চলছে লড়াই, চলবে লড়াই

শিহাব সরকার

দিনটি ছিলো এপ্রিলের মাঝামাঝি। ১৯৭১। এক দুপুরে তিতাসের পাড়ে বসে আছি। ওটার কূল ঘেঁষেই আমার মামাবাড়ি। হঠাৎ গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার শরাফত মামা হন্তদন্ত হয়ে মামাবাড়ির উঠানে এসে হাজির। খেয়া নৌকায় নদী পার হয়ে এ পাড়ায় আসতে হয়। মামার লুঙ্গি মালকোচা করে পরা। তাঁর সঙ্গে খাকী প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা দুই তরুণ। এদের একজনকে বয়সে বড় বলে মনে হলো। তিনজনেরই কাঁধে রাইফেল। সামান্য পেছনে আধা-পরিচিত দ্ইু কিশোর। ওরা খুব কসরত ক’রে একটা ছোট কামান বয়ে আনছিলো। লম্বা নল। পরে জেনেছি ওটা ফিল্ডগান। আমি তখন জীবনে ঐ অস্ত্রটি প্রথম দেখি।

মামা এক নাগাড়ে বলে গেলেন, চকের ওপাশে বড় মেঘনা দিয়ে একটা পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজ যাবে কিছুক্ষণ পর। ইপিআর-এর ওয়্যারলেসে খবরটা ধরা পড়েছে। জাহাজটা এলাকার সব গ্রাম আক্রমণ করবে। এগুলোতে নাকি মুক্তবাহিনীর ট্রেনিং হচ্ছে। আমি দেখলাম স্যান্ডো গেঞ্জি-প্যান্ট পরা দুই তরুণের একজনের হাতে ওয়্যারলেস। উর্দুতে বেশ কিছু মানুষ একসঙ্গে কথা বলছে। বুঝে নিলাম এরা ইপিআর বাহিনীর সৈনিক। উত্তেজনায় আমি স্থির থাকতে পারছিলাম না, যখন মামা বললেন ওরা নদীর পাড়ে পাটক্ষেতের ভেতর থেকে জাহাজ আক্রমণ করবেন। চওড়া মেঘনা আমার মামাবাড়ি থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। সারি সারি পালতোলা নৌকা, লঞ্চ চলাচল করে সারাক্ষণ। তখন অবশ্য এগুলোর সংখ্যা থেমে গেছে। নদীটা আসলে দেড়-দুই মাইল দূরে। এপ্রিলের কাঠফাটা রোদে আমরা যখন পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে জোরকদমে হেঁটে, দৌড়ে মেঘনার পাড়ে গিয়ে পৌঁছুলাম, ঘামে আমাদের গোসল হয়ে গেছে। যে কিশোর দু’জন কামান আর গোলার বাক্স বয়ে আনছিলো, ওদের শোচনীয় অবস্থা। কিন্তু মুখ সতেজ। পেশি টানটান। আমি নিজের মুখটা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম।

মামা আমাকে দল থেকে আস্তে করে বেরিয়ে গিয়ে নদীর পাড়টা রেকি করে আসতে বললেন; বিশেষ করে খেয়াল করতে বললেন দূরে জাহাজের আভাস পাওয়া যায় কিনা। আমাকে আর উঠতে হলো না। দুই ইপিআর জওয়ানের বড়জন জোরে বলে উঠলেন, “হাতিয়ার রেডি! সাউন্ড আসতেছে। কুইক!” শরাফত মামা আমাকে তাঁর পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে বললেন। একটা বড় বায়নাকুলার দিলেন হাতে। আমার খুব উত্তেজনা হচ্ছিলো, ভয়ও লাগছিলো। দেখতে দেখতে জাহাজটা আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে এসে গেলো। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম ডেকের ওপর পাকবাহিনীর সৈনিকরা কামানে গোলা ভরছে। একজন একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কিছু বলছিলো। বাকিরা মাথা নিচু করে শুনছে। স্ট্যান্ড-অ্যাট-ইজ ভঙ্গিতে সবাই দাঁড়ানো। অন্যদিকে বেশকিছু সৈনিক প্যারেড করছে, আরেক দল বাতাসে বেয়নেট চার্জের মহড়া করছে। দেখতে দেখতে বিশাল জাহাজটা আমাদের প্রায় চোখের সামনে। শরাফত মামা বললেন, “রাইফেলে কাজ হবে না। ফিল্ডগান লাগবে। হেভি শিপ।” সঙ্গে সঙ্গে ইপিআর-এর এক সৈনিক কামানে শেল ঢোকালেন। জোরে জোরে বললেন, “কানে হাত।” সঙ্গে সঙ্গে গগণবিদারী শব্দ। আমি বায়নাকুলারে দেখলাম বেশ কিছু পাকসেনা লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। মনে হলো হঠাৎ আক্রমণে ওরা হতভম্ব। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওরা পরিস্থিতি সামলে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করলো। ওদেরটাও ফিল্ডগান। অনবরত গোলার স্পি্লন্টার উড়ে যাচ্ছে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। আমরা সবাই মাটির সঙ্গে মিশে উপুড় হয়ে শুয়ে আছি। কামানের গোলা ছুঁড়ছিলেন যে ইপিআর সৈনিক, তিনি অবিরাম চার্জ করে যাচ্ছিলেন। শেল ভরছিলো দুই কিশোরের একজন। শরাফত মামা অবিরাম গোলাবর্ষণের মধ্যে চিৎকার করে বলে উঠলেন, “এবার রিট্রিট। ওরা আমাদের চেয়ে অনেক পাওয়ারফুল। এবার এয়ারফোর্সের প্লেন এসে পড়বে। লেট আস মুভ ব্যাক। আমাদের অপারেশন সাকসেসফুল।” মামা কথা শেষ করতে পারলেন না। এক ডজন স্যাবার জেট বিদ্যুৎগতিতে উড়ে গেলো মাথার ওপর দিয়ে। ইপিআরের দুই জওয়ানের সিনিয়ারজন বললেন, “স্টপ অল মুভমেন্ট। ঘাসের সঙ্গে মিশে মাটিতে লাশের মতো আমরা এখন পড়ে থাকবো। কতক্ষণ জানি না। আগে প্রাণ বাঁচাতে হবে। তারপর যুদ্ধ। অনেক যুদ্ধ আছে সামনে। জয় বাংলা।”

হাতে, পিঠে, মুখে পাটক্ষেতের হলুদ বিছা হাঁটছে। শরীর অবশ হয়ে আছে। স্যাবার জেটগুলো আমাদের ওপর দিয়ে আরেকটা চক্কর দিয়ে গেলো। আমার হাত থেকে বায়নাকুলাটার নিয়ে চোখে লাগিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখলেন একজন সৈনিক। তারপর বলে উঠলেন, ‘সর্বনাশ, এক্ষণ ওঠেন সবাই। জাহাজ পাড়ে

ভিড়তেছে। আমাদের এই জায়গা ছাড়তে হবে। নাইল্যা খ্যাত উঁচা আছে। কুজা হইয়া সবাই গ্রামের দিকে চলেন। কামানের দায়িত্ব আমি নিলাম।” এপ্রিলের তীব্র রোদে ঘামে জবজবে হয়ে যথাসম্ভব নিচু হয়ে এগুতে থাকলাম। শরাফত মামার খুব সাহস। তিনি এক ফাঁকে মাথা উঁচু করে জাহাজের অবস্থানটা দেখে বললেন, “জাহাজ পাড়ে ভিড়ছে। শালারা নামার পায়তারা করতেছে। মনে হয় ভয়ও পাইছে। ও ভাই, মারেন না আরো কয়খান শেল!”

“পাগলামি কইরেন না। এখন পাগলামির সময় না। আগে জান বাঁচান। আইজ রাইতে সব গ্রাম ঘেরাও দিয়া গুলি কইরা মানুষ মারবো। তার পরে গ্রাম জ্বালাইয়া দিব। বিকালের মধ্যে সবগুলা গ্রাম খালি করতে হইব। আগান। হাত পাও ছিলা গেলেও আগান।” ইপিআরের বয়স্ক সৈনিক ভদ্রলোক কথাগুলো বলে থামলেন।

দ্রুত বিকেল নেমে এলো। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা। মামাবাড়ি পৌঁছে দেখি লোকজন বাক্স-তোরঙ্গ গোছাচ্ছে, গাট্টি-বোঁচকা বাঁধছে। সবার চোখমুখ সন্ত্রস্ত, ফ্যাকাশে। নানা গম্ভীরভাবে সবকিছু তদারক করছেন। বলছেন, তিনি বাড়ি ছাড়বেন না। তিনি চলে গেলে গোয়ালভর্তি গরুগুলো কে দেখবে। একথা শুনে মহিলাদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেলো। “আমি বুড়া মানুষ। মিলিটারি আমারে কিছু করবে না।” আমরা সন্ধ্যার আগে-আগে বড়মামার শ্বশুরবাড়ি মোহিনীপুরের দিকে রওনা হয়ে গেলাম। সারারাত হাঁটতে হবে। ঘণ্টা দুয়েক হাঁটার পর কে যেন চিৎকার করে বলে উঠলো, “সবাই পিছে দেখেন।” দেখলাম অন্ধকার প্রান্তরের ওপারে দাউ দাউ করে গ্রাম জ্বলছে। আকাশের বর্ণ লাল। মানুষের আর্তচিৎকার ভেসে আসছে। ঐ শব্দ ছাপিয়ে রক্ত হিম করা কামানের গোলার শব্দ। একটা শব্দ অচেনা মনে হলো। ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন বললো, “মেশিনগান চালাইতাছে।” পড়িমড়ি করে আছাড় খেয়ে, ধুলোকাদা আর রক্তমাখা অবস্থায় আমরা যখন মোহিনীপুর পৌঁছুলাম, ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটা।

তিনদিন ছিলাম আমরা, সব মিলিয়ে মামাবাড়ির পঁচিশ-ত্রিশজন মানুষ, মোহিনীপুর গ্রামে। যখন মামাবাড়ি ফিরে এলাম, পুরো বাড়ি তছনছ। গোয়ালঘর ফাঁকা। একটা গরুও নেই। নানা নদীর পাড়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। নদীর ওপারে জ্বলন্ত গ্রামের পর গ্রাম দেখে গরুগুলো দড়ি ছিঁড়ে যে-যার মতো ছুটে বেরিয়ে গেছে। তার ওপর ভারি কামানের গোলার শব্দ। নানা বুদ্ধি করে স্বাধীন বাংলার পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন একটা লম্বা লগির মাথায়। তিনি ছিলেন এলাকার ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। তাঁর কাছে একটা পতাকা রাখা ছিলো, যেটা তাঁকে ওড়াতে হতো ১৪ই আগস্ট, পাকিস্তান দিবসে। সরকারের নির্দেশ। খোঁজাখুঁজির পর দুটো গরু পাওয়া গেলো। বাকিগুলো হারিয়ে যায় চিরতরে।

কিছুদিন পর দূর-দূরান্ত থেকে শরণার্থীরা দল বেঁধে আসতে থাকে নবীনগর লঞ্চঘাটে। ওখান থেকে লঞ্চে করে ওরা যাচ্ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে কসবায় পৌঁছে ত্রিপুরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে, অর্থাৎ আগরতলা শহরে এবং বিভিন্ন এলাকায়। মামাবাড়ি বা ঢাকার বাসার কাউকে কিছু না জানিয়ে আমিও ঠিক করলাম শরণার্থীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে ত্রিপুরা চলে যাবো। সেখান থেকে মেলাঘর ট্রেনিং ক্যাম্প। যাওয়ার দিন নবীনগর ঘাটে অন্যান্য যাত্রীর সঙ্গে লঞ্চের অপেক্ষা করছি। দশটা-এগারোটা বাজে। সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললে বিকেল চারটার মধ্যে আমি আগরতলা পৌঁছে যেতে পারবো। সেখান থেকে দীর্ঘ, দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়ে মেলাঘর। ওই পথটুকু নিয়ে আমি দুশ্চিন্তায় ছিলাম। অনেকে যানবাহন না পেয়ে হেঁটে চলে যায় ত্রিপুরার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে। আর আমি যাবো মেলাঘরে। সেখানে যাওয়ার সঙ্গী পাবো কিনা কে জানে! এসব নিয়ে ভাবছি, হঠাৎ কাঁধে হাতের স্পর্শ। পেছনে তাকিয়ে দেখি বড়মামা। থতমত খেয়ে গেলাম।

এইখানে কী? মামা জিজ্ঞেস করলেন।

কিছু না। মানুষ দেখতাছি। এত মানুষ ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাইতেছে। কারণটা কী। আমি ঢোক গিলে বললাম।

তুই বুঝি জানস না? তোর হাতে ব্যাগ ক্যান? আমার হাতে নীল রঙের চৌকোনা লম্বাটে একটা ব্যাগ ছিলো। আগেকার দিনে ডাক্তাররা এটা নিয়ে রোগীদের ভিজিটে যেতেন।

আমি একটা যুৎসই উত্তর খুঁজছিলাম। কী বিপদে পড়া গেল।

মেলাঘর যাইতাছস? এখন এই নামই লইস না। কসবা বর্ডারে গণ্ডগোল হইতাছে। অনেক মানুষ মারা গেছে। আমি তোরে কুমিল্লা বর্ডার দিয়া পার কইরা দিমু। সঙ্গে গ্রামের আরো অনেক ছেলে যাবে।

মন খারাপ হয়ে গেলো আমার। মুখে কিছু বললাম না। বড়মামা বলে কথা। আমার সাত মামার মধ্যে সবার বড়। কুমিল্লা বর্ডার দিয়েও পরে আমার আর ত্রিপুরা যাওয়া হয়ে ওঠে না। মামা বলেন বর্ডার ‘গরম’। সময় এলে বলবেন। পরে বুঝলাম, উনি আমাকে একা মেলাঘর পাঠাতে চাইছিলেন না। মামার গ্রামের ছেলেরা এপ্রিলের শুরুতেই ওপারে চলে গেছে। তার ওপর আমি মামাদের একমাত্র বোনের ছেলে। আম্মা ছিলেন সাত ভাই চম্পার মতো। তাঁর মৃত্যুর খবর নিয়ে যে টেলিগ্রামটা আসে করাচি থেকে চৌদ্দ বছর আগে, সেটা পোস্ট অফিস থেকে সংগ্রহ করেন এই মামাই। আব্বার চাকরিসূত্রে আমরা তিন বছর করাচি ছিলাম। আমি তখন একেবারে বালক।

টেলিগ্রামটি হাতে নিয়ে মামা প্রায় সারাদিন নিজের কাছে রেখেছিলেন। হাউমাউ করে কেঁদেছেন কখনো নদীর পাড়ে, কখনো নৌকায় বসে মাঝগাঙে। এহেন মামা আমাকে অজানা গন্তব্যে ছাড়তে চাইছিলেন না। বোধ হয়, তাঁর আশঙ্কা ছিলো আমি মুক্তিযুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরে আসতে পারবো না। মেলাঘর আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি সেবার। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত কাজে ঢাকা থেকে আগরতলা গিয়েছিলাম জুলাই মাসে। আমি তখন ঢাকা-কেন্দ্রিক মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হাতিরপুলের একটি গোপন আস্তানা থেকে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ‘স্বাধীনতা’ নামে হাতে লেখা একটি বুলেটিন বের করি। ঐ আস্তানায় আগরতলা এবং কলকাতার অনেক বুলেটিন ও পত্রিকা আসতো। নানা ছদ্মবেশে এবং বিভিন্ন গোপন পদ্ধতিতে আমরা কয়েকজন তরুণ ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকাটি ঢাকার বিভিন্ন গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতাম। খুবই বিপদসঙ্কুল কাজ ছিলো ওটা। আমি এবং আমার এক বন্ধু একবার বাজারের ব্যাগে ভরা বুলেটিনের বান্ডিলসহ রাজাকার ও পাকসেনাদের ক্যাম্পের সামনে ধরা পড়ে গেলাম। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়। সে কী অমানুষিক নির্যাতন। নেহাৎ ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে যাই।

জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ঢাকা ছিলো জনশূন্য শহর। জনসংখ্যার ষাটভাগ চলে গেছে গ্রামাঞ্চলে। সরকারি চাকরিজীবীরা ছাড়া ঢাকায় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ছিলো না প্রায়। পাকবাহিনী চাপ দিয়ে কিছু স্কুল-কলেজ খুলিয়ে রেখেছে। ছাত্রছাত্রী নেই। এক-দুইজন শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক বা প্রিন্সিপাল হাজির থাকেন। রাস্তায় মানুষ নেই প্রায়। পথচারীরা ভয়ার্ত মুখে দ্রুত চলাচল করে। অধিকাংশ মানুষের মাথায় টুপি। শার্টে, পাঞ্জাবিতে কলেমা বা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ লেখা কাগজের ব্যাজ। ঘর থেকে বেরিয়েই মানুষ ভেবে নেয়, কোন রাস্তা ধরে গেলে পাকবাহিনী বা রাজাকার-আলবদরের ক্যাম্প সামনে পড়বে না। আমি তখন অন্যদের সঙ্গে সাইক্লোস্টাইলে ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার মুদ্রণ এবং বিতরণ নিয়ে ব্যস্ত। সেন্ট্রাল রোডের বাসায় আব্বা, আমি এবং আমার এক নানা। একজন মামাও ছিলেন কিছুদিনের জন্য। আগস্টের দিকে শহরে ক্র্যাক প্লাটুনের অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। রাত আটটা-নটার দিকে শুরু হয় পাকবাহিনীর এলোপাথাড়ি গুলি। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্র্যাক প্লাটুনের গ্রেনেড এবং এলএমজির প্রত্যুত্তর। ভোররাত পর্যন্ত চলে এসব খণ্ডযুদ্ধ। ঢাকায় তখন যে ক’জন মানুষ আছে, সবাই রাতভর গোলাগুলির শব্দে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। গুলি বা গ্রেনেড ফাটার শব্দ না শুনলে ঘুম আসে না। দিনের বেলা ঢাকা আতঙ্কের নগরী। সন্ধ্যার পর শহর চলে যায় ক্র্যাক প্লাটুন এবং অন্যান্য গেরিলা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। এগুলোর একটি ছিলো গ্রীন রোডের আজিজ বাহিনী। বেশ ক’টি দুঃসাহসী অপারেশন চালায় গ্রুপটি ধানমন্ডি, ফার্মগেট ও নিউমার্কেট এলাকায়। আজিজ ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের ছাত্র ছিলো। বরাবর একটু দুর্ধর্ষ ধরনের। দুঃখ হয়, ঢাকার মুক্তিযুদ্ধকালীন অপারেশন নিয়ে যেসব ইতিহাস লেখা হয়েছে সেগুলোতে তেমনভাবে আজিজ বাহিনীর উল্লেখ নেই। অথচ ও ছিলো আপাদমস্তক একজন গেরিলা যোদ্ধা।

দুই.

ডিসেম্বর প্রথম সপ্তাহ থেকে ঢাকা বিমান বন্দরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান-কেন্দ্রিক পাকিস্তান এয়ারফোর্সের সব বিমান ধ্বংস হয়ে গেছে। চারদিক থেকে বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত করে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছে যৌথ বাহিনী। দেখতে দেখতে এসে গেলো বিজয়ী যৌথ বাহিনীর কাছে পরাজিত পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন। ষোলোই ডিসেম্বর, ১৯৭১। আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটি হলো ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে। গুজব ছিলো সারেন্ডারের আগে পাকবাহিনী ঘরে ঘরে ঢুকে বাঙালি নিধন করবে, মর্টার শেল মেরে শহর গুঁড়িয়ে দেবে। মূলত এসবের কিছুই হলো না। ষোলোই ডিসেম্বর বিকেল চারটায় যৌথ বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডারের প্রধান জেনারেল নিয়াজি। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এখনকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভুদ্যয়ের ঐ ঐতিহাসিক মুহূর্তের একজন নগণ্য সাক্ষী ছিলাম আমিও। পুরো অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত থেকে অন্যান্যদের সঙ্গে গলা চিরে স্লোগান দিই ‘জয় বাংলা’। তারপর খণ্ড খণ্ড মিছিলের সঙ্গে ঘুরি শহরময়।

ষোলোই ডিসেম্বর দেশ মুক্ত এবং স্বাধীন হলো। এবং একই সঙ্গে জন্ম নিলো আমার এক নতুন সত্তা। শৌখিন লেখক আমি। পঁচিশে মার্চ গণহত্যা শুরু হওয়ার পর কলম সরিয়ে রেখেছিলাম। সতেরোই ডিসেম্বর সেই ফাউন্টেন পেনে আবার কালি ভরলাম দোয়াত থেকে। ডাইরির পাতায় বড় বড় অক্ষরে লিখলাম, ‘আজ ঢাকা মুক্ত হলো। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন রাষ্ট্র।’ বেশকিছু কবিতা লিখে ফেললাম কয়েক দিনে। আমার কলম আর থামেনি। থামবেও না যতকাল বেঁচে আছি। লিখি আপন মনে। ছাপা হোক আর না হোক। পড়ি বিখ্যাত কবিদের লেখা। তরুণদের নতুন তরতাজা কবিতা। ব্যাধি এবং বার্ধক্যের ভারে আমি আজ শয্যাশায়ী। এখন আমার সারাক্ষণের সঙ্গী খবরের কাগজ। মাঝে মাঝে মনটা তিক্ত হয়ে যায়। আতঙ্ক চেপে ধরে। স্বপ্নে প্রায়ই একটা দৃশ্য দেখি। ঘোরকালো মেঘে হঠাৎ জ্যোৎ¯œাভরা আকাশ ছেয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে বাতাসে ভাসে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কোরাস, “দেশ স্বাধীন। কিন্তু চলছে লড়াই, চলবে লড়াই।”

image
আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
সংবাদ এবং আমার শৈশব
আমার বাতিঘর
শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা
নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
আমার ‘সংবাদ’
দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান
বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন
দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন
নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী
নতুন সময়ের গণমাধ্যম
‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’
মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

চলছে লড়াই, চলবে লড়াই

শিহাব সরকার

image

দিনটি ছিলো এপ্রিলের মাঝামাঝি। ১৯৭১। এক দুপুরে তিতাসের পাড়ে বসে আছি। ওটার কূল ঘেঁষেই আমার মামাবাড়ি। হঠাৎ গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার শরাফত মামা হন্তদন্ত হয়ে মামাবাড়ির উঠানে এসে হাজির। খেয়া নৌকায় নদী পার হয়ে এ পাড়ায় আসতে হয়। মামার লুঙ্গি মালকোচা করে পরা। তাঁর সঙ্গে খাকী প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা দুই তরুণ। এদের একজনকে বয়সে বড় বলে মনে হলো। তিনজনেরই কাঁধে রাইফেল। সামান্য পেছনে আধা-পরিচিত দ্ইু কিশোর। ওরা খুব কসরত ক’রে একটা ছোট কামান বয়ে আনছিলো। লম্বা নল। পরে জেনেছি ওটা ফিল্ডগান। আমি তখন জীবনে ঐ অস্ত্রটি প্রথম দেখি।

মামা এক নাগাড়ে বলে গেলেন, চকের ওপাশে বড় মেঘনা দিয়ে একটা পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজ যাবে কিছুক্ষণ পর। ইপিআর-এর ওয়্যারলেসে খবরটা ধরা পড়েছে। জাহাজটা এলাকার সব গ্রাম আক্রমণ করবে। এগুলোতে নাকি মুক্তবাহিনীর ট্রেনিং হচ্ছে। আমি দেখলাম স্যান্ডো গেঞ্জি-প্যান্ট পরা দুই তরুণের একজনের হাতে ওয়্যারলেস। উর্দুতে বেশ কিছু মানুষ একসঙ্গে কথা বলছে। বুঝে নিলাম এরা ইপিআর বাহিনীর সৈনিক। উত্তেজনায় আমি স্থির থাকতে পারছিলাম না, যখন মামা বললেন ওরা নদীর পাড়ে পাটক্ষেতের ভেতর থেকে জাহাজ আক্রমণ করবেন। চওড়া মেঘনা আমার মামাবাড়ি থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। সারি সারি পালতোলা নৌকা, লঞ্চ চলাচল করে সারাক্ষণ। তখন অবশ্য এগুলোর সংখ্যা থেমে গেছে। নদীটা আসলে দেড়-দুই মাইল দূরে। এপ্রিলের কাঠফাটা রোদে আমরা যখন পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে জোরকদমে হেঁটে, দৌড়ে মেঘনার পাড়ে গিয়ে পৌঁছুলাম, ঘামে আমাদের গোসল হয়ে গেছে। যে কিশোর দু’জন কামান আর গোলার বাক্স বয়ে আনছিলো, ওদের শোচনীয় অবস্থা। কিন্তু মুখ সতেজ। পেশি টানটান। আমি নিজের মুখটা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম।

মামা আমাকে দল থেকে আস্তে করে বেরিয়ে গিয়ে নদীর পাড়টা রেকি করে আসতে বললেন; বিশেষ করে খেয়াল করতে বললেন দূরে জাহাজের আভাস পাওয়া যায় কিনা। আমাকে আর উঠতে হলো না। দুই ইপিআর জওয়ানের বড়জন জোরে বলে উঠলেন, “হাতিয়ার রেডি! সাউন্ড আসতেছে। কুইক!” শরাফত মামা আমাকে তাঁর পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে বললেন। একটা বড় বায়নাকুলার দিলেন হাতে। আমার খুব উত্তেজনা হচ্ছিলো, ভয়ও লাগছিলো। দেখতে দেখতে জাহাজটা আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে এসে গেলো। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম ডেকের ওপর পাকবাহিনীর সৈনিকরা কামানে গোলা ভরছে। একজন একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কিছু বলছিলো। বাকিরা মাথা নিচু করে শুনছে। স্ট্যান্ড-অ্যাট-ইজ ভঙ্গিতে সবাই দাঁড়ানো। অন্যদিকে বেশকিছু সৈনিক প্যারেড করছে, আরেক দল বাতাসে বেয়নেট চার্জের মহড়া করছে। দেখতে দেখতে বিশাল জাহাজটা আমাদের প্রায় চোখের সামনে। শরাফত মামা বললেন, “রাইফেলে কাজ হবে না। ফিল্ডগান লাগবে। হেভি শিপ।” সঙ্গে সঙ্গে ইপিআর-এর এক সৈনিক কামানে শেল ঢোকালেন। জোরে জোরে বললেন, “কানে হাত।” সঙ্গে সঙ্গে গগণবিদারী শব্দ। আমি বায়নাকুলারে দেখলাম বেশ কিছু পাকসেনা লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। মনে হলো হঠাৎ আক্রমণে ওরা হতভম্ব। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওরা পরিস্থিতি সামলে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করলো। ওদেরটাও ফিল্ডগান। অনবরত গোলার স্পি্লন্টার উড়ে যাচ্ছে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। আমরা সবাই মাটির সঙ্গে মিশে উপুড় হয়ে শুয়ে আছি। কামানের গোলা ছুঁড়ছিলেন যে ইপিআর সৈনিক, তিনি অবিরাম চার্জ করে যাচ্ছিলেন। শেল ভরছিলো দুই কিশোরের একজন। শরাফত মামা অবিরাম গোলাবর্ষণের মধ্যে চিৎকার করে বলে উঠলেন, “এবার রিট্রিট। ওরা আমাদের চেয়ে অনেক পাওয়ারফুল। এবার এয়ারফোর্সের প্লেন এসে পড়বে। লেট আস মুভ ব্যাক। আমাদের অপারেশন সাকসেসফুল।” মামা কথা শেষ করতে পারলেন না। এক ডজন স্যাবার জেট বিদ্যুৎগতিতে উড়ে গেলো মাথার ওপর দিয়ে। ইপিআরের দুই জওয়ানের সিনিয়ারজন বললেন, “স্টপ অল মুভমেন্ট। ঘাসের সঙ্গে মিশে মাটিতে লাশের মতো আমরা এখন পড়ে থাকবো। কতক্ষণ জানি না। আগে প্রাণ বাঁচাতে হবে। তারপর যুদ্ধ। অনেক যুদ্ধ আছে সামনে। জয় বাংলা।”

হাতে, পিঠে, মুখে পাটক্ষেতের হলুদ বিছা হাঁটছে। শরীর অবশ হয়ে আছে। স্যাবার জেটগুলো আমাদের ওপর দিয়ে আরেকটা চক্কর দিয়ে গেলো। আমার হাত থেকে বায়নাকুলাটার নিয়ে চোখে লাগিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখলেন একজন সৈনিক। তারপর বলে উঠলেন, ‘সর্বনাশ, এক্ষণ ওঠেন সবাই। জাহাজ পাড়ে

ভিড়তেছে। আমাদের এই জায়গা ছাড়তে হবে। নাইল্যা খ্যাত উঁচা আছে। কুজা হইয়া সবাই গ্রামের দিকে চলেন। কামানের দায়িত্ব আমি নিলাম।” এপ্রিলের তীব্র রোদে ঘামে জবজবে হয়ে যথাসম্ভব নিচু হয়ে এগুতে থাকলাম। শরাফত মামার খুব সাহস। তিনি এক ফাঁকে মাথা উঁচু করে জাহাজের অবস্থানটা দেখে বললেন, “জাহাজ পাড়ে ভিড়ছে। শালারা নামার পায়তারা করতেছে। মনে হয় ভয়ও পাইছে। ও ভাই, মারেন না আরো কয়খান শেল!”

“পাগলামি কইরেন না। এখন পাগলামির সময় না। আগে জান বাঁচান। আইজ রাইতে সব গ্রাম ঘেরাও দিয়া গুলি কইরা মানুষ মারবো। তার পরে গ্রাম জ্বালাইয়া দিব। বিকালের মধ্যে সবগুলা গ্রাম খালি করতে হইব। আগান। হাত পাও ছিলা গেলেও আগান।” ইপিআরের বয়স্ক সৈনিক ভদ্রলোক কথাগুলো বলে থামলেন।

দ্রুত বিকেল নেমে এলো। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা। মামাবাড়ি পৌঁছে দেখি লোকজন বাক্স-তোরঙ্গ গোছাচ্ছে, গাট্টি-বোঁচকা বাঁধছে। সবার চোখমুখ সন্ত্রস্ত, ফ্যাকাশে। নানা গম্ভীরভাবে সবকিছু তদারক করছেন। বলছেন, তিনি বাড়ি ছাড়বেন না। তিনি চলে গেলে গোয়ালভর্তি গরুগুলো কে দেখবে। একথা শুনে মহিলাদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেলো। “আমি বুড়া মানুষ। মিলিটারি আমারে কিছু করবে না।” আমরা সন্ধ্যার আগে-আগে বড়মামার শ্বশুরবাড়ি মোহিনীপুরের দিকে রওনা হয়ে গেলাম। সারারাত হাঁটতে হবে। ঘণ্টা দুয়েক হাঁটার পর কে যেন চিৎকার করে বলে উঠলো, “সবাই পিছে দেখেন।” দেখলাম অন্ধকার প্রান্তরের ওপারে দাউ দাউ করে গ্রাম জ্বলছে। আকাশের বর্ণ লাল। মানুষের আর্তচিৎকার ভেসে আসছে। ঐ শব্দ ছাপিয়ে রক্ত হিম করা কামানের গোলার শব্দ। একটা শব্দ অচেনা মনে হলো। ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন বললো, “মেশিনগান চালাইতাছে।” পড়িমড়ি করে আছাড় খেয়ে, ধুলোকাদা আর রক্তমাখা অবস্থায় আমরা যখন মোহিনীপুর পৌঁছুলাম, ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটা।

তিনদিন ছিলাম আমরা, সব মিলিয়ে মামাবাড়ির পঁচিশ-ত্রিশজন মানুষ, মোহিনীপুর গ্রামে। যখন মামাবাড়ি ফিরে এলাম, পুরো বাড়ি তছনছ। গোয়ালঘর ফাঁকা। একটা গরুও নেই। নানা নদীর পাড়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। নদীর ওপারে জ্বলন্ত গ্রামের পর গ্রাম দেখে গরুগুলো দড়ি ছিঁড়ে যে-যার মতো ছুটে বেরিয়ে গেছে। তার ওপর ভারি কামানের গোলার শব্দ। নানা বুদ্ধি করে স্বাধীন বাংলার পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন একটা লম্বা লগির মাথায়। তিনি ছিলেন এলাকার ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। তাঁর কাছে একটা পতাকা রাখা ছিলো, যেটা তাঁকে ওড়াতে হতো ১৪ই আগস্ট, পাকিস্তান দিবসে। সরকারের নির্দেশ। খোঁজাখুঁজির পর দুটো গরু পাওয়া গেলো। বাকিগুলো হারিয়ে যায় চিরতরে।

কিছুদিন পর দূর-দূরান্ত থেকে শরণার্থীরা দল বেঁধে আসতে থাকে নবীনগর লঞ্চঘাটে। ওখান থেকে লঞ্চে করে ওরা যাচ্ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে কসবায় পৌঁছে ত্রিপুরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে, অর্থাৎ আগরতলা শহরে এবং বিভিন্ন এলাকায়। মামাবাড়ি বা ঢাকার বাসার কাউকে কিছু না জানিয়ে আমিও ঠিক করলাম শরণার্থীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে ত্রিপুরা চলে যাবো। সেখান থেকে মেলাঘর ট্রেনিং ক্যাম্প। যাওয়ার দিন নবীনগর ঘাটে অন্যান্য যাত্রীর সঙ্গে লঞ্চের অপেক্ষা করছি। দশটা-এগারোটা বাজে। সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললে বিকেল চারটার মধ্যে আমি আগরতলা পৌঁছে যেতে পারবো। সেখান থেকে দীর্ঘ, দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়ে মেলাঘর। ওই পথটুকু নিয়ে আমি দুশ্চিন্তায় ছিলাম। অনেকে যানবাহন না পেয়ে হেঁটে চলে যায় ত্রিপুরার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে। আর আমি যাবো মেলাঘরে। সেখানে যাওয়ার সঙ্গী পাবো কিনা কে জানে! এসব নিয়ে ভাবছি, হঠাৎ কাঁধে হাতের স্পর্শ। পেছনে তাকিয়ে দেখি বড়মামা। থতমত খেয়ে গেলাম।

এইখানে কী? মামা জিজ্ঞেস করলেন।

কিছু না। মানুষ দেখতাছি। এত মানুষ ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাইতেছে। কারণটা কী। আমি ঢোক গিলে বললাম।

তুই বুঝি জানস না? তোর হাতে ব্যাগ ক্যান? আমার হাতে নীল রঙের চৌকোনা লম্বাটে একটা ব্যাগ ছিলো। আগেকার দিনে ডাক্তাররা এটা নিয়ে রোগীদের ভিজিটে যেতেন।

আমি একটা যুৎসই উত্তর খুঁজছিলাম। কী বিপদে পড়া গেল।

মেলাঘর যাইতাছস? এখন এই নামই লইস না। কসবা বর্ডারে গণ্ডগোল হইতাছে। অনেক মানুষ মারা গেছে। আমি তোরে কুমিল্লা বর্ডার দিয়া পার কইরা দিমু। সঙ্গে গ্রামের আরো অনেক ছেলে যাবে।

মন খারাপ হয়ে গেলো আমার। মুখে কিছু বললাম না। বড়মামা বলে কথা। আমার সাত মামার মধ্যে সবার বড়। কুমিল্লা বর্ডার দিয়েও পরে আমার আর ত্রিপুরা যাওয়া হয়ে ওঠে না। মামা বলেন বর্ডার ‘গরম’। সময় এলে বলবেন। পরে বুঝলাম, উনি আমাকে একা মেলাঘর পাঠাতে চাইছিলেন না। মামার গ্রামের ছেলেরা এপ্রিলের শুরুতেই ওপারে চলে গেছে। তার ওপর আমি মামাদের একমাত্র বোনের ছেলে। আম্মা ছিলেন সাত ভাই চম্পার মতো। তাঁর মৃত্যুর খবর নিয়ে যে টেলিগ্রামটা আসে করাচি থেকে চৌদ্দ বছর আগে, সেটা পোস্ট অফিস থেকে সংগ্রহ করেন এই মামাই। আব্বার চাকরিসূত্রে আমরা তিন বছর করাচি ছিলাম। আমি তখন একেবারে বালক।

টেলিগ্রামটি হাতে নিয়ে মামা প্রায় সারাদিন নিজের কাছে রেখেছিলেন। হাউমাউ করে কেঁদেছেন কখনো নদীর পাড়ে, কখনো নৌকায় বসে মাঝগাঙে। এহেন মামা আমাকে অজানা গন্তব্যে ছাড়তে চাইছিলেন না। বোধ হয়, তাঁর আশঙ্কা ছিলো আমি মুক্তিযুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরে আসতে পারবো না। মেলাঘর আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি সেবার। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত কাজে ঢাকা থেকে আগরতলা গিয়েছিলাম জুলাই মাসে। আমি তখন ঢাকা-কেন্দ্রিক মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হাতিরপুলের একটি গোপন আস্তানা থেকে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ‘স্বাধীনতা’ নামে হাতে লেখা একটি বুলেটিন বের করি। ঐ আস্তানায় আগরতলা এবং কলকাতার অনেক বুলেটিন ও পত্রিকা আসতো। নানা ছদ্মবেশে এবং বিভিন্ন গোপন পদ্ধতিতে আমরা কয়েকজন তরুণ ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকাটি ঢাকার বিভিন্ন গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতাম। খুবই বিপদসঙ্কুল কাজ ছিলো ওটা। আমি এবং আমার এক বন্ধু একবার বাজারের ব্যাগে ভরা বুলেটিনের বান্ডিলসহ রাজাকার ও পাকসেনাদের ক্যাম্পের সামনে ধরা পড়ে গেলাম। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়। সে কী অমানুষিক নির্যাতন। নেহাৎ ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে যাই।

জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ঢাকা ছিলো জনশূন্য শহর। জনসংখ্যার ষাটভাগ চলে গেছে গ্রামাঞ্চলে। সরকারি চাকরিজীবীরা ছাড়া ঢাকায় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ছিলো না প্রায়। পাকবাহিনী চাপ দিয়ে কিছু স্কুল-কলেজ খুলিয়ে রেখেছে। ছাত্রছাত্রী নেই। এক-দুইজন শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক বা প্রিন্সিপাল হাজির থাকেন। রাস্তায় মানুষ নেই প্রায়। পথচারীরা ভয়ার্ত মুখে দ্রুত চলাচল করে। অধিকাংশ মানুষের মাথায় টুপি। শার্টে, পাঞ্জাবিতে কলেমা বা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ লেখা কাগজের ব্যাজ। ঘর থেকে বেরিয়েই মানুষ ভেবে নেয়, কোন রাস্তা ধরে গেলে পাকবাহিনী বা রাজাকার-আলবদরের ক্যাম্প সামনে পড়বে না। আমি তখন অন্যদের সঙ্গে সাইক্লোস্টাইলে ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার মুদ্রণ এবং বিতরণ নিয়ে ব্যস্ত। সেন্ট্রাল রোডের বাসায় আব্বা, আমি এবং আমার এক নানা। একজন মামাও ছিলেন কিছুদিনের জন্য। আগস্টের দিকে শহরে ক্র্যাক প্লাটুনের অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। রাত আটটা-নটার দিকে শুরু হয় পাকবাহিনীর এলোপাথাড়ি গুলি। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্র্যাক প্লাটুনের গ্রেনেড এবং এলএমজির প্রত্যুত্তর। ভোররাত পর্যন্ত চলে এসব খণ্ডযুদ্ধ। ঢাকায় তখন যে ক’জন মানুষ আছে, সবাই রাতভর গোলাগুলির শব্দে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। গুলি বা গ্রেনেড ফাটার শব্দ না শুনলে ঘুম আসে না। দিনের বেলা ঢাকা আতঙ্কের নগরী। সন্ধ্যার পর শহর চলে যায় ক্র্যাক প্লাটুন এবং অন্যান্য গেরিলা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। এগুলোর একটি ছিলো গ্রীন রোডের আজিজ বাহিনী। বেশ ক’টি দুঃসাহসী অপারেশন চালায় গ্রুপটি ধানমন্ডি, ফার্মগেট ও নিউমার্কেট এলাকায়। আজিজ ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের ছাত্র ছিলো। বরাবর একটু দুর্ধর্ষ ধরনের। দুঃখ হয়, ঢাকার মুক্তিযুদ্ধকালীন অপারেশন নিয়ে যেসব ইতিহাস লেখা হয়েছে সেগুলোতে তেমনভাবে আজিজ বাহিনীর উল্লেখ নেই। অথচ ও ছিলো আপাদমস্তক একজন গেরিলা যোদ্ধা।

দুই.

ডিসেম্বর প্রথম সপ্তাহ থেকে ঢাকা বিমান বন্দরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান-কেন্দ্রিক পাকিস্তান এয়ারফোর্সের সব বিমান ধ্বংস হয়ে গেছে। চারদিক থেকে বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত করে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছে যৌথ বাহিনী। দেখতে দেখতে এসে গেলো বিজয়ী যৌথ বাহিনীর কাছে পরাজিত পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন। ষোলোই ডিসেম্বর, ১৯৭১। আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটি হলো ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে। গুজব ছিলো সারেন্ডারের আগে পাকবাহিনী ঘরে ঘরে ঢুকে বাঙালি নিধন করবে, মর্টার শেল মেরে শহর গুঁড়িয়ে দেবে। মূলত এসবের কিছুই হলো না। ষোলোই ডিসেম্বর বিকেল চারটায় যৌথ বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডারের প্রধান জেনারেল নিয়াজি। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এখনকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভুদ্যয়ের ঐ ঐতিহাসিক মুহূর্তের একজন নগণ্য সাক্ষী ছিলাম আমিও। পুরো অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত থেকে অন্যান্যদের সঙ্গে গলা চিরে স্লোগান দিই ‘জয় বাংলা’। তারপর খণ্ড খণ্ড মিছিলের সঙ্গে ঘুরি শহরময়।

ষোলোই ডিসেম্বর দেশ মুক্ত এবং স্বাধীন হলো। এবং একই সঙ্গে জন্ম নিলো আমার এক নতুন সত্তা। শৌখিন লেখক আমি। পঁচিশে মার্চ গণহত্যা শুরু হওয়ার পর কলম সরিয়ে রেখেছিলাম। সতেরোই ডিসেম্বর সেই ফাউন্টেন পেনে আবার কালি ভরলাম দোয়াত থেকে। ডাইরির পাতায় বড় বড় অক্ষরে লিখলাম, ‘আজ ঢাকা মুক্ত হলো। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন রাষ্ট্র।’ বেশকিছু কবিতা লিখে ফেললাম কয়েক দিনে। আমার কলম আর থামেনি। থামবেও না যতকাল বেঁচে আছি। লিখি আপন মনে। ছাপা হোক আর না হোক। পড়ি বিখ্যাত কবিদের লেখা। তরুণদের নতুন তরতাজা কবিতা। ব্যাধি এবং বার্ধক্যের ভারে আমি আজ শয্যাশায়ী। এখন আমার সারাক্ষণের সঙ্গী খবরের কাগজ। মাঝে মাঝে মনটা তিক্ত হয়ে যায়। আতঙ্ক চেপে ধরে। স্বপ্নে প্রায়ই একটা দৃশ্য দেখি। ঘোরকালো মেঘে হঠাৎ জ্যোৎ¯œাভরা আকাশ ছেয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে বাতাসে ভাসে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কোরাস, “দেশ স্বাধীন। কিন্তু চলছে লড়াই, চলবে লড়াই।”