আমার বাতিঘর

হারুন উর রশীদ

দৈনিক সংবাদের সঙ্গে আমার পরিচয় যখন আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র তখন থেকে। আমরা যারা তখন অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম তাদের অনেকের কাছেই ‘বাংলাদেশ ইকোনমি’র জন্য সংবাদের অর্থনীতির পাতা ছিলো অবশ্য পাঠ্য। আর সেই থেকেই আমি সংবাদের পাঠক। এখনো ছাড়িনি সংবাদকে। আর সংবাদও আমাকে ছাড়েনি। আমার বিশ^াস আমাকে এখনো মনে রেখেছে।

১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি আমার ফুল টাইম সাংবাদিকতা সংবাদ থেকেই শুরু। তবে তার আগে বেশ কয়েকবার সংবাদে গিয়েছি। তারা একবার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাছাই করা ছাত্রদের নিয়ে তাদের অফিসে একটি মতবিনিময়ের আয়োজন করেছিলো সেই সময়ে। উদ্দেশ্য ছিলো তরুণরা সংবাদকে কীভাবে দেখতে চায়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির (ডিইউডিএস) সভাপতি হিসেবে আমাকেও ডাকা হয়েছিলো সেই আলোচনায়। জহুরুল হক হলে আমরা রুমমেট কার্জন ভাই (শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, এখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক) আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তখন পত্রিকাটির বিশ^বিদ্যালয় প্রতিবেদক। পরে তিনি সেখানে ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন।

বছর খানেক পর তিনি আমাকে পত্রিকাটির ক্রাইম রিপোর্টার হওয়ার প্রস্তাব দেন। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ আমিও রাজি হয়ে যাই। সেই থেকে আমি হয়ে যাই “সংবাদের হারুন”। এরপর সংবাদ ছেড়ে আরো অনেক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। কিন্তু সংবাদের হারুন- এই পরিচয়টি আমার স্থায়ী হয়ে গেছে।

সংবাদে প্রায় ছয় বছর ছিলাম। ওইখানেই আমি সিনিয়র রিপোর্টার হই। ৩৬ পুরানা পল্টনের সংবাদ ওই সময় আমাকে যা শিখিয়েছে তাই আমার সাংবাদিকতা জীবনের পুঁজি হয়ে আছে। সেই পুঁজি দিয়েই চলছি এখনো। তখনই শুনতাম, সবাই বলতেন সংবাদ একটি প্রতিষ্ঠান, সাংবাদিক তৈরির একটি কেন্দ্র। আমার জীবনে তা সত্য হয়েছে। আশা করি এখনো সেরকমই আছে। আমরা তখন চিফ রিপোর্টার হিসেবে পেয়েছি কাশেম ভাইকে (কাশেম হুমায়ূন, বর্তমানে ব্যবস্থাপনা সম্পাদক), নিউজ এডিটর ছিলেন মনজুরুল আহসান বুলবুল, সম্পাদক বজলুর রহমান। সবার উপরে ছিলেন মালিক এবং প্রধান সম্পাদক আহমদুল কবির। আর আমাদের ক্রাইম বিভাগের প্রধান ছিলেন বসির আহমেদ। রিপোর্টার হিসেবে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আছেন।

কাশেম ভাইকে অনেক ভয় পেতাম, শ্রদ্ধাও করতাম। তার ব্যক্তিত্ব এবং অসাধারণ তথ্যসূত্রের জন্য। এমন কোনো সেক্টর ছিলো না যেখানে কাশেম ভাইর পরিচিত সোর্স বা সূত্র ছিলো না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুলিশ সদর দপ্তর। সচিবালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। যেখানেই তখন আমরা রিপোর্টাররা ব্যর্থ হতাম কাশেম ভাইর কাছে যেতাম। তিনি আমাদের ব্যবস্থা করে দিতেন। কাশেম ভাই’র ব্যাপারে একটা কথা প্রচলিত আছে। তার পকেটে সব সময়ই চার-পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ রির্পোটের ডকুমেন্ট থাকত। তিনি আমাদের নিজের নিউজ ভাগ করে দিতেন। আমরা তার ডকুমেন্ট দিয়ে বাইলাইন স্টোরি করতাম। এখনো মনে আছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় তাহের উদ্দিন ঠাকুরসহ কয়েকজনকে যখন রাত তিনটার দিকে গ্রেপ্তার করা হয় সেই খবর বাংলাদেশে সাংবাদিকদের মধ্যে শুধু কাশেম ভাই-ই জানতেন। শুধু জানাই শেষ নয়, সেই সময়ে বুলবুল ভাইকে সাথে নিয়ে কাশেম ভাইসহ অন্যরা হাতে খবর লিখে সংবাদের সিটি এডিশন বের করেছিলেন। সেটা বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে এক ইতিহাস।

বুলবুল ভাই আমাকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা শিখিয়েছেন। আমার জন্য তিনি “সংবাদ নেপথ্য” নামে আলাদা একটি আইটেমই চালু করেছিলেন। মনে আছে সেই নিউজ প্রিন্ট স্লিপে লেখার যুগে তিনি পুরো প্রতিবেদন প্রয়োজনে রি-রাইট করতেন। আমাদের শুধু বলতেন “ছাপা হওয়ার পর একবার অবশ্যই পড়বে”। এভাবেই শেখাতেন তিনি।

বজলুর রহমান সাহেবকে আমরা বজলু ভাই ডাকতাম। তার সঙ্গে আমাদের কথা হতো কম। তিনি নিজেও স্বল্পভাষী ছিলেন। কিন্তু সপ্তাহে তার সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলেই মাসের খোরাক হয়ে যেত। তিনি আইডিয়ার সাথে সাংবাদিকতার নীতির ব্যাপারে আমাদের বলতেন। তার একটি কথা আমি আমার সাংবাদিকতা জীবনের নীতি হিসবে সব সময় মেনে চলার চেষ্টা করি। তিনি বলতেন, “তুমি যে প্রতিবেদন করবে সেটা যদি কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যায় তাহলে সেই ব্যক্তির আসনে নিজেকে বসাবে। তারপর উপলব্ধি করার চেষ্টা করবে রিপোর্টটি যেভাবে লিখেছ তা ঠিক হয়েছে কি না।”

সংবাদের নীতি ছিলো ব্যক্তি মুখ্য নয়, প্রতিষ্ঠান ও সিস্টেম নিয়ে কথা বলা। নিজের কোনো মন্তব্য নয়, তথ্য উপাত্ত এবং কমেন্ট তুলে ধরা। ভাষায় আবেগ নয়, বস্তুনিষ্ঠ হওয়া। আর সেই কারণেই সংবাদের প্রতিবেদন ছিলো বিশ^াসযোগ্যতায় শীর্ষে। অনেকেই মনে করতেন সংবাদে প্রতিবেদন ছাপা হলে অ্যাকশন হবে। এখনো নিশ্চয়ই তাই মনে করেন।

দীর্ঘদেহী আহমদুল কবিরকে আমরা দেখতাম অবিচলভাবে সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসতে। সরাসরি তাঁর রুমে ঢুকে যেতেন। হঠাৎ হঠাৎ আমাদের সাপ্তাহিক রিপোর্টার মিটিং-এ হাজির হতেন। বসতেন না, দাঁড়িয়ে কথা বলতেন দুই-একটি। আমরাও দাঁড়িয়ে পড়তাম। তবে নির্ভার থাকতাম। তিনি যা বলতেন বুলবুল ভাই ও কাসেম ভাইকে। বলার শুরুতে তিনি তাদের “বুদ্ধিমান” বলে সম্বোধন করতেন। মনে আছে একবার একটি গুরত্বপূর্ণ নিউজ শেষ পাতায় ছাপা হয়েছে। তিনি বুলবুল ভাইর কাছে জানতে চাইলেন কারণ। বুলবুল ভাই জবাবে বললেন, কৌশলগত কারণে একটু আন্ডার ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়েছে। তখন কবির সাহেব বললেন, নিউজ যদি ছাপো তাহলে সঠিক ট্রিটমেন্ট দেবে। মনে করো না পিছনের পাতায় ছাপলে কেউ দেখবে না।

একবার তখনকার দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে কর্মরত তার এক আত্মীয়ের বিরুদ্ধে আমি একটি প্রতিবেদন করি। ছাপাও হয়। যারা তার আত্মীয়কে জানতেন তারা বললেন, “হারুন এবার

তোমার খবর আছে।” বুলবুল ভাই ওইদিনই আমার কাছ থেকে ডকুমেন্টগুলো নেন। সম্ভবত কবির সাহেবকে দেখান। আমি ভয়ে ভয়ে আছি। একদিন বুলবুল ভাই-ই বললেন, “কবির সাহেব তোমার রিপোর্টের প্রশংসা করেছেন।”

আমরা যখন বেতন-ভাতার জন্য আন্দোলন করতাম তখন কবির সাহেবও আমাদের আন্দোলনে শরিক হতেন। একবার আমরা অবস্থান ধর্মঘট করছি তিনিও আমাদের সাথে এসে বসে গেলেন। বললেন, “আমার বেতনটাও তোমরা দাও।” ফলে আন্দোলন বেশি দূর এগোতো না। তখনকার ইউনিট চিফ কার্তিক দা (কার্তিক চ্যাটার্জি) সব ম্যানেজ করে ফেলতেন। আন্দোলনও হতো, কাজও চলত, বেতনও পেতাম। আসলে সংবাদের বিষয়টি ছিলো একটি পরিবারের মতো। আর সেই পরিবারে আরেকজন আশ্রয় ছিলেন মিশু ভাই (আলতামাশ কবির, বর্তমানে সম্পাদক)। আমরা আমাদের অভাব অনুযোগ নিয়ে তাঁর কাছে গেলে একটা সমাধান পেতাম। তিনি তখন ছিলেন নির্বাহী পরিচালক।

সন্তোষ গুপ্ত আমাকে ডাকতেন ‘‘ক্রাইম হারুন” বলে। একটু সামনে ঝুঁকে হাঁটতেন। তার সিগারেট ফোঁকার একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো। হাতের মুঠোয় ফিল্টার গুঁজে টানতেন। তার কাছে কোনো বিষয় নিয়ে গেলে তিনি দ্রুতই রেফারেন্সসহ আমাদের তথ্য দিতেন। মজার আলাপ করতেন। আরেকজন ছিলেন ড. মকবুলার রহমান। সহকারী সম্পাদক। বিদেশি একটি বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ানো বাদ দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। তাঁকে আমরা বলতাম চলন্ত ডিকশনারি। কোনো বিষয়ে ধারণা নিতে গেলে তার কাছে পাইনি এমন ঘটেনি। আরো বিস্তারিত কোথায় পাওয়া যাবে তাও তিনি বলে দিতেন। মুনীরুজ্জামান, সোহরাব হাসান ভাই বিভিন্নভাবে আমাদের শিখিয়েছেন ব্যালেন্সড রিপোর্টিং।

আমি সাহিত্যের লোক নই। তবে সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত ভাইকে দেখেছি। সংবাদের সাহিত্য পাতা পড়ে পড়েই কিছুটা সাহিত্য অনুরাগী হয়েছি।

আমরা একদল তরুণ ওই সময়ে উঁচু মাপের সব মানুষের সঙ্গে সংবাদে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সেটাই আমার জীবনের অনেক বড় অর্জন। কোনো চাকচিক্য ছিলো না, ছিলো না কোনো বাড়তি আয়েজন। ছোট ছোট টেবিলে, নিউজ প্রিন্টের স্লিপে লিখে আমরা সংবাদে সাংবাদিকতা শুরু করেছি। কিন্তু যেখানেই গিয়েছি সংবাদের সাংবদিক শুনলে সমীহ পেয়েছি। সেই সমীহ নিশ্চয়ই এখনো সংবাদের সাংবাদিকরা পান।

সংবাদ আমার জীবনের একটি বাতিঘর। আমার বাবা এখন বেঁচে নেই। কিন্তু আমি যখন সংবাদে কাজ শুরু করি তখন আমার বাবা বেশ খুশি হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলে, এখানে কিছু শিখতে পারবে। কতটা পেরেছি জানি না, তবে সংবাদ কাউকে শিখাতে কার্পণ্য করেছে বলে মনে হয়নি। দেশের প্রাচীনতম দৈনিকটির আরো অনেক গর্বের ইতিহাস আছে। সেটা আমি এখানে নাইবা বললাম। আমি আমার দেখা সংবাদের কিছু কথা বললাম। আমার বাতিঘর সংবাদ আলো ছড়াক বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। বেঁচে থাকুক অনন্তকাল।

আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
সংবাদ এবং আমার শৈশব
শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা
নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
চলছে লড়াই, চলবে লড়াই
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
আমার ‘সংবাদ’
দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান
বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন
দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন
নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী
নতুন সময়ের গণমাধ্যম
‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’
মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

আমার বাতিঘর

হারুন উর রশীদ

দৈনিক সংবাদের সঙ্গে আমার পরিচয় যখন আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র তখন থেকে। আমরা যারা তখন অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম তাদের অনেকের কাছেই ‘বাংলাদেশ ইকোনমি’র জন্য সংবাদের অর্থনীতির পাতা ছিলো অবশ্য পাঠ্য। আর সেই থেকেই আমি সংবাদের পাঠক। এখনো ছাড়িনি সংবাদকে। আর সংবাদও আমাকে ছাড়েনি। আমার বিশ^াস আমাকে এখনো মনে রেখেছে।

১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি আমার ফুল টাইম সাংবাদিকতা সংবাদ থেকেই শুরু। তবে তার আগে বেশ কয়েকবার সংবাদে গিয়েছি। তারা একবার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাছাই করা ছাত্রদের নিয়ে তাদের অফিসে একটি মতবিনিময়ের আয়োজন করেছিলো সেই সময়ে। উদ্দেশ্য ছিলো তরুণরা সংবাদকে কীভাবে দেখতে চায়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির (ডিইউডিএস) সভাপতি হিসেবে আমাকেও ডাকা হয়েছিলো সেই আলোচনায়। জহুরুল হক হলে আমরা রুমমেট কার্জন ভাই (শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, এখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক) আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তখন পত্রিকাটির বিশ^বিদ্যালয় প্রতিবেদক। পরে তিনি সেখানে ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন।

বছর খানেক পর তিনি আমাকে পত্রিকাটির ক্রাইম রিপোর্টার হওয়ার প্রস্তাব দেন। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ আমিও রাজি হয়ে যাই। সেই থেকে আমি হয়ে যাই “সংবাদের হারুন”। এরপর সংবাদ ছেড়ে আরো অনেক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। কিন্তু সংবাদের হারুন- এই পরিচয়টি আমার স্থায়ী হয়ে গেছে।

সংবাদে প্রায় ছয় বছর ছিলাম। ওইখানেই আমি সিনিয়র রিপোর্টার হই। ৩৬ পুরানা পল্টনের সংবাদ ওই সময় আমাকে যা শিখিয়েছে তাই আমার সাংবাদিকতা জীবনের পুঁজি হয়ে আছে। সেই পুঁজি দিয়েই চলছি এখনো। তখনই শুনতাম, সবাই বলতেন সংবাদ একটি প্রতিষ্ঠান, সাংবাদিক তৈরির একটি কেন্দ্র। আমার জীবনে তা সত্য হয়েছে। আশা করি এখনো সেরকমই আছে। আমরা তখন চিফ রিপোর্টার হিসেবে পেয়েছি কাশেম ভাইকে (কাশেম হুমায়ূন, বর্তমানে ব্যবস্থাপনা সম্পাদক), নিউজ এডিটর ছিলেন মনজুরুল আহসান বুলবুল, সম্পাদক বজলুর রহমান। সবার উপরে ছিলেন মালিক এবং প্রধান সম্পাদক আহমদুল কবির। আর আমাদের ক্রাইম বিভাগের প্রধান ছিলেন বসির আহমেদ। রিপোর্টার হিসেবে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আছেন।

কাশেম ভাইকে অনেক ভয় পেতাম, শ্রদ্ধাও করতাম। তার ব্যক্তিত্ব এবং অসাধারণ তথ্যসূত্রের জন্য। এমন কোনো সেক্টর ছিলো না যেখানে কাশেম ভাইর পরিচিত সোর্স বা সূত্র ছিলো না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুলিশ সদর দপ্তর। সচিবালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। যেখানেই তখন আমরা রিপোর্টাররা ব্যর্থ হতাম কাশেম ভাইর কাছে যেতাম। তিনি আমাদের ব্যবস্থা করে দিতেন। কাশেম ভাই’র ব্যাপারে একটা কথা প্রচলিত আছে। তার পকেটে সব সময়ই চার-পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ রির্পোটের ডকুমেন্ট থাকত। তিনি আমাদের নিজের নিউজ ভাগ করে দিতেন। আমরা তার ডকুমেন্ট দিয়ে বাইলাইন স্টোরি করতাম। এখনো মনে আছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় তাহের উদ্দিন ঠাকুরসহ কয়েকজনকে যখন রাত তিনটার দিকে গ্রেপ্তার করা হয় সেই খবর বাংলাদেশে সাংবাদিকদের মধ্যে শুধু কাশেম ভাই-ই জানতেন। শুধু জানাই শেষ নয়, সেই সময়ে বুলবুল ভাইকে সাথে নিয়ে কাশেম ভাইসহ অন্যরা হাতে খবর লিখে সংবাদের সিটি এডিশন বের করেছিলেন। সেটা বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে এক ইতিহাস।

বুলবুল ভাই আমাকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা শিখিয়েছেন। আমার জন্য তিনি “সংবাদ নেপথ্য” নামে আলাদা একটি আইটেমই চালু করেছিলেন। মনে আছে সেই নিউজ প্রিন্ট স্লিপে লেখার যুগে তিনি পুরো প্রতিবেদন প্রয়োজনে রি-রাইট করতেন। আমাদের শুধু বলতেন “ছাপা হওয়ার পর একবার অবশ্যই পড়বে”। এভাবেই শেখাতেন তিনি।

বজলুর রহমান সাহেবকে আমরা বজলু ভাই ডাকতাম। তার সঙ্গে আমাদের কথা হতো কম। তিনি নিজেও স্বল্পভাষী ছিলেন। কিন্তু সপ্তাহে তার সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলেই মাসের খোরাক হয়ে যেত। তিনি আইডিয়ার সাথে সাংবাদিকতার নীতির ব্যাপারে আমাদের বলতেন। তার একটি কথা আমি আমার সাংবাদিকতা জীবনের নীতি হিসবে সব সময় মেনে চলার চেষ্টা করি। তিনি বলতেন, “তুমি যে প্রতিবেদন করবে সেটা যদি কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যায় তাহলে সেই ব্যক্তির আসনে নিজেকে বসাবে। তারপর উপলব্ধি করার চেষ্টা করবে রিপোর্টটি যেভাবে লিখেছ তা ঠিক হয়েছে কি না।”

সংবাদের নীতি ছিলো ব্যক্তি মুখ্য নয়, প্রতিষ্ঠান ও সিস্টেম নিয়ে কথা বলা। নিজের কোনো মন্তব্য নয়, তথ্য উপাত্ত এবং কমেন্ট তুলে ধরা। ভাষায় আবেগ নয়, বস্তুনিষ্ঠ হওয়া। আর সেই কারণেই সংবাদের প্রতিবেদন ছিলো বিশ^াসযোগ্যতায় শীর্ষে। অনেকেই মনে করতেন সংবাদে প্রতিবেদন ছাপা হলে অ্যাকশন হবে। এখনো নিশ্চয়ই তাই মনে করেন।

দীর্ঘদেহী আহমদুল কবিরকে আমরা দেখতাম অবিচলভাবে সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসতে। সরাসরি তাঁর রুমে ঢুকে যেতেন। হঠাৎ হঠাৎ আমাদের সাপ্তাহিক রিপোর্টার মিটিং-এ হাজির হতেন। বসতেন না, দাঁড়িয়ে কথা বলতেন দুই-একটি। আমরাও দাঁড়িয়ে পড়তাম। তবে নির্ভার থাকতাম। তিনি যা বলতেন বুলবুল ভাই ও কাসেম ভাইকে। বলার শুরুতে তিনি তাদের “বুদ্ধিমান” বলে সম্বোধন করতেন। মনে আছে একবার একটি গুরত্বপূর্ণ নিউজ শেষ পাতায় ছাপা হয়েছে। তিনি বুলবুল ভাইর কাছে জানতে চাইলেন কারণ। বুলবুল ভাই জবাবে বললেন, কৌশলগত কারণে একটু আন্ডার ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়েছে। তখন কবির সাহেব বললেন, নিউজ যদি ছাপো তাহলে সঠিক ট্রিটমেন্ট দেবে। মনে করো না পিছনের পাতায় ছাপলে কেউ দেখবে না।

একবার তখনকার দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে কর্মরত তার এক আত্মীয়ের বিরুদ্ধে আমি একটি প্রতিবেদন করি। ছাপাও হয়। যারা তার আত্মীয়কে জানতেন তারা বললেন, “হারুন এবার

তোমার খবর আছে।” বুলবুল ভাই ওইদিনই আমার কাছ থেকে ডকুমেন্টগুলো নেন। সম্ভবত কবির সাহেবকে দেখান। আমি ভয়ে ভয়ে আছি। একদিন বুলবুল ভাই-ই বললেন, “কবির সাহেব তোমার রিপোর্টের প্রশংসা করেছেন।”

আমরা যখন বেতন-ভাতার জন্য আন্দোলন করতাম তখন কবির সাহেবও আমাদের আন্দোলনে শরিক হতেন। একবার আমরা অবস্থান ধর্মঘট করছি তিনিও আমাদের সাথে এসে বসে গেলেন। বললেন, “আমার বেতনটাও তোমরা দাও।” ফলে আন্দোলন বেশি দূর এগোতো না। তখনকার ইউনিট চিফ কার্তিক দা (কার্তিক চ্যাটার্জি) সব ম্যানেজ করে ফেলতেন। আন্দোলনও হতো, কাজও চলত, বেতনও পেতাম। আসলে সংবাদের বিষয়টি ছিলো একটি পরিবারের মতো। আর সেই পরিবারে আরেকজন আশ্রয় ছিলেন মিশু ভাই (আলতামাশ কবির, বর্তমানে সম্পাদক)। আমরা আমাদের অভাব অনুযোগ নিয়ে তাঁর কাছে গেলে একটা সমাধান পেতাম। তিনি তখন ছিলেন নির্বাহী পরিচালক।

সন্তোষ গুপ্ত আমাকে ডাকতেন ‘‘ক্রাইম হারুন” বলে। একটু সামনে ঝুঁকে হাঁটতেন। তার সিগারেট ফোঁকার একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো। হাতের মুঠোয় ফিল্টার গুঁজে টানতেন। তার কাছে কোনো বিষয় নিয়ে গেলে তিনি দ্রুতই রেফারেন্সসহ আমাদের তথ্য দিতেন। মজার আলাপ করতেন। আরেকজন ছিলেন ড. মকবুলার রহমান। সহকারী সম্পাদক। বিদেশি একটি বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ানো বাদ দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। তাঁকে আমরা বলতাম চলন্ত ডিকশনারি। কোনো বিষয়ে ধারণা নিতে গেলে তার কাছে পাইনি এমন ঘটেনি। আরো বিস্তারিত কোথায় পাওয়া যাবে তাও তিনি বলে দিতেন। মুনীরুজ্জামান, সোহরাব হাসান ভাই বিভিন্নভাবে আমাদের শিখিয়েছেন ব্যালেন্সড রিপোর্টিং।

আমি সাহিত্যের লোক নই। তবে সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত ভাইকে দেখেছি। সংবাদের সাহিত্য পাতা পড়ে পড়েই কিছুটা সাহিত্য অনুরাগী হয়েছি।

আমরা একদল তরুণ ওই সময়ে উঁচু মাপের সব মানুষের সঙ্গে সংবাদে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সেটাই আমার জীবনের অনেক বড় অর্জন। কোনো চাকচিক্য ছিলো না, ছিলো না কোনো বাড়তি আয়েজন। ছোট ছোট টেবিলে, নিউজ প্রিন্টের স্লিপে লিখে আমরা সংবাদে সাংবাদিকতা শুরু করেছি। কিন্তু যেখানেই গিয়েছি সংবাদের সাংবদিক শুনলে সমীহ পেয়েছি। সেই সমীহ নিশ্চয়ই এখনো সংবাদের সাংবাদিকরা পান।

সংবাদ আমার জীবনের একটি বাতিঘর। আমার বাবা এখন বেঁচে নেই। কিন্তু আমি যখন সংবাদে কাজ শুরু করি তখন আমার বাবা বেশ খুশি হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলে, এখানে কিছু শিখতে পারবে। কতটা পেরেছি জানি না, তবে সংবাদ কাউকে শিখাতে কার্পণ্য করেছে বলে মনে হয়নি। দেশের প্রাচীনতম দৈনিকটির আরো অনেক গর্বের ইতিহাস আছে। সেটা আমি এখানে নাইবা বললাম। আমি আমার দেখা সংবাদের কিছু কথা বললাম। আমার বাতিঘর সংবাদ আলো ছড়াক বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। বেঁচে থাকুক অনন্তকাল।