বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও কাজী মোতাহার হোসেন

এম আবদুল আলীম

কাজী মোতাহার হোসেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি। মুক্তচিন্তক, যশস্বী অধ্যাপক, নিষ্ঠাবান গবেষক, ধীমান সাহিত্য-সাধক, কীর্তিমান দাবাড়ু হিসেবে তিনি ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা, প্রগতিশীলতা এবং সর্বোপরি সংস্কারমুক্ত চিন্তা-চেতনা দ্বারা সমাজের অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করতে আজীবন কাজ করেছেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের সভ্য, শিখা পত্রিকার সম্পাদক এবং চিন্তাশীল মনীষী হিসেবে তিনি যে জ্ঞানালোক ছড়িয়েছেন; তাতে সমাজের অন্ধকার কুঠুরী যেমন আলোকিত হয়েছে, তেমনি মানুষের চিত্ত-মননের অন্ধকারও হয়েছে দূরীভূত। তাঁর চিন্তা-মননের ফসল সঞ্চরন (১৯৩৭), নজরুল কাব্য পরিচিতি (১৯৫৫), সে পথ লক্ষ করে (১৯৫৮), সিম্পোজিয়াম (১৯৬৫), গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস (১৯৭০), আলোক বিজ্ঞান (১৯৭৪) ও নির্বাচিত প্রবন্ধ (১৯৭৬) শিক্ষা-গবেষণা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে আকরগ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। কর্ম ও সাধনার স্বীকৃতি-স্বরূপ লাভ করেছেন সিতারা-ই ইমতিয়াজ উপাধি (১৯৬০), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৬), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৭৯) প্রভৃতি। অলঙ্কৃত করেছেন জাতীয় অধ্যাপকের পদ। ১২৫তম জন্মদিনে এই কীর্তিমান মনীষীর প্রতি নিবেদন করি গভীর শ্রদ্ধার্ঘ্য।

কাজী মোতাহার হোসেনের বেড়ে ওঠার কাল ছিল ভারতবর্ষ তথা বাংলার সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের এক যুগান্তরের কাল। ঔপনিবেশিক দুঃশাসনে পিষ্ট এ অঞ্চলের মানুষ তখন মুক্তির পথ খুঁজছে। কলকাতাকেন্দ্রিক জীবনের উঁচুতলায়; বিশেষত হিন্দুসমাজের উপরিভাগে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের আলো কতকটা ঠিকরে পড়লেও সামগ্রিকভাবে বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ঔপনিবেশিক দুঃশাসন আর শোষণে পিছিয়ে পড়ে। এর মধ্যে মুসলমানসমাজের অবস্থা মর্মান্তিক দশায় উপনীত হয়। বৈরী শাসনব্যবস্থায় আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক সকল দিক থেকেই তারা পিছিয়ে পড়ে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের আশান্বিত করলেও কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু এলিটদের চাপের মুখে তা রদ হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ হয় এবং হতাশ হয়ে পড়ে। বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যাকে কেন্দ্র করে ঢাকাই জীবন তথা পূর্ববঙ্গে নবজাগরণের ছোঁয়া লাগে। কলকাতায় যা ঘটেছিল ছিল উনিশ শতকে, ঢাকায় তার স্ফুরণ ঘটে বিশ শতকের বিশের দশকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক এই যে জাগরণ, বিশেষভাবে বলা যায়, পূর্ববঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে উত্থান; তার অনুঘটক হিসেবে যাঁরা সামনে ছিলেন, কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন তাঁদের অগ্রগণ্য। বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টি দ্বারা তিনি সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। সৃষ্টিরহস্য, মানবমনের বিবর্তন, মানুষের কল্যাণ, সমাজের অগ্রগতি প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা পরিচালিত হয়েছে বৈজ্ঞানিকের স্বচ্ছ দৃষ্টি দ্বারা। গোঁড়ামিপূর্ণ সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতি, বিশ্বাস-সংস্কার, ঘুণে-ধরা মূল্যবোধ সবকিছুকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সেসবের মূলোৎপাটনে তিনি শানিত যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। মানুষের আচারসর্বস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস, লোক দেখানো জীবন-যাপন, ভণ্ডামি প্রভৃতির স্বরূপ উন্মোচন এবং তা থেকে উত্তরণে ক্রমাগত প্রশ্ন তুলেছেন। লিখেছেন : ‘স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও সংসারে এত পাপাচার কেন, এটি বাস্তবিকই বড় আশ্চর্যের বিষয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অধিকাংশ লোকই মুখে বিশ্বাস করে, হৃদয়ে করে না। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ধনের যেমন প্রকৃত কদর হয় না, বিশ্বাসেরও তাই। আপন চেষ্টার দ্বারা, চিন্তার দ্বারা, সাধনার দ্বারা, আয়ত্ত্ব না করলে কোন জিনিসই আমাদের নিজস্ব হয় না।’ এও বলেছেন, এমন দশা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন সকলের ভেতর অবিরাম চেতনা সঞ্চারিত করে রাখবার মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পৌরুষ।

ধর্ম সম্পর্কে তিনি গভীর চিন্তার অভিনিবেশ ঘটিয়েছেন। তাঁর মতে, পৃথিবীতে যত পয়গম্বর এসেছেন, প্রত্যেকেই নিজ নিজ সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে সময়োপযোগী কতকগুলো সত্য প্রচার করেছেন। পৃথিবীর বড়ো বড়ো ধর্ম এক একটি আদর্শ হলেও প্রতিটি মানুষ তার ধর্মকে মনের রঙে রঞ্জিত করে নেয়। একটা সাধারণ ছাপ মারা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে যত লোক, তত ধর্ম। তবে কেবল দীক্ষা দ্বারা ধর্ম লাভ সম্ভব নয়, এজন্যে দরকার চিন্তা ও সাধনা। তাঁর মতে, যুগ যুগ ধরে সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতির সঙ্গে ধর্মের প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও পরোক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান। সমাজ এবং ধর্ম পরস্পর সম্পর্কযুক্ত; কারণ, মানুষের কল্যাণের জন্যই ধর্ম, মানুষের জন্যই সমাজ। ধর্ম এবং সমাজ যদি মানুষের অবাধ মুক্তির পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তার চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কিছু হতে পারে না। এজন্যে তিনি শিক্ষা ও জ্ঞানের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বলেছেন, শিক্ষা ও জ্ঞানবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ধর্ম ও সমাজের সূত্রগুলি স্পষ্টরূপে অনুধাবন করতে পারে। এতে ব্যক্তির উদারতা বৃদ্ধি পায়, বাড়ে সম্মানও। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের এই পুরিপুষ্টির মাধ্যমেই জাতির উন্নতির সিংহদ্বার খুলে যায়। ধর্ম মানুষের বিপদে আশ্রয়, শোকে সান্ত¦না এবং সম্পদে আত্মবিকাশের প্রধান উপায় হলেও সকল দেশে এবং সকল যুগেই মহাপুরুষ ও ধর্মপ্রচারকেরা স্বকালের সমাজের কাছে অশেষ প্রকার লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। নতুন আইডিয়া বা ভাবকে সকল সমাজেই ভয় ও সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। কাজী মোতাহার হোসেন এটিকে ইতিবাচকভাবেই দেখেছেন। বলেছেন, লোকের ভয় এবং দ্বিধার কষ্টিপাথবে যাচাই হয়ে নতুন আইডিয়া তাদের কাছে গৃহীত হয়। নতুন সত্যের আলো বহু গুণ উজ্জ্বল হয়ে মিথ্যার অপনোদন করে। তা সত্ত্বেও কালে কালে আবির্ভূত ধর্মকে সমাজের অধিকাংশ মানুষ অন্ধভাবে মেনে চলে এবং সেগুলোকে অলঙ্ঘনীয় সত্য ভেবে পথ হাঁটে। এক্ষেত্রে তারা যুক্তিকে গুরুত্ব না দিয়ে ভক্তিকে প্রাধান্য দেয়। কাজী মোতাহার হোসেন মানুষের এই ধর্মান্ধতা ও অন্ধবিশ্বাসের সমালোচনা করেছেন। তাঁর ধারণা, বিচারশক্তি বাদ দিয়ে ভক্তি বেশি দিন টিকতে পারে না। কেননা বিচারবোধহীন ভক্তি অত্যন্ত দুর্বল এবং টলটলায়মান। তিনি মনে করেন, লোকহিতই ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য, অক্ষরে অক্ষরে ধর্ম পালন করতে গিয়ে যদি লোকের অকল্যাণ হয়, তবে বুঝতে হবে কোথাও গলদ আছে।

সবার উপরে মানুষকেই তিনি সত্য বলে জেনেছেন। বলেছেন, মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক তা কেবল কতিপয় ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তাতে রয়েছে প্রাণের যোগ। তাই একজনের আনন্দে যেমন মন নেচে ওঠে, অন্যের দুঃখে তেমনি ডুকরে কেঁদে ওঠে বুক। ধর্মশিক্ষা যাতে মানুষকে একদেশদর্শী করতে না পারে সেজন্য ধর্মের পাশাপাশি ইতিহাস, বিজ্ঞান, ভূগোল, সাহিত্য, ভূণ্ডতত্ত্ব প্রভৃতির শিক্ষা গ্রহণ করতে বলেছেন। তাছাড়া ধর্মশিক্ষা যাতে সবকিছুকে ছাপিয়ে না ওঠে এবং অন্য শিক্ষাও যাতে ধর্মের মর্যাদার জন্য হানিকর না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে বলেছেন। ধর্মশিক্ষাকে আচারসর্বস্ব শিক্ষায় পরিণত না করে এর নৈতিক ও আত্মিক দিকের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। শিশুদের মনে ধর্মান্ধতা বা ধর্মবিরোধ কোনোটিই যাতে বাসা বাঁধে সেদিকে লক্ষ রেখে শিক্ষাদানের ওপর তাগিদ দিয়েছেন। টোল, মাদ্রাসা, হিন্দু কলেজ, ইসলামিক কলেজ এসব সাম্প্রদায়িক চিন্তায় নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠান দেশের জন্য সর্বৈব কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না বলে মনে করেছেন। তিনি বলেছেন, ধর্মের উদ্দেশ্য মানুষে মানুষে সংযোগ স্থাপন করা, বিরোধ সৃষ্টি নয়। যে শিক্ষা মানুষে-মানুষে হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়ায়, এক মানুষ থেকে অন্য মানুষকে আলাদা করে, তা প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। তবে ধর্মের প্রতি নির্লিপ্ত বা উদাসীন থাকার পক্ষপাতী নন। কোনো বিশেষ ধর্মে গভীরভাবে আস্থাশীল থেকে, অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং অন্য মানুষকে ভালোবাসার মধ্যেই ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত বলে তিনি বিশ্বাস করেছেন। বর্তমানে আমাদের সমাজে ধর্মের নামে যে সন্ত্রাস, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও প্রাণনাশের ঘটনা ঘটে, তা নিরসনে কাজী মোতাহার হোসেনের এই চিন্তা বিশেষভাবে পথ দেখাবে।

সবকিছুর উপরে তিনি ছিলেন বাঙালি ছিলেন। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি ছিল তাঁর গভীর মমত্ববোধ। বাঙালি মুসলমান যখন উর্দু ও আরবি ভাষাকে পবিত্র জ্ঞান করে তার প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়েছে, তখনও তিনি বাঙালিত্বকে বিসর্জন দেননি। ধর্ম ও তৎসংশ্লিষ্ট সমুদয় বিষয়ের প্রতি অন্ধ অনুরাগই বাঙালির এ দৈন্যের কারণ বলে মনে করেছেন। অশিক্ষা, ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং প্যান-ইসলামের স্বপ্নে বিভোর হওয়াকে বাঙালি মুসলমানের মাত্রাতিরিক্ত আরবি-উর্দুপ্রীতির কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসের তথ্য সামনে এনে যুক্তি দাঁড় করিয়ে লিখেছেন, মধ্যযুগে মুসলিম রাজত্বকালে মুসলমানেরা বাংলা ভাষার চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতা যেমন করেছেন, তেমনি অন্যকেও এক্ষেত্রে উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু ক্ষমতা হারানোর পর নানাদিক থেকে দুর্বল হয়ে তারা গোঁড়ামি ও প্রাচীনতাকে আঁকড়ে ধরে। আরবি-ফারসি ব্যতীত অন্য ভাষাকে কাফেরের ভাষা বলে ফতোয়া দেয়, ইংরেজিকেও হারাম বলে তা শিক্ষা থেকে দূরে থাকতে বলে। বাংলা ভাষাকে তারা অভিহিত করে পৌত্তলিক ভাষা বলে। ভাই গিরীশচন্দ্র বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদ করলে গোঁড়া মুসলমানরা ‘ধর্ম গেল’ ‘ধর্ম গেল’ বলে শোর তোলে। এমন বাস্তবতায়ও কাজী মোতাহার হোসেন বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি গভীরভাবে অনুরাগী হন এবং বাঙালিত্বের ঝাণ্ডা উচ্চে তুলে ধরেন। ১৯৩০ সালে শিখা পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ধর্ম্ম ও শিক্ষা’ নামক প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমানের আরবি ও উর্দুপ্রীতিকে তাদের দৈন্য ও দুর্বলতা বলে অভিহিত করেন এবং বাঙালিত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে লেখেন : ‘মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগী না হয়ে, উর্দ্দু ফারসী বোলচালের প্রতি মোহান্ধভাবে আকৃষ্ট হওয়া, এবং মনে মনে এই দুই ভাষা শ্রেষ্ঠ বলে কল্পনা করে উর্দ্দুভাষী পশ্চিমা লোককে আশরাফ বা কুলীন বলে মেনে নেওয়া বাঙ্গালী মুসলমানের পক্ষে ঘোর করংকের কথা।’ পাকিস্তানসৃষ্টির অব্যবহিত পরে পূর্ববঙ্গের অনেক মানুষ যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে উর্দুর পক্ষে ছাতা ধরেছিল, তখনও কাজী মোতাহার হোসেন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক প্রকাশিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাÑবাংলা না উর্দু? শীর্ষক পুস্তিকায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে লেখেন ‘রাষ্ট্রভাষা ও পাকিস্তানের ভাষাসমস্যা’ নামক প্রবন্ধ। ওই প্রবন্ধে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন, ‘বাংলাই রাষ্ট্রভাষা হইবে।’ এও বলেন, যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের রাষ্ট্রভাষা রূপে চাপানোর চেষ্টা করা হয় তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ তো হবেই, শিঘ্রই পূর্ব-পশ্চিমের সম্পর্কেরও অবসান ঘটতে পারে। সরকার দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা বাদ দেওয়া শুরু করলে অনেক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তিনিও লেখনী ধারণ করেন এবং সভা-সমিতির মাধ্যমে প্রতিবাদ করেন। ১৯৫১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে চালুর দাবিতে স্মারকলিপি প্রদানকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। বাঙালি সংস্কৃতির মূলোৎপাটনে ষাটের দশকে মুসলিম লীগ সরকার রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধসহ নানা অপতৎপরতা শুরু করলে তা রুখে দিতে কাজী মোতাহার হোসেন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন। বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং গবেষক হয়েও সাহিত্য-সংস্কৃতির করেছেন এবং বাঙালিত্বের গৌরব সবকিছুর উর্ধ্বে তুলে ধরে জীবনের পথ চলেছেন।

মুসলমানসমাজে নারীদের পিছিয়ে রাখা তাঁকে মর্মযাতনা দিয়েছে। এর নিরসনে তিনি নারীশিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সঙ্গীতচর্চা নিয়ে মুসলমানদের স্ববিরোধী কর্মকাণ্ড তাঁকে বিস্মিত করেছে। অনেক মুসলমান সঙ্গীতকে হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছে। হারমোনিয়াম এবং বাংলা গানের সুর শুনে তারা ‘ধর্ম গেল’ আওয়াজ তুললেও তারাই আবার কাওয়ালি গান বা উর্দু-ফারসি ও আরবি গজল শুনে ভাবাবিষ্ট ও আনন্দে গদগদ হয়েছে। এক্ষত্রে ধর্মের যুক্তি অপেক্ষা ধর্মান্ধতা বেশি কাজ করেছে বলে তিনি মনে করেছেন। তাই বলেছেন, সঙ্গীত যদি লোকের প্রাণ স্পর্শ করে, সঙ্গীতের দ্বারা যদি জীবন ছন্দ ও মধুময় হয়, সঙ্গীত যদি আনন্দ-বিষাদ-ভক্তি-প্রেমের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি ঘটায়, তবে তাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে চেপে রাখা সমীচীন নয়। চিত্র, নাটক, ভাস্কর্য, কারুকার্য সম্বন্ধেও একই কথা খাটে। সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের স্বভাবজাত যে আকর্ষণ, তা-ই তাকে পৌঁছে দেয় সুন্দর প্রেমময় পরমপুরুষের কাছে, যার আনন্দ অপার। সুকুমার বৃত্তির চর্চা এক্ষেত্রে অন্তরায় না হয়ে সহায়ক হতে পারে বলে কাজী মোতাহার হোসেন যুক্তিগ্রাহ্য অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

এভাবেই বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারি কাজী মোতাহার হোসেন সমাজে আলো ছড়িয়েছেন। তিনি নিজে যেমন পরিচ্ছন্ন ও আলোকিত জীবনের অধিকারী ছিলেন, অন্যদেরকেও তেমনি আলোর পথ দেখিয়েছেন। সঙ্কীর্ণতা কিংবা হীনম্মন্যতা তাঁকে কখনোই স্পর্শ করেনি। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্র স্বীয় দায়িত্ববোধে থেকেছেন অবিচল। সুবিধাবাদ কিংবা বৈষয়িক লাভের আশায় গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাননি। স্বার্থ ও পদ-পদবির লোভে করেননি আপোস। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, নিষ্কলুষ চিন্তার এই দৃঢ়চেতা বাঙালি এবং বৃদ্ধিদীপ্ত মনীষীর চিন্তা সমাজের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আলো ফেলে তাকে এগিয়ে নেবে। তাঁর চিন্তা-চেতনা নতুন প্রজন্মকে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথে এগিয়ে চলার প্রেরণা ও শক্তি জোগাবে। অবক্ষয়িত সমাজ ও রাষ্ট্রে তাঁর জীবন, কর্ম ও সৃষ্টিসম্ভার কাজ করবে সঞ্জিবনীসুধার।

বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই ২০২২ , ১৩ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৯ জিলহজ ১৪৪৩

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও কাজী মোতাহার হোসেন

এম আবদুল আলীম

কাজী মোতাহার হোসেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি। মুক্তচিন্তক, যশস্বী অধ্যাপক, নিষ্ঠাবান গবেষক, ধীমান সাহিত্য-সাধক, কীর্তিমান দাবাড়ু হিসেবে তিনি ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা, প্রগতিশীলতা এবং সর্বোপরি সংস্কারমুক্ত চিন্তা-চেতনা দ্বারা সমাজের অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করতে আজীবন কাজ করেছেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের সভ্য, শিখা পত্রিকার সম্পাদক এবং চিন্তাশীল মনীষী হিসেবে তিনি যে জ্ঞানালোক ছড়িয়েছেন; তাতে সমাজের অন্ধকার কুঠুরী যেমন আলোকিত হয়েছে, তেমনি মানুষের চিত্ত-মননের অন্ধকারও হয়েছে দূরীভূত। তাঁর চিন্তা-মননের ফসল সঞ্চরন (১৯৩৭), নজরুল কাব্য পরিচিতি (১৯৫৫), সে পথ লক্ষ করে (১৯৫৮), সিম্পোজিয়াম (১৯৬৫), গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস (১৯৭০), আলোক বিজ্ঞান (১৯৭৪) ও নির্বাচিত প্রবন্ধ (১৯৭৬) শিক্ষা-গবেষণা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে আকরগ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। কর্ম ও সাধনার স্বীকৃতি-স্বরূপ লাভ করেছেন সিতারা-ই ইমতিয়াজ উপাধি (১৯৬০), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৬), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৭৯) প্রভৃতি। অলঙ্কৃত করেছেন জাতীয় অধ্যাপকের পদ। ১২৫তম জন্মদিনে এই কীর্তিমান মনীষীর প্রতি নিবেদন করি গভীর শ্রদ্ধার্ঘ্য।

কাজী মোতাহার হোসেনের বেড়ে ওঠার কাল ছিল ভারতবর্ষ তথা বাংলার সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের এক যুগান্তরের কাল। ঔপনিবেশিক দুঃশাসনে পিষ্ট এ অঞ্চলের মানুষ তখন মুক্তির পথ খুঁজছে। কলকাতাকেন্দ্রিক জীবনের উঁচুতলায়; বিশেষত হিন্দুসমাজের উপরিভাগে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের আলো কতকটা ঠিকরে পড়লেও সামগ্রিকভাবে বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ঔপনিবেশিক দুঃশাসন আর শোষণে পিছিয়ে পড়ে। এর মধ্যে মুসলমানসমাজের অবস্থা মর্মান্তিক দশায় উপনীত হয়। বৈরী শাসনব্যবস্থায় আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক সকল দিক থেকেই তারা পিছিয়ে পড়ে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের আশান্বিত করলেও কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু এলিটদের চাপের মুখে তা রদ হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ হয় এবং হতাশ হয়ে পড়ে। বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যাকে কেন্দ্র করে ঢাকাই জীবন তথা পূর্ববঙ্গে নবজাগরণের ছোঁয়া লাগে। কলকাতায় যা ঘটেছিল ছিল উনিশ শতকে, ঢাকায় তার স্ফুরণ ঘটে বিশ শতকের বিশের দশকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক এই যে জাগরণ, বিশেষভাবে বলা যায়, পূর্ববঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে উত্থান; তার অনুঘটক হিসেবে যাঁরা সামনে ছিলেন, কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন তাঁদের অগ্রগণ্য। বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টি দ্বারা তিনি সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। সৃষ্টিরহস্য, মানবমনের বিবর্তন, মানুষের কল্যাণ, সমাজের অগ্রগতি প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা পরিচালিত হয়েছে বৈজ্ঞানিকের স্বচ্ছ দৃষ্টি দ্বারা। গোঁড়ামিপূর্ণ সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতি, বিশ্বাস-সংস্কার, ঘুণে-ধরা মূল্যবোধ সবকিছুকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সেসবের মূলোৎপাটনে তিনি শানিত যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। মানুষের আচারসর্বস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস, লোক দেখানো জীবন-যাপন, ভণ্ডামি প্রভৃতির স্বরূপ উন্মোচন এবং তা থেকে উত্তরণে ক্রমাগত প্রশ্ন তুলেছেন। লিখেছেন : ‘স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও সংসারে এত পাপাচার কেন, এটি বাস্তবিকই বড় আশ্চর্যের বিষয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অধিকাংশ লোকই মুখে বিশ্বাস করে, হৃদয়ে করে না। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ধনের যেমন প্রকৃত কদর হয় না, বিশ্বাসেরও তাই। আপন চেষ্টার দ্বারা, চিন্তার দ্বারা, সাধনার দ্বারা, আয়ত্ত্ব না করলে কোন জিনিসই আমাদের নিজস্ব হয় না।’ এও বলেছেন, এমন দশা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন সকলের ভেতর অবিরাম চেতনা সঞ্চারিত করে রাখবার মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পৌরুষ।

ধর্ম সম্পর্কে তিনি গভীর চিন্তার অভিনিবেশ ঘটিয়েছেন। তাঁর মতে, পৃথিবীতে যত পয়গম্বর এসেছেন, প্রত্যেকেই নিজ নিজ সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে সময়োপযোগী কতকগুলো সত্য প্রচার করেছেন। পৃথিবীর বড়ো বড়ো ধর্ম এক একটি আদর্শ হলেও প্রতিটি মানুষ তার ধর্মকে মনের রঙে রঞ্জিত করে নেয়। একটা সাধারণ ছাপ মারা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে যত লোক, তত ধর্ম। তবে কেবল দীক্ষা দ্বারা ধর্ম লাভ সম্ভব নয়, এজন্যে দরকার চিন্তা ও সাধনা। তাঁর মতে, যুগ যুগ ধরে সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতির সঙ্গে ধর্মের প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও পরোক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান। সমাজ এবং ধর্ম পরস্পর সম্পর্কযুক্ত; কারণ, মানুষের কল্যাণের জন্যই ধর্ম, মানুষের জন্যই সমাজ। ধর্ম এবং সমাজ যদি মানুষের অবাধ মুক্তির পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তার চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কিছু হতে পারে না। এজন্যে তিনি শিক্ষা ও জ্ঞানের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বলেছেন, শিক্ষা ও জ্ঞানবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ধর্ম ও সমাজের সূত্রগুলি স্পষ্টরূপে অনুধাবন করতে পারে। এতে ব্যক্তির উদারতা বৃদ্ধি পায়, বাড়ে সম্মানও। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের এই পুরিপুষ্টির মাধ্যমেই জাতির উন্নতির সিংহদ্বার খুলে যায়। ধর্ম মানুষের বিপদে আশ্রয়, শোকে সান্ত¦না এবং সম্পদে আত্মবিকাশের প্রধান উপায় হলেও সকল দেশে এবং সকল যুগেই মহাপুরুষ ও ধর্মপ্রচারকেরা স্বকালের সমাজের কাছে অশেষ প্রকার লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। নতুন আইডিয়া বা ভাবকে সকল সমাজেই ভয় ও সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। কাজী মোতাহার হোসেন এটিকে ইতিবাচকভাবেই দেখেছেন। বলেছেন, লোকের ভয় এবং দ্বিধার কষ্টিপাথবে যাচাই হয়ে নতুন আইডিয়া তাদের কাছে গৃহীত হয়। নতুন সত্যের আলো বহু গুণ উজ্জ্বল হয়ে মিথ্যার অপনোদন করে। তা সত্ত্বেও কালে কালে আবির্ভূত ধর্মকে সমাজের অধিকাংশ মানুষ অন্ধভাবে মেনে চলে এবং সেগুলোকে অলঙ্ঘনীয় সত্য ভেবে পথ হাঁটে। এক্ষেত্রে তারা যুক্তিকে গুরুত্ব না দিয়ে ভক্তিকে প্রাধান্য দেয়। কাজী মোতাহার হোসেন মানুষের এই ধর্মান্ধতা ও অন্ধবিশ্বাসের সমালোচনা করেছেন। তাঁর ধারণা, বিচারশক্তি বাদ দিয়ে ভক্তি বেশি দিন টিকতে পারে না। কেননা বিচারবোধহীন ভক্তি অত্যন্ত দুর্বল এবং টলটলায়মান। তিনি মনে করেন, লোকহিতই ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য, অক্ষরে অক্ষরে ধর্ম পালন করতে গিয়ে যদি লোকের অকল্যাণ হয়, তবে বুঝতে হবে কোথাও গলদ আছে।

সবার উপরে মানুষকেই তিনি সত্য বলে জেনেছেন। বলেছেন, মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক তা কেবল কতিপয় ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তাতে রয়েছে প্রাণের যোগ। তাই একজনের আনন্দে যেমন মন নেচে ওঠে, অন্যের দুঃখে তেমনি ডুকরে কেঁদে ওঠে বুক। ধর্মশিক্ষা যাতে মানুষকে একদেশদর্শী করতে না পারে সেজন্য ধর্মের পাশাপাশি ইতিহাস, বিজ্ঞান, ভূগোল, সাহিত্য, ভূণ্ডতত্ত্ব প্রভৃতির শিক্ষা গ্রহণ করতে বলেছেন। তাছাড়া ধর্মশিক্ষা যাতে সবকিছুকে ছাপিয়ে না ওঠে এবং অন্য শিক্ষাও যাতে ধর্মের মর্যাদার জন্য হানিকর না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে বলেছেন। ধর্মশিক্ষাকে আচারসর্বস্ব শিক্ষায় পরিণত না করে এর নৈতিক ও আত্মিক দিকের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। শিশুদের মনে ধর্মান্ধতা বা ধর্মবিরোধ কোনোটিই যাতে বাসা বাঁধে সেদিকে লক্ষ রেখে শিক্ষাদানের ওপর তাগিদ দিয়েছেন। টোল, মাদ্রাসা, হিন্দু কলেজ, ইসলামিক কলেজ এসব সাম্প্রদায়িক চিন্তায় নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠান দেশের জন্য সর্বৈব কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না বলে মনে করেছেন। তিনি বলেছেন, ধর্মের উদ্দেশ্য মানুষে মানুষে সংযোগ স্থাপন করা, বিরোধ সৃষ্টি নয়। যে শিক্ষা মানুষে-মানুষে হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়ায়, এক মানুষ থেকে অন্য মানুষকে আলাদা করে, তা প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। তবে ধর্মের প্রতি নির্লিপ্ত বা উদাসীন থাকার পক্ষপাতী নন। কোনো বিশেষ ধর্মে গভীরভাবে আস্থাশীল থেকে, অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং অন্য মানুষকে ভালোবাসার মধ্যেই ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত বলে তিনি বিশ্বাস করেছেন। বর্তমানে আমাদের সমাজে ধর্মের নামে যে সন্ত্রাস, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও প্রাণনাশের ঘটনা ঘটে, তা নিরসনে কাজী মোতাহার হোসেনের এই চিন্তা বিশেষভাবে পথ দেখাবে।

সবকিছুর উপরে তিনি ছিলেন বাঙালি ছিলেন। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি ছিল তাঁর গভীর মমত্ববোধ। বাঙালি মুসলমান যখন উর্দু ও আরবি ভাষাকে পবিত্র জ্ঞান করে তার প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়েছে, তখনও তিনি বাঙালিত্বকে বিসর্জন দেননি। ধর্ম ও তৎসংশ্লিষ্ট সমুদয় বিষয়ের প্রতি অন্ধ অনুরাগই বাঙালির এ দৈন্যের কারণ বলে মনে করেছেন। অশিক্ষা, ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং প্যান-ইসলামের স্বপ্নে বিভোর হওয়াকে বাঙালি মুসলমানের মাত্রাতিরিক্ত আরবি-উর্দুপ্রীতির কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসের তথ্য সামনে এনে যুক্তি দাঁড় করিয়ে লিখেছেন, মধ্যযুগে মুসলিম রাজত্বকালে মুসলমানেরা বাংলা ভাষার চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতা যেমন করেছেন, তেমনি অন্যকেও এক্ষেত্রে উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু ক্ষমতা হারানোর পর নানাদিক থেকে দুর্বল হয়ে তারা গোঁড়ামি ও প্রাচীনতাকে আঁকড়ে ধরে। আরবি-ফারসি ব্যতীত অন্য ভাষাকে কাফেরের ভাষা বলে ফতোয়া দেয়, ইংরেজিকেও হারাম বলে তা শিক্ষা থেকে দূরে থাকতে বলে। বাংলা ভাষাকে তারা অভিহিত করে পৌত্তলিক ভাষা বলে। ভাই গিরীশচন্দ্র বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদ করলে গোঁড়া মুসলমানরা ‘ধর্ম গেল’ ‘ধর্ম গেল’ বলে শোর তোলে। এমন বাস্তবতায়ও কাজী মোতাহার হোসেন বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি গভীরভাবে অনুরাগী হন এবং বাঙালিত্বের ঝাণ্ডা উচ্চে তুলে ধরেন। ১৯৩০ সালে শিখা পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ধর্ম্ম ও শিক্ষা’ নামক প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমানের আরবি ও উর্দুপ্রীতিকে তাদের দৈন্য ও দুর্বলতা বলে অভিহিত করেন এবং বাঙালিত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে লেখেন : ‘মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগী না হয়ে, উর্দ্দু ফারসী বোলচালের প্রতি মোহান্ধভাবে আকৃষ্ট হওয়া, এবং মনে মনে এই দুই ভাষা শ্রেষ্ঠ বলে কল্পনা করে উর্দ্দুভাষী পশ্চিমা লোককে আশরাফ বা কুলীন বলে মেনে নেওয়া বাঙ্গালী মুসলমানের পক্ষে ঘোর করংকের কথা।’ পাকিস্তানসৃষ্টির অব্যবহিত পরে পূর্ববঙ্গের অনেক মানুষ যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে উর্দুর পক্ষে ছাতা ধরেছিল, তখনও কাজী মোতাহার হোসেন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক প্রকাশিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাÑবাংলা না উর্দু? শীর্ষক পুস্তিকায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে লেখেন ‘রাষ্ট্রভাষা ও পাকিস্তানের ভাষাসমস্যা’ নামক প্রবন্ধ। ওই প্রবন্ধে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন, ‘বাংলাই রাষ্ট্রভাষা হইবে।’ এও বলেন, যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের রাষ্ট্রভাষা রূপে চাপানোর চেষ্টা করা হয় তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ তো হবেই, শিঘ্রই পূর্ব-পশ্চিমের সম্পর্কেরও অবসান ঘটতে পারে। সরকার দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা বাদ দেওয়া শুরু করলে অনেক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তিনিও লেখনী ধারণ করেন এবং সভা-সমিতির মাধ্যমে প্রতিবাদ করেন। ১৯৫১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে চালুর দাবিতে স্মারকলিপি প্রদানকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। বাঙালি সংস্কৃতির মূলোৎপাটনে ষাটের দশকে মুসলিম লীগ সরকার রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধসহ নানা অপতৎপরতা শুরু করলে তা রুখে দিতে কাজী মোতাহার হোসেন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন। বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং গবেষক হয়েও সাহিত্য-সংস্কৃতির করেছেন এবং বাঙালিত্বের গৌরব সবকিছুর উর্ধ্বে তুলে ধরে জীবনের পথ চলেছেন।

মুসলমানসমাজে নারীদের পিছিয়ে রাখা তাঁকে মর্মযাতনা দিয়েছে। এর নিরসনে তিনি নারীশিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সঙ্গীতচর্চা নিয়ে মুসলমানদের স্ববিরোধী কর্মকাণ্ড তাঁকে বিস্মিত করেছে। অনেক মুসলমান সঙ্গীতকে হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছে। হারমোনিয়াম এবং বাংলা গানের সুর শুনে তারা ‘ধর্ম গেল’ আওয়াজ তুললেও তারাই আবার কাওয়ালি গান বা উর্দু-ফারসি ও আরবি গজল শুনে ভাবাবিষ্ট ও আনন্দে গদগদ হয়েছে। এক্ষত্রে ধর্মের যুক্তি অপেক্ষা ধর্মান্ধতা বেশি কাজ করেছে বলে তিনি মনে করেছেন। তাই বলেছেন, সঙ্গীত যদি লোকের প্রাণ স্পর্শ করে, সঙ্গীতের দ্বারা যদি জীবন ছন্দ ও মধুময় হয়, সঙ্গীত যদি আনন্দ-বিষাদ-ভক্তি-প্রেমের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি ঘটায়, তবে তাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে চেপে রাখা সমীচীন নয়। চিত্র, নাটক, ভাস্কর্য, কারুকার্য সম্বন্ধেও একই কথা খাটে। সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের স্বভাবজাত যে আকর্ষণ, তা-ই তাকে পৌঁছে দেয় সুন্দর প্রেমময় পরমপুরুষের কাছে, যার আনন্দ অপার। সুকুমার বৃত্তির চর্চা এক্ষেত্রে অন্তরায় না হয়ে সহায়ক হতে পারে বলে কাজী মোতাহার হোসেন যুক্তিগ্রাহ্য অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

এভাবেই বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারি কাজী মোতাহার হোসেন সমাজে আলো ছড়িয়েছেন। তিনি নিজে যেমন পরিচ্ছন্ন ও আলোকিত জীবনের অধিকারী ছিলেন, অন্যদেরকেও তেমনি আলোর পথ দেখিয়েছেন। সঙ্কীর্ণতা কিংবা হীনম্মন্যতা তাঁকে কখনোই স্পর্শ করেনি। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্র স্বীয় দায়িত্ববোধে থেকেছেন অবিচল। সুবিধাবাদ কিংবা বৈষয়িক লাভের আশায় গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাননি। স্বার্থ ও পদ-পদবির লোভে করেননি আপোস। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, নিষ্কলুষ চিন্তার এই দৃঢ়চেতা বাঙালি এবং বৃদ্ধিদীপ্ত মনীষীর চিন্তা সমাজের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আলো ফেলে তাকে এগিয়ে নেবে। তাঁর চিন্তা-চেতনা নতুন প্রজন্মকে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথে এগিয়ে চলার প্রেরণা ও শক্তি জোগাবে। অবক্ষয়িত সমাজ ও রাষ্ট্রে তাঁর জীবন, কর্ম ও সৃষ্টিসম্ভার কাজ করবে সঞ্জিবনীসুধার।