আমার ‘সংবাদ’

মনির হোসেন

গেল শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকের কথা। আমার সাংবাদিকতা জীবনের সবেমাত্র শুরু, বছরতিনেক হবে। ‘সংবাদ’-এ আমি তখন স্টাফ রিপোর্টার। একবার একটা রিপোর্ট তৈরির জন্য জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালকের মন্তব্য দরকার, একদিন চলে গেলাম রাজধানীর কাকরাইলে ব্যুরোর প্রধান কার্যালয়ে। গিয়ে দেখি মহাপরিচালক মহোদয় বাইরের কয়েকজন অতিথির সাথে বৈঠক করছেন। তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী জানালেন, তাড়াতাড়িই বৈঠক শেষ হবে। তাই আমি বৈঠক শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেই অফিসেই অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিছুক্ষণ পর মনে হলো, এই ফাঁকে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে পরিচিত হয়ে আসি, ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। প্রথমেই গেলাম ব্যুরোর একজন পরিচালক জনাব সাখাওয়াৎ হোসেন সাহেবের কাছে। আমি তখন নিতান্তই এক তরুণ। ‘সংবাদ’ থেকে এসেছি শুনে মনে হলো উনি একটু অবাক হয়েছেন। হয়তো আরও বয়স্ক কোনো সাংবাদিককে আশা করেছিলেন।

তবুও অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন সাখাওয়াৎ সাহেব। তাঁর সাথে সাক্ষাতের কারণ জানতে চাইলেন, জানালাম শুধুই পরিচিত হওয়ার জন্য। আমি যে মহাপরিচালক সাহেবের কাছে এসেছি সেটাও বললাম। একথা জানার পর চা-বিস্কুট খাওয়ালেন, এরপর আচমকাই বলে উঠলেন, ‘চলো, তোমাকে আরো কয়েকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই’। পরিচয়ের কয়েক মিনিটের মধ্যেই ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে এলেন! আমাকে নিয়ে একে একে অন্যান্য পরিচালকের কক্ষে গেলেন, তাঁদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, এরপর আমাকে নিয়ে আবার নিজের রুমে ফিরে এলেন। নিজেই ফোন করে জেনে নিলেন মহাপরিচালকের বৈঠকটি শেষ হতে আরো কিছুটা সময় লাগতে পারে। এটা জেনে আরেক প্রস্থ চা-বিস্কুটের আদেশ দিলেন।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আচমকাই আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার মতো একজন অপরিচিত, বয়সে তরুণ সাংবাদিককে অন্য পরিচালকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে নিয়ে গেলাম কেন জানো?’ এর উত্তর আমার কাছে ছিলো না। তিনি নিজেই বলতে শুরু করলেন।

‘সংবাদ। শুধু সংবাদের কারণে’। এরপর বললেন নিজের ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার কথা। তখন দৈনিক সংবাদপত্র বলতেই বুঝতেন শুধু ‘সংবাদ’। কারণ ‘সংবাদ’ প্রগতিশীলদের আঁতুড় ঘর, ‘সংবাদ’ বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক, পাঠকের মননশীল রুচি তৈরির কারিগর। আর সেই ‘সংবাদ’ থেকে আমি গেছি, তাই নিজের অতি আপনজন মনে করে অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে দু’টি দেশ হওয়ার পর পাকিস্তান নামের দেশটির অংশ এই পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত মুসলমানের কাছে উর্দু আর ইংরেজি ভাষার প্রবল প্রতাপ। প্রকৃতপক্ষে এই প্রতাপ শুরু ভারত বিভাগেরও আগে। এই কারণেই তখনকার শিক্ষা-সাংস্কৃতির কেন্দ্র কলকাতা থেকে মুসলমানদের হাতে প্রকাশিত সকল দৈনিক, পাক্ষিক বা মাসিক পত্রিকারই নামকরণ উর্দুতে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর নামের অবস্থাও একই। ঠিক ঐ সময়টায় ঢাকা থেকে বাংলা নাম নিয়ে প্রকাশ হয় দৈনিক পত্রিকা ‘সংবাদ’। দুঃসাহস বটে!

দুঃসাহস এই কারণে, বাংলা নামের পত্রিকাটি পাঠক কতটা গ্রহণ করবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিলোই। সেই অনিশ্চয়তাকে জয় করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন ‘সংবাদ’-এর প্রথম সম্পাদক খায়রুল কবির। চ্যালেঞ্জ জয়ের জন্য পত্রিকায় সহকর্মী হিসাবে বেছে নেন সেসময় প্রগতিশীল, আরও সুষ্পষ্টভাবে বললে বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত মানুষদেরকে। গত শতাব্দীর সেই সময়টায় সারাবিশ্বেই

মেধাবী তরুণদের কাছে বামপন্থী রাজনীতি ছিলো এক প্রবল আকর্ষণ। কয়েক বছরের মধ্যেই প্রকাশক হিসাবে ‘সংবাদ’-এর হাল ধরেন খায়রুল কবিরের ছোট ভাই আহমদুল কবির, যিনি নিজেও ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত। পাকিস্তানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে সেই সময়কার প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলটির প্রতিষ্ঠায় নেপথ্যে যুক্ত ছিলেন তিনি। এরপর থেকে ‘সংবাদ’কে এগিয়ে নিয়েছেন সত্যেন সেন, শহীদুল্লা কায়সার, জহুর হোসেন চৌধুরীর মতো মানুষেরা। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে শিক্ষিত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার পথে ‘সংবাদ’ ছিলো প্রথম সারির সংগঠক। একজন্যই স্বাধিকার ও পরবর্তীতে স্বাধীনতা ও বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক ‘সংবাদ’ হয়ে ওঠে পশ্চিম পাকিস্তানিদের চক্ষুশূল। যার ‘অবধারিত পরিণাম’ ছিলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ‘সংবাদ’-এ পাকিস্তানিদের আক্রমণ। পত্রিকার অফিসটি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। এই আগুনে অফিসের ভেতরেই প্রাণ দেন শহীদ সাবের।

স্বাধীনতার পরেও একই গতিতে চলতে থাকে ‘সংবাদ’-এর এই যাত্রা। আহমদুল কবির আর জহুর হোসেন চৌধুরীর সাথে এই পর্বে ‘সংবাদ’কে এগিয়ে নেয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করেন সন্তোষ গুপ্ত, বজলুর রহমানের মতো সাংবাদিকতার মহীরুহরা। কিছুদিন ছিলেন কে জি মুস্তাফা। ‘সংবাদ’ হয়তো কখনো দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা ছিলো না, কিন্তু এর ‘ভার’ ছিলো অন্য সব বহুল প্রচারিত পত্রিকার চেয়ে অনেক বেশি। দেশের শিক্ষিতজন, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন এবং সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলে ‘সংবাদ’-এর গ্রহণযোগ্যতা ছিলো প্রশ্নাতীত।

‘সংবাদ’-এর এই দীর্ঘ যাত্রায় যোদ্ধা হিসাবে ছিলেন আরও অসংখ্য তরুণ সাংবাদিক। ‘সংবাদ’-এ সাংবাদিকতার ‘প্রশিক্ষণ’ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন অন্যান্য সংবাদপত্রে। এভাবেই একসময় ‘সংবাদ’ হয়ে ওঠে সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণশালা।

আমার সাংবাদিকতার প্রথম প্রশিক্ষণও এই ‘সংবাদ’ থেকে। এখানে সাংবাদিকতা শিখেছি সন্তোষ গুপ্ত, বজলুর রহমান, কে জি মুস্তাফাদের কাছে। কোনো কিছু জানতে চাইলে কখনো বিমুখ করেননি সদা গম্ভীর সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত। সম্পাদকীয় বিভাগের আরেক সহকারী সম্পাদক ড. মকবুলার রহমান ছিলেন যেন সব বিষয়ে জ্ঞানের ভাণ্ডার। পদার্থ বিজ্ঞানই হোক কিংবা হোক ধর্মতত্ত্ব- ড. মকবুলার রহমান বুঝিয়ে দিতেন শিক্ষকের মতো। চিফ রিপোর্টার কাশেম হুমায়ূন শিখিয়েছেন তথ্যের উৎস খুঁজে বের করা আর তথ্য সংগ্রহের কৌশল। হাতে ধরে রাজনৈতিক রিপোর্ট লেখার কৌশল শিখিয়েছেন জাফর ওয়াজেদ, যিনি এখন প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের মহাপরিচালক। খেলাধুলার নেপথ্যের খুঁটিনাটি শিখিয়েছেন অজয় বড়ুয়া আর পার্থ তানভীর নভেদ, ক্রীড়া বিভাগের রওশন জামিল শিখিয়েছেন বিদেশি শব্দের উচ্চারণ ও সেই অনুযায়ী বানান রীতি। আমার মতো একদল নবীন সাংবাদিকের অভিভাবক ছিলেন বার্তা সম্পাদক আতাউর রহমান, যাঁর ভাষায় আমরা ছিলাম ‘কচি-কাঁচা’। ছিলেন আরেকজন অভিভাবক কবি সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আমাদের মতো ‘কচি কাঁচা’র উপর কেউ চোটপাটের চেষ্টা করলে চোটপাটকারীকে শাসাতেন তিনি।

আর প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক আহমদুল কবির? একটা ঘটনা টেনেই বলছি তাঁর জ্ঞানের কথা। একবার তিস্তা ব্যারাজ নিয়ে একটা রিপোর্ট করলেন তখনকার সিনিয়র রিপোর্টার জাফর ওয়াজেদ। তখন আমরা সকল রিপোর্টার প্রতিদিন সকালে অফিসে এসে অস্থায়ী সম্পাদক কে জি মুস্তাফার নেতৃত্বে একটা সংক্ষিপ্ত বৈঠক করি। জাফর ওয়াজেদ ভাইয়ের রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার দিন সকালে অফিসে এসে হাজির প্রধান সম্পাদক আহমদুল কবির। তিস্তার রিপোর্ট নিয়ে জাফর ভাইকে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। জাফর ভাই যদ্দুর সম্ভব উত্তর দিলেও সন্তুষ্ট হলেন না আহমদুল কবির। এরপর নিজেই তিস্তাসহ দেশের উত্তরবঙ্গের নদ-নদী নিয়ে আমাদেরকে ঘণ্টাখানেক ব্রিফ করলেন। বলা ভাল ক্লাস নিলেন। উত্তরবঙ্গের কোন্ নদীর দৈর্ঘ্য প্রস্থ আর গভীরতা কত, কোন্ নদী ড্রেজিং করে গভীরতা বাড়ালে কোন্ কোন্ জেলা-উপজেলার কত হাজার বা লাখ একর জমি সেচের আওতায় আসবে, কোন্ নদীতে বর্ষাকালীন পানি ধরে রাখার রিজার্ভার তৈরি করা উচিত- সবই বলছিলেন তিনি। মনে হচ্ছিলো তিনি অর্থনীতির ছাত্র নন, পানিসম্পদ বিজ্ঞানের ছাত্র! শুধু নদ-নদী নয়, কখনো ভূমিকম্প হলে পরদিন অফিসে এসে ভূতত্ত্ববিদ্যা শেখাতেন, কখনো কখনো সাহিত্যপাতায় প্রকাশিত কোনো নিবন্ধ নিয়ে আবুল হাসনাত ভাইয়ের সাথে সাহিত্য সমালোচকের মতো আলাপ জুড়তেন। আর অর্থনীতি তো তাঁর নিজের বিষয়, তাই অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য বিষয়ক রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা ছিলো তাঁর প্রিয় বিষয়।

এক দশক এই প্রশিক্ষণশালায় কাটিয়ে আমি ‘সংবাদ’ ছেড়ে আসি। এখনো সাংবাদিকতা শিখছি, কিন্তু ‘সংবাদ’কে বড্ড মিস করি।

image
আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
সংবাদ এবং আমার শৈশব
আমার বাতিঘর
শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা
নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
চলছে লড়াই, চলবে লড়াই
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান
বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন
দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন
নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী
নতুন সময়ের গণমাধ্যম
‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’
মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

আমার ‘সংবাদ’

মনির হোসেন

image

গেল শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকের কথা। আমার সাংবাদিকতা জীবনের সবেমাত্র শুরু, বছরতিনেক হবে। ‘সংবাদ’-এ আমি তখন স্টাফ রিপোর্টার। একবার একটা রিপোর্ট তৈরির জন্য জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালকের মন্তব্য দরকার, একদিন চলে গেলাম রাজধানীর কাকরাইলে ব্যুরোর প্রধান কার্যালয়ে। গিয়ে দেখি মহাপরিচালক মহোদয় বাইরের কয়েকজন অতিথির সাথে বৈঠক করছেন। তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী জানালেন, তাড়াতাড়িই বৈঠক শেষ হবে। তাই আমি বৈঠক শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেই অফিসেই অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিছুক্ষণ পর মনে হলো, এই ফাঁকে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে পরিচিত হয়ে আসি, ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। প্রথমেই গেলাম ব্যুরোর একজন পরিচালক জনাব সাখাওয়াৎ হোসেন সাহেবের কাছে। আমি তখন নিতান্তই এক তরুণ। ‘সংবাদ’ থেকে এসেছি শুনে মনে হলো উনি একটু অবাক হয়েছেন। হয়তো আরও বয়স্ক কোনো সাংবাদিককে আশা করেছিলেন।

তবুও অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন সাখাওয়াৎ সাহেব। তাঁর সাথে সাক্ষাতের কারণ জানতে চাইলেন, জানালাম শুধুই পরিচিত হওয়ার জন্য। আমি যে মহাপরিচালক সাহেবের কাছে এসেছি সেটাও বললাম। একথা জানার পর চা-বিস্কুট খাওয়ালেন, এরপর আচমকাই বলে উঠলেন, ‘চলো, তোমাকে আরো কয়েকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই’। পরিচয়ের কয়েক মিনিটের মধ্যেই ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে এলেন! আমাকে নিয়ে একে একে অন্যান্য পরিচালকের কক্ষে গেলেন, তাঁদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, এরপর আমাকে নিয়ে আবার নিজের রুমে ফিরে এলেন। নিজেই ফোন করে জেনে নিলেন মহাপরিচালকের বৈঠকটি শেষ হতে আরো কিছুটা সময় লাগতে পারে। এটা জেনে আরেক প্রস্থ চা-বিস্কুটের আদেশ দিলেন।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আচমকাই আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার মতো একজন অপরিচিত, বয়সে তরুণ সাংবাদিককে অন্য পরিচালকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে নিয়ে গেলাম কেন জানো?’ এর উত্তর আমার কাছে ছিলো না। তিনি নিজেই বলতে শুরু করলেন।

‘সংবাদ। শুধু সংবাদের কারণে’। এরপর বললেন নিজের ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার কথা। তখন দৈনিক সংবাদপত্র বলতেই বুঝতেন শুধু ‘সংবাদ’। কারণ ‘সংবাদ’ প্রগতিশীলদের আঁতুড় ঘর, ‘সংবাদ’ বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক, পাঠকের মননশীল রুচি তৈরির কারিগর। আর সেই ‘সংবাদ’ থেকে আমি গেছি, তাই নিজের অতি আপনজন মনে করে অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে দু’টি দেশ হওয়ার পর পাকিস্তান নামের দেশটির অংশ এই পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত মুসলমানের কাছে উর্দু আর ইংরেজি ভাষার প্রবল প্রতাপ। প্রকৃতপক্ষে এই প্রতাপ শুরু ভারত বিভাগেরও আগে। এই কারণেই তখনকার শিক্ষা-সাংস্কৃতির কেন্দ্র কলকাতা থেকে মুসলমানদের হাতে প্রকাশিত সকল দৈনিক, পাক্ষিক বা মাসিক পত্রিকারই নামকরণ উর্দুতে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর নামের অবস্থাও একই। ঠিক ঐ সময়টায় ঢাকা থেকে বাংলা নাম নিয়ে প্রকাশ হয় দৈনিক পত্রিকা ‘সংবাদ’। দুঃসাহস বটে!

দুঃসাহস এই কারণে, বাংলা নামের পত্রিকাটি পাঠক কতটা গ্রহণ করবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিলোই। সেই অনিশ্চয়তাকে জয় করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন ‘সংবাদ’-এর প্রথম সম্পাদক খায়রুল কবির। চ্যালেঞ্জ জয়ের জন্য পত্রিকায় সহকর্মী হিসাবে বেছে নেন সেসময় প্রগতিশীল, আরও সুষ্পষ্টভাবে বললে বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত মানুষদেরকে। গত শতাব্দীর সেই সময়টায় সারাবিশ্বেই

মেধাবী তরুণদের কাছে বামপন্থী রাজনীতি ছিলো এক প্রবল আকর্ষণ। কয়েক বছরের মধ্যেই প্রকাশক হিসাবে ‘সংবাদ’-এর হাল ধরেন খায়রুল কবিরের ছোট ভাই আহমদুল কবির, যিনি নিজেও ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত। পাকিস্তানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে সেই সময়কার প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলটির প্রতিষ্ঠায় নেপথ্যে যুক্ত ছিলেন তিনি। এরপর থেকে ‘সংবাদ’কে এগিয়ে নিয়েছেন সত্যেন সেন, শহীদুল্লা কায়সার, জহুর হোসেন চৌধুরীর মতো মানুষেরা। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে শিক্ষিত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার পথে ‘সংবাদ’ ছিলো প্রথম সারির সংগঠক। একজন্যই স্বাধিকার ও পরবর্তীতে স্বাধীনতা ও বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক ‘সংবাদ’ হয়ে ওঠে পশ্চিম পাকিস্তানিদের চক্ষুশূল। যার ‘অবধারিত পরিণাম’ ছিলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ‘সংবাদ’-এ পাকিস্তানিদের আক্রমণ। পত্রিকার অফিসটি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। এই আগুনে অফিসের ভেতরেই প্রাণ দেন শহীদ সাবের।

স্বাধীনতার পরেও একই গতিতে চলতে থাকে ‘সংবাদ’-এর এই যাত্রা। আহমদুল কবির আর জহুর হোসেন চৌধুরীর সাথে এই পর্বে ‘সংবাদ’কে এগিয়ে নেয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করেন সন্তোষ গুপ্ত, বজলুর রহমানের মতো সাংবাদিকতার মহীরুহরা। কিছুদিন ছিলেন কে জি মুস্তাফা। ‘সংবাদ’ হয়তো কখনো দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা ছিলো না, কিন্তু এর ‘ভার’ ছিলো অন্য সব বহুল প্রচারিত পত্রিকার চেয়ে অনেক বেশি। দেশের শিক্ষিতজন, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন এবং সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলে ‘সংবাদ’-এর গ্রহণযোগ্যতা ছিলো প্রশ্নাতীত।

‘সংবাদ’-এর এই দীর্ঘ যাত্রায় যোদ্ধা হিসাবে ছিলেন আরও অসংখ্য তরুণ সাংবাদিক। ‘সংবাদ’-এ সাংবাদিকতার ‘প্রশিক্ষণ’ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন অন্যান্য সংবাদপত্রে। এভাবেই একসময় ‘সংবাদ’ হয়ে ওঠে সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণশালা।

আমার সাংবাদিকতার প্রথম প্রশিক্ষণও এই ‘সংবাদ’ থেকে। এখানে সাংবাদিকতা শিখেছি সন্তোষ গুপ্ত, বজলুর রহমান, কে জি মুস্তাফাদের কাছে। কোনো কিছু জানতে চাইলে কখনো বিমুখ করেননি সদা গম্ভীর সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত। সম্পাদকীয় বিভাগের আরেক সহকারী সম্পাদক ড. মকবুলার রহমান ছিলেন যেন সব বিষয়ে জ্ঞানের ভাণ্ডার। পদার্থ বিজ্ঞানই হোক কিংবা হোক ধর্মতত্ত্ব- ড. মকবুলার রহমান বুঝিয়ে দিতেন শিক্ষকের মতো। চিফ রিপোর্টার কাশেম হুমায়ূন শিখিয়েছেন তথ্যের উৎস খুঁজে বের করা আর তথ্য সংগ্রহের কৌশল। হাতে ধরে রাজনৈতিক রিপোর্ট লেখার কৌশল শিখিয়েছেন জাফর ওয়াজেদ, যিনি এখন প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের মহাপরিচালক। খেলাধুলার নেপথ্যের খুঁটিনাটি শিখিয়েছেন অজয় বড়ুয়া আর পার্থ তানভীর নভেদ, ক্রীড়া বিভাগের রওশন জামিল শিখিয়েছেন বিদেশি শব্দের উচ্চারণ ও সেই অনুযায়ী বানান রীতি। আমার মতো একদল নবীন সাংবাদিকের অভিভাবক ছিলেন বার্তা সম্পাদক আতাউর রহমান, যাঁর ভাষায় আমরা ছিলাম ‘কচি-কাঁচা’। ছিলেন আরেকজন অভিভাবক কবি সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আমাদের মতো ‘কচি কাঁচা’র উপর কেউ চোটপাটের চেষ্টা করলে চোটপাটকারীকে শাসাতেন তিনি।

আর প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক আহমদুল কবির? একটা ঘটনা টেনেই বলছি তাঁর জ্ঞানের কথা। একবার তিস্তা ব্যারাজ নিয়ে একটা রিপোর্ট করলেন তখনকার সিনিয়র রিপোর্টার জাফর ওয়াজেদ। তখন আমরা সকল রিপোর্টার প্রতিদিন সকালে অফিসে এসে অস্থায়ী সম্পাদক কে জি মুস্তাফার নেতৃত্বে একটা সংক্ষিপ্ত বৈঠক করি। জাফর ওয়াজেদ ভাইয়ের রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার দিন সকালে অফিসে এসে হাজির প্রধান সম্পাদক আহমদুল কবির। তিস্তার রিপোর্ট নিয়ে জাফর ভাইকে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। জাফর ভাই যদ্দুর সম্ভব উত্তর দিলেও সন্তুষ্ট হলেন না আহমদুল কবির। এরপর নিজেই তিস্তাসহ দেশের উত্তরবঙ্গের নদ-নদী নিয়ে আমাদেরকে ঘণ্টাখানেক ব্রিফ করলেন। বলা ভাল ক্লাস নিলেন। উত্তরবঙ্গের কোন্ নদীর দৈর্ঘ্য প্রস্থ আর গভীরতা কত, কোন্ নদী ড্রেজিং করে গভীরতা বাড়ালে কোন্ কোন্ জেলা-উপজেলার কত হাজার বা লাখ একর জমি সেচের আওতায় আসবে, কোন্ নদীতে বর্ষাকালীন পানি ধরে রাখার রিজার্ভার তৈরি করা উচিত- সবই বলছিলেন তিনি। মনে হচ্ছিলো তিনি অর্থনীতির ছাত্র নন, পানিসম্পদ বিজ্ঞানের ছাত্র! শুধু নদ-নদী নয়, কখনো ভূমিকম্প হলে পরদিন অফিসে এসে ভূতত্ত্ববিদ্যা শেখাতেন, কখনো কখনো সাহিত্যপাতায় প্রকাশিত কোনো নিবন্ধ নিয়ে আবুল হাসনাত ভাইয়ের সাথে সাহিত্য সমালোচকের মতো আলাপ জুড়তেন। আর অর্থনীতি তো তাঁর নিজের বিষয়, তাই অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য বিষয়ক রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা ছিলো তাঁর প্রিয় বিষয়।

এক দশক এই প্রশিক্ষণশালায় কাটিয়ে আমি ‘সংবাদ’ ছেড়ে আসি। এখনো সাংবাদিকতা শিখছি, কিন্তু ‘সংবাদ’কে বড্ড মিস করি।