সংবাদ এবং আমার শৈশব

শান্তা মারিয়া

সংবাদ পত্রিকার কথা ভাবলেই আমি ফিরে যাই আমার শৈশবে। ফিরে যাই সত্তর ও আশির দশকে। ফিরে যাই আমার তারুণ্যের নব্বইয়ের দশকে। বলতে গেলে আমার লেখালেখি আমার প্রত্যাশা- সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘সংবাদ’ পত্রিকার নাম।

খুব ছোটবেলার কথা বলি। আমাদের বাড়িতে তিনটি পত্রিকা রাখা হতো। একটি ইংরেজি পত্রিকা আর দুটি বাংলা পত্রিকা। বাংলা পত্রিকার মধ্যে আসতো সংবাদ এবং ইত্তেফাক। ইত্তেফাকে বিজ্ঞাপন থাকতো এবং এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষার রুটিনসহ নানা জরুরি ও বাণিজ্যিক খবর ছাপা হতো। চাঞ্চল্যকর অপরাধের খবরও। সংবাদ রাখা হতো প্রাণের টানে। আমার বাবা কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর এই পত্রিকাটি ছাড়া চলতো না। সংবাদ তিনি পড়তেন সন্ধ্যায়। কাজের শেষে ঘরে ফিরে সংবাদ পত্রিকা এবং এক কাপ ওভালটিন মেশানো দুধ নিয়ে তিনি বসতেন ড্রইংরুমে।

বাবাকে দেখে দেখে আমারও সংবাদের প্রতি ছিল আলাদা আকর্ষণ। ছোটবেলায় আমি সাংবাদিক বলতেই বুঝতাম সন্তোষ গুপ্তকে। কারণ খুব ছোটবেলা থেকেই সংবাদ পত্রিকার অফিসে যেতাম বাবার সঙ্গে। বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন সন্তোষ গুপ্ত। দুজনের বয়সও কাছাকাছি। বাবার জন্ম ১৯২৬ সালে আর সন্তোষ গুপ্তর ১৯২৫ সালে। বাবা তাঁকে সন্তোষদা ডাকতেন। সেসময় সংবাদ অফিস ছিল পুরান ঢাকায়। ২৬৩ নম্বর বংশাল রোডে। যতদূর মনে পড়ে মানসী সিনেমা হলের কাছে। তখন আমার তিন চার বছর বয়স হবে। মুখে মুখে কবিতা লিখতাম। বাবা সেগুলোসহ আমাকে নিয়ে যান সংবাদ অফিসে। সন্তোষ কাকা সেগুলো দেখে সংবাদের খেলাঘর পাতায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। সেটিই আমার প্রথম প্রকাশিত লেখা। সাল ১৯৭৫। বয়স পাঁচ বছর। লেখাটি বয়সসহই ছাপা হয়েছিল। সংবাদ তাই আমার প্রথম প্রকাশিত লেখার স্মৃতিবাহী পত্রিকা। আমার কাছে এই স্মৃতি অমূল্য। প্রথম যেদিন সংবাদের খেলাঘর পাতায় নিজের নামসহ কবিতা ছাপা হতে দেখি সেদিন থেকে প্রথম ভালোবাসা হয়ে যায় সংবাদ।

সন্তোষ কাকা আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। আমি কোনো কিছু লিখে বাবাকে দেখালে তিনি সেটা প্রথমেই সন্তোষদাকে দেখাতেন। কারণ বাবার বিশ্বাস ছিল তিনি নিজে সাহিত্য অত বোঝেন না। আমিও তাই অপেক্ষায় থাকতাম সন্তোষ কাকার মতামতের। লেখালেখিতে আমার অত্মবিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর সন্তোষ গুপ্তর হাতে গড়া।

সংবাদ অফিসে গেলে প্রথমেই খাওয়াতেন ডালপুরি। আমি ছোট এবং বাবা চা খান না। তাই ডালপুরি এবং নাবিস্কো গ্লুকোজ বিস্কুট। সন্তোষ কাকা চেইন স্মোকার ছিলেন। সেটা বড় হয়ে দেখেছি। কিন্তু ছোটবেলায় আমার সামনে তিনি কোনোদিন সিগারেট খাননি।

খেলাঘরে আমার অনেক কবিতাই প্রকাশিত হয়েছিল। খেলাঘর পাতাটিকে তাই মনে হতো খুব আপন।

পরে সংবাদের পল্টন অফিসেও যেতাম বাবার সঙ্গে।

মনে আছে আশির দশকে আমি একটি কিশোর রোমান্টিক কবিতা সন্তোষ কাকাকে দেখালে তিনি সেটির এত প্রশংসা করেছিলেন যে, আমার মনটা ভরে গিয়েছিল। যদিও সংবাদের সাহিত্য পাতায় সেই ছেলেমানুষী লেখাটি ছাপা হয়নি। কারণ সেটি মানসম্মত ছিল না। সংবাদের সাহিত্য পাতায় আমার কবিতা প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল অনেক দিন। এতে বোঝা যায় স্বজনপ্রীতি ছিল না তার মধ্যে। ১৯৭৯ সালে আমার প্রথম প্রকাশিত বই (তখন আমার ৯ বছর বয়স) ‘মাধ্যাকর্ষণ’-এর ভূমিকাও লিখেছিলেন সন্তোষ গুপ্ত এবং বইটির আলোচনাও প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদেই।

সাংবাদিক হিসেবে আমার আদর্শ সন্তোষ কাকা। এখনও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই সংবাদ অফিসের সেই কাঠের চেয়ার টেবিল। সেখানে সন্তোষকাকার টেবিলে কাগজের স্তূপ। তার সৌম্য চেহারা। পরনে সাদা পোশাক। হাতে সিগারেট। সেই সিগারেট খাবার বা ধরার ভঙ্গিটিও অন্যরকম। অমায়িক ব্যবহার। একমাথা সাদা চুল। সন্তোষ কাকার হাসি ছিল অত্যন্ত স্নিগ্ধ। সেই স্নিগ্ধ চেহারাতেই তিনি আমার স্মৃতিতে চির দিন বেঁচে থাকবেন।

বলছিলাম সংবাদের সাহিত্য পাতার কথা। সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মানসম্মত ও প্রগতিশীল লেখা ছাপা হতো সংবাদে। মনে আছে আমাদের পুরো পরিবারের সবচেয়ে প্রিয় ছিল সৈয়দ শামসুল হকের ‘হৃৎকলমের টানে’ কলাম। প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হতো। সেটি পড়ার জন্য উন্মুখ থাকতাম আমরা। যদিও আমার তখন ওই কলাম পড়ার বয়স হয়নি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ভাইয়ার দেখাদেখি সেটা না পড়লে চলবেই না। সাহিত্য পাতার গল্প-কবিতাও ছিল সেরা লেখকদের। সেসময় সংবাদের সাহিত্য পাতায় লেখা প্রকাশ হওয়া মানেই রীতিমতো জাতে ওঠা। সেরা লেখকদের পংক্তিতে পৌঁছে যাওয়া।

নব্বইয়ের দশকে যখন বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পে ছিলাম তখন লেখক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় সংবাদের সাহিত্য পাতার প্রসঙ্গ চলে আসতো অবধারিতভাবে। অপেক্ষায় থাকতাম যদি সাহিত্য পাতায় একটা কবিতা প্রকাশ হয়। সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক তখন ছিলেন আবুল হাসনাত। তিনি কবিতা লিখতেন মাহমুদ আল জামান নামে। দীর্ঘ দুই যুগ তিনি সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। অমায়িক ভদ্রলোক। মৃদুভাষী। কিন্তু মনের ভিতরটা ছিল ভীষণ কঠিন। তার মানে মানসম্মত না হলে অতি প্রিয়জনের লেখাও তিনি প্রকাশ করতেন না। হাসনাত ভাইয়ের টেবিলে লেখা দিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। মনে শংকা ছিল, লেখাটি প্রকাশ হবে তো? কখনও হতো, কখনও বাতিল হয়ে যেত।

আমার কাছে আজও মনে হয় সংবাদের সাহিত্য পাতা সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সংবাদের চেয়ে সার্কুলেশনে অনেক অনেক এগিয়ে থাকা পত্রিকার সাহিত্য পাতাকেও আমি তেমন গুরুত্ব দিই না। কারণ সেসব জায়গায় মনে হয় বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে লেখাগুলো কোনোমতে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু সংবাদের সাহিত্য পাতায় লেখাগুলো তাদের আপন স্থান খুঁজে পায়।

সংবাদের বিনোদন পাতাটিও ছিল খুব রুচিশীল। সিনেমার কিছু খবরাখবর থাকতো বটে কিন্তু কিচ্ছা কাহিনী বা স্ক্যান্ডাল নিউজ কখনও সেখানে দেখিনি। বরং মঞ্চ নাটকের খবরাখবর মিলতো। বিনোদনে শুধু আমার নয়, সেই যুগের শিক্ষিত পরিবারের কিশোর তরুণদের রুচি গঠনে সংবাদের ভূমিকা বেশ বড় বলতে হবে।

সংবাদের আরেকজন সাংবাদিক ছিলেন বাবার বন্ধু। তিনিও বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের একজন স্তম্ভ। তিনি কে জি মুস্তাফা। কে জি চাচা যখন সংবাদে ছিলেন তখন বাবার সঙ্গে তাঁর অফিসকক্ষেও যাওয়া হতো।

বাবার লেখাও প্রকাশ হয়েছে সংবাদে। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি, তার তোলা ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের আলোকচিত্র, বাংলা বর্ষপঞ্জি বিষয়ক লেখা।

সংবাদের প্রবাদপ্রতীম সম্পাদক বজলুর রহমান ছিলেন বাবার অত্যন্ত কাছের মানুষ। বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাংবাদিক হিসেবে তিনি তো কিংবদন্তি। ব্যস্ত এই মহান মানুষটি যখন বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করতেন তখন কিন্তু তার মধ্যে কোনো বিরক্তি বা ‘সময় নষ্ট হচ্ছে এমন ভাব’ দেখিনি। কমিউনিস্ট পার্টির সূত্রেই তিনি ছিলেন বাবার নিকটজন।

বামপন্থী আন্দোলনের সূত্রেই বাবার দীক্ষাগুরু কিংবদন্তি লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক কমরেড রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদ বুদ্ধিজীবী কমরেড শহীদুল্লা কায়সার, কিংবদন্তি বিপ্লবী ও লেখক কমরেড সত্যেন সেন, কমরেড ফারহাদ প্রমুখ সকলেই ছিলেন বাবার খুব কাছের মানুষ এবং তারা প্রত্যেকেই সংবাদ পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন। বামপন্থী সাংবাদিকদের একান্ত আপন এই পত্রিকাটি সেকারণেই ছিল বাবার সবচেয়ে প্রিয়। আমারও।

সংবাদ বলতে আরেকজনের স্মৃতি মনে পড়লো। কবি ও সাংবাদিক বাশিরা ইসলাম। খেলাঘর পাতা থেকে তার সঙ্গে আলাপ। সেও লেখালেখি করতো শৈশব থেকে। আমার চেয়ে কিছুটা সিনিয়র ছিলেন। আমরা একসঙ্গে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিলাম। সংবাদের এই সাংবাদিক বড় অকালে ও অভিমানে চলে গেছেন নশ্বর জীবন থেকে। ‘বিরান খামার’ তার কবিতার বই।

সাংবাদিকতায় নারীদের অবস্থান গড়ে নেওয়ার পিছনেও সংবাদের ভূমিকা কম নয়। বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রর প্রতিষ্ঠাতা নাসিমুন আর হক মিনু, বিবিসিখ্যাত সাংবাদিক ঊর্মি রহমানসহ অনেক নারী সাংবাদিক তাদের সাংবাদিকতা জীবন সংবাদ থেকে শুরু করেছেন।

সংবাদে আমার প্রিয়জনদের কথা বলে শেষ হবে না। এখনও আছেন কবি ওবায়েদ আকাশ, কিছুদিন আগেও ছিলেন ছোটবোন সেবিকা দেবনাথসহ অনেকে।

সংবাদ পত্রিকাটি যখনি হাতে নেই, একটা সৌরভ পাই, স্মৃতির সৌরভ। ঐতিহ্যের সৌরভ। আমার শৈশব, কিশোরবেলা আর তারুণ্যকে ধারণ করে আছে সংবাদ। মনে পড়ে যায় সন্ধ্যাবেলা বাবার পাশে বসে সংবাদ পড়ার স্মৃতি। মনে পড়ে যায় প্রথম লেখা প্রকাশের আনন্দ, মনে পড়ে তারুণ্যে কবিতা প্রকাশের গৌরব, সন্তোষ কাকার স্নেহমাখা সৌম্য চেহারা।

সংবাদ চিরদিনই আছে এবং থাকবে আমার প্রিয় পত্রিকার সারিতে। ৭২তম জন্মদিনে বলি ‘জয়তু সংবাদ’।

image
আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
আমার বাতিঘর
শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা
নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
চলছে লড়াই, চলবে লড়াই
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
আমার ‘সংবাদ’
দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান
বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন
দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন
নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী
নতুন সময়ের গণমাধ্যম
‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’
মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

সংবাদ এবং আমার শৈশব

শান্তা মারিয়া

image

সংবাদ পত্রিকার কথা ভাবলেই আমি ফিরে যাই আমার শৈশবে। ফিরে যাই সত্তর ও আশির দশকে। ফিরে যাই আমার তারুণ্যের নব্বইয়ের দশকে। বলতে গেলে আমার লেখালেখি আমার প্রত্যাশা- সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘সংবাদ’ পত্রিকার নাম।

খুব ছোটবেলার কথা বলি। আমাদের বাড়িতে তিনটি পত্রিকা রাখা হতো। একটি ইংরেজি পত্রিকা আর দুটি বাংলা পত্রিকা। বাংলা পত্রিকার মধ্যে আসতো সংবাদ এবং ইত্তেফাক। ইত্তেফাকে বিজ্ঞাপন থাকতো এবং এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষার রুটিনসহ নানা জরুরি ও বাণিজ্যিক খবর ছাপা হতো। চাঞ্চল্যকর অপরাধের খবরও। সংবাদ রাখা হতো প্রাণের টানে। আমার বাবা কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর এই পত্রিকাটি ছাড়া চলতো না। সংবাদ তিনি পড়তেন সন্ধ্যায়। কাজের শেষে ঘরে ফিরে সংবাদ পত্রিকা এবং এক কাপ ওভালটিন মেশানো দুধ নিয়ে তিনি বসতেন ড্রইংরুমে।

বাবাকে দেখে দেখে আমারও সংবাদের প্রতি ছিল আলাদা আকর্ষণ। ছোটবেলায় আমি সাংবাদিক বলতেই বুঝতাম সন্তোষ গুপ্তকে। কারণ খুব ছোটবেলা থেকেই সংবাদ পত্রিকার অফিসে যেতাম বাবার সঙ্গে। বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন সন্তোষ গুপ্ত। দুজনের বয়সও কাছাকাছি। বাবার জন্ম ১৯২৬ সালে আর সন্তোষ গুপ্তর ১৯২৫ সালে। বাবা তাঁকে সন্তোষদা ডাকতেন। সেসময় সংবাদ অফিস ছিল পুরান ঢাকায়। ২৬৩ নম্বর বংশাল রোডে। যতদূর মনে পড়ে মানসী সিনেমা হলের কাছে। তখন আমার তিন চার বছর বয়স হবে। মুখে মুখে কবিতা লিখতাম। বাবা সেগুলোসহ আমাকে নিয়ে যান সংবাদ অফিসে। সন্তোষ কাকা সেগুলো দেখে সংবাদের খেলাঘর পাতায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। সেটিই আমার প্রথম প্রকাশিত লেখা। সাল ১৯৭৫। বয়স পাঁচ বছর। লেখাটি বয়সসহই ছাপা হয়েছিল। সংবাদ তাই আমার প্রথম প্রকাশিত লেখার স্মৃতিবাহী পত্রিকা। আমার কাছে এই স্মৃতি অমূল্য। প্রথম যেদিন সংবাদের খেলাঘর পাতায় নিজের নামসহ কবিতা ছাপা হতে দেখি সেদিন থেকে প্রথম ভালোবাসা হয়ে যায় সংবাদ।

সন্তোষ কাকা আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। আমি কোনো কিছু লিখে বাবাকে দেখালে তিনি সেটা প্রথমেই সন্তোষদাকে দেখাতেন। কারণ বাবার বিশ্বাস ছিল তিনি নিজে সাহিত্য অত বোঝেন না। আমিও তাই অপেক্ষায় থাকতাম সন্তোষ কাকার মতামতের। লেখালেখিতে আমার অত্মবিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর সন্তোষ গুপ্তর হাতে গড়া।

সংবাদ অফিসে গেলে প্রথমেই খাওয়াতেন ডালপুরি। আমি ছোট এবং বাবা চা খান না। তাই ডালপুরি এবং নাবিস্কো গ্লুকোজ বিস্কুট। সন্তোষ কাকা চেইন স্মোকার ছিলেন। সেটা বড় হয়ে দেখেছি। কিন্তু ছোটবেলায় আমার সামনে তিনি কোনোদিন সিগারেট খাননি।

খেলাঘরে আমার অনেক কবিতাই প্রকাশিত হয়েছিল। খেলাঘর পাতাটিকে তাই মনে হতো খুব আপন।

পরে সংবাদের পল্টন অফিসেও যেতাম বাবার সঙ্গে।

মনে আছে আশির দশকে আমি একটি কিশোর রোমান্টিক কবিতা সন্তোষ কাকাকে দেখালে তিনি সেটির এত প্রশংসা করেছিলেন যে, আমার মনটা ভরে গিয়েছিল। যদিও সংবাদের সাহিত্য পাতায় সেই ছেলেমানুষী লেখাটি ছাপা হয়নি। কারণ সেটি মানসম্মত ছিল না। সংবাদের সাহিত্য পাতায় আমার কবিতা প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল অনেক দিন। এতে বোঝা যায় স্বজনপ্রীতি ছিল না তার মধ্যে। ১৯৭৯ সালে আমার প্রথম প্রকাশিত বই (তখন আমার ৯ বছর বয়স) ‘মাধ্যাকর্ষণ’-এর ভূমিকাও লিখেছিলেন সন্তোষ গুপ্ত এবং বইটির আলোচনাও প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদেই।

সাংবাদিক হিসেবে আমার আদর্শ সন্তোষ কাকা। এখনও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই সংবাদ অফিসের সেই কাঠের চেয়ার টেবিল। সেখানে সন্তোষকাকার টেবিলে কাগজের স্তূপ। তার সৌম্য চেহারা। পরনে সাদা পোশাক। হাতে সিগারেট। সেই সিগারেট খাবার বা ধরার ভঙ্গিটিও অন্যরকম। অমায়িক ব্যবহার। একমাথা সাদা চুল। সন্তোষ কাকার হাসি ছিল অত্যন্ত স্নিগ্ধ। সেই স্নিগ্ধ চেহারাতেই তিনি আমার স্মৃতিতে চির দিন বেঁচে থাকবেন।

বলছিলাম সংবাদের সাহিত্য পাতার কথা। সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মানসম্মত ও প্রগতিশীল লেখা ছাপা হতো সংবাদে। মনে আছে আমাদের পুরো পরিবারের সবচেয়ে প্রিয় ছিল সৈয়দ শামসুল হকের ‘হৃৎকলমের টানে’ কলাম। প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হতো। সেটি পড়ার জন্য উন্মুখ থাকতাম আমরা। যদিও আমার তখন ওই কলাম পড়ার বয়স হয়নি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ভাইয়ার দেখাদেখি সেটা না পড়লে চলবেই না। সাহিত্য পাতার গল্প-কবিতাও ছিল সেরা লেখকদের। সেসময় সংবাদের সাহিত্য পাতায় লেখা প্রকাশ হওয়া মানেই রীতিমতো জাতে ওঠা। সেরা লেখকদের পংক্তিতে পৌঁছে যাওয়া।

নব্বইয়ের দশকে যখন বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পে ছিলাম তখন লেখক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় সংবাদের সাহিত্য পাতার প্রসঙ্গ চলে আসতো অবধারিতভাবে। অপেক্ষায় থাকতাম যদি সাহিত্য পাতায় একটা কবিতা প্রকাশ হয়। সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক তখন ছিলেন আবুল হাসনাত। তিনি কবিতা লিখতেন মাহমুদ আল জামান নামে। দীর্ঘ দুই যুগ তিনি সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। অমায়িক ভদ্রলোক। মৃদুভাষী। কিন্তু মনের ভিতরটা ছিল ভীষণ কঠিন। তার মানে মানসম্মত না হলে অতি প্রিয়জনের লেখাও তিনি প্রকাশ করতেন না। হাসনাত ভাইয়ের টেবিলে লেখা দিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। মনে শংকা ছিল, লেখাটি প্রকাশ হবে তো? কখনও হতো, কখনও বাতিল হয়ে যেত।

আমার কাছে আজও মনে হয় সংবাদের সাহিত্য পাতা সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সংবাদের চেয়ে সার্কুলেশনে অনেক অনেক এগিয়ে থাকা পত্রিকার সাহিত্য পাতাকেও আমি তেমন গুরুত্ব দিই না। কারণ সেসব জায়গায় মনে হয় বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে লেখাগুলো কোনোমতে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু সংবাদের সাহিত্য পাতায় লেখাগুলো তাদের আপন স্থান খুঁজে পায়।

সংবাদের বিনোদন পাতাটিও ছিল খুব রুচিশীল। সিনেমার কিছু খবরাখবর থাকতো বটে কিন্তু কিচ্ছা কাহিনী বা স্ক্যান্ডাল নিউজ কখনও সেখানে দেখিনি। বরং মঞ্চ নাটকের খবরাখবর মিলতো। বিনোদনে শুধু আমার নয়, সেই যুগের শিক্ষিত পরিবারের কিশোর তরুণদের রুচি গঠনে সংবাদের ভূমিকা বেশ বড় বলতে হবে।

সংবাদের আরেকজন সাংবাদিক ছিলেন বাবার বন্ধু। তিনিও বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের একজন স্তম্ভ। তিনি কে জি মুস্তাফা। কে জি চাচা যখন সংবাদে ছিলেন তখন বাবার সঙ্গে তাঁর অফিসকক্ষেও যাওয়া হতো।

বাবার লেখাও প্রকাশ হয়েছে সংবাদে। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি, তার তোলা ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের আলোকচিত্র, বাংলা বর্ষপঞ্জি বিষয়ক লেখা।

সংবাদের প্রবাদপ্রতীম সম্পাদক বজলুর রহমান ছিলেন বাবার অত্যন্ত কাছের মানুষ। বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাংবাদিক হিসেবে তিনি তো কিংবদন্তি। ব্যস্ত এই মহান মানুষটি যখন বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করতেন তখন কিন্তু তার মধ্যে কোনো বিরক্তি বা ‘সময় নষ্ট হচ্ছে এমন ভাব’ দেখিনি। কমিউনিস্ট পার্টির সূত্রেই তিনি ছিলেন বাবার নিকটজন।

বামপন্থী আন্দোলনের সূত্রেই বাবার দীক্ষাগুরু কিংবদন্তি লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক কমরেড রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদ বুদ্ধিজীবী কমরেড শহীদুল্লা কায়সার, কিংবদন্তি বিপ্লবী ও লেখক কমরেড সত্যেন সেন, কমরেড ফারহাদ প্রমুখ সকলেই ছিলেন বাবার খুব কাছের মানুষ এবং তারা প্রত্যেকেই সংবাদ পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন। বামপন্থী সাংবাদিকদের একান্ত আপন এই পত্রিকাটি সেকারণেই ছিল বাবার সবচেয়ে প্রিয়। আমারও।

সংবাদ বলতে আরেকজনের স্মৃতি মনে পড়লো। কবি ও সাংবাদিক বাশিরা ইসলাম। খেলাঘর পাতা থেকে তার সঙ্গে আলাপ। সেও লেখালেখি করতো শৈশব থেকে। আমার চেয়ে কিছুটা সিনিয়র ছিলেন। আমরা একসঙ্গে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিলাম। সংবাদের এই সাংবাদিক বড় অকালে ও অভিমানে চলে গেছেন নশ্বর জীবন থেকে। ‘বিরান খামার’ তার কবিতার বই।

সাংবাদিকতায় নারীদের অবস্থান গড়ে নেওয়ার পিছনেও সংবাদের ভূমিকা কম নয়। বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রর প্রতিষ্ঠাতা নাসিমুন আর হক মিনু, বিবিসিখ্যাত সাংবাদিক ঊর্মি রহমানসহ অনেক নারী সাংবাদিক তাদের সাংবাদিকতা জীবন সংবাদ থেকে শুরু করেছেন।

সংবাদে আমার প্রিয়জনদের কথা বলে শেষ হবে না। এখনও আছেন কবি ওবায়েদ আকাশ, কিছুদিন আগেও ছিলেন ছোটবোন সেবিকা দেবনাথসহ অনেকে।

সংবাদ পত্রিকাটি যখনি হাতে নেই, একটা সৌরভ পাই, স্মৃতির সৌরভ। ঐতিহ্যের সৌরভ। আমার শৈশব, কিশোরবেলা আর তারুণ্যকে ধারণ করে আছে সংবাদ। মনে পড়ে যায় সন্ধ্যাবেলা বাবার পাশে বসে সংবাদ পড়ার স্মৃতি। মনে পড়ে যায় প্রথম লেখা প্রকাশের আনন্দ, মনে পড়ে তারুণ্যে কবিতা প্রকাশের গৌরব, সন্তোষ কাকার স্নেহমাখা সৌম্য চেহারা।

সংবাদ চিরদিনই আছে এবং থাকবে আমার প্রিয় পত্রিকার সারিতে। ৭২তম জন্মদিনে বলি ‘জয়তু সংবাদ’।