অর্থনীতির সংকট কাটবে কীভাবে?

রেজাউল করিম খোকন

গত ১৩-১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। রাজস্ব আয়ে ঘাটতির পাশাপাশি নতুন করে যোগ হয়েছে বিশ্ব সংকট। বিশেষ করে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স আয়ে ঘাটতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে। টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অসহনীয় হয়ে উঠছে জিনিসপত্রের দাম। মনে হচ্ছে, আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও বেসামাল হয়ে উঠবে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

বর্তমানে করোনা উত্তরণের কথা বলা হলেও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকগুলো এখনো আগের অবস্থায় ফিরে যায়নি। রপ্তানি ছাড়া অর্থনীতির আর কোনো সূচকই ভালো নেই। মূল্যস্ফীতি এখন ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। রপ্তানি বাড়লেও বাণিজ্য ঘাটতি এখন গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে যাওয়ায় চলতি হিসাবের যে ঘাটতি, তা-ও গত ৫০ বছরে দেখা যায়নি। এর প্রভাবে শুধু চলতি বছরেই টাকার অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে ১০ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে অর্থনীতি চাপ, অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মধ্যে আছে।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনও সংকটে পড়েছে। ফলে সাশ্রয়ের দিকে যেতে হচ্ছে সরকারকে। একই সঙ্গে জ্বালানি খাতের ভর্তুকি সরকারের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি এখন বিশ্বেরই সবচেয়ে বড় সমস্যা। সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ১ শতাংশ, যা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির অবনমনÑএই দুটোর মিশ্রণ দেশের অর্থনীতিতে পড়েছে। দেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম। এ জায়গা শক্তিশালী হলে প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং আমদানি নিজস্ব অর্থায়নে করা সম্ভব হতো। আবার ইদানীং আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। কিন্তু গত তিন-চার বছরে ক্রমান্বয়ে টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়নি। এমন অবস্থায় এখন একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেড়েছে।

তবে বৈশ্বিক মন্দা শুরু হলে দেশের রপ্তানি কমবে। করোনা সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্যোগে পর্যুদস্থ ছিল বিশ্ব অর্থনীতি। যদিও দুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল সমৃদ্ধির পথে। নিয়ন্ত্রিত ছিল মূল্যস্ফীতি। বড় প্রবৃদ্ধিতে ছিল রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে তেজি ভাব ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেশের রপ্তানি ছাড়ায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে হঠাৎ করেই চোরাবালিতে ঠেলে দিয়েছে। গত অর্থবছরের (২০২১-২২) মে পর্যন্ত ১১ মাসেই দেশের আমদানি ব্যয় ছাড়িয়েছে ৮১ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। ইতিহাস সৃষ্টি করা এ আমদানি ব্যয়ের নেতিবাচক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে বৈদেশিক বাণিজ্যের সবকটি সূচকে। দিন যত যাচ্ছে দেশের অর্থনীতির মৌলিক সূচকগুলো ততই নাজুক হয়ে উঠছে। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছে ১৫ শতাংশেরও বেশি। গত মে পর্যন্ত অর্থবছরের ১১ মাসেই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।

দেশের অর্থনৈতিক সংকটে নড়েচড়ে বসেছে সরকারও। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেলসহ নানা ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। সংকটের কারণে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও চাপের মুখে পড়েছে। জ্বালানিসাশ্রয়ী নীতিতে হাঁটতে গিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন কমিয়ে এনেছে সরকার। সারা দেশে লোডশেডিংয়ের শিডিউল করে দেয়ার মতো কঠোর নীতিও চালু করা হয়েছে। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ জ্বালানি তেলের সংকটের কারণে চাপে পড়েছে দেশের শিল্প উৎপাদন। এরই মধ্যে শিল্পোদ্যোক্তারা নিজেদের উদ্বেগের কথা জানাতে শুরু করেছেন। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভুল নীতির কারণে আজকের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যে যে অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়েছে, সেটি দ্রুতই কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই। বরং আগামীতে এ পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণসহায়তা নেয়ার আলোচনা উঠেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ অবশেষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ঋণ চেয়েছে। এজন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু করতে আইএমএফকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে ঋণের অঙ্ক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়নি। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ৩ বছরের জন্য চায় ৪৫০ কোটি ডলার।

শুধু আইএমএফ নয়; বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকার কাছ থেকেও বাজেট সহায়তা নেয়ার আলোচনা চলছে। এডিবির সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের বাজেট-সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে। সামাজিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার- এই দুই খাতে অর্থ খরচ করতে হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের জন্য দুই মাস আগেই এডিবির কাছে সহায়তা চেয়েছে সরকার। তবে কিছু শর্ত নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। যেমন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় অর্থ প্রদান সহজ করা, প্রকৃত সুবিধাভোগী চিহ্নিত করা, অর্থ খরচে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে কর দেয়ার ব্যবস্থা সহজ করা; আয়কর ও শুল্ক নিয়ে নতুন দুটি আইন চালু এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে সহায়তা দেয়া।

অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ৭০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে। জাইকার কাছেও বাজেট সহায়তা চেয়ে অনুরোধ করার ব্যাপারে কাজ চলছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে ঋণ নেয়ার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। ৫-৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেলে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি থাকবে না। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা ভালো। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। সে তুলনায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কম।

বর্তমান পরিস্থিতিতে দাতা সংস্থাগুলো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কঠিন কোনো শর্ত দেয়ার সম্ভাবনা নেই। অর্থনীতির সামগ্রিক দিক পর্যালোচনা করলে আমরা বিশ্ব পরিস্থিতির তুলনায় অনেক ভালো আছি। এ কারণে বড় কোনো সংকটের শঙ্কা নেই। তবে সরকারের ব্যবস্থাপনা আরও সুষ্ঠু হতে হবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে যে সংকট চলছে, সেটি রেকর্ড পণ্য আমদানি ও বিশ্ববাজারে পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ফল। করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের আমদানি কমে গিয়েছিল। মহামারীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আমদানি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে আমদানি পণ্যের পরিমাণ না বাড়লেও মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এ কারণে গত অর্থবছরে রেকর্ড আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

আশার কথা হলো, আমাদের রফতানি আয়ও প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। রপ্তানিতে বড় প্রবৃদ্ধি হওয়ার পরও বাণিজ্য ঘাটতি ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়াটি শঙ্কার। বৈদেশিক বাণিজ্যে নিয়ে দেশে যা কিছু হচ্ছে সবই ভুল নীতির খেসারত। যে মাত্রার সামঞ্জস্যহীনতা তৈরি হয়েছে, সেটি শিগগিরই কাটিয়ে ওঠা কঠিন। বহু আগে থেকেই দেশের অর্থনীতিবিদরা আমদানির ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছিল। কিন্তু সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক দেখব, দেখছি বলে সময়ক্ষেপণ করেছে। এ কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এদিকে রপ্তানির বর্তমান প্রবৃদ্ধি নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে তৈরি পণ্যগুলো রপ্তানির প্রধান গন্তব্য পশ্চিমা দেশগুলো।

কোভিড-১৯ মহামারীর অভিঘাত কাটিয়ে দেশগুলোর বাজার চাঙ্গা হতে শুরু করেছিল। অনেক দিন নিষ্ক্রিয় থাকা বিক্রয়কেন্দ্রগুলো সক্রিয় হওয়ার পর চাহিদার উল্লম্ফনও দেখা গিয়েছিল, যার প্রতিফলন হিসেবে মোট রপ্তানিতে বড় প্রবৃদ্ধি দেখতে পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে এ প্রবৃদ্ধি টেকসই হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কারণ, করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে পশ্চিমা বাজারগুলোর চাহিদায় ভাটার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। গত অর্থবছরে প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলারের আমদানি হয়েছে। প্রকৃতই এ পরিমাণ পণ্য দেশে আমদানি হয়েছে কিনা, সেটি বড় প্রশ্ন। কারণ, দেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে অর্থনীতির কোন সূচকেই ইতিহাস সৃষ্টি করা এ আমদানির প্রতিফলন নেই। আমদানির নামে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে গেল কি না, সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে যে সংকট সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নেই। শুধু রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সংকটের তুলনায় সেসব উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। বৈদেশিক বাণিজ্যের ছিদ্রগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি ভুল নীতির ফল। আগামীতে এ সংকট আরও গভীর হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

সোমবার, ০১ আগস্ট ২০২২ , ১৭ শ্রাবণ ১৪২৯ ২ মহররম ১৪৪৪

অর্থনীতির সংকট কাটবে কীভাবে?

রেজাউল করিম খোকন

গত ১৩-১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। রাজস্ব আয়ে ঘাটতির পাশাপাশি নতুন করে যোগ হয়েছে বিশ্ব সংকট। বিশেষ করে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স আয়ে ঘাটতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে। টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অসহনীয় হয়ে উঠছে জিনিসপত্রের দাম। মনে হচ্ছে, আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও বেসামাল হয়ে উঠবে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

বর্তমানে করোনা উত্তরণের কথা বলা হলেও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকগুলো এখনো আগের অবস্থায় ফিরে যায়নি। রপ্তানি ছাড়া অর্থনীতির আর কোনো সূচকই ভালো নেই। মূল্যস্ফীতি এখন ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। রপ্তানি বাড়লেও বাণিজ্য ঘাটতি এখন গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে যাওয়ায় চলতি হিসাবের যে ঘাটতি, তা-ও গত ৫০ বছরে দেখা যায়নি। এর প্রভাবে শুধু চলতি বছরেই টাকার অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে ১০ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে অর্থনীতি চাপ, অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মধ্যে আছে।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনও সংকটে পড়েছে। ফলে সাশ্রয়ের দিকে যেতে হচ্ছে সরকারকে। একই সঙ্গে জ্বালানি খাতের ভর্তুকি সরকারের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি এখন বিশ্বেরই সবচেয়ে বড় সমস্যা। সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ১ শতাংশ, যা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও বৈশ্বিক পরিস্থিতির অবনমনÑএই দুটোর মিশ্রণ দেশের অর্থনীতিতে পড়েছে। দেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম। এ জায়গা শক্তিশালী হলে প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং আমদানি নিজস্ব অর্থায়নে করা সম্ভব হতো। আবার ইদানীং আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। কিন্তু গত তিন-চার বছরে ক্রমান্বয়ে টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়নি। এমন অবস্থায় এখন একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেড়েছে।

তবে বৈশ্বিক মন্দা শুরু হলে দেশের রপ্তানি কমবে। করোনা সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্যোগে পর্যুদস্থ ছিল বিশ্ব অর্থনীতি। যদিও দুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল সমৃদ্ধির পথে। নিয়ন্ত্রিত ছিল মূল্যস্ফীতি। বড় প্রবৃদ্ধিতে ছিল রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে তেজি ভাব ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেশের রপ্তানি ছাড়ায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে হঠাৎ করেই চোরাবালিতে ঠেলে দিয়েছে। গত অর্থবছরের (২০২১-২২) মে পর্যন্ত ১১ মাসেই দেশের আমদানি ব্যয় ছাড়িয়েছে ৮১ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। ইতিহাস সৃষ্টি করা এ আমদানি ব্যয়ের নেতিবাচক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে বৈদেশিক বাণিজ্যের সবকটি সূচকে। দিন যত যাচ্ছে দেশের অর্থনীতির মৌলিক সূচকগুলো ততই নাজুক হয়ে উঠছে। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছে ১৫ শতাংশেরও বেশি। গত মে পর্যন্ত অর্থবছরের ১১ মাসেই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।

দেশের অর্থনৈতিক সংকটে নড়েচড়ে বসেছে সরকারও। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেলসহ নানা ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। সংকটের কারণে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও চাপের মুখে পড়েছে। জ্বালানিসাশ্রয়ী নীতিতে হাঁটতে গিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন কমিয়ে এনেছে সরকার। সারা দেশে লোডশেডিংয়ের শিডিউল করে দেয়ার মতো কঠোর নীতিও চালু করা হয়েছে। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ জ্বালানি তেলের সংকটের কারণে চাপে পড়েছে দেশের শিল্প উৎপাদন। এরই মধ্যে শিল্পোদ্যোক্তারা নিজেদের উদ্বেগের কথা জানাতে শুরু করেছেন। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভুল নীতির কারণে আজকের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যে যে অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়েছে, সেটি দ্রুতই কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই। বরং আগামীতে এ পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণসহায়তা নেয়ার আলোচনা উঠেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ অবশেষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ঋণ চেয়েছে। এজন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু করতে আইএমএফকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে ঋণের অঙ্ক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়নি। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ৩ বছরের জন্য চায় ৪৫০ কোটি ডলার।

শুধু আইএমএফ নয়; বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকার কাছ থেকেও বাজেট সহায়তা নেয়ার আলোচনা চলছে। এডিবির সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের বাজেট-সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে। সামাজিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার- এই দুই খাতে অর্থ খরচ করতে হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের জন্য দুই মাস আগেই এডিবির কাছে সহায়তা চেয়েছে সরকার। তবে কিছু শর্ত নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। যেমন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় অর্থ প্রদান সহজ করা, প্রকৃত সুবিধাভোগী চিহ্নিত করা, অর্থ খরচে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে কর দেয়ার ব্যবস্থা সহজ করা; আয়কর ও শুল্ক নিয়ে নতুন দুটি আইন চালু এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে সহায়তা দেয়া।

অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ৭০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে। জাইকার কাছেও বাজেট সহায়তা চেয়ে অনুরোধ করার ব্যাপারে কাজ চলছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে ঋণ নেয়ার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। ৫-৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেলে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি থাকবে না। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা ভালো। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। সে তুলনায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কম।

বর্তমান পরিস্থিতিতে দাতা সংস্থাগুলো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কঠিন কোনো শর্ত দেয়ার সম্ভাবনা নেই। অর্থনীতির সামগ্রিক দিক পর্যালোচনা করলে আমরা বিশ্ব পরিস্থিতির তুলনায় অনেক ভালো আছি। এ কারণে বড় কোনো সংকটের শঙ্কা নেই। তবে সরকারের ব্যবস্থাপনা আরও সুষ্ঠু হতে হবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে যে সংকট চলছে, সেটি রেকর্ড পণ্য আমদানি ও বিশ্ববাজারে পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ফল। করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের আমদানি কমে গিয়েছিল। মহামারীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আমদানি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে আমদানি পণ্যের পরিমাণ না বাড়লেও মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এ কারণে গত অর্থবছরে রেকর্ড আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

আশার কথা হলো, আমাদের রফতানি আয়ও প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। রপ্তানিতে বড় প্রবৃদ্ধি হওয়ার পরও বাণিজ্য ঘাটতি ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়াটি শঙ্কার। বৈদেশিক বাণিজ্যে নিয়ে দেশে যা কিছু হচ্ছে সবই ভুল নীতির খেসারত। যে মাত্রার সামঞ্জস্যহীনতা তৈরি হয়েছে, সেটি শিগগিরই কাটিয়ে ওঠা কঠিন। বহু আগে থেকেই দেশের অর্থনীতিবিদরা আমদানির ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছিল। কিন্তু সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক দেখব, দেখছি বলে সময়ক্ষেপণ করেছে। এ কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এদিকে রপ্তানির বর্তমান প্রবৃদ্ধি নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে তৈরি পণ্যগুলো রপ্তানির প্রধান গন্তব্য পশ্চিমা দেশগুলো।

কোভিড-১৯ মহামারীর অভিঘাত কাটিয়ে দেশগুলোর বাজার চাঙ্গা হতে শুরু করেছিল। অনেক দিন নিষ্ক্রিয় থাকা বিক্রয়কেন্দ্রগুলো সক্রিয় হওয়ার পর চাহিদার উল্লম্ফনও দেখা গিয়েছিল, যার প্রতিফলন হিসেবে মোট রপ্তানিতে বড় প্রবৃদ্ধি দেখতে পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে এ প্রবৃদ্ধি টেকসই হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কারণ, করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে পশ্চিমা বাজারগুলোর চাহিদায় ভাটার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। গত অর্থবছরে প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলারের আমদানি হয়েছে। প্রকৃতই এ পরিমাণ পণ্য দেশে আমদানি হয়েছে কিনা, সেটি বড় প্রশ্ন। কারণ, দেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে অর্থনীতির কোন সূচকেই ইতিহাস সৃষ্টি করা এ আমদানির প্রতিফলন নেই। আমদানির নামে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে গেল কি না, সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে যে সংকট সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নেই। শুধু রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সংকটের তুলনায় সেসব উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। বৈদেশিক বাণিজ্যের ছিদ্রগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি ভুল নীতির ফল। আগামীতে এ সংকট আরও গভীর হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]