বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে

আতিউর রহমান

সারা বিশ্বই দারুণ অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। কোভিড চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে যখন বিশ্ব অর্থনীতি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিল তখনই দেখা দিল সরবরাহ চেইনের ব্যাপক দুর্বলতা। বাড়তি চাহিদার সাথে জাহাজ পরিবহনসহ পণ্য সরবরাহ পেরে উঠছিল না। তাই চাহিদা ও সরবরাহে ভারসাম্যহীনতার কারণে পণ্যমূল্য বাড়তে থাকে। তাছাড়া সারা বিশ্বেই যথার্থ কারণেই তারল্য পরিস্থিতি ছিল খুবই ঢিলেঢালা। দুইয়ে মিলে বিশ্ব অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। এর মধ্যে মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে জেঁকে বসে ইউক্রেন যুদ্ধ। বাড়ন্ত তেল, গ্যাস ও খাদ্যের মূল্যের ওপর যুদ্ধের প্রভাব পড়ায় সরবরাহ চেইন আরও নাজুক রূপ ধারণ করে। এর ওপর আসে রাশিয়ার লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা। ফলে দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে গড়ে ওঠা গ্লোবালাইজশনের সুফল হঠাৎ করেই উবে যেতে শুরু করে। সে কারণে সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতি আরও দ্রুত লয়ে বাড়তে থাকে। বিশেষ করে জ্বালানির দাম বেশি হারে বাড়ায় কোর ইনফ্লেশনও বেশি হারে বাড়ছে। তাছাড়া আমদানি খরচ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের চেয়ে অনেক বেশি হবার কারণে বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই চলতি হিসেবে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর চাপ গিয়ে পড়ছে ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার মূল্যমানের ওপর। প্রকৃত বিনিময় হারের কাছাকাছি থাকার প্রয়োজনে বেশিরভাগ দেশেই তাদের মুদ্রামান নমনীয় রেখে ধীরে ধীরে অবমূল্যায়নের কৌশল নিয়েছে। এর ফলে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে। তাই আমদানি মূল্যস্ফীতিও বেড়ে চলছে। একই সঙ্গে আবার এ কারণে আমদানির পরিমাণের ওপর লাগাম টানা যাচ্ছে। বাংলাদেশসহ

অনেক দেশই এর ওপর শুল্ক এবং মার্জিন বাড়িয়ে বিলাসী পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্দেশ্য আমদানি চাহিদা কমিয়ে ফেলা। অন্যদিকে বিনিময় হার নমনীয় করায় রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ার সুযোগ বেড়েছে। কিন্তু একদিকে ডলারের দাম আরও বাড়বে বলে বাজারে গুজব থাকায় এবং ফেডের আগ্রাসীভাবে সুদের হার বাড়িয়ে সংকোচন নীতি নেবার কারণে ডলার মূল্যের বন্ডসহ সকল আর্থিক পণ্যের দামই বাড়ছে। তাই উন্নয়নশীল দেশের শেয়ার মার্কেটে বা বন্ডে বিনিয়োগ করা বিদেশি বিনিয়োগ এখন যুক্তরাষ্ট্রমুখী হয়েছে। এমন সময় উন্নয়নশীল দেশের বন্ডের রিটার্নের হার না বাড়লে এই চঞ্চলমতি ডলার বিনিয়োগ ধরে রাখা খুবই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়নশীল দেশসমূহ বৈদেশিক মুদ্রার বাজারকে স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে ধীরে ধীরে তাদের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে। এশিয়ার আর্থিক সংকটকালে স্বল্প রিজার্ভ থাকায় তারা এই কাজটি করতে পারে নি। মালয়েশিয়া সেই সময় ডলার বিকিকিনি বরং বন্ধ করে দিয়েছিল। ইতোমধ্যে অনেক দেশেই রিজার্ভ প্রচুর বেড়েছে। তাই ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ভারত প্রচুর পরিমাণ ডলার রিজার্ভ থেকে বিক্রি করেছে। বাংলাদেশও গত এগারো মাসে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলারের মতো রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে। তাছাড়া অনেক অবকাঠামো নির্মাণেও পর্যাপ্ত ডলার জোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটা সম্ভব হচ্ছে কারণ ২০০৯ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিপুল হারে রিজার্ভ বৃদ্ধি করার কৌশল গ্রহণ করেছিল বলে। ঐ সময় আমাদের রিজার্ভ ছিল মাত্র সাত বিলিয়ন ডলারের মতো। ২০১৬ সালে তা ৩২ বিলিয়ন জলারে উঠে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক এই ধারা মোটামুটিভাবে অক্ষুণœ রাখে। তাই এই অর্থবছরে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার বিক্রি করার পরও আমাদের রিজার্ভ এখন প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার রয়ে গেছে। যদি প্রয়োজন হয় ডলার আরও বিক্রি করা যেতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা স্থিতিশীল করতে এশিয়ার অনেক দেশই তা করছে। আমাদের রিজার্ভ সাময়িকভাবে চল্লিশের নিচে নামলেও আতঙ্কিত হবার কোনো কারণ নেই। তবে হালে বিনিময় হার নমনীয় করার পর ধীরে ধীরে আবার রিজার্ভ বাড়তে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও আর্থিক সংস্থা থেকে আরও দীর্ঘমেয়াদী ঋণ নিতে এবং পাইপলাইনে থাকা প্রস্তাবিত ঋণ বেশি করে ছাড় করানোর পাশাপাশি স্পেশাল ইকোনমিক জোনে সরাসরি বিনিয়োগ আরও বেশি আকর্ষণ করা গেলে রিজার্ভ নিশ্চয় আরও বাড়বে। অন্যদিকে প্রবাসীদের ডলার বন্ড ও ওয়েজ আর্নার বন্ডে বিনিয়োগের নিয়মনীতি আরও গ্রাহক-বান্ধব করার পাশাপাশি রিটার্নের হার বাড়ানো গেলে বাংলাদেশের দিকে ডলারের প্রবাহ নিশ্চয় বাড়বে।

ডলার খরচে মিতব্যায়ী হবার বেশ কিছু সতর্কতামূলক নীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। আরও বেশ কিছু দিন এই নীতি অব্যাহত রাখতে হতে পারে। একইভাবে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণেও সাবধান হতে হবে। এক্ষুনি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হবে তেমন প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগী থেকে অযথা স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপে উন্নয়ন প্রকল্প এই সময়টায় না নেয়াই উচিত হবে। সেজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নের ধারা মনিটরিং-এর মাত্রা বাড়াতে হব। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাকে দেয়া বিদেশি ঋণের কিস্তি শোধের শিডিউল এমনভাবে করতে হবে যাতে একই সময় অনেকগুলো দায়শোধের ঘটনা না ঘটে। পর্যায়ক্রমে শোধ করলে হঠাৎ রিজার্ভের ওপর চাপ পড়বে না। ইআরডি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে আলাপ করে এই শিডিউল নিশ্চয় তৈরি করতে পারে। একইভাবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে যেন উন্নয়ন প্রকল্পগুলো এমনভাবে নেয়া হয় যাতে করে বিদেশ থেকে আমদানি করা কাঁচামাল ও কনসাল্টটেন্সির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। আমাদের প্রকৌশলিরা এখন বেশ দক্ষ। তাই তারা নিশ্চয় প্রয়োজনীয় উপদেষ্টা সার্ভিস দিতে পারবেন। পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় সিমেন্ট, বিটুমিন ও রডের সরবরাহের বড়ো অংশ কিন্তু আমাদের দেশীয় উদ্যোক্তারাই দিয়েছেন। তাই উন্নয়ন প্রকল্পে শুধু শুধু বিদেশি উপকরণ ব্যবহার না করে দেশি পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে পারলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে।

এমন করে সবদিক ভেবে সাধানতার সঙ্গে বিদেশি মুদ্রার সংগ্রহ ও ব্যবহার করতে পারলে আমাদের বৈদেশিক বাজার স্থিতিশীল রাখা মোটেও কঠিন হবে না। প্রয়োজন সকল অংশিজনের মধ্যে আরও নিবিড় সহযোগিতা ও সমন্বয়ের। আর দরকার বিদেশি মুদ্রার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করে করে জ্বালানি আমদানির দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়া। মনে হচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়বে। তাই এর সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং অর্থায়নে আরও দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করে যেতে হবে। বিপিসিসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রশাসনিক দক্ষতা আরও বাড়াতে হবে। তাদেরও বাজার থেকে ডলার কিনে তেল আমদানির চেষ্টা করতে হবে। একই সঙ্গে তেলের আগাম মজুদ গড়ার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা (যেমন ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) ও সংশ্লিষ্ট অন্য সহযোগীদের সাথে আলাপ করে এ বাবদ বিদেশি ঋণ ও সরবরাহ পাইপলাইন গড়ে তোলার জন্য ফিউচার অপশন নিয়ে কার্যকরভাবে ভাবতে হবে। মনে রাখা চাই তেলের দাম ঠিক রাখার ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি। এজন্য দরকার হবে স্মার্ট অর্থনৈতিক কূটনীতির। আশা করি বাংলাদেশ ব্যাংক, বিপিসি এবং অর্থ মন্ত্রণালয় মিলে এই সংকটকালে যথেষ্ট সহযোগিতা ও দক্ষতার পরিচয় দিতে পারবে। নিঃসন্দেহে বিশ্ব অর্থনৈতিক এই সংকটকালে বাংলাদেশকে খুবই সাবধানে পা ফেলতে হবে।

আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
সংবাদ এবং আমার শৈশব
আমার বাতিঘর
শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা
নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
চলছে লড়াই, চলবে লড়াই
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
আমার ‘সংবাদ’
দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান
বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন
দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন
নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী
নতুন সময়ের গণমাধ্যম
‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’
মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সংকট

বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে

আতিউর রহমান

সারা বিশ্বই দারুণ অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। কোভিড চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে যখন বিশ্ব অর্থনীতি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিল তখনই দেখা দিল সরবরাহ চেইনের ব্যাপক দুর্বলতা। বাড়তি চাহিদার সাথে জাহাজ পরিবহনসহ পণ্য সরবরাহ পেরে উঠছিল না। তাই চাহিদা ও সরবরাহে ভারসাম্যহীনতার কারণে পণ্যমূল্য বাড়তে থাকে। তাছাড়া সারা বিশ্বেই যথার্থ কারণেই তারল্য পরিস্থিতি ছিল খুবই ঢিলেঢালা। দুইয়ে মিলে বিশ্ব অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। এর মধ্যে মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে জেঁকে বসে ইউক্রেন যুদ্ধ। বাড়ন্ত তেল, গ্যাস ও খাদ্যের মূল্যের ওপর যুদ্ধের প্রভাব পড়ায় সরবরাহ চেইন আরও নাজুক রূপ ধারণ করে। এর ওপর আসে রাশিয়ার লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা। ফলে দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে গড়ে ওঠা গ্লোবালাইজশনের সুফল হঠাৎ করেই উবে যেতে শুরু করে। সে কারণে সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতি আরও দ্রুত লয়ে বাড়তে থাকে। বিশেষ করে জ্বালানির দাম বেশি হারে বাড়ায় কোর ইনফ্লেশনও বেশি হারে বাড়ছে। তাছাড়া আমদানি খরচ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের চেয়ে অনেক বেশি হবার কারণে বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই চলতি হিসেবে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর চাপ গিয়ে পড়ছে ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার মূল্যমানের ওপর। প্রকৃত বিনিময় হারের কাছাকাছি থাকার প্রয়োজনে বেশিরভাগ দেশেই তাদের মুদ্রামান নমনীয় রেখে ধীরে ধীরে অবমূল্যায়নের কৌশল নিয়েছে। এর ফলে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে। তাই আমদানি মূল্যস্ফীতিও বেড়ে চলছে। একই সঙ্গে আবার এ কারণে আমদানির পরিমাণের ওপর লাগাম টানা যাচ্ছে। বাংলাদেশসহ

অনেক দেশই এর ওপর শুল্ক এবং মার্জিন বাড়িয়ে বিলাসী পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্দেশ্য আমদানি চাহিদা কমিয়ে ফেলা। অন্যদিকে বিনিময় হার নমনীয় করায় রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ার সুযোগ বেড়েছে। কিন্তু একদিকে ডলারের দাম আরও বাড়বে বলে বাজারে গুজব থাকায় এবং ফেডের আগ্রাসীভাবে সুদের হার বাড়িয়ে সংকোচন নীতি নেবার কারণে ডলার মূল্যের বন্ডসহ সকল আর্থিক পণ্যের দামই বাড়ছে। তাই উন্নয়নশীল দেশের শেয়ার মার্কেটে বা বন্ডে বিনিয়োগ করা বিদেশি বিনিয়োগ এখন যুক্তরাষ্ট্রমুখী হয়েছে। এমন সময় উন্নয়নশীল দেশের বন্ডের রিটার্নের হার না বাড়লে এই চঞ্চলমতি ডলার বিনিয়োগ ধরে রাখা খুবই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়নশীল দেশসমূহ বৈদেশিক মুদ্রার বাজারকে স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে ধীরে ধীরে তাদের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে। এশিয়ার আর্থিক সংকটকালে স্বল্প রিজার্ভ থাকায় তারা এই কাজটি করতে পারে নি। মালয়েশিয়া সেই সময় ডলার বিকিকিনি বরং বন্ধ করে দিয়েছিল। ইতোমধ্যে অনেক দেশেই রিজার্ভ প্রচুর বেড়েছে। তাই ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ভারত প্রচুর পরিমাণ ডলার রিজার্ভ থেকে বিক্রি করেছে। বাংলাদেশও গত এগারো মাসে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলারের মতো রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে। তাছাড়া অনেক অবকাঠামো নির্মাণেও পর্যাপ্ত ডলার জোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটা সম্ভব হচ্ছে কারণ ২০০৯ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিপুল হারে রিজার্ভ বৃদ্ধি করার কৌশল গ্রহণ করেছিল বলে। ঐ সময় আমাদের রিজার্ভ ছিল মাত্র সাত বিলিয়ন ডলারের মতো। ২০১৬ সালে তা ৩২ বিলিয়ন জলারে উঠে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক এই ধারা মোটামুটিভাবে অক্ষুণœ রাখে। তাই এই অর্থবছরে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার বিক্রি করার পরও আমাদের রিজার্ভ এখন প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার রয়ে গেছে। যদি প্রয়োজন হয় ডলার আরও বিক্রি করা যেতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা স্থিতিশীল করতে এশিয়ার অনেক দেশই তা করছে। আমাদের রিজার্ভ সাময়িকভাবে চল্লিশের নিচে নামলেও আতঙ্কিত হবার কোনো কারণ নেই। তবে হালে বিনিময় হার নমনীয় করার পর ধীরে ধীরে আবার রিজার্ভ বাড়তে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও আর্থিক সংস্থা থেকে আরও দীর্ঘমেয়াদী ঋণ নিতে এবং পাইপলাইনে থাকা প্রস্তাবিত ঋণ বেশি করে ছাড় করানোর পাশাপাশি স্পেশাল ইকোনমিক জোনে সরাসরি বিনিয়োগ আরও বেশি আকর্ষণ করা গেলে রিজার্ভ নিশ্চয় আরও বাড়বে। অন্যদিকে প্রবাসীদের ডলার বন্ড ও ওয়েজ আর্নার বন্ডে বিনিয়োগের নিয়মনীতি আরও গ্রাহক-বান্ধব করার পাশাপাশি রিটার্নের হার বাড়ানো গেলে বাংলাদেশের দিকে ডলারের প্রবাহ নিশ্চয় বাড়বে।

ডলার খরচে মিতব্যায়ী হবার বেশ কিছু সতর্কতামূলক নীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। আরও বেশ কিছু দিন এই নীতি অব্যাহত রাখতে হতে পারে। একইভাবে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণেও সাবধান হতে হবে। এক্ষুনি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হবে তেমন প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগী থেকে অযথা স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপে উন্নয়ন প্রকল্প এই সময়টায় না নেয়াই উচিত হবে। সেজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নের ধারা মনিটরিং-এর মাত্রা বাড়াতে হব। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাকে দেয়া বিদেশি ঋণের কিস্তি শোধের শিডিউল এমনভাবে করতে হবে যাতে একই সময় অনেকগুলো দায়শোধের ঘটনা না ঘটে। পর্যায়ক্রমে শোধ করলে হঠাৎ রিজার্ভের ওপর চাপ পড়বে না। ইআরডি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে আলাপ করে এই শিডিউল নিশ্চয় তৈরি করতে পারে। একইভাবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে যেন উন্নয়ন প্রকল্পগুলো এমনভাবে নেয়া হয় যাতে করে বিদেশ থেকে আমদানি করা কাঁচামাল ও কনসাল্টটেন্সির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। আমাদের প্রকৌশলিরা এখন বেশ দক্ষ। তাই তারা নিশ্চয় প্রয়োজনীয় উপদেষ্টা সার্ভিস দিতে পারবেন। পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় সিমেন্ট, বিটুমিন ও রডের সরবরাহের বড়ো অংশ কিন্তু আমাদের দেশীয় উদ্যোক্তারাই দিয়েছেন। তাই উন্নয়ন প্রকল্পে শুধু শুধু বিদেশি উপকরণ ব্যবহার না করে দেশি পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে পারলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে।

এমন করে সবদিক ভেবে সাধানতার সঙ্গে বিদেশি মুদ্রার সংগ্রহ ও ব্যবহার করতে পারলে আমাদের বৈদেশিক বাজার স্থিতিশীল রাখা মোটেও কঠিন হবে না। প্রয়োজন সকল অংশিজনের মধ্যে আরও নিবিড় সহযোগিতা ও সমন্বয়ের। আর দরকার বিদেশি মুদ্রার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করে করে জ্বালানি আমদানির দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়া। মনে হচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়বে। তাই এর সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং অর্থায়নে আরও দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করে যেতে হবে। বিপিসিসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রশাসনিক দক্ষতা আরও বাড়াতে হবে। তাদেরও বাজার থেকে ডলার কিনে তেল আমদানির চেষ্টা করতে হবে। একই সঙ্গে তেলের আগাম মজুদ গড়ার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা (যেমন ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) ও সংশ্লিষ্ট অন্য সহযোগীদের সাথে আলাপ করে এ বাবদ বিদেশি ঋণ ও সরবরাহ পাইপলাইন গড়ে তোলার জন্য ফিউচার অপশন নিয়ে কার্যকরভাবে ভাবতে হবে। মনে রাখা চাই তেলের দাম ঠিক রাখার ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি। এজন্য দরকার হবে স্মার্ট অর্থনৈতিক কূটনীতির। আশা করি বাংলাদেশ ব্যাংক, বিপিসি এবং অর্থ মন্ত্রণালয় মিলে এই সংকটকালে যথেষ্ট সহযোগিতা ও দক্ষতার পরিচয় দিতে পারবে। নিঃসন্দেহে বিশ্ব অর্থনৈতিক এই সংকটকালে বাংলাদেশকে খুবই সাবধানে পা ফেলতে হবে।