছিল পাক বাহিনীরা ফরিদপুর শহর জালিয়ে দিয়েছে। জালিয়ে দিয়েছে বলাকা হোটেল; তখনকার ফরিদপুর শহরের একমাত্র হোটেল।

আমরা তিন ভাই; ফুয়াদ ভায়ের ছোট দুই ভাই দুই বোন; অন্য দুই পরিবারের বাচ্চারা; সব মিলিয়ে বিরাট এক বাহিনি। সারাদিন হৈহৈ আর কিচির মিচির করে কাটিয়ে দিতাম। আনন্দ উপকরনের কোন কমতি ছিল না। উনাদের ছিল আম কাঠালের গাছ; বড় পুকুর; পুকুর পাড়ে বাহাড়ী ফল মূলের গাছ। এত রকম গাছ এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ তখনও হয়নি। অবাক বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে যেত; গাল হা হয়ে যেত।

চর এলাকার মানুষদের জীবন যাপন সম্পর্কে তখনও কোন ধারণা ছিল না। ভোর হতেই রাখালরা পান্তা ভাত খেয়ে বের হয়ে যায় মাঠে। বাড়ির অন্যরাও নাস্তা সারেন পান্তা ভাত দিয়েই।

আমাদের বেলায় হলো ব্যতিক্রম। আমাদের জন্য হতো গরম ভাত; ভাজি; ভর্তা; এসব। যদিও আমরা সকালে রুটি ভাজি খেতে অভ্যস্থ ছিলাম।

চাচী কে দেখতাম সারাক্ষণ রান্না ঘরে রান্না করেই যাচ্ছেন। উনি ছিলেন ভীষণ নিরীহ স্বভাবের। কখনও উনাকে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে শুনিনি। এটা আমার জন্য একটা ভিন্নতর অভিজ্ঞতা। আমাদের পরিবারে সব সময়ই মায়ের চোখ রাঙানি আর কঠিন শাসনের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। তাই চাচীর এই নীরব স্বভাবে অবাক হয়েছি।

ফুয়াদ ভাইদের পাশের ভিটেটা ছিল খালেক ভাইদের। খালেক ভাই ফুয়াদ ভায়ের বয়সি কিংবা কিছু বড় হবে। উনারা বন্ধুর মত মিশতেন। খালেক ভাই খুব যুক্তি দিয়ে গ্রামীণ কায়দায় কথা বলতেন। খালেক ভাইদের বাড়ির পেছনে ছিল পেঁয়াজের ক্ষেত। ফুয়াদ ভাইদের বাড়ির ভেতর দিয়ে এই ক্ষেতটাতে আসা যেত। আমরা দলবেঁধে এই ক্ষেতের চার পাশে দৌড়ে বেরাতাম। ক্ষেতের পেছন দিকটায় কোন বসত বাড়ি ছিলনা । ছিল শুধু ক্ষেতের পর ক্ষেত। আকাশের দিকে তাকালে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত। আমরা এই আকাশের দিকে তাকাতাম; দেখতাম সূর্যাস্ত; দেখতাম চাঁদ।

একদিন বিকেলে পেঁয়াজ ক্ষেতে গেছি; দেখি সবাই অবাক হয়ে কি দেখছে আর জোরে জোরে বলছে; পাকিস্তানি প্লেন গোয়ালন্দ ঘাটে বোমা ফেলছে। বোম ফেলা তখনও দেখিনি। চুপ করে দাড়িয়ে দেখলাম; স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দুটি প্লেন ঘুরে ঘুরে বোম ফেলছে। একটা বোম ফেলে উঠছে; সংগে সংগে আরেকটা বোম ফেলছে। মনে হচ্ছিল দুটি বড় চিল পালাক্রমে মাছ শিকার করছে। কোন শব্দ অবশ্য পাওয়া যাচ্ছিল না । কিন্তু আকাশে দেখা যাচ্ছিল গাঢ় কালো ধোওয়া। পরদিন আমাদের খোজ করতে আব্বা এলো।

আমার মা খুব রেডিও শুনতো। আব্বা আসার সময় তাই বাসার রেডিও টা সংগে করে নিয়ে এসেছিল। আমাদের এই রেডিও টার সাথে জড়িয়ে আছে আরেক ইতিহাস। আমার প্রফেসর চাচা phd করতে canada গিয়েছিলেন। সেখান থেকে এই রেডিওটা এনেছিলেন; তাই আমাদের পরিবারে এই রেডিও টা একটা নিয়মিত গর্বের বিষয় ছিল। প্রায়ই খবর শুনতে লোকজন বাসায় জড়ো হতো। কখনও আকাশ বাণী কোলকাতা; কখনও হয়ত বিবিসি লন্ডন কিংবা ভয়েস অফ আমেরিকা? এত সব মনে নেই; তবে সবাই যে খুব আগ্রহ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে শুনতো এটা মনে আছে।

আব্বার কাছে শুনছিলাম আমাদের বাসার খবর। এলাকার খবর। শুনলাম পড়শিরা কেউ তখনও ফিরেনি। আব্বা আমাদের বাসার মেইন দরজায় তালা লাগিয়ে; দেয়াল টপকে ভেতরে গিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকতো। রাতে বাতি জালাতো না। আর খাটের নিচে বিছানা করে ঘুমাতো। মাঝে মাঝে দুএকটা গুলির আওয়াজ শুনতো; কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারতো না। একদিন রাতে বাসায় দরজায় প্রচণ্ড আওয়াজ পেলো; উনি বুঝতে পারলো কেউ তালা ভাংগার চেষ্টা করছে। আমার আব্বার ছিল সততা আর বুক ভরা সাহস। উনি বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ঘটনাটা সামলালো।

চিৎকার করে বললো “ জলিল ; ও জলিল কুড়াল টা নিয়ে উঠতো; আমি রামদা টা নিছি; খোল তো দেখি কারা দরজা ধাককায়”? সংগে সংগে দরজায় ধাককানো বন্ধ হয়ে যায়।

আব্বার মুখে পুরো ঘটনাটা শুনে সবাই আতংকিত হয়। কী সাংঘাতিক! সবাই আব্বার সাহস আর বুদ্ধির তারিফ করে। আসলে রাতে আব্বা একাই ছিল। জলিল ভাই ছিল পাশের বাড়িতে। উিনি পাশের বাড়ির মোন্তাজ মিয়ার মেয়ে জামাই। আব্বা জলিল বলে ডাকছিলো যাতে কেউ বুঝতে না পারে আব্বা একা আছে। বাড়ি ঘর ফাকা দেখে তখন ডাকাতির উৎপাত বেড়ে গিয়েছিল। এটাই নিয়ম; বিপদে একদল মানুষ যেমন অন্য মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসে; আবার অন্য দল মানুষই মানুষের সর্বনাশ করে।

আমরা ভালো আছি দেখে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে আব্বা বাসায় ফিরে যায়। মাকে খুব চিন্তিত দেখায়।

এদিকে রেডিওটা থাকাতে যেন ফুয়াদ ভাইদের বাড়িটা আরো প্রানবন্ত হয়ে উঠলো। বাড়ির মহিলারা দিনের বেলায় কাজের ফাঁকে রেডিও শুনতো। আর সন্ধায় পুরুষরা রেডিওটার দখল নিতো। প্রতিদিন সন্ধায় উনাদের কাচারি ঘরে রিতিমত আড্ডা বসতো। আশে পাশের দু চার বাড়ি থেকে লোকজন আসতো খবর শুনতে। জোরে জোরে রেডিও বাজতো। আমার এখনও কানে বাজে সেই দরাজ কন্ঠ “আকাশ বাণী; খবর পড়ছি দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায়।”

এভাবেই হৈহুল্লোড় করে কাটছিল দিন। এর পর আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে এলো। সাময়িক বন্ধ হলো পাক বাহিনীর বর্বরতা। স্কুল কলেজ খুলে দিল। অফিস আদালত স্বাভাবিক হলো। আব্বা আসলো আমাদের নিতে। আমি আর আমার ছোট ভাই তুহিন চলে এলাম আব্বার সংগে। খোকন; আমার বড় ভাই রয়ে গেল মায়ের সাথে। পরে পরিস্থিতি বুঝে আসবে।

(বাকি অংশ আগামী সংখ্যায় পড়ুন)

বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই ২০২২ , ১৩ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৯ জিলহজ ১৪৪৩

দৃশ্যপট ফরিদপুর ১৯৭০-৭২

একজন কিশোরের চোখে দেখা সেই সময়

মিনহাজ আহমেদ

image

তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

যে সময়টার কথা বলছি সেটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কিছু আগে থেকে ১৯৭০-৭২। আমার এখনও ঝাপসা মনে পড়ে, ছেলেবেলায় মা আমাকে কাজল পরিয়ে দিত। দিত আমার কপালে কালো ফোঁটা। আমি ছিলাম না নয়ন কাড়া সুন্দর; বরং অসুন্দরের মাঝেই ছিল স্থান। মার মনে খুউব আশা ছিল বড় ছেলের পরে এবারে হবে মেয়ে সন্তান। কিন্তু হলো এক জীর্ণ-শীর্ণ মৃতপ্রায় শিশু; এই আমি। মায়ের কাছে শুনেছি ছোটবেলায় আমি ছিলাম খুবই রুগ্ন। মা বড়াই করে বলতেন পাশের বাড়ির খালাম্মা নাকি বলতেন- “এছেলে বাঁচলে সেদ্ধ বীজে ধান গজাবে”। সেদ্ধ বীজে ধান হয় কিনা জানি না; আমি ঠিকই বেঁচে উঠেছি।

কিন্তু মায়ের মেয়ে সন্তানের আশা অপূর্ণ থেকে যায়।

মেয়ের বদলে ছেলে; মা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। তাই মা আমাকে চোখে কাজল পরাতেন। মেয়েদের ফ্রক পরিয়ে রাখতেন; দীর্ঘদিন পর্যন্ত।

চোখে কাজল দেয়াতে যে জ্বালাপোড়া করতো তা এখনও আমার মনে আছে।

আমরা যে এলাকায় থাকতাম সেটা ফরিদপুর শহরের ছোট একটা এলাকা; লক্ষ্মীপুর; না পুরো গ্রাম না পুরো শহর; যাকে বলে মফঃস্বল। আমাদের বাসাটা ছিল রেলস্টেশনের কাছে। যে বাড়িটায় থাকতাম সেটা ছিল বড় একটা একতলা লম্বা বিল্ডিং। বাসায় ছিল একটা লম্বা বারান্দা। পাশাপাশি তিনটা একই ধরনের বাড়ি। বাড়িগুলো ছিল Enemies property; ব্রিটিশ ভারত বিভাজনের পর; তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার বাড়িগুলোর দখল নেয় এবং ব্যবহার করে সরকারি বাসভবন হিসেবে।

আমার বাবা ছিলেন সরকারি স্কুলের শিক্ষক। আমাদের পাশের বাসায় ছিলেন হক সাহেব; উনি ডিসি অফিসের নাজির। তার পাশের বাসায় ছিলেন একজন রিটায়ার্ড ডিএসপি; তার পাশের বাড়িটাও ডিএসপি সাহেবের। ভাড়া দিয়েছেন; থাকতেন পুলিশের এক সাবেক কর্মকর্তা। তার পাশেই থাকতেন হাশেম স্যার; উনি স্থানীয় সরকারি কলেজের দর্শনের অধ্যাপক। হাশেম স্যারের বাসার পরেই পৌরসভার রাস্তা। হাশেম স্যারের বাসা থেকে আমাদের বাসা অবধি মাটির রাস্তা। রাস্তাটা মূলত আমাদের বাসা অবধি এসে থেমে গেছে। আমাদের বাসার পুবে থাকতো মন্তাজ মিয়া। উনি প্রধানত ছিলেন কৃষিজীবী আর বাকি সময়ে করতেন গরুর হাটে দালালি।

মফস্বল শহরের বাসিন্দা হিসেবে আমরা একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকতাম। এই মিলেমিশাটা ছিল অন্যরকমের। সুখ-দুঃখের পাশাপাশি আমরা আত্মীয়তাও ভাগাভাগি করতাম। যেমন আমার মামা হতো সবার মামা। আবার আমার চাচা সবার চাচা। ঠিক তেমনি পাশের বাড়ির হক সাহেবের বড় মেয়ে আমাদের সবারই বড় আপা; মেজ আপা আমাদের সবারই মেজ আপা।

আমাদের বাসার সামনে যে লম্বা রাস্তা ছিল আমরা সারাক্ষণ সেই রাস্তায় খেলতাম। কত ধরনের খেলা; কখনও ডাংগুলি কখনও ক্রিকেট কখনও ফুটবল।

ডিএসপি সাহেব ছিলেন বুড়ো। আমরা সবাই উনাকে নানা বলে ডাকতাম। আমার মাও বলতো নানা; আমরাও বলতাম নানা। একটা ইজি চেয়ারে লম্বা বারান্দায় বসে থাকতেন নানা। আমরা খেলতে খেলতে একটু হৈচৈ করলেই বকা দিতেন। এলাকার সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে সবাই উনাকে খুব সম্মান করতেন। আমাদের পাড়ার আপারা দলবেঁধে খেলতেন গোল্লাছুট; ছি বুড়ি এসব খেলা। মাঝে মাঝে দল ভারি করার জন্য আমাদেরও সংগে নিতেন।

আমি যে স্কুলটায় পড়া শুরু করি ওটা ছিল ক্রিশ্চিয়ান মিশন স্কুল। স্কুলটা চালাতো ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি। মিশনারির ছিল নিজস্ব প্রাইমারি স্কুল; church; লাইব্রেরি; কারখানা; পুকুর; টিচারদের বাড়ি; গোরস্থান। যেন একটা উপ-শহর। স্কুলের স্থাপত্য ছিল পশ্চিমা ধাঁচে গড়া। লম্বা লম্বা ভবন; slanted টালির ছাদ। সুন্দর পরিপাটি; কোলাহলমুক্ত কুহেলিকাময় এক অনুপম পরিবেশ। বিদ্যা শিক্ষার জন্য যেন এক আদর্শ স্থান।

স্কুলটা ছিল প্রাইমারি পর্যন্ত। স্কুলে কোনো পুরুষ শিক্ষক বা স্টাফ ছিল না। একশ ভাগ টিচারই ছিল ক্রিশ্চিয়ান আর সবাই এই ক্যাম্পাসেই থাকতেন। টিচারদের আমরা দিদি বলে ডাকতাম।

বড়দিদির বাসাটা ছিল বাংলো প্যাটার্নের। বাসায় ছিল সুন্দর বাগান। সবসময়ই ফুটে থাকতো বড় বড় হলুদ গাদা ফুল; জবা ফুল; রজনিগন্ধা; বেলি; টগর; হাসনা হেনা; বাহারি রঙের পাতা বাহার। বাড়ির গেটে ছিল লাল কৃষ্ণচূড়া। বাড়ির ভেতরে ছিল একটা বড় আমগাছ। গাছটায় প্রায় দেখা যেত বড় মৌচাক। মাঝে মাঝে ভর দুপুরে বড়দি আমাদের পুরো ক্লাসের ছেলে মেয়েদের উনার বাসায় নিয়ে যেতেন। গল্প বলার ক্লাসটা উনার বাসাতেই বসতো। একদিন বিকেল বেলায় আপাদের সাথে গোল্লাছুট খেলছি; এমন সময় আমার স্কুলের এক সহপাঠী নাম তুষার কী কারণে আমাদের এলাকায় এসেছিল জানি না; আমাকে মেয়েদের সাথে খেলতে দেখে ফেলে। সেই থেকেই আমাকে দেখলেই ক্ষ্যাপাতো মেয়েদের সাথে খেলেছি বলে।

আসলে আমি তখনও ছেলেমেয়ের মধ্যে পার্থক্য তুষারের মতো করে বুঝতে শিখিনি। পরে বুঝেছিলাম তুষার আসলেই ছিল ইঁচড়েপাকা।

ছোটবেলায় আমি ছিলাম চরম মেধাবি; বিশেষ করে মার্বেল খেলায়। অথচ মার্বল খেলাটা কেন যেন আমাদের সভ্য সমাজে স্বীকৃত ছিল না। অথচ মার্বেল খেলায় ছিল আমার চরম প্রতিভা। তাই এই প্রতিভার বিকাশে আমি সভ্য সমাজকে পাশ কাটিয়ে বস্তির ছেলেদের সাথে মিশতে থাকি। হক সাহেবের বড় ছেলের নাম আনোয়ার। উনি আমাদের অনেক বড়। হক সাহেবের ছেলেমেয়েরা উনাকে দাদা বলে ডাকতো; তাই আমরাও উনাকে দাদা বলে ডাকতাম। দাদার কাজই ছিল কাউকে মার্বেল খেলতে দেখলে বাধা দেওয়া। মার্বেলগুলো কেড়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া। বিষয়টা আমার মোটেও পছন্দ হতো না। আমি মার্বেল খেলার মাঝে খারাপ কিছু খুঁজে পাইনি। তাইতো মার্বেল খেলতে আমাকে যেতে হতো রেলওয়ের বস্তিতে।

একদিন রেল বস্তিতে মার্বেল খেলছি। মন ফুরফুরে। অনেক মার্বেল জিতেছি। হঠাৎ করেই আমার পাড়ার এক বন্ধু এসে আমাকে বললো “সাজন, তোমাকে বাসায় ডাকছে।’ আমিতো ফুরফুরে মেজাজে বাসায় ফিরেছি। বাসায় আসা মাত্র মা আমাকে একটা কাঠের লাকড়ি দিয়ে প্রচণ্ড জোরে মারতে লাগলো। অন্যান্য সময় মা মারলে আব্বা সেভ করতেন। এবারে আব্বার কাছে এগুতেই আমাকে উপরে তুলে নিচে ফেলে দিলো। অর্থাৎ আছাড় দিলো। আমার বাবা হয়তো বুঝতেই পারে নাই কি হয়েছিল আরো কত ভয়ানক পরিণতি হতে পারতো। আমি যখন চোখ খুললাম দেখলাম আমার কপাল ভেজা। শুয়ে আছি মেজো আপার কোলে। আছাড় খেয়ে ংবহংব হারিয়েছিলাম। মেজোপা আমাকে কোলে তুলে দৌড়ে উনাদের বাসায় নিয়ে এসেছেন। বাবা মার জয়েন্ট ভেনচারে দেওয়া শাজা এই প্রথম।

আমাদের মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে শাসন শোষণ মায়ের পক্ষ থেকেই আসতো। আমার মায়ের জল্লাদপনা আমার মোটেই পছন্দ হতো না।

পরে বুঝেছিলাম আমার আদর্শলিপি পড়া বন্ধু বাসায় নালিশ করেছিল। “সাজন বস্তির ছেলেদের সাথে মার্বেল খেলছে।” কথাটা শুনে বাবা-মা দুজনেরই মাথায় আগুন জেলে উঠেছিল।

সেই থেকে থেমে গেল আমার জীবনের প্রথম প্রতিভা বিকাশ; “মার্বেল খেলা”।

পেলাম প্রথম পারিবারিক শিক্ষা “বস্তির ছেলেদের সাথে মেশা যাবে না। বেছে নিতে হবে আমার নিজস্ব ক্লাস “মধ্যবিত্তের ক্লাস”।

তখন বুঝিনি। আজ বুঝি। আসলে মধ্যবিত্তের নেই কোন ক্লাস। এরা শুধুই আপোসকামী। কখনও আপোস করে উচ্চবিত্তের সাথে কখনও নিম্নবিত্তের সাথে। কেবলই খুজে বেড়ায় নিরাপত্তা। আমি সেই মধ্যবত্তিদেরই দলে।

পর্ব-২

আমার মার্বেল খেলা প্রতিভার মৃত্যু হলো। ছোটবেলা থেকেই আমার স্বভাবের মাঝে ছিল এক দুরন্তপনা। সব সময় আদর্শ লিপির আদর্শ কথা মানতে মন সায় দিত না। নিয়ম ভাঙার মাঝে যে অনাবিল আনন্দ লুকিয়ে আছে আমি সেই আনন্দ রসের সন্ধানে ব্যস্ত থাকতাম। মধ্যবিত্তের গদবাধা শাসনের বেড়াজাল আমার কৈশরের বাধাহীন উচ্ছলতায় বাধ সাধতো।

সেইযে বৃষ্টিতে ভিজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাদা-মাটিতে ফুটবল খেলা; চোখ লাল করে গলাডুব জলে গোসল করা; ভেজা কাপড়ে থরথরিয়ে কাপতে কাপতে বাড়ি ফেরা; আর সব শেষে মার হাতে চেলা কাঠের বাড়ি খাওয়া; এটা ছিল আমাদের কৈশোর কালের খুবই পরিচিত গল্প।

আমার ছিল লিকলিকে অস্থিসার ছোট্ট শরীর; বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চকচকে চোখ; মায়াবি একখানি মুখ আর ধারালো চোখা নাক। পাড়ার আপুরা আমাকে ডেকে ছড়া কাটতে বলতো। আপুদের ছড়া শুনিয়ে চমকে দেয়ার মত মিষ্টি গলা ছিল আমার। আপুরা আমার নাক টেনে দিত।

একবার এক আপু আমার নাক টেনে বলেছিল “তোর নাক দুটো আমায় দিয়ে দে।” সেই আলো আপা; কি মিষ্টি ছিল দেখতে । এখন কোথায় আছে কেমন আছে; কে জানে।

পাড়ার ছেলে মেয়েরা দল বেঁধে পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম। যাওয়া আসার পুরো পথ জুড়ে রয়েছে কত বিচিত্র অনুভূতি; আনন্দ স্মৃতি। তবে রয়েছে কিছু ভয়ার্ত অনুভতিও। স্কুলে যাওয়ার কিয়দংশ পথ যেতে হতো সুশীলা মাসির বাড়ির উপর দিয়ে। সুশীলা মাসি ছিল পুরো ফরিদপুর শহরের একটি জনপ্রিয় নাম। পেশায় একজন নার্স-কাম ধাত্রী। আমাদের প্রজন্ম এমনকি তারও অনেক আগের প্রজন্মের অধিকাংশেরই জন্ম সুশিলা মাসির হাতে। অত্যন্ত বিচক্ষণ এই মহিলা ছিলেন সবার মাসিমা। সাদা ধবধবে আইরন করা শাড়ি; চোখে রুপালি ফ্রেমের চশমা; সাদা হাইহিল জুতো; মাথায় সাদা কালো চুল আর হাতে ডাক্তারি ব্যাগ; এই বেশে সুশিলা মাসি যখন হেঁটে যেত তখন দূর থেকে লোকজন চিৎকার করে জানতে চাইতো “মাসিমা কেমন আছো? কোথায় যাচ্ছো”। মাসিমার ছিল দরাজ কন্ঠ আর ছিল তার প্রান খোলা অট্টহাসি।

মাসিমার ছিল মাছ ধরার নেশা। মাঝে মাঝে আমাদের বাসার সামনের পুকুরটায় সারা দিন মোড়ায় বসে বড়শি পেতে বসে থাকতো।

মাসিমার বাড়িতে ছিল বেশ কয়েকটা কুকুর। কুকুরগুলো যাওয়া আসার পথে বেশ জালাতন করতো। কাছে কেউ না থাকলে ঘেউ ঘেউ করে ঝাপিয়ে পড়তো। মাসিমার বাড়ির কেউ যখনই ডাকতো কুকুরগুলো সংগে সংগে থেমে যেত। ওই অল্প একটু রাস্তা পেরুতে পিলে শুকিয়ে যেত। যদিও ওরা আমার জানামতে কাউকে কখনও কামড়ায় নি। এভাবই কাটছিল আমার কৈশোর কাল।

হঠাৎ একদিন ঘুম ভাংলো প্রচণ্ড শব্দের মাঝে। আমাদের বাসার সবাই জেগে গেছি। মনে হচ্ছিল যেন হাজার হাজার বাজি ফুটছে। বাড়ির বেড় হলাম সবাই। দেখলাম হক সাহেব; মোন্তাজ মিয়া; হাশেম স্যার সবাই জড়ো হয়েছে আমাদের বাসার সামনে। বলাবলি করছে পাকিস্তানি আর্মি গোলাগুলি করতে করতে পদ্মা পাড়ি দিয়ে গোয়ালন্দ দিয়ে শহরে ঢুকছে। আমাদের বাসা থেকে পদ্মা নদী খুব দূরে নয়। বাসার মাইল দুই উত্তরেই শুরু পদ্মার চর। তারপর মাইলকে মাইল চর। এর পর নদী। এর মাঝে ছিল না তেমন কোন বসতি। গুলির আওয়াজ গুলো তাই খুব বিকটই মনে হচ্ছিল। তখনও দেশ-রাজনীতি এসব শুনিনি। তবে বড়দের পাশাপাশি আমরাও ভয় পাচ্ছিলাম। শুনছিলাম পাকিস্থানি আর্মিরা সামনে যা পাচ্ছে তাই উড়িয়ে দিচ্ছে; মানুষ ঘরবাড়ি সব। হাতে সময় খুবই অল্প। খুব শীঘ্রই আর্মিরা শহরে ঢুকে পড়বে। যা কিছু ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। যদিও আমাদের এলাকাটা মেইন শহর থেকে মাইল দুয়েক দূরে; কিন্তু মেইন রেলস্টেশনের কাছে।

মন্তাজ মিয়া ঠিক করলেন উনি ছেলে মেয়ে নিয়ে উনার শ্বশুর বাড়ি যাবেন। রিক্সাও ঠিক করে ফেললেন। প্রায় বিশ মাইল পথ। আমাদের সামনে দিয়ে উনারা আল্লার নামে রওয়ানা হলেন।

হক সাহেব ঠিক করলেন উনারা যাবেন পদ্মার কোন এক চরে উনার অফিসের পিউনের বাসায়। উনারা কিছু লেপ কাথা বালিশ গুছিয়ে পায়ে হেঁটেই বেরিয়ে পড়লেন। হাশেম স্যারও তাই করলেন। রওয়ানা হলেন কোন এক গ্রামে উনার ভাইয়ের বাড়িতে। ডি এস পি সাহেব মানে বৃদ্ধ নানাও চলে গেলেন; তবে ঠিক কোথায় গিয়েছিলেন মনে নেই।

দেখতে দেখতে আমাদের পাঁচটা বাড়ির সবাই যে যেখানে পেরেছে সরে পড়েছে। এলাকাটা খুব অল্প সময়েই জন-বিচ্ছিন্ন এক পল্লীতে পরিণত হলো। বাকি রয়ে গেলাম শুধু আমরা। আমরা তিন ভাই তখন সবাই এত ছোটযে বাবা-মা কে কোন সাহায্য করা আমাদের সাধ্যের বাইরে।

আব্বার কথা মনে পড়ে। উনি শুধু চুলে হাত বুলাচ্ছিলেন আর পায়চারি করছিলেন।

গুলাগুলির আওয়াজটা ততক্ষণে থেমে গিয়েছে। তড়িঘড়ি করে মা আমাদের খাইয়ে দিল। ঠিক কিছুক্ষণ পরে আমাদের বাসায় দৌড়ে এসে পৌঁছালো ফুয়াদ ভাই আর তাদের বাড়ির রাখাল (নাম মনে নেই)।

ফুয়াদ ভাই সম্পর্কে আমাদের চাচাত ভাই। উনারা থাকেন পদ্মার চর এলাকায়; এলাকাটার নাম চরমাধবপুর। ফুয়াদ ভাইয়ের বাবা আমার বাবার ফুপাতো ভাই। আমার এই চাচা জেলা জজ কোর্টের পেশকার ছিলেন। খুবই নিরীহ স্বভাবের একজন সৎ মানুষ ছিলেন। উনি বয়সে আব্বার বড় ছিলেন; তবুও আব্বাকে খুব ভক্তি করতেন। ফুয়াদ ভাইয়ের বয়স তখন ষোল-সতের হবে। জেলা স্কুলে পড়তেন। চাচা জজ কোর্ট থেকে রিটায়ার্ড করে চরে বাড়ি করেন। জমি-জমা কিনে নিজের তালুক গড়ে তুলেন। ফুয়াদ ভাই এই চর এলাকা থেকে প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতেন। ফুয়াদ ভাই প্রায়শই আমাদের বাসায় আসতেন। উনাদের সাথে আমাদের আত্মীয়তা তাই রয়ে গিয়েছিল।

হাজার হাজার লোক শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটছে। যে যেভাবে পারে যতটুকু পারে তাই নিয়ে জীবন বাচাতে ছুটে চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়।

ফুয়াদ ভাইরা দীর্ঘ অপেক্ষা করে আমাদের কোনো খোঁজ না পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে এসেছেন।

শুধু আমার এটুকু মনে আছে উনাদের কে বলতে “আপনারা এখনও বের হননি”।

এতক্ষনে আব্বা-মা যেন প্রানে পানি পেল। নিমিষেই আমাদেরকে তৈরি করে; লেপ-বালিশ আর মাঝারি সাইজের একটা কালো ট্রাংকে যা ধরে তাই ভরে রওয়ানা হই আমরা আমাদের রেডক্রস বাহিনির সাথে। সত্যিই; সেদিন গ্রামের এই সকল আত্মীয়রাই ছিল আমাদের উদ্ধার কর্মি; আমাদের আন্তর্জাতিক রেডক্রস। সেদিন যদি এই লোকগুলি আমাদের সাহায্যে না এগিয়ে আসতো; তাহলে আরো কত লক্ষ প্রাণ যে পাক হানাদার বাহিনীর স্বীকার হতো তা একমাত্র স্রষ্টাই জানে। রাখাল ভায়ের বয়স আর ফুয়াদ ভায়ের বয়স ছিল কাছাকাছি।

রাখাল ভায়ের মাথায় লেপ বালিশ; ফুয়াদ ভাইয়ের মাথায় ট্রাংক তুলে দিয়ে আমরা তিন ভাই মার সাথে পায়ে হেটে রওয়ানা দিলাম। আব্বা রয়ে গেল বাড়ি পাহাড়ার জন্য। আব্বা একা না; পাশের বাসায় মোন্তাজ মিয়ার মেয়ের জামাই জলিল ভাইও ছিল।

অতটুকু বয়সে এতটা পথ কখনও হাটিনি। তারপর এ শুধু হাটা নয়; জীবন বাচাতে ছুটে চলা। হাজার হাজার মানুষ শুধু ছুটছে; এদের অনেকেই জানেনা কোথায় থামবে; কোথায় উঠবে; কোথায় পাবে একটু নিরাপদ আশ্রয়?

পর্ব : ৩

ফুয়াদ ভাইদের বাড়িতে এটাই ছিল আমাদের প্রথম যাওয়া। অনেক কষ্ট হয়েছিল হাঁটতে; আবার অনেক মজাও হয়েছিল। মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। রাস্তার দুই ধারে শুধুই ধুধু মাঠ আর মাঠ। দূরে দূরে বিচ্ছিন্ন বাড়ি ঘর। দলে দলে লোক হাঁটছে। যদ্দুর মনে পড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। পরে জেনেছি এটাই হচ্ছে ইলশেগুঁড়ি। হয়ত এই বৃষ্টিতে অনেক ইলিশ ধরা পড়ে; তাই বুঝি নাম হয়েছে ইলশেগুড়ি। রাস্তার কিছুদূর পর পর গ্রামের লোকেরা মুড়ি-গুড়; চিড়া পানি নিয়ে বসে ছিল। হেঁটে চলা পৌর বাসীদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল গ্রামের এই মানুষগুলি। কেউ কেউ একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটছিল। মনে হচ্ছিল যেন এই হাঁটা পথ আর শেষ হবে না।

মাটির রাস্তার জায়গায় জায়গায় কাদা জমে ছিল। আমাদের পা কাদায় ভরে গিয়েছিল; মনে হচ্ছিল কাদার বুট পড়ে মার্চ করছি। যেতে যেতে অনেকে গল্প করছিল। এদের মধ্যে অনেক পরিবার ছিল যারা তিন দিন ধরে হাঁটছে; চোখে মুখে ক্লান্তি আর ভীতি নিয়ে।

আমরা যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধা হয় হয়। বাড়ির সামনে মাটির রাস্তা থেকে বাড়িটা বেশ খানিকটা উঁচুতে। অনেকটা ছোট্ট টিলার মতো। ক্ষেতের পাশে মাটির রাস্তা থেকে খাড়া উঠে গেছে সরু পথ বাড়ির আঙিনা পর্যন্ত। আমরা যখন বাড়িতে উঠছিলাম মনে হচ্ছিল পাহাড়ে উঠছি। এটাই চর এলাকার অধিকাংশ বাড়ির স্থাপত্য। বাড়ির আঙিনা থেকে ঢাল বেয়ে নেমে গেছে সরু পথ। তারপর মাটির রাস্তা; এর পর বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেত। বাড়ির আঙিনাটা বেশ প্রশস্ত। উনারা এজায়গাটা কে ব্যবহার করেন ধান মাড়াইয়ের কাজে। ধান মাড়াই মানে ধান গাছ থেকে ধানের বীজগুলোকে আলাদা করা। আঙিনার একপাশে গোয়াল ঘর আর অন্য পাশে কাচারি ঘর। বাড়িতে যখন এলাম মনে আছে সবাই বাড়ির আঙিনায় উদগ্রিব হয়ে অপেক্ষা করছিল আমাদের আসার।

বাড়িতে ঢোকার পর আমাদের নিয়ে গেল ভেতরে। চাপ কল চিপে আমরা কাদা-মাটি ছাড়িয়ে হাত পা ধুলাম। দেখলাম আমাদের আগে আরো দুটি ফ্যামেলি এসে উঠেছে উনাদের বাসায়। ওনাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কেউই নয়। ফুয়াদ ভাইদের বাড়িতে ছিল বেশ কতগুলো বড় বড় ঘর। ঘরগুলো ছিল টিনের; কিন্তু মেঝেটা ছিল মাটির। এই চর এলাকায় তখনও সিমেন্ট কংক্রিটের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়নি। আমাদেরকে থাকার জন্য একটা ঘর দিল।

রাতে সবাই বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে দেখলাম দূরে আকাশ গাঢ় লাল। বড়রা বলাবলি করছিল পাক বাহিনীরা ফরিদপুর শহর জালিয়ে দিয়েছে। জালিয়ে দিয়েছে বলাকা হোটেল; তখনকার ফরিদপুর শহরের একমাত্র হোটেল।

আমরা তিন ভাই; ফুয়াদ ভায়ের ছোট দুই ভাই দুই বোন; অন্য দুই পরিবারের বাচ্চারা; সব মিলিয়ে বিরাট এক বাহিনি। সারাদিন হৈহৈ আর কিচির মিচির করে কাটিয়ে দিতাম। আনন্দ উপকরনের কোন কমতি ছিল না। উনাদের ছিল আম কাঠালের গাছ; বড় পুকুর; পুকুর পাড়ে বাহাড়ী ফল মূলের গাছ। এত রকম গাছ এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ তখনও হয়নি। অবাক বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে যেত; গাল হা হয়ে যেত।

চর এলাকার মানুষদের জীবন যাপন সম্পর্কে তখনও কোন ধারণা ছিল না। ভোর হতেই রাখালরা পান্তা ভাত খেয়ে বের হয়ে যায় মাঠে। বাড়ির অন্যরাও নাস্তা সারেন পান্তা ভাত দিয়েই।

আমাদের বেলায় হলো ব্যতিক্রম। আমাদের জন্য হতো গরম ভাত; ভাজি; ভর্তা; এসব। যদিও আমরা সকালে রুটি ভাজি খেতে অভ্যস্থ ছিলাম।

চাচী কে দেখতাম সারাক্ষণ রান্না ঘরে রান্না করেই যাচ্ছেন। উনি ছিলেন ভীষণ নিরীহ স্বভাবের। কখনও উনাকে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে শুনিনি। এটা আমার জন্য একটা ভিন্নতর অভিজ্ঞতা। আমাদের পরিবারে সব সময়ই মায়ের চোখ রাঙানি আর কঠিন শাসনের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। তাই চাচীর এই নীরব স্বভাবে অবাক হয়েছি।

ফুয়াদ ভাইদের পাশের ভিটেটা ছিল খালেক ভাইদের। খালেক ভাই ফুয়াদ ভায়ের বয়সি কিংবা কিছু বড় হবে। উনারা বন্ধুর মত মিশতেন। খালেক ভাই খুব যুক্তি দিয়ে গ্রামীণ কায়দায় কথা বলতেন। খালেক ভাইদের বাড়ির পেছনে ছিল পেঁয়াজের ক্ষেত। ফুয়াদ ভাইদের বাড়ির ভেতর দিয়ে এই ক্ষেতটাতে আসা যেত। আমরা দলবেঁধে এই ক্ষেতের চার পাশে দৌড়ে বেরাতাম। ক্ষেতের পেছন দিকটায় কোন বসত বাড়ি ছিলনা । ছিল শুধু ক্ষেতের পর ক্ষেত। আকাশের দিকে তাকালে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত। আমরা এই আকাশের দিকে তাকাতাম; দেখতাম সূর্যাস্ত; দেখতাম চাঁদ।

একদিন বিকেলে পেঁয়াজ ক্ষেতে গেছি; দেখি সবাই অবাক হয়ে কি দেখছে আর জোরে জোরে বলছে; পাকিস্তানি প্লেন গোয়ালন্দ ঘাটে বোমা ফেলছে। বোম ফেলা তখনও দেখিনি। চুপ করে দাড়িয়ে দেখলাম; স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দুটি প্লেন ঘুরে ঘুরে বোম ফেলছে। একটা বোম ফেলে উঠছে; সংগে সংগে আরেকটা বোম ফেলছে। মনে হচ্ছিল দুটি বড় চিল পালাক্রমে মাছ শিকার করছে। কোন শব্দ অবশ্য পাওয়া যাচ্ছিল না । কিন্তু আকাশে দেখা যাচ্ছিল গাঢ় কালো ধোওয়া। পরদিন আমাদের খোজ করতে আব্বা এলো।

আমার মা খুব রেডিও শুনতো। আব্বা আসার সময় তাই বাসার রেডিও টা সংগে করে নিয়ে এসেছিল। আমাদের এই রেডিও টার সাথে জড়িয়ে আছে আরেক ইতিহাস। আমার প্রফেসর চাচা phd করতে canada গিয়েছিলেন। সেখান থেকে এই রেডিওটা এনেছিলেন; তাই আমাদের পরিবারে এই রেডিও টা একটা নিয়মিত গর্বের বিষয় ছিল। প্রায়ই খবর শুনতে লোকজন বাসায় জড়ো হতো। কখনও আকাশ বাণী কোলকাতা; কখনও হয়ত বিবিসি লন্ডন কিংবা ভয়েস অফ আমেরিকা? এত সব মনে নেই; তবে সবাই যে খুব আগ্রহ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে শুনতো এটা মনে আছে।

আব্বার কাছে শুনছিলাম আমাদের বাসার খবর। এলাকার খবর। শুনলাম পড়শিরা কেউ তখনও ফিরেনি। আব্বা আমাদের বাসার মেইন দরজায় তালা লাগিয়ে; দেয়াল টপকে ভেতরে গিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকতো। রাতে বাতি জালাতো না। আর খাটের নিচে বিছানা করে ঘুমাতো। মাঝে মাঝে দুএকটা গুলির আওয়াজ শুনতো; কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারতো না। একদিন রাতে বাসায় দরজায় প্রচণ্ড আওয়াজ পেলো; উনি বুঝতে পারলো কেউ তালা ভাংগার চেষ্টা করছে। আমার আব্বার ছিল সততা আর বুক ভরা সাহস। উনি বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ঘটনাটা সামলালো।

চিৎকার করে বললো “ জলিল ; ও জলিল কুড়াল টা নিয়ে উঠতো; আমি রামদা টা নিছি; খোল তো দেখি কারা দরজা ধাককায়”? সংগে সংগে দরজায় ধাককানো বন্ধ হয়ে যায়।

আব্বার মুখে পুরো ঘটনাটা শুনে সবাই আতংকিত হয়। কী সাংঘাতিক! সবাই আব্বার সাহস আর বুদ্ধির তারিফ করে। আসলে রাতে আব্বা একাই ছিল। জলিল ভাই ছিল পাশের বাড়িতে। উিনি পাশের বাড়ির মোন্তাজ মিয়ার মেয়ে জামাই। আব্বা জলিল বলে ডাকছিলো যাতে কেউ বুঝতে না পারে আব্বা একা আছে। বাড়ি ঘর ফাকা দেখে তখন ডাকাতির উৎপাত বেড়ে গিয়েছিল। এটাই নিয়ম; বিপদে একদল মানুষ যেমন অন্য মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসে; আবার অন্য দল মানুষই মানুষের সর্বনাশ করে।

আমরা ভালো আছি দেখে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে আব্বা বাসায় ফিরে যায়। মাকে খুব চিন্তিত দেখায়।

এদিকে রেডিওটা থাকাতে যেন ফুয়াদ ভাইদের বাড়িটা আরো প্রানবন্ত হয়ে উঠলো। বাড়ির মহিলারা দিনের বেলায় কাজের ফাঁকে রেডিও শুনতো। আর সন্ধায় পুরুষরা রেডিওটার দখল নিতো। প্রতিদিন সন্ধায় উনাদের কাচারি ঘরে রিতিমত আড্ডা বসতো। আশে পাশের দু চার বাড়ি থেকে লোকজন আসতো খবর শুনতে। জোরে জোরে রেডিও বাজতো। আমার এখনও কানে বাজে সেই দরাজ কন্ঠ “আকাশ বাণী; খবর পড়ছি দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায়।”

এভাবেই হৈহুল্লোড় করে কাটছিল দিন। এর পর আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে এলো। সাময়িক বন্ধ হলো পাক বাহিনীর বর্বরতা। স্কুল কলেজ খুলে দিল। অফিস আদালত স্বাভাবিক হলো। আব্বা আসলো আমাদের নিতে। আমি আর আমার ছোট ভাই তুহিন চলে এলাম আব্বার সংগে। খোকন; আমার বড় ভাই রয়ে গেল মায়ের সাথে। পরে পরিস্থিতি বুঝে আসবে।

(বাকি অংশ আগামী সংখ্যায় পড়ুন)