বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট : বাংলাদেশের উপায় কী

ডোরিন চৌধুরী

এক মাস ধরে বাংলাদেশে লোডশেডিং আবারও ফিরে এসেছে। তীব্র দাবদাহের মধ্যেও প্রায় সব এলাকায় দৈনিক এক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ থাকছে না। বিদ্যুতের উৎপাদন অনুযায়ী চাহিদা মেটাতে রুটিন করে লোডশেডিং করা হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বেশ কয়েক দিন ধরে জ্বালানি সংকটের প্রভাবে বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিচ্ছে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই। মূলত বিশ্বব্যপী জ্বালানি সংকট এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে দেশে দেশে সংকট দেখা দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটেই এখন জানতে চাওয়া, বাংলাদেশে হঠাৎ লোডশেডিং ফিরে আসার কারণ কি? আরচলমান বিশ্ব সংকটের সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা কি?

বাংলাদেশে লোডশেডিং

গেল একদশকে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশ প্রশংসনীয় সফলতা অর্জন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫০০০ মেগাওয়াট, যা দৈনন্দিন চাহিদা ১৩০০০-১৫০০০ মেগাওয়াটের তুলনায় অনেক বেশি। তাই, গত কয়েক বছর ধরে প্রায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছিল সরকার। কিন্তু, মহামারী পরবর্তী বিশ্ব সংকট ও ইউক্রেনে যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বশেষ মূল্য বৃদ্ধিতে গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিট ২৫ ডলার থেকে ৩৮ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। ফলে, প্রভাব পড়েছে গ্যাসের আমদানিতে। আমদানি কমে যাওয়ায় ন্যাশনাল গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহও কমাতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। সংকটের পর, ২.৮ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে মাত্র ৫১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। ফলাফল, দৈনন্দিন চাহিদার তুলনায় ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি, যা পোষাতে হচ্ছে রুটিনমাফিক লোডশেডিং দিয়ে।

উল্লেখ্য যে, গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে মূলত দুটি রাস্তা থাকে সরকারের জন্য। হয়, লোডশেডিং দিয়ে ঘাটতি মেটানো অথবা চড়া দামে গ্যাস কেনার জন্য ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেয়া।

গ্যাস সংকটের কারণ কি?

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে মূল জ্বালানি গ্যাস, তেল এবং কয়লা। দেশে গ্যাসফিল্ড থাকলেও বাসাবাড়ি এবং শিল্প কারখানায় ব্যবহার থাকায় তা পর্যাপ্ত নয়। তাই মধ্যপ্রাচ্য হতে গ্যাস আমদানি করা হয় নিয়মিত।

কিন্তু মহামারির পর থেকে বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম চড়া যাচ্ছিল। ইউক্রেন সংকট ও রাশিয়াকে দেয়া স্যাংকশনের ফলে তা আরও তীব্রতর হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিউত্তরে রাশিয়া থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ করছে পশ্চিমা দেশগুলো। তাই বিকল্প উৎস হিসেবে তারা ঝুঁকে পড়ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং ‘স্পট মার্কেট’-এর ওপর। ফলে, সেখানে সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেড়ে গিয়েছে এবং দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহামারীর সময় থেকে গেল দুই বছরে গ্যাসের দাম প্রায় ১০০০% বৃদ্ধি পেয়েছে ইতোমধ্যে।

জুন মাসের শেষের দিকে টেক্সাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস টার্মিনাল মেইনটেন্যান্সের কারণে সাময়িক বন্ধ করায় গ্যাসের দাম আরো ৬০% বেড়ে যায়। অন্যদিকে, জার্মানি-রাশিয়ার মধ্যকার নর্ড স্ট্রিমলাইনও একি কারণে ১০ দিনের জন্য বন্ধ করা হয়, যা পরবর্তী চালু করা হলেও যুদ্ধের প্রভাবে রাশিয়া সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে গ্যাসের বাজার এই মুহূর্তে বেশ টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে। এমনকি, জার্মানি আশঙ্কা করছে ২০০৮-এর অর্থনৈতিক সংকটের মতো ধস নামতে পারে জ্বালানি সেক্টরেও, দেউলিয়া হতে পারে অনেক বড় জ্বালানি কোম্পানিগুলিও। যাইহোক, মধ্যপ্রাচ্যের ওপর পশ্চিমাদেশগুলোর গ্যাসের জন্য ঝুঁকে পড়ায় বিপদে আছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। অধিক দামে গ্যাস কিনতে হচ্ছে তাদের। ফলে সংকটে পড়ছে এশিয়ার অনেক দেশ। বৃহৎ জ্বালানি কোম্পানি শেলের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট স্টিভ হিলও একই আশঙ্কা করেছেন সাম্প্রতি। ব্লুুমবার্গের কাছে তিনি বলেন, ‘ইউরোপ এলএনজি শুষে নিচ্ছে বাজার থেকে। যার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো গ্যাস পাবে না।’

তবে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি সরকারেরও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। জ্বালানি পরিকল্পনায় অদূরদর্শিতা, জ্বালানি ব্যবসায় অদক্ষতা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি বৃদ্ধিতে উদাসীনতা ইত্যাদিও দেশকে আকস্মিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সরকার বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামের প্রবণতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সঠিক সময়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে।

বিশ্বব্যপী লোডশেডিংয়ের চিত্র

জ্বালানি সংকট ও উচ্চম্যূলের প্রভাব গোটা বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। সত্য হচ্ছে স্টিভ হিলের আশঙ্কা। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং নেপাল ইতোমধ্যে লোডশেডিং এ বাধ্য হচ্ছে। মে মাসে ভারতেও একই সমস্যা দেখা দেয়। দক্ষিণ এশিয়ার বাহিরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও লোডশেডিং হচ্ছে। এমনকি, জাপান তার নাগরিকদের এসির ব্যবহার কমাতে অনুরোধ করতে বাধ্য হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বেও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে জনমনে অসন্তুষ্টি দেখা দিয়েছে, সরকার হিমশিম খাচ্ছে দাম নিয়ন্ত্রণে।

বাংলাদেশের সামনে উপায় কি?

বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের প্রেক্ষাপটে স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য লোডশেডিং একটি বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশেরও সময় হয়েছে এই বাস্তবতা মেনে নেয়ার। গত এক মাসে মোটামুটি বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তবে, আমদানি উৎস বৃদ্ধি করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে, মায়ানমার একটি ভালো উৎস হতে পারে। সেখানে বিশাল গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে এবং প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় পরিবহন খরচ ও কম হবে। এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা যেতেই পারে।

অন্যদিকে, রাশিয়ার জ্বালানি আরেকটি সমাধান হতে পারে। রাশিয়া এখন বিশ্ববাজারের তুলনায় কমদামে তেল ও গ্যাস বিক্রি করছে। ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা ইতোমধ্যে রাশিয়ার জ্বালানি কিনছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে, বাংলাদেশের জন্য একটি নৈতিক সংকট রয়েছে।

উদার দৃষ্টিকোণ হতে বলা যায়, বাংলাদেশের রাশিয়ার জ্বালানি কেনা ঠিক হবে না কেননা, তা যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে অবদান রাখতে পারে। কিন্তু বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ বলে, ঘরের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশের উচিৎ সুলভমূল্যে রাশিয়ার জ্বালানি কেনা।

তবে বাংলাদেশ এখনো বাস্তববাদের রাস্তায় হাঁটছে না। বাংলাদেশের মতো অনেক দেশই রাশিয়ার জ্বালানি কিনছে না। পশ্চিমা বিশ্বের উচিৎ হবে এসব রাষ্ট্রের ত্যাগ স্বীকার করা এবং তারা যেন এই অবস্থান ধরে রাখতে পারে সেজন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। নতুবা, অদূর ভবিষ্যতে এসব দেশ বাধ্য হবে তাদের জাতীয় স্বার্থে অবস্থান পরিবর্তনে। পরিশেষে বলা যায়, তৃতীয় বিশ্বে ব্যক্তি ও রাষ্ট্র পর্যায়ে মিতব্যয়িতা চর্চার কোন বিকল্প নেই; অন্তত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগপর্যন্ত।

[লেখক : ডক্টরাল গবেষক,

গ্রোনিয়েন বিশ্ববিদ্যালয়, নেদারল্যান্ডস]

মঙ্গলবার, ০২ আগস্ট ২০২২ , ১৮ শ্রাবণ ১৪২৯ ৩ মহররম ১৪৪৪

বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট : বাংলাদেশের উপায় কী

ডোরিন চৌধুরী

এক মাস ধরে বাংলাদেশে লোডশেডিং আবারও ফিরে এসেছে। তীব্র দাবদাহের মধ্যেও প্রায় সব এলাকায় দৈনিক এক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ থাকছে না। বিদ্যুতের উৎপাদন অনুযায়ী চাহিদা মেটাতে রুটিন করে লোডশেডিং করা হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বেশ কয়েক দিন ধরে জ্বালানি সংকটের প্রভাবে বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিচ্ছে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই। মূলত বিশ্বব্যপী জ্বালানি সংকট এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে দেশে দেশে সংকট দেখা দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটেই এখন জানতে চাওয়া, বাংলাদেশে হঠাৎ লোডশেডিং ফিরে আসার কারণ কি? আরচলমান বিশ্ব সংকটের সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা কি?

বাংলাদেশে লোডশেডিং

গেল একদশকে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশ প্রশংসনীয় সফলতা অর্জন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫০০০ মেগাওয়াট, যা দৈনন্দিন চাহিদা ১৩০০০-১৫০০০ মেগাওয়াটের তুলনায় অনেক বেশি। তাই, গত কয়েক বছর ধরে প্রায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছিল সরকার। কিন্তু, মহামারী পরবর্তী বিশ্ব সংকট ও ইউক্রেনে যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বশেষ মূল্য বৃদ্ধিতে গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিট ২৫ ডলার থেকে ৩৮ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। ফলে, প্রভাব পড়েছে গ্যাসের আমদানিতে। আমদানি কমে যাওয়ায় ন্যাশনাল গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহও কমাতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। সংকটের পর, ২.৮ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে মাত্র ৫১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। ফলাফল, দৈনন্দিন চাহিদার তুলনায় ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি, যা পোষাতে হচ্ছে রুটিনমাফিক লোডশেডিং দিয়ে।

উল্লেখ্য যে, গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে মূলত দুটি রাস্তা থাকে সরকারের জন্য। হয়, লোডশেডিং দিয়ে ঘাটতি মেটানো অথবা চড়া দামে গ্যাস কেনার জন্য ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেয়া।

গ্যাস সংকটের কারণ কি?

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে মূল জ্বালানি গ্যাস, তেল এবং কয়লা। দেশে গ্যাসফিল্ড থাকলেও বাসাবাড়ি এবং শিল্প কারখানায় ব্যবহার থাকায় তা পর্যাপ্ত নয়। তাই মধ্যপ্রাচ্য হতে গ্যাস আমদানি করা হয় নিয়মিত।

কিন্তু মহামারির পর থেকে বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম চড়া যাচ্ছিল। ইউক্রেন সংকট ও রাশিয়াকে দেয়া স্যাংকশনের ফলে তা আরও তীব্রতর হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিউত্তরে রাশিয়া থেকে জ্বালানি কেনা বন্ধ করছে পশ্চিমা দেশগুলো। তাই বিকল্প উৎস হিসেবে তারা ঝুঁকে পড়ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং ‘স্পট মার্কেট’-এর ওপর। ফলে, সেখানে সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেড়ে গিয়েছে এবং দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহামারীর সময় থেকে গেল দুই বছরে গ্যাসের দাম প্রায় ১০০০% বৃদ্ধি পেয়েছে ইতোমধ্যে।

জুন মাসের শেষের দিকে টেক্সাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস টার্মিনাল মেইনটেন্যান্সের কারণে সাময়িক বন্ধ করায় গ্যাসের দাম আরো ৬০% বেড়ে যায়। অন্যদিকে, জার্মানি-রাশিয়ার মধ্যকার নর্ড স্ট্রিমলাইনও একি কারণে ১০ দিনের জন্য বন্ধ করা হয়, যা পরবর্তী চালু করা হলেও যুদ্ধের প্রভাবে রাশিয়া সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে গ্যাসের বাজার এই মুহূর্তে বেশ টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে। এমনকি, জার্মানি আশঙ্কা করছে ২০০৮-এর অর্থনৈতিক সংকটের মতো ধস নামতে পারে জ্বালানি সেক্টরেও, দেউলিয়া হতে পারে অনেক বড় জ্বালানি কোম্পানিগুলিও। যাইহোক, মধ্যপ্রাচ্যের ওপর পশ্চিমাদেশগুলোর গ্যাসের জন্য ঝুঁকে পড়ায় বিপদে আছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। অধিক দামে গ্যাস কিনতে হচ্ছে তাদের। ফলে সংকটে পড়ছে এশিয়ার অনেক দেশ। বৃহৎ জ্বালানি কোম্পানি শেলের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট স্টিভ হিলও একই আশঙ্কা করেছেন সাম্প্রতি। ব্লুুমবার্গের কাছে তিনি বলেন, ‘ইউরোপ এলএনজি শুষে নিচ্ছে বাজার থেকে। যার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো গ্যাস পাবে না।’

তবে, বৈশ্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি সরকারেরও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। জ্বালানি পরিকল্পনায় অদূরদর্শিতা, জ্বালানি ব্যবসায় অদক্ষতা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি বৃদ্ধিতে উদাসীনতা ইত্যাদিও দেশকে আকস্মিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সরকার বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামের প্রবণতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সঠিক সময়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে।

বিশ্বব্যপী লোডশেডিংয়ের চিত্র

জ্বালানি সংকট ও উচ্চম্যূলের প্রভাব গোটা বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। সত্য হচ্ছে স্টিভ হিলের আশঙ্কা। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং নেপাল ইতোমধ্যে লোডশেডিং এ বাধ্য হচ্ছে। মে মাসে ভারতেও একই সমস্যা দেখা দেয়। দক্ষিণ এশিয়ার বাহিরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও লোডশেডিং হচ্ছে। এমনকি, জাপান তার নাগরিকদের এসির ব্যবহার কমাতে অনুরোধ করতে বাধ্য হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বেও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে জনমনে অসন্তুষ্টি দেখা দিয়েছে, সরকার হিমশিম খাচ্ছে দাম নিয়ন্ত্রণে।

বাংলাদেশের সামনে উপায় কি?

বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের প্রেক্ষাপটে স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য লোডশেডিং একটি বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশেরও সময় হয়েছে এই বাস্তবতা মেনে নেয়ার। গত এক মাসে মোটামুটি বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তবে, আমদানি উৎস বৃদ্ধি করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে, মায়ানমার একটি ভালো উৎস হতে পারে। সেখানে বিশাল গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে এবং প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় পরিবহন খরচ ও কম হবে। এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা যেতেই পারে।

অন্যদিকে, রাশিয়ার জ্বালানি আরেকটি সমাধান হতে পারে। রাশিয়া এখন বিশ্ববাজারের তুলনায় কমদামে তেল ও গ্যাস বিক্রি করছে। ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা ইতোমধ্যে রাশিয়ার জ্বালানি কিনছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে, বাংলাদেশের জন্য একটি নৈতিক সংকট রয়েছে।

উদার দৃষ্টিকোণ হতে বলা যায়, বাংলাদেশের রাশিয়ার জ্বালানি কেনা ঠিক হবে না কেননা, তা যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে অবদান রাখতে পারে। কিন্তু বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ বলে, ঘরের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশের উচিৎ সুলভমূল্যে রাশিয়ার জ্বালানি কেনা।

তবে বাংলাদেশ এখনো বাস্তববাদের রাস্তায় হাঁটছে না। বাংলাদেশের মতো অনেক দেশই রাশিয়ার জ্বালানি কিনছে না। পশ্চিমা বিশ্বের উচিৎ হবে এসব রাষ্ট্রের ত্যাগ স্বীকার করা এবং তারা যেন এই অবস্থান ধরে রাখতে পারে সেজন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। নতুবা, অদূর ভবিষ্যতে এসব দেশ বাধ্য হবে তাদের জাতীয় স্বার্থে অবস্থান পরিবর্তনে। পরিশেষে বলা যায়, তৃতীয় বিশ্বে ব্যক্তি ও রাষ্ট্র পর্যায়ে মিতব্যয়িতা চর্চার কোন বিকল্প নেই; অন্তত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগপর্যন্ত।

[লেখক : ডক্টরাল গবেষক,

গ্রোনিয়েন বিশ্ববিদ্যালয়, নেদারল্যান্ডস]