শুকিয়ে ঠনঠনে জলাশয়, এখন খেতের পাট কৃষকের গলার কাঁটা

পাটের ঐতিহ্য ধরে রাখতে বৃহত্তর যশোরাঞ্চালের নদী-খাল খননের দাবি

গত কয়েক বছর পাটের দাম ছিল বেশ। তাই এ বছরও লাভের আশায় কৃষকেরা বেশি পাটচাষ করেছিলেন। খেতের পাট দেখে হাসি-খুশিতে ছিলেন তারা। ভেবেছিলেন সোনালি আঁশের সেই সোনালি দিন ফিরে এসেছে বুঝি। কিন্তু সেই আশা আজ নিরাশায় পরিণত হতে চলেছে। কেননা আষাঢ় পার হয়ে শ্রাবণের মাঝামাঝি সময়। মাঝে মধ্যে দু-এক পশলা ছাড়া ভারী বৃষ্টির দেখা নেই। গ্রামের খানাখন্দ, ডোবা-নালাসহ পাট পচানো সব ধরনের জলাশয় পানির অভাবে শুকিয়ে ঠনঠনে। এদিকে গত কয়েক দিনের কাঠফাঁটা রোদে খেতের পাট শুকিয়ে যাচ্ছে। পানি নেই তাই কৃষকেরা খেতের পাট কাটতেও পারছেন না। উপায় না পেয়ে কেউ কেউ বাড়ির পুকুরের হাঁটু পানিতে পাট জাগ দিচ্ছেন। আবার অনেকে শ্যালো মেশিনে খানাখন্দের পানি তুলে কাদা পানিতে ডুবিয়ে রাখছেন পাট। যাদের কোন উপায় নেই তারা দূরের গ্রামের জলাশয় ভাড়া নিয়ে পাট পচানোর চেষ্টায় আছেন। এতে তাদের বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন ব্যয়। ফলে এ বছর পাট নিয়ে কোন সুখবর দেখছেন না কৃষকেরা। কৃষকদের ভাষ্য, বৃহত্তর যশোর অঞ্চলেই বেশি পাট চাষ হয়ে থাকে। ফলে সরকারি উদ্যোগে এ অঞ্চলের নদী খালগুলো খনন করা জরুরি।

সরেজমিন কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন মাঠে গেলে দেখা যায়, বেশিরভাগ পাট খেতেই দাঁড়িয়ে আছে। তবে প্রচ- খরায় এ পাটগুলো শুকাতে শুরু করেছে। আবার কোন কোন কৃষক পাট কেটে খানাখন্দের পাশে ফেলে রেখেছেন। তারা বৃষ্টির আশায় চেয়ে আছেন। খানাখন্দে একটু পানি জমলেই সেখানে জাগ দেবেন। তার আগে অনেক পাট শুকিয়ে জ¦ালানিতে পরিণত হচ্ছে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর এক হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু এক হাজার ৫২৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। চাষিরা জানায়, আষাঢ় শেষে শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি সময় এসে গেলেও জলাশয়ে পানি নেই। প্রকৃতির খামখেয়ালি আবহাওয়ায় প্রখর রোদে শুকিয়ে গেছে খাল, বিল, পুকুর, জলাশয় ফেঁটে চৌচির। এতে জমিতে উৎপাদিত পাট কেটে তা পচানো নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। অনেকেই বাড়তি টাকা খরচ করে পুকুর ভাড়া বা শুষ্ক পুকুরে পানি দিয়ে পাট জাগ দিচ্ছেন। এতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ।

উপজেলার মোল্যাডাঙ্গা গ্রামের কৃষক নাইমুল ইসলাম জানান, এ বছর ২ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। প্রতি বছর যেখানে পাট পচাতে দেন, সে স্থানটি শুকিয়ে ফেঁটে চৌচির। তাই বাধ্য হয়ে পুকুরের মাছ বিক্রি করে সেখানে জাগ দিচ্ছেন। খড়িকাডাঙ্গা গ্রামের ইনামুল ইসলাম জানান, তাদের বাড়ির পাশের ডোবায় পানি তুলে বেশ কয়েকজন জাগ দিয়েছেন। মনোহরপুর গ্রামের আতিয়ার রহমান জানান, মোট ২৪ জন পাটচাষি গ্রামের সুলতান মাহামুদের মাঠের একটি ডোবা ভাড়া নিয়ে শ্যালো মেশিনে পানি সেচ দিয়ে সবাই পাট পচাচ্ছেন। এজন্য তাদের জায়গা ভাড়াবাবদ ৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।

ঈশ^রবা গ্রামের পাটচাষি আকিদুল ইসলাম জানান, গতবারের তুলনায় এবার পাটের ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু জলাশয়ে পানির অভাবে পাট জাগ দিতে পারছি না। মাঠে পাট কেটে ফেলে রাখা হয়েছে। রোদে পাট শুকিয়ে যাচ্ছে। ভালো ফলন হলেও পাটের ন্যায্য দাম পাওয়া যাবে না।

অধিকাংশ কৃষকের ভাষ্য, আগের দিনের মতো গ্রামের পতিত জলাশয় নেই বললেই চলে। এগুলো সব ভরাট করে চাষাবাদের উপযোগী হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ বাধ্য হয়ে হাঁটু পানি কাদার মধ্যে ডুবিয়ে পাট পচাচ্ছেন। বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন আর আগের দিনের মােত বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টি হয় না। এদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নদী খালগুলো সব ভরাট হয়ে গেছে। এ অবস্থায় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জসহ পাট উৎপাদনের বিশেষ এলাকা খ্যাত বৃহত্তর যশোরাঞ্চালের সব নদী ও খালগুলো খনন হওয়া জরুরি। এটা করতে পারলেই ফিরে আসবে সোনালি আঁশের সেই সোনালি দিন।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শিকদার মোহায়মেন আক্তার জানান, পাট পচাতে বৃষ্টির পানির কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এ বছর বর্ষা মৌসুমে পানি নেই বললেই চলে। ফলে পাট পচাতে পারছেন না কৃষকেরা। কিন্তু রিবন রেটিং পদ্ধতিতে অল্প পানিতে পাট পচানো যায়। তিনি রিবন পদ্ধতিতে পাট পচানোর পরামর্শ দিচ্ছেন।

শনিবার, ৩০ জুলাই ২০২২ , ১৫ শ্রাবণ ১৪২৯ ৩০ জিলহজ ১৪৪৩

শুকিয়ে ঠনঠনে জলাশয়, এখন খেতের পাট কৃষকের গলার কাঁটা

পাটের ঐতিহ্য ধরে রাখতে বৃহত্তর যশোরাঞ্চালের নদী-খাল খননের দাবি

সাবজাল হোসেন, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ)

image

কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) : পানি নেই, শুকিয়ে যাচ্ছে পাট ডোবা জলাশয়ে ৫ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে গ্রামের ২৪ কৃষক পাট পঁচাচ্ছেন -সংবাদ

গত কয়েক বছর পাটের দাম ছিল বেশ। তাই এ বছরও লাভের আশায় কৃষকেরা বেশি পাটচাষ করেছিলেন। খেতের পাট দেখে হাসি-খুশিতে ছিলেন তারা। ভেবেছিলেন সোনালি আঁশের সেই সোনালি দিন ফিরে এসেছে বুঝি। কিন্তু সেই আশা আজ নিরাশায় পরিণত হতে চলেছে। কেননা আষাঢ় পার হয়ে শ্রাবণের মাঝামাঝি সময়। মাঝে মধ্যে দু-এক পশলা ছাড়া ভারী বৃষ্টির দেখা নেই। গ্রামের খানাখন্দ, ডোবা-নালাসহ পাট পচানো সব ধরনের জলাশয় পানির অভাবে শুকিয়ে ঠনঠনে। এদিকে গত কয়েক দিনের কাঠফাঁটা রোদে খেতের পাট শুকিয়ে যাচ্ছে। পানি নেই তাই কৃষকেরা খেতের পাট কাটতেও পারছেন না। উপায় না পেয়ে কেউ কেউ বাড়ির পুকুরের হাঁটু পানিতে পাট জাগ দিচ্ছেন। আবার অনেকে শ্যালো মেশিনে খানাখন্দের পানি তুলে কাদা পানিতে ডুবিয়ে রাখছেন পাট। যাদের কোন উপায় নেই তারা দূরের গ্রামের জলাশয় ভাড়া নিয়ে পাট পচানোর চেষ্টায় আছেন। এতে তাদের বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন ব্যয়। ফলে এ বছর পাট নিয়ে কোন সুখবর দেখছেন না কৃষকেরা। কৃষকদের ভাষ্য, বৃহত্তর যশোর অঞ্চলেই বেশি পাট চাষ হয়ে থাকে। ফলে সরকারি উদ্যোগে এ অঞ্চলের নদী খালগুলো খনন করা জরুরি।

সরেজমিন কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন মাঠে গেলে দেখা যায়, বেশিরভাগ পাট খেতেই দাঁড়িয়ে আছে। তবে প্রচ- খরায় এ পাটগুলো শুকাতে শুরু করেছে। আবার কোন কোন কৃষক পাট কেটে খানাখন্দের পাশে ফেলে রেখেছেন। তারা বৃষ্টির আশায় চেয়ে আছেন। খানাখন্দে একটু পানি জমলেই সেখানে জাগ দেবেন। তার আগে অনেক পাট শুকিয়ে জ¦ালানিতে পরিণত হচ্ছে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর এক হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু এক হাজার ৫২৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। চাষিরা জানায়, আষাঢ় শেষে শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি সময় এসে গেলেও জলাশয়ে পানি নেই। প্রকৃতির খামখেয়ালি আবহাওয়ায় প্রখর রোদে শুকিয়ে গেছে খাল, বিল, পুকুর, জলাশয় ফেঁটে চৌচির। এতে জমিতে উৎপাদিত পাট কেটে তা পচানো নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। অনেকেই বাড়তি টাকা খরচ করে পুকুর ভাড়া বা শুষ্ক পুকুরে পানি দিয়ে পাট জাগ দিচ্ছেন। এতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ।

উপজেলার মোল্যাডাঙ্গা গ্রামের কৃষক নাইমুল ইসলাম জানান, এ বছর ২ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। প্রতি বছর যেখানে পাট পচাতে দেন, সে স্থানটি শুকিয়ে ফেঁটে চৌচির। তাই বাধ্য হয়ে পুকুরের মাছ বিক্রি করে সেখানে জাগ দিচ্ছেন। খড়িকাডাঙ্গা গ্রামের ইনামুল ইসলাম জানান, তাদের বাড়ির পাশের ডোবায় পানি তুলে বেশ কয়েকজন জাগ দিয়েছেন। মনোহরপুর গ্রামের আতিয়ার রহমান জানান, মোট ২৪ জন পাটচাষি গ্রামের সুলতান মাহামুদের মাঠের একটি ডোবা ভাড়া নিয়ে শ্যালো মেশিনে পানি সেচ দিয়ে সবাই পাট পচাচ্ছেন। এজন্য তাদের জায়গা ভাড়াবাবদ ৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।

ঈশ^রবা গ্রামের পাটচাষি আকিদুল ইসলাম জানান, গতবারের তুলনায় এবার পাটের ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু জলাশয়ে পানির অভাবে পাট জাগ দিতে পারছি না। মাঠে পাট কেটে ফেলে রাখা হয়েছে। রোদে পাট শুকিয়ে যাচ্ছে। ভালো ফলন হলেও পাটের ন্যায্য দাম পাওয়া যাবে না।

অধিকাংশ কৃষকের ভাষ্য, আগের দিনের মতো গ্রামের পতিত জলাশয় নেই বললেই চলে। এগুলো সব ভরাট করে চাষাবাদের উপযোগী হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ বাধ্য হয়ে হাঁটু পানি কাদার মধ্যে ডুবিয়ে পাট পচাচ্ছেন। বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন আর আগের দিনের মােত বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টি হয় না। এদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নদী খালগুলো সব ভরাট হয়ে গেছে। এ অবস্থায় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জসহ পাট উৎপাদনের বিশেষ এলাকা খ্যাত বৃহত্তর যশোরাঞ্চালের সব নদী ও খালগুলো খনন হওয়া জরুরি। এটা করতে পারলেই ফিরে আসবে সোনালি আঁশের সেই সোনালি দিন।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শিকদার মোহায়মেন আক্তার জানান, পাট পচাতে বৃষ্টির পানির কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এ বছর বর্ষা মৌসুমে পানি নেই বললেই চলে। ফলে পাট পচাতে পারছেন না কৃষকেরা। কিন্তু রিবন রেটিং পদ্ধতিতে অল্প পানিতে পাট পচানো যায়। তিনি রিবন পদ্ধতিতে পাট পচানোর পরামর্শ দিচ্ছেন।