লোহাগড়া ছাড়াও জুলাইয়ে আরও ছয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা

নড়াইলের লোহাগড়া ছাড়াও জুলাই মাসে আরও ছয়টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া জুলাই মাসের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা বন্দুকযুদ্ধে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন ও হয়রানি অনেকাংশে বেড়েছে, কারা হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে গণপিটুনির মতো আইন হাতে তুলে নেয়ার ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতায় হত্যার মতো ঘটনা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাধারণ নাগরিকদের বস্তুনিষ্ঠ ও স্বাধীন চিন্তা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং মতামত প্রকাশের সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মতো ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। সীমান্তে হতাহতের ঘটনাও বন্ধ হয়নি।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ ঘটনাগুলো ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় এমএসএফ গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এসব ঘটনা রোধে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে।

গতকাল এমএসএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনটি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। সংবাদসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া প্রায় প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই স্থানীয় হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারদের মাধ্যমে ভেরিফাই করা হয়েছে।

এমএসএফের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালের জুলাই মাসে সবচেয়ে উদ্বেগজনক যে ঘটনা ঘটেছে তা হলোÑ ১৮ জুলাই রাতে নড়াইলের লোহাগড়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকের একটি পোস্টে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ তুলে নড়াইলের লোহাগড়ায় হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তিনটি বসতবাড়ি ও ছয়টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা। একই সঙ্গে কয়েকটি মন্দিরে হামলা করে চারটি মন্দির ভাঙচুর করাসহ একটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এছাড়া চারটি বাড়িঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর করে টাকাসহ স্বর্ণালঙ্কার লুট করার অভিযোগও উঠেছে।

এই হামলা ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ প্রশাসন কর্তৃক যথাযথ ভূমিকা না নেয়া বিষয়টিকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা নির্যাতন এ সময়ে একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত কয়েক দশক ধরে একই কায়দায় স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালিয়ে আসছে। একইভাবে বিচারহীনতার কারণে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ একপর্যায়ে শটগান দিয়ে ফাঁকা গুলি করে কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে কাউকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানা যায়নি।

এমএসএফ মনে করে, যেসব চক্র এ ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে সহিংসতার ঘটনা ঘটলেই একে অন্যকে দোষারোপ করে মূল অপরাধীদের প্রকারান্তরে দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়; যার ফলে প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করা যায় না। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে আজঅবধি কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। হিন্দু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থতাতেই ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী একের পর এক সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে আরও ছয়টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে পাহাড়িদের ২৩টি ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে নয়ন কুমার সরকার (২২) নামের আলাউদ্দিন আহমেদ ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রকে মুসলিম এক মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের জের ধরে কৌশলে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ১৩ জুলাই বান্দরবানের লামা উপজেলায় আদিবাসী ভূমি রক্ষা আন্দোলনের সংগঠক রংধজন ত্রিপুরার ওপর হামলা করা হয়।

৪ জুলাই গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার তালুককানুপুর ইউনিয়নের দামোদরপুরের হিন্দুপাড়া গ্রামে এক রাতে চারটি পারিবারিক পূজা মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় হাতেনাতে অভিযুক্ত আরিফুল ইসলাম নামে এক যুবককে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। ১৩ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আবুল খায়ের বকশী নামের এক ব্যক্তির নেতৃত্বে ২৫-৩০ জনের একটি দল উপজেলার বানাইল ইউনিয়নের ভূষুণ্ডি গ্রামের রথখোলা মন্দিরের কালীমূর্তি, সরস্বতীর মূর্তি ও রাধাকৃষ্ণের মূর্তি ভাঙচুর করে। এছাড়া মন্দিরের সীমানার ৫০-৬০টি ফলদ গাছও কেটে ফেলে।

২ জুলাই বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের ঢাকা মহানগর (উত্তর) সাধারণ সম্পাদক অখিল চন্দ্র মণ্ডলকে হত্যার হুমকি দেয় স্থানীয় জনৈক নেতা হুমায়ুন কবির নীরু গ্যাংয়ের সদস্যরা। তিনি মন্দিরের কক্ষ দখল করে ডেকোরেটরের মালামাল রাখার প্রতিবাদ করেছিলেন। আনুমানিক রাত ৮টা নাগাদ অখিল মণ্ডলের মীরপুর-পীরেরবাগ এলাকায় তিন যুবক বাসায় ঢুকে তার স্ত্রীর কাছে অখিলকে হত্যার হুমকি দেয়।

২৩ মার্চ রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সেচের পানি না পেয়ে আত্মহত্যা করা সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মারানডি ও তার চাচাতো ভাই রবি মারানডির পরিবারের সদস্যরা এখনও আতঙ্কে আছেন। বাইরে থেকে কেউ খোঁজখবর নিতে গেলে ভয়ে তারা কথা বলতে পারেন না। বাইরের লোকজন দেখলে তারা বাড়ি ছেড়েই পালিয়ে যান। প্রভাবশালী মহলের চাপ থাকার কারণে কোন সামাজিক সহায়তা গ্রহণ করতে পারেন না।

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা

এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে দেশে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা যেমনÑ ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, হত্যা, আত্মহত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বিগত মাসগুলোর মতোই অব্যাহত রয়েছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

তথ্য অনুযায়ী এ মাসে ৩৫৪টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৫৯টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৬টি, ধর্ষণ ও হত্যা ২টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩ জন ও গণধর্ষণের শিকার ২ জন প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরী।

উল্লেখ্য, ধর্ষণের শিকার ৫৯ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ২৬ জন কিশোরী রয়েছে, অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ জন শিশু ও ৭ জন কিশোরী এবং ধর্ষণ ও হত্যার শিকার ২ জন শিশু। ধর্ষণের চেষ্টা ২২টি, যৌন হয়রানি ২৮টি ও শারীরিক নির্যাতনের ৪৪টি ঘটনা ঘটেছে। এ সময় একজন শিশু, ২৮ জন কিশোরী ও ৩৯ জন নারীসহ মোট ৬৮ জন আত্মহত্যা করেছে। এদের মধ্যে দুইজন প্রতিবন্ধী নারী রয়েছে। অ্যাসিড নিক্ষেপে আক্রান্ত হয়েছেন একজন নারী।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গোলাগুলি

দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন একজন, গুলিবিদ্ধ হন একজন ও আহত হয়েছেন র‌্যাবের দুই সদস্য।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও ছিনতাই এবং হয়রানির অভিযোগ

তথ্য অনুযায়ী, এ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাছাড়া পুলিশের কিছু সদস্যের অশোভন আচরণ, নির্যাতন ও ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনার আপোষ করা এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

কারা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু

এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে কারা হেফাজতে ২ জনের মৃত্যু হয় যা গত মাসের তুলনায় কমলেও উদ্বেগজনক। এছাড়া কারাগারে নির্যাতন ও বিনা অপরাধে কারাগারে আটকের অভিযোগ উঠেছে। এমএসএফ মনে করে, কারাগারের অভ্যন্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি, হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনাগুলো সঠিকভাবে তদন্ত করা জরুরি।

নির্বাচনী ও রাজনৈতিক সহিংসতা

রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকারদলীয় ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, নির্বাচন ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহিংসতা, হানাহানি হতাহতের ঘটনাসহ নাগরিক জীবনে উৎকণ্ঠা বেড়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যকার সংঘাত-সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিকার। ফলে হতাহতের ঘটনা ঘটেই চলেছে।

এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে নির্বাচনী ও রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৭টি ঘটনায় শিশুসহ মারা গেছে ৫ জন এবং আহত হয়েছেন ২৬৬ জন। নির্বাচনী সহিংসতায় ২ জন এবং ৩ জন রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেছে।

সীমান্তে হতাহত ও অনুপ্রবেশ

জুলাই মাসে ৩টি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে উভয় পক্ষের সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক আটক বা বাধা প্রদানের ঘটনা ঘটেছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার/অপব্যবহার

তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ৩ জন বিরোধী দল বিএনপির নেতা ও নেত্রী ও ২ জন দম্পতিসহ মোট ৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৬টি মামলা করা হয়েছে এবং একটি মামলার আবেদন করা হয়েছে।

সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশে হামলা

জুলাই মাসে ১২ ঘটনায় একজন সাংবাদিকের মরদেহ, একজন মহিলা সাংবাদিকের ঝুলন্ত লাশ, ২ জন সাংবাদিককে প্রাণনাশের হুমকি, ৫ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধাগ্রস্ত করা ও হয়রানি করা হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে মারধরের হুমকিসহ তাদের বাসাবাড়ি এবং মোটরসাইকেল ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে যেভাবে বাধা দেয়া হচ্ছে এবং তাদের যেভাবে হয়রানি ও শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে তা শুধুমাত্র অনাকাক্সিক্ষতই নয় বরং বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করার শামিল।

গণপিটুনি

জুলাই মাসের অন্যতম একটি উদ্বেগজনক বিষয় ছিল গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনা। প্রচলিত আইন অবজ্ঞা করে গণপিটুনি ঘটনাগুলোকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে এমএসএফ মনে করে। এমএসএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ মাসে অন্তত ১৬টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ৭ জন নিহত ও ৯ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। চুরি বা ডাকাতি বা পরকীয়া সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছে।

সোমবার, ০১ আগস্ট ২০২২ , ১৭ শ্রাবণ ১৪২৯ ২ মহররম ১৪৪৪

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন

লোহাগড়া ছাড়াও জুলাইয়ে আরও ছয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

নড়াইলের লোহাগড়া ছাড়াও জুলাই মাসে আরও ছয়টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া জুলাই মাসের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা বন্দুকযুদ্ধে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন ও হয়রানি অনেকাংশে বেড়েছে, কারা হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে গণপিটুনির মতো আইন হাতে তুলে নেয়ার ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতায় হত্যার মতো ঘটনা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাধারণ নাগরিকদের বস্তুনিষ্ঠ ও স্বাধীন চিন্তা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং মতামত প্রকাশের সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মতো ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। সীমান্তে হতাহতের ঘটনাও বন্ধ হয়নি।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ ঘটনাগুলো ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় এমএসএফ গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এসব ঘটনা রোধে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে।

গতকাল এমএসএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনটি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। সংবাদসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া প্রায় প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই স্থানীয় হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারদের মাধ্যমে ভেরিফাই করা হয়েছে।

এমএসএফের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালের জুলাই মাসে সবচেয়ে উদ্বেগজনক যে ঘটনা ঘটেছে তা হলোÑ ১৮ জুলাই রাতে নড়াইলের লোহাগড়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকের একটি পোস্টে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ তুলে নড়াইলের লোহাগড়ায় হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তিনটি বসতবাড়ি ও ছয়টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা। একই সঙ্গে কয়েকটি মন্দিরে হামলা করে চারটি মন্দির ভাঙচুর করাসহ একটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এছাড়া চারটি বাড়িঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর করে টাকাসহ স্বর্ণালঙ্কার লুট করার অভিযোগও উঠেছে।

এই হামলা ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ প্রশাসন কর্তৃক যথাযথ ভূমিকা না নেয়া বিষয়টিকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা নির্যাতন এ সময়ে একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত কয়েক দশক ধরে একই কায়দায় স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালিয়ে আসছে। একইভাবে বিচারহীনতার কারণে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ একপর্যায়ে শটগান দিয়ে ফাঁকা গুলি করে কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে কাউকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানা যায়নি।

এমএসএফ মনে করে, যেসব চক্র এ ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে সহিংসতার ঘটনা ঘটলেই একে অন্যকে দোষারোপ করে মূল অপরাধীদের প্রকারান্তরে দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়; যার ফলে প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করা যায় না। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে আজঅবধি কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। হিন্দু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থতাতেই ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী একের পর এক সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে আরও ছয়টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে পাহাড়িদের ২৩টি ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে নয়ন কুমার সরকার (২২) নামের আলাউদ্দিন আহমেদ ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রকে মুসলিম এক মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের জের ধরে কৌশলে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ১৩ জুলাই বান্দরবানের লামা উপজেলায় আদিবাসী ভূমি রক্ষা আন্দোলনের সংগঠক রংধজন ত্রিপুরার ওপর হামলা করা হয়।

৪ জুলাই গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার তালুককানুপুর ইউনিয়নের দামোদরপুরের হিন্দুপাড়া গ্রামে এক রাতে চারটি পারিবারিক পূজা মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় হাতেনাতে অভিযুক্ত আরিফুল ইসলাম নামে এক যুবককে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। ১৩ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আবুল খায়ের বকশী নামের এক ব্যক্তির নেতৃত্বে ২৫-৩০ জনের একটি দল উপজেলার বানাইল ইউনিয়নের ভূষুণ্ডি গ্রামের রথখোলা মন্দিরের কালীমূর্তি, সরস্বতীর মূর্তি ও রাধাকৃষ্ণের মূর্তি ভাঙচুর করে। এছাড়া মন্দিরের সীমানার ৫০-৬০টি ফলদ গাছও কেটে ফেলে।

২ জুলাই বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের ঢাকা মহানগর (উত্তর) সাধারণ সম্পাদক অখিল চন্দ্র মণ্ডলকে হত্যার হুমকি দেয় স্থানীয় জনৈক নেতা হুমায়ুন কবির নীরু গ্যাংয়ের সদস্যরা। তিনি মন্দিরের কক্ষ দখল করে ডেকোরেটরের মালামাল রাখার প্রতিবাদ করেছিলেন। আনুমানিক রাত ৮টা নাগাদ অখিল মণ্ডলের মীরপুর-পীরেরবাগ এলাকায় তিন যুবক বাসায় ঢুকে তার স্ত্রীর কাছে অখিলকে হত্যার হুমকি দেয়।

২৩ মার্চ রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সেচের পানি না পেয়ে আত্মহত্যা করা সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মারানডি ও তার চাচাতো ভাই রবি মারানডির পরিবারের সদস্যরা এখনও আতঙ্কে আছেন। বাইরে থেকে কেউ খোঁজখবর নিতে গেলে ভয়ে তারা কথা বলতে পারেন না। বাইরের লোকজন দেখলে তারা বাড়ি ছেড়েই পালিয়ে যান। প্রভাবশালী মহলের চাপ থাকার কারণে কোন সামাজিক সহায়তা গ্রহণ করতে পারেন না।

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা

এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে দেশে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা যেমনÑ ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, হত্যা, আত্মহত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বিগত মাসগুলোর মতোই অব্যাহত রয়েছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

তথ্য অনুযায়ী এ মাসে ৩৫৪টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৫৯টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৬টি, ধর্ষণ ও হত্যা ২টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩ জন ও গণধর্ষণের শিকার ২ জন প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরী।

উল্লেখ্য, ধর্ষণের শিকার ৫৯ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ২৬ জন কিশোরী রয়েছে, অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ জন শিশু ও ৭ জন কিশোরী এবং ধর্ষণ ও হত্যার শিকার ২ জন শিশু। ধর্ষণের চেষ্টা ২২টি, যৌন হয়রানি ২৮টি ও শারীরিক নির্যাতনের ৪৪টি ঘটনা ঘটেছে। এ সময় একজন শিশু, ২৮ জন কিশোরী ও ৩৯ জন নারীসহ মোট ৬৮ জন আত্মহত্যা করেছে। এদের মধ্যে দুইজন প্রতিবন্ধী নারী রয়েছে। অ্যাসিড নিক্ষেপে আক্রান্ত হয়েছেন একজন নারী।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গোলাগুলি

দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন একজন, গুলিবিদ্ধ হন একজন ও আহত হয়েছেন র‌্যাবের দুই সদস্য।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও ছিনতাই এবং হয়রানির অভিযোগ

তথ্য অনুযায়ী, এ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাছাড়া পুলিশের কিছু সদস্যের অশোভন আচরণ, নির্যাতন ও ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনার আপোষ করা এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

কারা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু

এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে কারা হেফাজতে ২ জনের মৃত্যু হয় যা গত মাসের তুলনায় কমলেও উদ্বেগজনক। এছাড়া কারাগারে নির্যাতন ও বিনা অপরাধে কারাগারে আটকের অভিযোগ উঠেছে। এমএসএফ মনে করে, কারাগারের অভ্যন্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি, হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনাগুলো সঠিকভাবে তদন্ত করা জরুরি।

নির্বাচনী ও রাজনৈতিক সহিংসতা

রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকারদলীয় ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, নির্বাচন ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহিংসতা, হানাহানি হতাহতের ঘটনাসহ নাগরিক জীবনে উৎকণ্ঠা বেড়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যকার সংঘাত-সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিকার। ফলে হতাহতের ঘটনা ঘটেই চলেছে।

এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে নির্বাচনী ও রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৭টি ঘটনায় শিশুসহ মারা গেছে ৫ জন এবং আহত হয়েছেন ২৬৬ জন। নির্বাচনী সহিংসতায় ২ জন এবং ৩ জন রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেছে।

সীমান্তে হতাহত ও অনুপ্রবেশ

জুলাই মাসে ৩টি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে উভয় পক্ষের সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক আটক বা বাধা প্রদানের ঘটনা ঘটেছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার/অপব্যবহার

তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ৩ জন বিরোধী দল বিএনপির নেতা ও নেত্রী ও ২ জন দম্পতিসহ মোট ৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৬টি মামলা করা হয়েছে এবং একটি মামলার আবেদন করা হয়েছে।

সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশে হামলা

জুলাই মাসে ১২ ঘটনায় একজন সাংবাদিকের মরদেহ, একজন মহিলা সাংবাদিকের ঝুলন্ত লাশ, ২ জন সাংবাদিককে প্রাণনাশের হুমকি, ৫ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধাগ্রস্ত করা ও হয়রানি করা হয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে মারধরের হুমকিসহ তাদের বাসাবাড়ি এবং মোটরসাইকেল ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে যেভাবে বাধা দেয়া হচ্ছে এবং তাদের যেভাবে হয়রানি ও শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে তা শুধুমাত্র অনাকাক্সিক্ষতই নয় বরং বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করার শামিল।

গণপিটুনি

জুলাই মাসের অন্যতম একটি উদ্বেগজনক বিষয় ছিল গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনা। প্রচলিত আইন অবজ্ঞা করে গণপিটুনি ঘটনাগুলোকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে এমএসএফ মনে করে। এমএসএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ মাসে অন্তত ১৬টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ৭ জন নিহত ও ৯ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। চুরি বা ডাকাতি বা পরকীয়া সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছে।