নিহতদের স্বজনের আহাজারি

‘আমি যেতে না করেছিলাম তাকে। সে কয়, মা আর তো যাইতে পারবো না। এবার যাইতে দাও এরপর থিকা তুমি যা কইবা সেইটাই শুনবো’ এভাবে বিলাপ করে কাঁদছিলেন তানভীর হাসান হৃদয়ের মা লাকী আক্তার। তিনি তখনো জানেন না তার কলিজার টুকরা ছেলে কেমন আছে। লাকী আক্তার বলেন, ‘হাত-পা যা ভাঙে ভাঙুক আমার ছেলেরে জীবিত আমার কাছে ফিরায় দাও আল্লাহ। আমি অনেক নামাজ পড়মু, রোজা রাখমু, তুমি শুধু আমার হৃদয়রে জীবিত আমার বুকে দিয়া দাও।’ কিন্তু হৃদয় আর মায়ের আকুতি শোনার মতো অবস্থায় নেই। সব কিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছে মায়ের হৃদয় ভেঙেচুড়ে দিয়ে।

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় ট্রেন দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বেলা তিনটা থেকেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভিড় করতে থাকেন বন্ধু-বান্ধব-স্বজনেরা। আশপাশ থেকে যারা দুর্ঘটনার খবর পেয়েছেন তারা ছুটে এসেছেন। যদি কোন কাজে আসতে পারেন। সবাই হতাহত তরুণদের আসার অপেক্ষায়। আর নিহত ব্যক্তির তালিকায় যেন স্বজনের নাম না থাকে, সৃষ্টিকর্তার কাছে সে প্রার্থনাই করছিলেন।

নিহত ১১ জনের মধ্যে আরেকজন ইশাম (১৬)। এসএসসি শেষে কানাডায় মায়ের কাছে ফেরার কথা ছিল ইশামের। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার এস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ইশাম পরীক্ষা দিয়েই কানাডায় মায়ের কাছে চলে যাওয়ার কথা ছিল। তবে মায়ের কোলে আর ফেরা হলো না তার। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে বসে বিলাপ করছিলেন ইশামের চাচা মো. মানিক। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমার ভাইপো ইশাম (মুসহাব আহমেদ) আসছে নাকি? আল্লাহ তাকে কেন ওখানে নিয়ে গেল। আল্লাহ ওকে একটু বাঁচিয়ে রেখো।’ আর বার বার বলছেন, ‘ইশাম, আমি তোর মাকে কী বুঝ দেবো?’

নিহত জিয়াউল হক সজীবের বাবা মো. হামিদ ও ভাই একজন অন্যজনকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছেন। মো. হামিদ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি যাইতে দিতে চাই নাই। আমার মন চায় নাই। ছেলে জেদ করলো, বলে সবাই যাইতেছে। দিনে দিনে ফিরবে বলে ছেলে সকাল ৭টায় বাড়ি থেকে বের হইছে। তার ভাইকে বলে গেছে ‘রাত ১০টা হতে পারে। ম্যানেজ করিস।’ সেই ছেলে আসলো, আমি কি পাপ করছি, আমারে এত বড় শাস্তি কেন দিলা আল্লাহ। আমারে নিয়া নিতা আমার ছেলেরে বাঁচায় রাখতা। আমারে আর ডাকবে না, আমার পাশে বসবে না, কেমনে বাঁচবো এই ছেলেরে ছাড়া।’ কোচিং সেন্টারের শিক্ষক রাকিবের মা পারভিন বেগম বিকেল ৪টার দিকে হাসপাতালে আসেন। কথা বলতে পারছেন না। শুধু খুঁজতে থাকেন ছেলে মোস্তফা মাসুদ রাকিবকে। রাকিবের চাচা সারওয়ার বলেন, তারা কয়েকজন কোচিং সেন্টারটি চালাতেন। লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল রাকিব। ওর মাকে কিভাবে সামলাবো তাই ভাবছি।’

সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক আবদুস শুক্কুরের ছেলে আয়াতও ছিল ওই মাইক্রোবাসে। ছেলেকে খুঁজতে এসে হাসপাতালের সামনেই অজ্ঞান হয়ে যান।

গতকাল দুপুরে মিরসরাই বড়তাকিয়া এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ আরোহী নিহত হন। গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত পাঁচজন। হতাহত ব্যক্তিরা সবাই ‘আরএনজে কোচিং সেন্টার’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষক। এছাড়া মাইক্রোবাসের চালকও আছেন। তাদের বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার খন্দকিয়া এলাকায়। দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

শনিবার, ৩০ জুলাই ২০২২ , ১৫ শ্রাবণ ১৪২৯ ৩০ জিলহজ ১৪৪৩

নিহতদের স্বজনের আহাজারি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

‘আমি যেতে না করেছিলাম তাকে। সে কয়, মা আর তো যাইতে পারবো না। এবার যাইতে দাও এরপর থিকা তুমি যা কইবা সেইটাই শুনবো’ এভাবে বিলাপ করে কাঁদছিলেন তানভীর হাসান হৃদয়ের মা লাকী আক্তার। তিনি তখনো জানেন না তার কলিজার টুকরা ছেলে কেমন আছে। লাকী আক্তার বলেন, ‘হাত-পা যা ভাঙে ভাঙুক আমার ছেলেরে জীবিত আমার কাছে ফিরায় দাও আল্লাহ। আমি অনেক নামাজ পড়মু, রোজা রাখমু, তুমি শুধু আমার হৃদয়রে জীবিত আমার বুকে দিয়া দাও।’ কিন্তু হৃদয় আর মায়ের আকুতি শোনার মতো অবস্থায় নেই। সব কিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছে মায়ের হৃদয় ভেঙেচুড়ে দিয়ে।

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় ট্রেন দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বেলা তিনটা থেকেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভিড় করতে থাকেন বন্ধু-বান্ধব-স্বজনেরা। আশপাশ থেকে যারা দুর্ঘটনার খবর পেয়েছেন তারা ছুটে এসেছেন। যদি কোন কাজে আসতে পারেন। সবাই হতাহত তরুণদের আসার অপেক্ষায়। আর নিহত ব্যক্তির তালিকায় যেন স্বজনের নাম না থাকে, সৃষ্টিকর্তার কাছে সে প্রার্থনাই করছিলেন।

নিহত ১১ জনের মধ্যে আরেকজন ইশাম (১৬)। এসএসসি শেষে কানাডায় মায়ের কাছে ফেরার কথা ছিল ইশামের। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার এস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ইশাম পরীক্ষা দিয়েই কানাডায় মায়ের কাছে চলে যাওয়ার কথা ছিল। তবে মায়ের কোলে আর ফেরা হলো না তার। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে বসে বিলাপ করছিলেন ইশামের চাচা মো. মানিক। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমার ভাইপো ইশাম (মুসহাব আহমেদ) আসছে নাকি? আল্লাহ তাকে কেন ওখানে নিয়ে গেল। আল্লাহ ওকে একটু বাঁচিয়ে রেখো।’ আর বার বার বলছেন, ‘ইশাম, আমি তোর মাকে কী বুঝ দেবো?’

নিহত জিয়াউল হক সজীবের বাবা মো. হামিদ ও ভাই একজন অন্যজনকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছেন। মো. হামিদ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি যাইতে দিতে চাই নাই। আমার মন চায় নাই। ছেলে জেদ করলো, বলে সবাই যাইতেছে। দিনে দিনে ফিরবে বলে ছেলে সকাল ৭টায় বাড়ি থেকে বের হইছে। তার ভাইকে বলে গেছে ‘রাত ১০টা হতে পারে। ম্যানেজ করিস।’ সেই ছেলে আসলো, আমি কি পাপ করছি, আমারে এত বড় শাস্তি কেন দিলা আল্লাহ। আমারে নিয়া নিতা আমার ছেলেরে বাঁচায় রাখতা। আমারে আর ডাকবে না, আমার পাশে বসবে না, কেমনে বাঁচবো এই ছেলেরে ছাড়া।’ কোচিং সেন্টারের শিক্ষক রাকিবের মা পারভিন বেগম বিকেল ৪টার দিকে হাসপাতালে আসেন। কথা বলতে পারছেন না। শুধু খুঁজতে থাকেন ছেলে মোস্তফা মাসুদ রাকিবকে। রাকিবের চাচা সারওয়ার বলেন, তারা কয়েকজন কোচিং সেন্টারটি চালাতেন। লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল রাকিব। ওর মাকে কিভাবে সামলাবো তাই ভাবছি।’

সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক আবদুস শুক্কুরের ছেলে আয়াতও ছিল ওই মাইক্রোবাসে। ছেলেকে খুঁজতে এসে হাসপাতালের সামনেই অজ্ঞান হয়ে যান।

গতকাল দুপুরে মিরসরাই বড়তাকিয়া এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ আরোহী নিহত হন। গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত পাঁচজন। হতাহত ব্যক্তিরা সবাই ‘আরএনজে কোচিং সেন্টার’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষক। এছাড়া মাইক্রোবাসের চালকও আছেন। তাদের বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার খন্দকিয়া এলাকায়। দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।