একটা সময় ছিল যখন বিদ্যুত মাঝেমধ্যে আসত, তখন নিজেরাও সারাক্ষণ সতর্ক থাকতাম। যতটুকু সময় বিদ্যুত থাকত প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে নিতাম। অনেকদিন হলো বিদ্যুতের সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছিল। বিদ্যুতের আসা-যাওয়া ছিল না বললেই চলে। আমাদের জীবনযাত্রারও পরিবর্তন হয়েছিল। সাংসারিক অনেক কাজও বিদ্যুত নির্ভর হয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিনে বিদ্যুতের আসা-যাওয়ায় সেই পুরনো দিন আবার ফিরে এসেছে প্রায়।’ কথাগুলো বলছিলেন গোয়ালন্দ শহরের কলেজপাড়া মহল্লার গৃহবধূ সামিয়া ফারহানা। গত রবিবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে কথা হয় তার সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘সংসারের নানা কাজ কর্মশেষে যখন গোসল করতে বাথরুমে গেছি, তখন দেখি টাংকির পানি শেষ, এদিকে বিদ্যুতও নেই। ওদিকে পরিষ্কার করার জন্য বেশকিছু কাপড়ও ভিজিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু বিদ্যুত না আসা পর্যন্ত সেগুলো ধোয়া বা নিজের গোসল কোনটাই করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে দুপুরের খাওয়া বিকেলে সারতে হলো। এমন হলে তো অসুস্থ হয়ে পড়ব।’
গৃহবধূ সামিয়া ফারহানার মতো অনেকের ঘরেই একই অবস্থা। তীব্র তাপদাহে টানা কয়েকদিনের অসহ্য গরমের মাঝে শরতের হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি হলেও ভ্যাপসা গরমে স্বস্তি ফিরছে না রাজবাড়ীর গোয়ালন্দবাসীর মধ্যে। আর সেই অস্বস্তি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় বিদ্যুতের লোডশেডিং। গত কয়েকদিন ধরে তীব্র গরমের সঙ্গে ভয়াবহ রূপে ফিরে এসেছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি। বিদ্যুতের এই লোডশেডিং শুধু জীবনযাত্রায়ই প্রভাব ফেলেনি। ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এই অঞ্চলের ব্যাবসা-বানিজ্যে। বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম পোল্ট্র জোন হিসেবে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের নাম রয়েছে। পোল্ট্রি মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের জন্য গোয়ালন্দেই রয়েছে অন্তত অর্ধশত পোল্ট্রি হ্যাচারিজ। দীর্ঘদিন ধরে পোল্ট্রি ফিডের (খাদ্য) দাম বেশি থাকা অপরদিকে বাচ্চার দাম কম থাকায় এ সকল পোল্ট্রি হ্যাচারিজগুলো অনেকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। এর মধ্যে লোডশেডিং নিয়ে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে পোল্ট্রি হ্যাচারিজগুলো।
এ প্রসঙ্গে গোয়ালন্দ হ্যাচারিজ লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সায়েম খান জানান, প্রতিমাসে তিনি সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা বিদ্যুত বিল পরিশোধ করেন। আর যদি বিদ্যুত না থাকে তবে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুত সরবরাহ করতে গিয়ে তার কোম্পানিকে গুণতে হয় অন্তত ২৫ লাখ টাকা। প্রতি এক ঘণ্টা লোডশেডিং থাকলে তাদের অতিরিক্ত খরচ হয় ২ হাজার টাকা। এমনিতেই নানা প্রতিকূলতার কারণে পোল্ট্রি শিল্প খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। এ পরিস্থিতিতে বাচ্চা উৎপাদনে আরো বেশি খরচ হলে এ শিল্প আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় বর্তমান যে সংকট তা লোডশেডিং দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না।
কারণ, ধরেন আমার প্রতিষ্ঠানে ১ মিনিটের জন্য বিদ্যুতবিহীন রাখা সম্ভব না। ১ মিনিট বিদ্যুত বন্ধ থাকলে মেশিনে থাকা লাখ লাখ বাচ্চা মারা যাবে। সুতরাং আমাকে জেনারেটরে জ¦ালানি তেল খরচ করে বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। এজন্য আমাকে কিন্তু জ¦ালানি তেল কিনতেই হচ্ছে।’ এবার ধরেন, ‘আমি জেনারেটর দিয়ে এক লিটার তেলে যে পরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদন করতে পারছি, বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো ওই একই জ¦ালানিতে তার চেয়ে অন্তত ৫-৬ গুণ বেশি বিদ্যুত উৎপাদান করতে পারে। সুতরাং লোডশেডিং দিয়ে জ¦ালানি তেলের ওপর চাপ কমার কোন কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না।’
গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা প্রণব ঘোষ জানান, তার এলাকায় গত কয়েকদিনে ৫-৬ বার লোডশেডিং হয়েছে। প্রতিবার ১ থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুত ছিল না। তিনি বলেন, ‘এক যুগ আগে দিনে ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা লোডশেডিং দেখেছি। তবে এরপর ধীরে ধীরে লোডশেডিং বিদায় নিয়েছিল। গত কয়েকদিন ধরে যা হচ্ছে, তা বিগত ৭-৮ বছরে দেখা যায়নি। তবে সরকার যেহেতু ঘোষণা করে লোডশেডিং দিচ্ছে, এটা কার্যকর হলে সবাই লোডশেডিংয়ে জন্য প্রস্তুত থাকতে পারবে, এতে ভোগান্তি অনেকাংশে কমবে।’
সরকারী গোয়ালন্দ কামরুল ইসলাম কলেজের প্রভাষক মো. জাকির হোসেন জানান, যেহেতু বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক না, এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার যথাযথ সিদ্ধান্তই নিয়েছে। জ¦ালানী তেল-গ্যাসের উপর চাপ কমাতে আমাদেরকে বিদ্যুত ব্যবহারে আরও মিতব্যায়ী হতে হবে।
গোয়ালন্দ বাজারের ইলেকট্রনিক্স মালামাল বিক্রেতা শহিদুল ইসলাম জানান, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে ঘোষণায় আগের চেয়ে চার্জার লাইট, ফ্যানের বিক্রি বেড়েছে।
ওয়েস্ট্রান জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিভিউশন কোম্পানি লিঃ এর গোয়ালন্দ কার্যালয়ের আবাসিক প্রকৌশলী (আরই) শাহ নেওয়াজ শাহিন সাংবাদিকদের জানান, দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে লোডশেডিং করা অনেকটা অসম্ভব। কারণ সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেশি থাকলে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দেয়া হয়। আর কখন এ রকম পরিস্থিতি হবে তা আগে থেকে জানা যায় না।
আমরা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগযোগ করে যত দূর সম্ভব সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এ পরিস্থিতিতে কয়েকদিন গেলে আমরা পরিষ্কার ধারণা দিতে পারব ।
গোয়ালন্দ, (রাজবাড়ী) : লোডশেডিংয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছন্দপতন। এর প্রভাব পড়েছে অর্ধশত পৌল্ট্রি খামারে। লোকসানের আশঙ্কায় খামারিরা -সংবাদ
আরও খবরমঙ্গলবার, ০২ আগস্ট ২০২২ , ১৮ শ্রাবণ ১৪২৯ ৩ মহররম ১৪৪৪
প্রতিনিধি, গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী)
গোয়ালন্দ, (রাজবাড়ী) : লোডশেডিংয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছন্দপতন। এর প্রভাব পড়েছে অর্ধশত পৌল্ট্রি খামারে। লোকসানের আশঙ্কায় খামারিরা -সংবাদ
একটা সময় ছিল যখন বিদ্যুত মাঝেমধ্যে আসত, তখন নিজেরাও সারাক্ষণ সতর্ক থাকতাম। যতটুকু সময় বিদ্যুত থাকত প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে নিতাম। অনেকদিন হলো বিদ্যুতের সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছিল। বিদ্যুতের আসা-যাওয়া ছিল না বললেই চলে। আমাদের জীবনযাত্রারও পরিবর্তন হয়েছিল। সাংসারিক অনেক কাজও বিদ্যুত নির্ভর হয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিনে বিদ্যুতের আসা-যাওয়ায় সেই পুরনো দিন আবার ফিরে এসেছে প্রায়।’ কথাগুলো বলছিলেন গোয়ালন্দ শহরের কলেজপাড়া মহল্লার গৃহবধূ সামিয়া ফারহানা। গত রবিবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে কথা হয় তার সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘সংসারের নানা কাজ কর্মশেষে যখন গোসল করতে বাথরুমে গেছি, তখন দেখি টাংকির পানি শেষ, এদিকে বিদ্যুতও নেই। ওদিকে পরিষ্কার করার জন্য বেশকিছু কাপড়ও ভিজিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু বিদ্যুত না আসা পর্যন্ত সেগুলো ধোয়া বা নিজের গোসল কোনটাই করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে দুপুরের খাওয়া বিকেলে সারতে হলো। এমন হলে তো অসুস্থ হয়ে পড়ব।’
গৃহবধূ সামিয়া ফারহানার মতো অনেকের ঘরেই একই অবস্থা। তীব্র তাপদাহে টানা কয়েকদিনের অসহ্য গরমের মাঝে শরতের হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি হলেও ভ্যাপসা গরমে স্বস্তি ফিরছে না রাজবাড়ীর গোয়ালন্দবাসীর মধ্যে। আর সেই অস্বস্তি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় বিদ্যুতের লোডশেডিং। গত কয়েকদিন ধরে তীব্র গরমের সঙ্গে ভয়াবহ রূপে ফিরে এসেছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি। বিদ্যুতের এই লোডশেডিং শুধু জীবনযাত্রায়ই প্রভাব ফেলেনি। ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এই অঞ্চলের ব্যাবসা-বানিজ্যে। বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম পোল্ট্র জোন হিসেবে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের নাম রয়েছে। পোল্ট্রি মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের জন্য গোয়ালন্দেই রয়েছে অন্তত অর্ধশত পোল্ট্রি হ্যাচারিজ। দীর্ঘদিন ধরে পোল্ট্রি ফিডের (খাদ্য) দাম বেশি থাকা অপরদিকে বাচ্চার দাম কম থাকায় এ সকল পোল্ট্রি হ্যাচারিজগুলো অনেকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। এর মধ্যে লোডশেডিং নিয়ে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে পোল্ট্রি হ্যাচারিজগুলো।
এ প্রসঙ্গে গোয়ালন্দ হ্যাচারিজ লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সায়েম খান জানান, প্রতিমাসে তিনি সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা বিদ্যুত বিল পরিশোধ করেন। আর যদি বিদ্যুত না থাকে তবে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুত সরবরাহ করতে গিয়ে তার কোম্পানিকে গুণতে হয় অন্তত ২৫ লাখ টাকা। প্রতি এক ঘণ্টা লোডশেডিং থাকলে তাদের অতিরিক্ত খরচ হয় ২ হাজার টাকা। এমনিতেই নানা প্রতিকূলতার কারণে পোল্ট্রি শিল্প খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। এ পরিস্থিতিতে বাচ্চা উৎপাদনে আরো বেশি খরচ হলে এ শিল্প আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় বর্তমান যে সংকট তা লোডশেডিং দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না।
কারণ, ধরেন আমার প্রতিষ্ঠানে ১ মিনিটের জন্য বিদ্যুতবিহীন রাখা সম্ভব না। ১ মিনিট বিদ্যুত বন্ধ থাকলে মেশিনে থাকা লাখ লাখ বাচ্চা মারা যাবে। সুতরাং আমাকে জেনারেটরে জ¦ালানি তেল খরচ করে বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। এজন্য আমাকে কিন্তু জ¦ালানি তেল কিনতেই হচ্ছে।’ এবার ধরেন, ‘আমি জেনারেটর দিয়ে এক লিটার তেলে যে পরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদন করতে পারছি, বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো ওই একই জ¦ালানিতে তার চেয়ে অন্তত ৫-৬ গুণ বেশি বিদ্যুত উৎপাদান করতে পারে। সুতরাং লোডশেডিং দিয়ে জ¦ালানি তেলের ওপর চাপ কমার কোন কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না।’
গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা প্রণব ঘোষ জানান, তার এলাকায় গত কয়েকদিনে ৫-৬ বার লোডশেডিং হয়েছে। প্রতিবার ১ থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুত ছিল না। তিনি বলেন, ‘এক যুগ আগে দিনে ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা লোডশেডিং দেখেছি। তবে এরপর ধীরে ধীরে লোডশেডিং বিদায় নিয়েছিল। গত কয়েকদিন ধরে যা হচ্ছে, তা বিগত ৭-৮ বছরে দেখা যায়নি। তবে সরকার যেহেতু ঘোষণা করে লোডশেডিং দিচ্ছে, এটা কার্যকর হলে সবাই লোডশেডিংয়ে জন্য প্রস্তুত থাকতে পারবে, এতে ভোগান্তি অনেকাংশে কমবে।’
সরকারী গোয়ালন্দ কামরুল ইসলাম কলেজের প্রভাষক মো. জাকির হোসেন জানান, যেহেতু বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক না, এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার যথাযথ সিদ্ধান্তই নিয়েছে। জ¦ালানী তেল-গ্যাসের উপর চাপ কমাতে আমাদেরকে বিদ্যুত ব্যবহারে আরও মিতব্যায়ী হতে হবে।
গোয়ালন্দ বাজারের ইলেকট্রনিক্স মালামাল বিক্রেতা শহিদুল ইসলাম জানান, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে ঘোষণায় আগের চেয়ে চার্জার লাইট, ফ্যানের বিক্রি বেড়েছে।
ওয়েস্ট্রান জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিভিউশন কোম্পানি লিঃ এর গোয়ালন্দ কার্যালয়ের আবাসিক প্রকৌশলী (আরই) শাহ নেওয়াজ শাহিন সাংবাদিকদের জানান, দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে লোডশেডিং করা অনেকটা অসম্ভব। কারণ সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেশি থাকলে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দেয়া হয়। আর কখন এ রকম পরিস্থিতি হবে তা আগে থেকে জানা যায় না।
আমরা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগযোগ করে যত দূর সম্ভব সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এ পরিস্থিতিতে কয়েকদিন গেলে আমরা পরিষ্কার ধারণা দিতে পারব ।