রেজাউল করিম খোকন
মাছে ভাতে বাঙালি-এটা বাংলার জনপ্রিয় প্রবাদ। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের খাদ্য তালিকায় মাছের প্রাধান্য আগের মতো নেই। দেশের নদী, খাল, বিল, হাওর-বাঁওড়ে এখন মাছের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। তবে আধুনিক মৎস্য চাষাবাদ পদ্ধতি ফের দেশকে মাছের বাড়তি জোগান এনে দিয়েছে।
দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাছের সরবরাহ ক্রমাগত বাড়ছে। এতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা যেমন মিটছে, তেমনি বিশ্ববাজারেও বাড়ছে রপ্তানি। তবে এ খাতে এখন পর্যন্ত সমুদ্রের অবদান সামান্যই। এখন সমুদ্রে যে বিপুল অর্থনৈতিক এলাকা বাংলাদেশের আওতায় এসেছে, সেখানে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য চাই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তোলা। সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫, অথচ মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।
সমুদ্র বিজয়ে দেশে ব্লু-ইকোনমির ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দেশের উন্নয়নের জন্য অর্থনীতির সমৃদ্ধির জন্য এই সম্পদের দ্রুত ও কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মৎস্য খাতে সার্বিক উন্নয়নের জন্য দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি এবং গভীর সমুদ্রে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য বাংলাদেশ এ বিষয়ে ইতোমধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে মীমাংসিত সমুদ্রসীমায় মাছের উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এজন্য বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় দস্যুতা ও বিদেশি ট্রলারের অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এর পাশাপাশি দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে ইলিশ ট্রাস্ট ফান্ড গঠনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
দেশের মৎস্য সম্পদের আহরণ ও উন্নয়নে আয়োজিত এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সামনে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে মাছ চাষ, চিংড়ি চাষিদের এক অংকের সুদে ঋণ, চিংড়ির রেনু পোনা আহরণ বন্ধে দরিদ্র জেলেদের খাদ্য সহায়তা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, হস্তান্তরিত জলমহালগুলো মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে ন্যস্ত করা, হালদা নদী রক্ষায় রবার ড্যাম তুলে ফেলা, মৎস্য উৎপাদনে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিল ও ভূমি উন্নয়ন করে ছাড় দেয়া, মাছের খাবারের উপাদান আমদানিতেও শুল্কছাড়সহ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গঠনমূলক প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী এ বৈঠকে সংশ্লিষ্টদের দ্রুততম সময়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার জটিলতা দূর করার নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি গভীর সমুদ্রে মাছের উৎপাদন বাড়াতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলেছেন। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধির পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ায় জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। কৃষির অন্যান্য খাত-উপখাতের তুলনায় মাছের উৎপাদন বাড়ার হার বেশি। বিগত ১৫- ১৬ বছরে এ খাতে বছরে ১০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী সাগর এলাকায় প্রতি বছর ৮০০ মিলিয়ন টন মাছ ধরা পড়ে। এর মধ্যে মাত্র দশমিক ৭০ মিলিয়ন টন মাছ দেশের জেলেরা ধরে থাকে। বিশাল সমুদ্রসীমায় মৎস্য সম্পদের ১ শতাংশও ধরতে পারছে না বাংলাদেশের জেলেরা উন্নত জাহাজ ও প্রযুক্তির অভাবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় কী পরিমাণ মৎস্য সম্পদ রয়েছে, সে ব্যাপারেও কোন তথ্য সরকারের কাছে নেই। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে অনায়সেই বিলিয়ন ডলার আয় করা যায়। এ ছাড়া মাছের তেল থেকে ওষুধ, সস প্রভৃতি তৈরি করা সম্ভব। এতে নতুন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব। সমুদ্রে যে বিপুল অর্থনৈতিক এলাকা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে সেখানে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য চাই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তোলা। একই সঙ্গে দক্ষ জনবল তৈরির ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। মাছের বাজার নিয়ে দুর্ভাবনা নেই। বলা যায়, গোটা বিশ্বেই মাছের অপরিমেয় চাহিদা রয়েছে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য বিদেশি বিনিয়োগকেও স্বাগত জানাতে হবে।
মায়ানমারের মতো সমুদ্রে মাছ ধরার সব নৌযানকে নিবন্ধনের আওতায় আনা এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে মৎস্য অধিদপ্তর করা উচিত। সামুদ্রিক জেলেদের জন্য ‘সামুদ্রিক মৎষ্য পরামর্শ কেন্দ্র’ চালু করা যায়। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে জেলেরা প্রতিদিন ‘মাছের বসতি’ সম্পর্কে জানতে পারবে। এতে জেলেদের অর্থ ও সময় বাঁচবে। এ কাজে মৎস্য বিজ্ঞানীদের লাগানো যায়।
আধুনিক ট্রলার বা ফ্রিজার ঘণ্টায় এক টনেরও বেশি মাছ ধরতে ও প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম। ভারত, থাইল্যান্ড, মায়ানমারসহ অনেক দেশই এ প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে প্রক্রিয়াজাত করে। উন্নত ট্রলারে থাকা-খাওয়ার সুবিধাও ভালো। এর চেয়ে বড় কথা, এগুলো অনেক নিরাপদ। ফলে এসব দেশের জেলেরা দীর্ঘদিন সমুদ্রে অবস্থান করে মাছ ধরতে পারে। মায়ানমার ও ভারতের সমুদ্র সীমায় স্রোত ও ঢেউ বেশি থাকায় আমাদের জলসীমা থেকে তারা অনেক সময় মাছ ধরে নিয়ে যায়। সামুদ্রিক ঢেউ ও স্রোতের বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) আধুনিক জাহাজ আমদানি করে পিপিপির মাধ্যমে বা কিস্তিতে জেলেদের দিতে পারে। ডাটাবেইস করে সামুদ্রিক মাছ ধরার প্রতিটি নৌকা ও মালিককে সরকারি নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে।
এ ছাড়া মৎস্য আহরণ বাড়াতে সামুদ্রিক নৌযান, ট্রলারগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করে সমুদ্রের সর্বশেষ অবস্থা সব সময় জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। গভীর সমুদ্রে মৎস্য সম্পদ আহরণে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। হংকং, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো কেবলমাত্র সমুদ্রকে ব্যবহার করেই বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়েছে। সমুদ্র শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে। আমাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে অনেক দিন নানা ধরনের বিরোধ ছিল, এখন সে অবস্থা নেই। তারপরেও আমরা কেন আমাদের সমুদ্রসীমায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না, সেটাও বিবেচনার বিষয়। সমুদ্র সম্পদ আহরণ এবং এর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির চেহারাও বদলে দেওয়া সম্ভব। বিশেষ করে আমাদের সমুদ্র সীমায় মৎস্য সম্পদ আহরণে বিরাজমান সমস্যাগুলো অবিলম্বে দূর করা প্রয়োজন। এখনো আমাদের জেলেরা নির্বিঘ্নে-নিশ্চিন্তে গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরতে পারছে না। তাদের জানমাল নানা হুমকির মধ্যে পড়ছে হরহামেশাই। সামগ্রিক বাস্তবতা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। সমুদ্রসম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের ব্যাপারে বিলম্ব করার কোন অবকাশ নেই। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকেও এগিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-বিএফআরআই সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট যে পরিমাণ মাছ উৎপাদিত হয়, তার মধ্যে কার্প, অর্থাৎ রুই জাতীয় মাছ ২১ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় রুই মাছ, ১১ শতাংশ। এরপরে রয়েছে পাঙাশ (১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ), তেলাপিয়া (৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ), কাতলা (পৌনে ৭ শতাংশ) ও সিলভার কার্প (৭ দশমিক ৩ শতাংশ)। গত এক যুগে দেশি ৩৬ প্রজাতির ছোট মাছের চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর ফলে এ সময়ে চাষের মাছ উৎপাদন ৬৭ হাজার মেট্রিক টন থেকে বেড়ে প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দেশে স্বাদু পানির ২৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ৩০টি প্রজাতির চাষ বেশি হচ্ছে। বাকিগুলোর চাষ বাড়লে বাংলাদেশের মাছ উৎপাদন ৫০ লাখ টনে পৌঁছাবে।
আশা করি, আগামী কয়েক বছরে দেশের মাছের উৎপাদন আরও বাড়ানো যাবে। তবে মাছের উৎপাদন ধরে রাখার জন্য নদী ও জলাশয়গুলোকে দূষণমুক্ত করতে হবে বলে মনে করছেন। নদ-নদী দূষণমুক্ত না রাখলে ইলিশের উৎপাদন ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
শুক্রবার, ২৯ জুলাই ২০২২ , ১৪ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৯ জিলহজ ১৪৪৩
রেজাউল করিম খোকন
মাছে ভাতে বাঙালি-এটা বাংলার জনপ্রিয় প্রবাদ। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের খাদ্য তালিকায় মাছের প্রাধান্য আগের মতো নেই। দেশের নদী, খাল, বিল, হাওর-বাঁওড়ে এখন মাছের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। তবে আধুনিক মৎস্য চাষাবাদ পদ্ধতি ফের দেশকে মাছের বাড়তি জোগান এনে দিয়েছে।
দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাছের সরবরাহ ক্রমাগত বাড়ছে। এতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা যেমন মিটছে, তেমনি বিশ্ববাজারেও বাড়ছে রপ্তানি। তবে এ খাতে এখন পর্যন্ত সমুদ্রের অবদান সামান্যই। এখন সমুদ্রে যে বিপুল অর্থনৈতিক এলাকা বাংলাদেশের আওতায় এসেছে, সেখানে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য চাই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তোলা। সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫, অথচ মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।
সমুদ্র বিজয়ে দেশে ব্লু-ইকোনমির ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দেশের উন্নয়নের জন্য অর্থনীতির সমৃদ্ধির জন্য এই সম্পদের দ্রুত ও কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মৎস্য খাতে সার্বিক উন্নয়নের জন্য দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি এবং গভীর সমুদ্রে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য বাংলাদেশ এ বিষয়ে ইতোমধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে মীমাংসিত সমুদ্রসীমায় মাছের উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এজন্য বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় দস্যুতা ও বিদেশি ট্রলারের অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এর পাশাপাশি দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে ইলিশ ট্রাস্ট ফান্ড গঠনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
দেশের মৎস্য সম্পদের আহরণ ও উন্নয়নে আয়োজিত এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সামনে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে মাছ চাষ, চিংড়ি চাষিদের এক অংকের সুদে ঋণ, চিংড়ির রেনু পোনা আহরণ বন্ধে দরিদ্র জেলেদের খাদ্য সহায়তা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, হস্তান্তরিত জলমহালগুলো মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে ন্যস্ত করা, হালদা নদী রক্ষায় রবার ড্যাম তুলে ফেলা, মৎস্য উৎপাদনে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিল ও ভূমি উন্নয়ন করে ছাড় দেয়া, মাছের খাবারের উপাদান আমদানিতেও শুল্কছাড়সহ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গঠনমূলক প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী এ বৈঠকে সংশ্লিষ্টদের দ্রুততম সময়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার জটিলতা দূর করার নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি গভীর সমুদ্রে মাছের উৎপাদন বাড়াতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলেছেন। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধির পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ায় জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। কৃষির অন্যান্য খাত-উপখাতের তুলনায় মাছের উৎপাদন বাড়ার হার বেশি। বিগত ১৫- ১৬ বছরে এ খাতে বছরে ১০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী সাগর এলাকায় প্রতি বছর ৮০০ মিলিয়ন টন মাছ ধরা পড়ে। এর মধ্যে মাত্র দশমিক ৭০ মিলিয়ন টন মাছ দেশের জেলেরা ধরে থাকে। বিশাল সমুদ্রসীমায় মৎস্য সম্পদের ১ শতাংশও ধরতে পারছে না বাংলাদেশের জেলেরা উন্নত জাহাজ ও প্রযুক্তির অভাবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় কী পরিমাণ মৎস্য সম্পদ রয়েছে, সে ব্যাপারেও কোন তথ্য সরকারের কাছে নেই। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে অনায়সেই বিলিয়ন ডলার আয় করা যায়। এ ছাড়া মাছের তেল থেকে ওষুধ, সস প্রভৃতি তৈরি করা সম্ভব। এতে নতুন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব। সমুদ্রে যে বিপুল অর্থনৈতিক এলাকা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে সেখানে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য চাই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তোলা। একই সঙ্গে দক্ষ জনবল তৈরির ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। মাছের বাজার নিয়ে দুর্ভাবনা নেই। বলা যায়, গোটা বিশ্বেই মাছের অপরিমেয় চাহিদা রয়েছে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য বিদেশি বিনিয়োগকেও স্বাগত জানাতে হবে।
মায়ানমারের মতো সমুদ্রে মাছ ধরার সব নৌযানকে নিবন্ধনের আওতায় আনা এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে মৎস্য অধিদপ্তর করা উচিত। সামুদ্রিক জেলেদের জন্য ‘সামুদ্রিক মৎষ্য পরামর্শ কেন্দ্র’ চালু করা যায়। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে জেলেরা প্রতিদিন ‘মাছের বসতি’ সম্পর্কে জানতে পারবে। এতে জেলেদের অর্থ ও সময় বাঁচবে। এ কাজে মৎস্য বিজ্ঞানীদের লাগানো যায়।
আধুনিক ট্রলার বা ফ্রিজার ঘণ্টায় এক টনেরও বেশি মাছ ধরতে ও প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম। ভারত, থাইল্যান্ড, মায়ানমারসহ অনেক দেশই এ প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে প্রক্রিয়াজাত করে। উন্নত ট্রলারে থাকা-খাওয়ার সুবিধাও ভালো। এর চেয়ে বড় কথা, এগুলো অনেক নিরাপদ। ফলে এসব দেশের জেলেরা দীর্ঘদিন সমুদ্রে অবস্থান করে মাছ ধরতে পারে। মায়ানমার ও ভারতের সমুদ্র সীমায় স্রোত ও ঢেউ বেশি থাকায় আমাদের জলসীমা থেকে তারা অনেক সময় মাছ ধরে নিয়ে যায়। সামুদ্রিক ঢেউ ও স্রোতের বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) আধুনিক জাহাজ আমদানি করে পিপিপির মাধ্যমে বা কিস্তিতে জেলেদের দিতে পারে। ডাটাবেইস করে সামুদ্রিক মাছ ধরার প্রতিটি নৌকা ও মালিককে সরকারি নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে।
এ ছাড়া মৎস্য আহরণ বাড়াতে সামুদ্রিক নৌযান, ট্রলারগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করে সমুদ্রের সর্বশেষ অবস্থা সব সময় জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। গভীর সমুদ্রে মৎস্য সম্পদ আহরণে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। হংকং, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো কেবলমাত্র সমুদ্রকে ব্যবহার করেই বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়েছে। সমুদ্র শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে। আমাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে অনেক দিন নানা ধরনের বিরোধ ছিল, এখন সে অবস্থা নেই। তারপরেও আমরা কেন আমাদের সমুদ্রসীমায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না, সেটাও বিবেচনার বিষয়। সমুদ্র সম্পদ আহরণ এবং এর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির চেহারাও বদলে দেওয়া সম্ভব। বিশেষ করে আমাদের সমুদ্র সীমায় মৎস্য সম্পদ আহরণে বিরাজমান সমস্যাগুলো অবিলম্বে দূর করা প্রয়োজন। এখনো আমাদের জেলেরা নির্বিঘ্নে-নিশ্চিন্তে গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরতে পারছে না। তাদের জানমাল নানা হুমকির মধ্যে পড়ছে হরহামেশাই। সামগ্রিক বাস্তবতা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। সমুদ্রসম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের ব্যাপারে বিলম্ব করার কোন অবকাশ নেই। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকেও এগিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-বিএফআরআই সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট যে পরিমাণ মাছ উৎপাদিত হয়, তার মধ্যে কার্প, অর্থাৎ রুই জাতীয় মাছ ২১ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় রুই মাছ, ১১ শতাংশ। এরপরে রয়েছে পাঙাশ (১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ), তেলাপিয়া (৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ), কাতলা (পৌনে ৭ শতাংশ) ও সিলভার কার্প (৭ দশমিক ৩ শতাংশ)। গত এক যুগে দেশি ৩৬ প্রজাতির ছোট মাছের চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর ফলে এ সময়ে চাষের মাছ উৎপাদন ৬৭ হাজার মেট্রিক টন থেকে বেড়ে প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দেশে স্বাদু পানির ২৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ৩০টি প্রজাতির চাষ বেশি হচ্ছে। বাকিগুলোর চাষ বাড়লে বাংলাদেশের মাছ উৎপাদন ৫০ লাখ টনে পৌঁছাবে।
আশা করি, আগামী কয়েক বছরে দেশের মাছের উৎপাদন আরও বাড়ানো যাবে। তবে মাছের উৎপাদন ধরে রাখার জন্য নদী ও জলাশয়গুলোকে দূষণমুক্ত করতে হবে বলে মনে করছেন। নদ-নদী দূষণমুক্ত না রাখলে ইলিশের উৎপাদন ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]