১১ লাশ হস্তান্তর, চারদিকে কান্নার রোল, স্তব্ধ গোটা গ্রাম

একসঙ্গে এত মৃত্যু দেখেনি খন্দকিয়া গ্রামবাসী

স্তব্ধ গোটা গ্রাম। লাশের গাড়ি দেখার সঙ্গে সঙ্গে খন্দকিয়া গ্রামে কান্নার রোল। একসঙ্গে এত মৃত্যু এলাকার মানুষ আগে কখনোই দেখেনি। হৃদয়বিদারক সেই দৃশ্য বাবা কাঁদছেন, মা-ভাই বোনরা কাঁদছে, পুরো গ্রাম কাঁদছে।

গতকাল সকাল পৌঁনে ১০টার দিকে হাটহাজারী উপজেলার খন্দকিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায় হৃদয়বিদারক দৃশ্য। দুর্ঘটনায় নিহত কোচিং সেন্টারের শিক্ষক জিয়াউল হক সজীবের লাশ জানাজার জন্য খাটে তোলার সময় শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েন তার মা শাহনাজ আক্তার। কাঁদেন বাবা আবদুল হামিদ ও বোন শারমিন আক্তার। তারা কিছুতেই লাশ নিতে দেবেন না। স্বজনদের শত অনুরোধেও থামেনি তাদের বুকফাটা কান্না। অন্যদিকে মাইক্রোবাস চালক গোলাম মোস্তাফার মৃতদেহ দেখে বাবা বাবা বলে চিৎকার করে কাঁদছিল তার তিন বছরের শিশুকন্যা। অ্যাম্বুলেন্স থেকে মোস্তাফার লাশ খাটিয়ায় তোলার সময় বাবাকে এমন অবস্থায় দেখে স্বজনের কোলে থাকা মোস্তাফার মেয়ে শোকে ভেঙে পড়ে।

গতকাল সকাল ১০টায় স্থানীয় ছমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা হয় জিয়াউল হক সজীবের। একই জানাজায় মাইক্রোবাসের চালক গোলাম মোস্তাফাসহ শিক্ষার্থী সামিরুল ইসলাম হাসান, রিদুয়ান চৌধুরী ও ইকবাল হোসেন মারুফের জানাজা হয়। পরে তাদের স্থানীয় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এরপর সকাল সাড়ে ১০টায় খন্দকিয়া কেএস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী মোসহাব আহমেদ হিসামের জানাজা হয়। এছাড়া শিকারপুর ইউনিয়নে মোস্তাফা মাসুদ রাকিব ও ফতেপুর ইউনিয়নে মো. আসিফের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

গত শুক্রবার রাতেই ১১ লাশ হাটহাজারী চিকনদন্ডী ইউনিয়নে খন্দাকিয়া গ্রামে এসে পৌঁছায়। ছমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে সাজ্জাদ হোসেনের জানাজা শেষে গ্রামের বাড়ি দক্ষিণ মাদ্রাসায় ২য় দফা জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় এবং আলম কোম্পানির বাড়িতে ওয়াহিদুল আলম জিসানের জানাজা শেষে তাকেও স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। দুর্ঘটনায় নিহত শান্ত শীলকে ধলই ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামে তার মামার বাড়িতে সৎকার করা হয়।

নিহতদের স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম রেলওয়ের জিআরপি থানা থেকে নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, মীরসরাই দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টারের চার শিক্ষক জিয়াউল হক সজীব (২২), মোস্তাফা মাসুদ রাকিব (১৯), রিদুয়ান চৌধুরী (২২) ও ওয়াহিদুল আলম জিসান (২৩) এবং কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থী সামিরুল ইসলাম হাসান (১৭), মোসাহাব আহমেদ হিসাম (১৬), ইকবাল হোসেন মারুফ (১৭), শান্ত শীল (১৭), সাজ্জাদ হোসেন (২৩), মো. আসিফ (১৮) এবং মাইক্রোবাসের চালক গোলাম মোস্তাফা (২৬)।

সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুর ইসলাম মাহমুদ, হাটহাজারী দারুল উলুম মুইনুল ইসলাম মাদ্রাসার মহাপরিচালক মাওলানা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক এমএ সালাম, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ইবরাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন শাহ, সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক ইউনুস গনি চৌধুরী, হাটহাজারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এসএম রাশেদুল আলমসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারা এবং নিহতদের স্কুলের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী ও বন্ধুরা জানাজায় অংশ নেন।

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ শাহিদুল আলম জানান, দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেক পরিবারকে দাফন-কাফনের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে নগদ ২৫ হাজার টাকা এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের জন্য নগদ ১৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে।

উল্লেখ্য, হাটহাজারী উপজেলার চিকনদন্ডী ইউনিয়নের যুগীরহাট বাজারের শেখ ফরিদ মার্কেটে আরএনজে নামে একটি কোচিং সেন্টারে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু তরুণ ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণী এবং এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কোচিং করান। কোচিং সেন্টারের শিক্ষকেরা গত শুক্রবার এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নিয়ে মাইক্রোবাসযোগে মীরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ঝরনা পর্যটনকেন্দ্র দেখতে যান। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে মীরসরাইয়ের বড়তাকিয়া রেলক্রসিং অতিক্রম করার সময় মহানগর প্রভাতী ট্রেনের ধাক্কায় শিক্ষক-শিক্ষার্র্থী বহনকারী গাড়িটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এ সময় গাড়িতে থাকা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও চালকসহ ১১ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়।

রবিবার, ৩১ জুলাই ২০২২ , ১৬ শ্রাবণ ১৪২৯ ১ মহররম ১৪৪৪

১১ লাশ হস্তান্তর, চারদিকে কান্নার রোল, স্তব্ধ গোটা গ্রাম

একসঙ্গে এত মৃত্যু দেখেনি খন্দকিয়া গ্রামবাসী

জিয়া চৌধুরী, হাটহাজারী (চট্টগ্রাম)

image

হাটহাজারী চিকনদন্ডী ইউনিয়নের খন্দকিয়া গ্রামে স্বজনের হাতে লাশ হস্তান্তর -সংবাদ

স্তব্ধ গোটা গ্রাম। লাশের গাড়ি দেখার সঙ্গে সঙ্গে খন্দকিয়া গ্রামে কান্নার রোল। একসঙ্গে এত মৃত্যু এলাকার মানুষ আগে কখনোই দেখেনি। হৃদয়বিদারক সেই দৃশ্য বাবা কাঁদছেন, মা-ভাই বোনরা কাঁদছে, পুরো গ্রাম কাঁদছে।

গতকাল সকাল পৌঁনে ১০টার দিকে হাটহাজারী উপজেলার খন্দকিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায় হৃদয়বিদারক দৃশ্য। দুর্ঘটনায় নিহত কোচিং সেন্টারের শিক্ষক জিয়াউল হক সজীবের লাশ জানাজার জন্য খাটে তোলার সময় শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েন তার মা শাহনাজ আক্তার। কাঁদেন বাবা আবদুল হামিদ ও বোন শারমিন আক্তার। তারা কিছুতেই লাশ নিতে দেবেন না। স্বজনদের শত অনুরোধেও থামেনি তাদের বুকফাটা কান্না। অন্যদিকে মাইক্রোবাস চালক গোলাম মোস্তাফার মৃতদেহ দেখে বাবা বাবা বলে চিৎকার করে কাঁদছিল তার তিন বছরের শিশুকন্যা। অ্যাম্বুলেন্স থেকে মোস্তাফার লাশ খাটিয়ায় তোলার সময় বাবাকে এমন অবস্থায় দেখে স্বজনের কোলে থাকা মোস্তাফার মেয়ে শোকে ভেঙে পড়ে।

গতকাল সকাল ১০টায় স্থানীয় ছমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা হয় জিয়াউল হক সজীবের। একই জানাজায় মাইক্রোবাসের চালক গোলাম মোস্তাফাসহ শিক্ষার্থী সামিরুল ইসলাম হাসান, রিদুয়ান চৌধুরী ও ইকবাল হোসেন মারুফের জানাজা হয়। পরে তাদের স্থানীয় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এরপর সকাল সাড়ে ১০টায় খন্দকিয়া কেএস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী মোসহাব আহমেদ হিসামের জানাজা হয়। এছাড়া শিকারপুর ইউনিয়নে মোস্তাফা মাসুদ রাকিব ও ফতেপুর ইউনিয়নে মো. আসিফের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

গত শুক্রবার রাতেই ১১ লাশ হাটহাজারী চিকনদন্ডী ইউনিয়নে খন্দাকিয়া গ্রামে এসে পৌঁছায়। ছমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে সাজ্জাদ হোসেনের জানাজা শেষে গ্রামের বাড়ি দক্ষিণ মাদ্রাসায় ২য় দফা জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় এবং আলম কোম্পানির বাড়িতে ওয়াহিদুল আলম জিসানের জানাজা শেষে তাকেও স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। দুর্ঘটনায় নিহত শান্ত শীলকে ধলই ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামে তার মামার বাড়িতে সৎকার করা হয়।

নিহতদের স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম রেলওয়ের জিআরপি থানা থেকে নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, মীরসরাই দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টারের চার শিক্ষক জিয়াউল হক সজীব (২২), মোস্তাফা মাসুদ রাকিব (১৯), রিদুয়ান চৌধুরী (২২) ও ওয়াহিদুল আলম জিসান (২৩) এবং কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থী সামিরুল ইসলাম হাসান (১৭), মোসাহাব আহমেদ হিসাম (১৬), ইকবাল হোসেন মারুফ (১৭), শান্ত শীল (১৭), সাজ্জাদ হোসেন (২৩), মো. আসিফ (১৮) এবং মাইক্রোবাসের চালক গোলাম মোস্তাফা (২৬)।

সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুর ইসলাম মাহমুদ, হাটহাজারী দারুল উলুম মুইনুল ইসলাম মাদ্রাসার মহাপরিচালক মাওলানা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক এমএ সালাম, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ইবরাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন শাহ, সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক ইউনুস গনি চৌধুরী, হাটহাজারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এসএম রাশেদুল আলমসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারা এবং নিহতদের স্কুলের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী ও বন্ধুরা জানাজায় অংশ নেন।

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ শাহিদুল আলম জানান, দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেক পরিবারকে দাফন-কাফনের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে নগদ ২৫ হাজার টাকা এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের জন্য নগদ ১৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে।

উল্লেখ্য, হাটহাজারী উপজেলার চিকনদন্ডী ইউনিয়নের যুগীরহাট বাজারের শেখ ফরিদ মার্কেটে আরএনজে নামে একটি কোচিং সেন্টারে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু তরুণ ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণী এবং এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কোচিং করান। কোচিং সেন্টারের শিক্ষকেরা গত শুক্রবার এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নিয়ে মাইক্রোবাসযোগে মীরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ঝরনা পর্যটনকেন্দ্র দেখতে যান। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে মীরসরাইয়ের বড়তাকিয়া রেলক্রসিং অতিক্রম করার সময় মহানগর প্রভাতী ট্রেনের ধাক্কায় শিক্ষক-শিক্ষার্র্থী বহনকারী গাড়িটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এ সময় গাড়িতে থাকা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও চালকসহ ১১ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়।