দুদকের মামলায় প্রদীপের ২০ ও স্ত্রী চুমকির ২১ বছরের কারাদণ্ড

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদকের) করা মামলায় প্রদীপ কুমার দাশকে ২০ এবং তার স্ত্রী চুমকি কারণকে ২১ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তসহ চার কোটি ২১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গতকাল চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ মুন্সী আবদুল মজিদের আদালতে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মাহমুদুল হক মাহমুদ। এদিকে রায় ঘোষণার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এর আগে গত ১৮ জুলাই চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ মুন্সী আবদুল মজিদের আদালতে এ মামলায় দুদকপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ বাদী হয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দীন। দুদক আইন ২০০৪-এর ২৬(২) ও ২৭ (১), মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় তাদের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। এরপর গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক মুন্সী আবদুল মজিদ দুর্নীতি মামলার চার্জ গঠনের মাধ্যমে প্রদীপ এবং তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিলেন।

এর আগে গত বছরের ২৬ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন। প্রদীপ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকলেও চলতি বছরের ২৩ মে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন প্রদীপের স্ত্রী চুমকি। পরে আদালত শুনানি শেষে তাকে কারাগারে পাঠান। জানা গেছে, চুমকির ৪ কোটি ৮০ লাখ ৬৪ হাজার ৬৫১ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিপরীতে বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৬ হাজার ২৩৪ টাকা। বাকি সম্পদ অর্থাৎ ২ কোটি ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪১৭ টাকার সম্পদ অবৈধভাবে অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় ছয়তলা বাড়ি, ষোলশহরে একটি বাড়ি, ৪৫ ভরি স্বর্ণ, একটি কার ও মাইক্রোবাস, কক্সবাজারের একটি ফ্ল্যাটের মালিক প্রদীপের স্ত্রী চুমকি। প্রদীপের ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থে স্ত্রী চুমকি এসব সম্পদ অর্জন করেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে উঠে এসেছে। এছাড়া চুমকি নিজেকে মাছ ব্যবসায়ী দাবি করলেও তার কোন প্রমাণ পায়নি দুদক।

জানা গেছে, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর মেরিনড্রাইভ চেকপোস্টে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় একই বছরের ৬ আগস্ট থেকে কারাগারে রয়েছেন ওসি প্রদীপ। সিনহা হত্যা মামলায় প্রদীপকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

গতকাল সকালে রায় ঘোষণার পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ মুন্সী আবদুল মজিদের আদালতে থেকে নিয়ে যাওয়া সময় বারান্দায় প্রদীপ কুমার দাশ ক্ষোভ প্রকাশ করে চিৎকার করে বলেন, আমি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমি নির্দোষ। আমি কোন অপরাধ করিনি। আমি দুর্নীতি করিনি।

প্রদীপ আরও বলেন, আমাকে সিনহা হত্যা মামলায় যে রায় দেয়া হয়েছে সেখানে আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আপনারা সম্পূর্ণভাবে তদন্ত করে দেখেন। আমি মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স বাস্তবায়নের জন্য যুদ্ধ করেছি। যাতে আর কোন ঐশী (বাবা-মাকে খুন করার দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত) তৈরি না হয়। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি যাতে যুবসমাজ ধ্বংস না হয়। আমি কোন অপরাধ করিনি। অনুসন্ধান করে দেখেন। আজকের রায়ের বিরুদ্ধে আমি উচ্চ আদালতে যাব।

প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকি কারনের আইনজীবী সমীর দাশগুপ্ত বলেন, কক্সবাজার জেলার মহেশখালী থানার সেলিম এলাহীর অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক প্রদীপ ও চুমকির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। মামলায় সাক্ষী করা হলেও সেলিম এলাহী সাক্ষ্য দেননি। ২৪ জন সাক্ষীর মধ্যে দুইজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীকে আদালতে জেরা করা হয়। বাকি ২২ জনের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেছে। তারা মামলা সম্পর্কে অবগত নন। আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। ন্যায়বিচারের জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করবো।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মাহমুদুল হক মাহমুদ বলেন, প্রদীপ কুমার দাশ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ঘুষ-দুর্নীতি ও ক্ষমতার ব্যবহার করে যেসব সম্পদ অর্জন করেছেন সেগুলো স্ত্রীর মাধ্যমে বৈধ করার চেষ্টা করেছেন। সেটা আদালতে ২৪ জন সাক্ষীর মাধ্যমে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আদালত সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে বলেছেন, আসামিরা পরস্পরের যোগসাজশে এই অপরাধ করেছেন। তাই আদালত তাদের শাস্তি দিয়েছেন। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট সেটা কার্যকর চাই।

বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই ২০২২ , ১৩ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৯ জিলহজ ১৪৪৩

দুদকের মামলায় প্রদীপের ২০ ও স্ত্রী চুমকির ২১ বছরের কারাদণ্ড

চট্টগ্রাম ব্যুরো

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদকের) করা মামলায় প্রদীপ কুমার দাশকে ২০ এবং তার স্ত্রী চুমকি কারণকে ২১ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তসহ চার কোটি ২১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গতকাল চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ মুন্সী আবদুল মজিদের আদালতে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মাহমুদুল হক মাহমুদ। এদিকে রায় ঘোষণার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এর আগে গত ১৮ জুলাই চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ মুন্সী আবদুল মজিদের আদালতে এ মামলায় দুদকপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ বাদী হয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দীন। দুদক আইন ২০০৪-এর ২৬(২) ও ২৭ (১), মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় তাদের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। এরপর গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক মুন্সী আবদুল মজিদ দুর্নীতি মামলার চার্জ গঠনের মাধ্যমে প্রদীপ এবং তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিলেন।

এর আগে গত বছরের ২৬ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন। প্রদীপ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকলেও চলতি বছরের ২৩ মে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন প্রদীপের স্ত্রী চুমকি। পরে আদালত শুনানি শেষে তাকে কারাগারে পাঠান। জানা গেছে, চুমকির ৪ কোটি ৮০ লাখ ৬৪ হাজার ৬৫১ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিপরীতে বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৬ হাজার ২৩৪ টাকা। বাকি সম্পদ অর্থাৎ ২ কোটি ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪১৭ টাকার সম্পদ অবৈধভাবে অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় ছয়তলা বাড়ি, ষোলশহরে একটি বাড়ি, ৪৫ ভরি স্বর্ণ, একটি কার ও মাইক্রোবাস, কক্সবাজারের একটি ফ্ল্যাটের মালিক প্রদীপের স্ত্রী চুমকি। প্রদীপের ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থে স্ত্রী চুমকি এসব সম্পদ অর্জন করেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে উঠে এসেছে। এছাড়া চুমকি নিজেকে মাছ ব্যবসায়ী দাবি করলেও তার কোন প্রমাণ পায়নি দুদক।

জানা গেছে, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর মেরিনড্রাইভ চেকপোস্টে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় একই বছরের ৬ আগস্ট থেকে কারাগারে রয়েছেন ওসি প্রদীপ। সিনহা হত্যা মামলায় প্রদীপকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

গতকাল সকালে রায় ঘোষণার পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ মুন্সী আবদুল মজিদের আদালতে থেকে নিয়ে যাওয়া সময় বারান্দায় প্রদীপ কুমার দাশ ক্ষোভ প্রকাশ করে চিৎকার করে বলেন, আমি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমি নির্দোষ। আমি কোন অপরাধ করিনি। আমি দুর্নীতি করিনি।

প্রদীপ আরও বলেন, আমাকে সিনহা হত্যা মামলায় যে রায় দেয়া হয়েছে সেখানে আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আপনারা সম্পূর্ণভাবে তদন্ত করে দেখেন। আমি মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স বাস্তবায়নের জন্য যুদ্ধ করেছি। যাতে আর কোন ঐশী (বাবা-মাকে খুন করার দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত) তৈরি না হয়। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি যাতে যুবসমাজ ধ্বংস না হয়। আমি কোন অপরাধ করিনি। অনুসন্ধান করে দেখেন। আজকের রায়ের বিরুদ্ধে আমি উচ্চ আদালতে যাব।

প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকি কারনের আইনজীবী সমীর দাশগুপ্ত বলেন, কক্সবাজার জেলার মহেশখালী থানার সেলিম এলাহীর অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক প্রদীপ ও চুমকির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। মামলায় সাক্ষী করা হলেও সেলিম এলাহী সাক্ষ্য দেননি। ২৪ জন সাক্ষীর মধ্যে দুইজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীকে আদালতে জেরা করা হয়। বাকি ২২ জনের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেছে। তারা মামলা সম্পর্কে অবগত নন। আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। ন্যায়বিচারের জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করবো।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মাহমুদুল হক মাহমুদ বলেন, প্রদীপ কুমার দাশ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ঘুষ-দুর্নীতি ও ক্ষমতার ব্যবহার করে যেসব সম্পদ অর্জন করেছেন সেগুলো স্ত্রীর মাধ্যমে বৈধ করার চেষ্টা করেছেন। সেটা আদালতে ২৪ জন সাক্ষীর মাধ্যমে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আদালত সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে বলেছেন, আসামিরা পরস্পরের যোগসাজশে এই অপরাধ করেছেন। তাই আদালত তাদের শাস্তি দিয়েছেন। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট সেটা কার্যকর চাই।