সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন

সঞ্জীব কুমার দেবনাথ

সংগীত উৎপত্তির প্রারম্ভিক লগ্নে আমাদের এই ভারতীয় উপ-মহাদেশে সামগান, নাথগীতি, চর্যাগীতি প্রভৃতি প্রকীর্ণ শ্রেণির প্রবন্ধসংগীত গীত হতো। পর্যায়ক্রমে কাঠামোগত পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে সেই গানগুলো বর্তমান সাংগীতিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই পরিবর্তন সর্বপ্রথম শুরু হয় রামনিধি গুপ্ত ওরফে নিধুবাবুর হাতে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে পাঞ্জাব অঞ্চলের শোরি মিয়া নামে একজন সংগীতজ্ঞ কর্তৃক উদ্ভাবিত ‘টপ্পা’ গায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করে তিনি বাংলা গানে ‘টপ্পা’র প্রচলন করেন। নিধুবাবু প্রবর্তিত এই সংগীতধারা ঊনবিংশ শতাব্দীজুড়ে বাংলা গানকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তাঁর গানে আধুনিক যুগের রোমান্টিক চেতনার উন্মেষ ঘটে এবং আধুনিক বাংলা গীতধারা সূচিত হয়। সংগীতের ভাব ও রূপের ক্ষেত্রে নব-চিন্তা আনায়নে নিধুবাবুর পরই আসেন বিভাসা প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে নিধুবাবু-উত্তর বাংলা গানের বিকাশ সাধিত হয়েছে মূলত ব্রাহ্মধর্মান্দোলন, দেশোদ্দীপনা ও নাট্যমঞ্চ এই ত্রি-ধারায়। প্রথমত, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সংগীতবিজ্ঞানী কৃষ্ণধন বন্দোপাধ্যায় কর্তৃক বাংলা গানের স্বরলিপির পদ্ধতি প্রণয়নের পর বিষ্ণুপুরের ধ্রুপদকে ব্যবহার করে বাংলা গানে ভাব ও বন্দিশের গাম্ভীর্য আনতে উদ্যোগ নেয় ব্রাহ্মসমাজ। দ্বিতীয়ত, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গরোধ আন্দোলনকালে রাখিবন্ধন উৎসবকে কেন্দ্র করে রচিত হয় অসংখ্য স্বদেশি গান, জেগে ওঠে বাংলা গানে দেশভাবনার অনুচ্চ ইঙ্গিত। তৃতীয়ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ বাংলা নাটকে ব্যবহার করতে থাকেন সমসাময়িক কালের চাহিদানুযায়ী প্রাণবন্ত বাংলা গান।

মোটামুটিভাবে বলা যায়- ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের সেই ত্রি-ধারার গীতরীতিই সতর্ক অনুধাবনে সমীকৃত হয়েছে নতুন ভাবনা রূপায়ণে। এই চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলা গান একটি পরিপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করে। যুগ যুগ ধরে এ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত অনেক কবি-সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকারের মধ্যে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উলেখযোগ্য হলেন- পঞ্চপ্রদীপ খ্যাত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন এবং কাজী নজরুল ইসলাম। এই পাঁচ অলৌকিক কিন্নর পর পর আভির্ভূত হয়ে বাংলা গানে অনির্ণীত রূপায়বব সংগঠনে ও বাঙালির বাণীময় আত্মোদঘাটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত অনুভূতিকে নিজের মতো করে প্রকাশ করেছেন নিজেদের বাণী ও সুর সৃজনে, যেগুলো যুগ যুগ ধরে চিরায়ত বাংলার সারস্বত সাধনার শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্যরূপে নিবেদিত হয়ে আসছে।

এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনপ্রণালি ও সংস্কৃতি নিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় যেসব বাণী ও সুর রচনা করেছিলেন, সেগুলো লোকগীতি নামে বাংলা গানের বিশেষ আদর্শ হিসেবে সমাদৃত, যা এখনও আমাদের দেশে বহমান রয়েছে। লোকগীতি বাঙালি জাতির শেকড়- যা এদেশে স্বাভাবিকভাবে জন্ম নিয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই বিকশিত হচ্ছে, কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি, বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো অবকাশও নেই। তাছাড়া বাংলাদেশের নদী-সংলগ্ন এলাকায় রচিত ভাটিয়ালি, রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়া, চাপইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের মাটি ও মানুষের গানসহ মরমিয়া সাধকদের বাউলগান এদেশের সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে। ফলে তাঁরা খুঁজে পায় তাদের শেকড়ের ঠিকানা। এসময় বাউলসংগীতের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা কুষ্টিয়ার লালন ফকির, ফিকির চাঁদ নামে সমধিক পরিচিত কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, গগন হরকরা, মরমিসংগীতে সুনামগঞ্জের হাছন রাজা, রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক সংগীতে রাধারমণ এবং এর পরবর্তী পর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনোমোহন দত্ত, যশোহরের বিজয় সরকার, সুনামগঞ্জের আব্দুল করিম প্রমুখের অধ্যাত্মিক, ভাব-সংগীত, লোকসংগীত, এবং বাংলাদেশের গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী গান এদেশের জনচিত্ত জয় করতে সমর্থ হয়। তখন আমাদের দেশে গণসংগীত নামে আরও একটি সংগীতধারার প্রচলন শুরু হয়। এর রূপকার ছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। মূলত শ্রমজীবী মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা এবং তাদের সংগ্রামের সমন্বিত রূপই হলো গণসংগীত বা জীবনের গান। এ জাতীয় গানের মর্মার্থে থাকে স্বদেশচিন্তা এবং সমাজের অন্যায়, অবিচার ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এসব গান চল্লিশের দশক থেকে আধুনিক গানের গীতিকার ও সুরকারগণই সৃষ্টি করে আসছে।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পঞ্চপ্রদীপের পঞ্চম প্রদীপ নজরুল পরবর্তী বাংলা গানে সুরের চলনে ও গীত রচনায় আসে নানা বিভাজন। গীতিকার গান লেখেন, সুরকার সুর দেন, কণ্ঠে রূপায়ণ করেন আরেকজন। আবার এগুলো সমন্বয়ের জন্য তথা গানের পরিপূর্ণ রূপ প্রকাশ করার জন্য থাকেন অ্যারেঞ্জার নামে এক নতুন ব্যক্তি। এ সময়টাতে গ্রামফোন কোম্পানি, বেতার কেন্দ্র এবং সবাক চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে বাংলা গানের চাহিদা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়, সৃষ্টি হয় নতুন শ্রুতৃম-লীর। পাশাপাশি নজরুলের কথা অনুসরণ ও অনুকরণ করে অবির্ভাব ঘটে বেশকিছু গীতিকবি ও সুর¯্রষ্টার। তাদের মধ্যে অনেকেই প্রার্থিত মান রক্ষা করতে পারেনি। এমতাবস্থায়, আধুনিক গানের সমান্তরাল সম্প্রসারণরূপে ‘রাগপ্রধান গান’ নামে আরও একটি ভিন্ন সংগীতধারার গোড়াপত্তন করেন সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী, যা এখনও সজীব রয়েছে।

এ সময় বাংলা গীত রচনায় যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে সজনীকান্ত দাস (১৯০০-১৯৬২), হীরেন বসু (১৯০৩-১৯৮৭), শৈলেন রায় (১৯০৫-১৯৬৩), অজয় ভট্টাচার্য (১৯০৬-১৯৪৩), সুরোধ পুরকায়স্থ (১৯০৭-১৯৮৪), প্রণব রায় (১৯১১-১৯৭৫) প্রমুখ। সুর রচয়িতাদের মধ্যে কৃষ্ণ চন্দ্র দে (১৮৯৩-১৯৬২), দিলীপ কুমার রায় (১৮৯৬-১৯৮০), শচীন দেববর্মণ (১৯০৬-১৯৭৫), হিমাংশু দত্ত (১৯০৮-১৯৪৪), রাইচাঁদ বড়াল (১৯০৩-১৯৮১), কমল দাশগুপ্ত (১৯১২-১৯৭৪), শৈলেশ দত্তগুপ্ত (?- ১৯৬৩), সলিল চৌধুরী ( ১৯২৩-১৯৯৫) প্রমুখ এবং গায়ক-গায়িকাদের মধ্যে কৃষ্ণ চন্দ্র দে (১৮৯৩-১৯৬২), জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী (১৯০২-১৯৪৭), সায়গল (১৯০৪-১৯৪৭), পঙ্কজ কুমার মলি¬ক (১৯০৫-১৯৭৮), শচীন দেববর্মণ, আঙুরবালা (১৯০৭-১৯৮৩), সাহানা দেবী (১৯০৭-১৯৯০), কানন বালা (১৯১৬-১৯৯২), জগন্ময় মিত্র (১৯১৮-২০০৩) প্রমুখ শিল্পীর নাম উলে¬খযোগ্য। এসব গীতিকার, সুরকার এবং কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে প্রকাশের মৌলিকতা ও ভাবনায় নতুনত্ব ছিল, যা সর্বজনস্বীকৃত। এর পরবর্তী পর্যায়ে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার (১৯২৫-১৯৮৬), শ্যামল গুপ্ত (১৯২২-২০১০), পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৪-১৯৯৯) এবং মোহিনী চৌধুরীর (১৯২০-১৯৮৭) মতো গীতিকার, জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (১৯২০-১৯৮৯) মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৯৩১-১৯৯২), মান্না দে (১৯১৯-২০১৪), সতীনাথ মুখোপাধ্যায় (১৯২৫-১৯৯২), উৎপলা সেন (১৯২৪-২০০৫)), সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় (১৯৩১-২০২২), প্রতিমা বন্দোপাধ্যায় (১৯৩৪-২০০৪), নির্মলা মিশ্র, আরতী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ কণ্ঠশিল্পীর কণ্ঠে আশ্রয় করে বাংলা গান পুরো ষাটের দশক বাংলা ভাষা-ভাষীদের আদর কুড়োতে সমর্থ হয়েছে এবং এখনও গানগুলো মানুষের কাছে বরণীয় হয়ে আছে।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সাতচলি¬শ পরবর্তী দেশ বিভাগের পর ধর্মীয় ঐক্যসূত্রের বাঁধনে পাকিস্তানের ভাবাদর্শ ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তানি স্বৈরশাসক সংগীতচর্চাসহ বাঙালি সংস্কৃতির ওপর ক্রমাগত আঘাত হানতে শুরু করে। এদেশীয় কিছু বাঙালি অনুচরের সহযোগিতায় এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সরকার রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। অথচ রবীন্দ্রসংগীত নবসৃষ্ট পাকিস্তানি বাংলাভাষীদের অনুভূতিকে গভীরতা ও তীক্ষèতা দান করেছে এবং তাদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। শেষ পর্যন্ত সেনা শাসনের সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এদেশের বিভিন্ন জায়গায় পালিত হয় রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী। ওয়াহিদুল হক এবং সন্জীদা খাতুনের নেতৃত্বে তখন গড়ে ওঠে রবীন্দ্রসংগীত চর্চার একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফরম। পরবর্তীতে এটি ‘ছায়নট সংগীতবিদ্যায়তন’ নামে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার শিক্ষালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলা সংগীতের প্রচার, প্রসার ও বিকাশে ছায়ানটের অবদান সর্বজনবিদিত। ছায়ানটের সফল কর্মযজ্ঞের ফলেই রবীন্দ্রসংগীত চর্চা স্বাভাবিক হয়ে এর বাণী ও সুর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কলিম শরাফী, জাহিদুর রহিম, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, অদিতি মহসিন, মিতা হক, পাপিয়া সারওয়ার, সাদী মোহাম্মদ, কাদেরী কিবরিয়া প্রমুখ রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, শত বাধাবিপত্তির পরও সাতচলি¬শ পরবর্তী দেশ বিভাগ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং আমাদের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এ দেশে বেশকিছ উৎকৃষ্ট দেশাত্মবোধক, উদ্দীপনামূলক সংগ্রামী গানের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক গান রচিত হয়েছে। এ সময়ে ঢাকাকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে নতুন সংস্কৃতি চর্চার উদ্ভব ঘটে। ফলে এদেশের গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পীরাও ক্রমান্বয়ে নিজ নিজ প্রতিভা দিয়ে জনচিত্ত জয় করার উদ্যোগ নেয়। তখন গীতিকার হিসেবে সিকান্দার আবু জাফর, খান আতাউর রহমান, গোবিন্দ হালদার, জহির রায়হান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, জিয়া হায়দার, গাজী মাজহারুল আনোয়ার প্রমুখ। সুরকার হিসেবে সত্য সাহা, বারীন মজুমদার, সমর দাস, আলতাফ মাহমুদ, আব্দুল আহাদ, খান আতাউর রহমান, সুবল দাস, খন্দকার নুরুল আলম, শেখ লুৎফর রহমান, আব্দুল লতিফ, আনোয়ার পারভেজ, আপেল মাহমুদ, সুজেয় শ্যাম প্রমুখ এবং কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আব্বাসউদ্দিন আহমেদ, লায়লা আর্জুমান্দ বানু, ফিরোজা বেগম, আব্দুল আলীম, আলতাফ মাহমুদ, মাহমুদুন্নবী, আব্দুল জব্বার, বশীর আহমেদ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, আঞ্জুমানআরা বেগম, নিলুফার ইয়াসমীন, রুণা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, সুবীর নন্দী প্রমুখের নাম উলে¬খযোগ্য।

উল্লিখিত গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের কালজয়ী গানগুলো এদেশের সংগ্রামী মানুষকে নিরন্তর প্রেরণা যুগিয়েছে এবং বাংলা গানকে অনেকাংশে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু সে ধরনের গান এখন আর রচিত হয় না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঘুরেফিরে পুরানো একই গান গীত হয়ে থাকে। কারণ, প্রযোজক/ রেকর্ড কোম্পানিগুলো নাকি এসব গান উৎপাদনে তেমন বাণিজ্য করতে পারে না।

অর্থাৎ উদার সাংস্কৃতিক মনোভাব এখন হারিয়ে যাচ্ছে। গীতিকার, সুরকার, শিল্পী ও কলা-কুশলিদের পারস্পরিক চিন্তা-ভাবনায় সমন্বয়হীনতার এহেন অভাবই বাংলা গানে এঁকে দিচ্ছে মানহীনতার এক অমার্জনীয় কলঙ্ক। ভালো অর্থপ্রাপ্তির আশায় অসাধু প্রযোজক কিংবা রেকর্ড কোম্পানিগুলো এখন চায় প্রণয়-সর্বস্ব সস্তা চপলতা বা সাজানো বেদনাসংবলিত বাংলাগান। এই প্রফেসনাল দৃষ্টিভঙ্গি এবং অর্ডারি গান তৈরির নতুন ধারা শিল্পী ও কলা-কুশলির সৃজনাবেগ ও মৌলিকতা অনেকটাই ভ্রষ্ট করছে। চাকচিক্যহীন পরিকল্পনাশূন্য উদ্ভট বাণীর এসব অবান্তর সুরে মেলডির চেয়ে হাজার রকমের যন্ত্রই যেন মুখ্য। ফলে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা গানের বৈশিষ্ট্য। এদিকে বাজার মাত করা অভিনেতা অভিনেত্রীরা টেলিভিশনের পর্দায় ঠোঁট নাড়িয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে অর্থহীন গানগুলো আরও জমিয়ে দিতে।

এই জাতীয় গান যত সাফল্য পায়, যত জনপ্রিয় হয়, ততই প্রকট হয় আধুনিক গানের দৈন্যদশা। ফলে পঞ্চাশ বা ষাট দশকে বাংলা গান যেভাবে শ্রোতাদের মন জয় করেছিল আজ তা পারছে না। সে গানগুলো তৈরি হতো কাব্যধর্মী কথা ও সুরের সমন্বয়ে, রেকর্ড করা হতো গানের সাথে সম্পৃক্ত সবার উপস্থিতিতে, থাকতো সবার আন্তরিকতা, চলতো পারস্পরিক মতবিনিময় এবং দীর্ঘক্ষণের মহড়া। কিন্তু বর্তমান উন্নততর নিষ্প্রাণ টেকনোলজির সুবাদে সংশি্লষ্ট কারোর সঙ্গে নিজ নিজ বিষয় নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন পড়ে না। একতারা, দোতারা, তবলা, হারমনিয়াম, ঢোল, মৃদঙ্গ, পাখওয়াজ, বাঁশের বাঁশি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র থাকতো বাংলা গানের অনুষঙ্গ হিসেবে। কিন্তু এসব বাদ্যযন্ত্র ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। ফলে বাংলা গানের স্বতন্ত্র মেজাজ ও মানব হৃদয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আবেগ ও অনুভূতি আজ লোপ পেতে বসেছে, চলছে পেছনে যাবার পালা। কিন্তু এখনও ‘হারানো দিনের গান’ নামে সেই গানগুলো শ্রোতাদের কাছে অনেক প্রিয়।

অনেকটা বাধ্য হয়ে অভিজাত রেকর্ডিং কোম্পানিগুলো প্রকাশ করে চলেছে পুরনো হিট গান বা তার রিমেক। তবে এখন আর ক্যাসেট বের করতে হয় না। ইউ টিউবে আপলোড করে চলেছে চলি¬শ থেকে সত্তরের দশকে গাওয়া শিল্পীদের আধুনিক গান। ১লা বৈশাখ, বর্ষামঙ্গল, বসন্ত উৎসব, ঈদ কিংবা পূজা উপলক্ষে এখন আর নতুন গান রচিত হয় না। পঞ্চপ্রদীপের গানেই সে কাজ মিটে যায়। তবে একটা কুচক্রি মহল কিছু কিছু যৌনগন্ধী শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে সস্তা, দুর্বল ও অর্থহীন কিছু গান রচনা করছে। সেগুলোকে অনেক সময় ঐতিহ্যবাহী বাউল নাম দিয়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে কিংবা স্টেজে প্রচার করছে। তারা গানের মৌলিকত্ব নষ্ট করার অপতৎপরতা চালাচ্ছে, যা একেবারেই অনভিপ্রেত। এ ধরনের অনৈতিক কর্মকা- সরকারকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। একথা সত্য যে, মানুষকে আত্মস্থ করতে, উদ্বুদ্ধ করতে এবং উৎসের দিকে ফেরাবার জন্য সমসাময়িক গানের ভূমিকা সবচেয়ে কার্যকর। সুতরাং নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন ভাবনার, নতুন সুরের গান দিতেই হবে। তবে তা অবশ্যই হতে হবে আমাদেও বাঙালি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যথায় তারা পথভ্রষ্ট হয়ে চলে যাবে চিৎকৃত স্ববিরোধে।

আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি এবং মুক্তিযুদ্ধের মতো গৌরবময় অধ্যায় পাড়ি দিয়েছি- সেই গৌরবে আমরা সবাই গৌরবান্বিত। কিন্তু সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে গান গাওয়ার নামে যখন আমাদের তরুণ প্রজন্মকে মঞ্চে লম্ফ-ঝম্প করতে দেখি, তখন নিজেকে অপরাধী মনে হয় এই ভেবে যে, আমরা আমাদের সন্তানকে আমাদের নিজস্ব সংগীতের ভাবসম্পদ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারিনি। এটা আমাদেরই ব্যর্থতা।

এরপরও বলতে হয় বাংলা গান থেমে নেই। যুগ যুগ ধরে চলছে এবং চলবে সেই চিরায়ত সারস্বত সাধনা। মনে রাখতে হবে, বাংলা গান বাঙালি জাতির বিচিত্র সম্পদ এবং এক মহান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য; বাংলা গান বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুতরাং বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, দর্শন, শ্রেণিসাম্য, সমাজের প্রতিচ্ছবি- সবকিছুই এই বাংলা গানের মাধ্যমে লালন করতে হবে এবং তা করতে হবে আমাদের জাতীয় স্বার্থে। এদেশের মাটি ও মানুষের সেই অমূল্য সম্পদকে এবং বাঙালি সংস্কৃতিকে মনেপ্রাণে ভালবাসতে হবে; প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের সামনে তা তুলে ধরতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে মৌলিক গান সৃষ্টির পরিকল্পনা করা এবং তা ছড়িয়ে দেওয়া প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এ লক্ষ্য নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের নতুন গীতিকার ও সুরকারের গান প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের দিয়ে গাওয়াতে হবে, কাব্যধর্মী গান লেখাতে হবে, মেলোডিবহুল সুরারোপ করতে হবে। বাংলা সংগীতের বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ কথা ও সুরের সমন্বয়কে সমুন্নত রাখতে হবে। তবেই বাঙালি আবার নিজেকে খুঁজে পাবে বাংলার আবহমান সেই ঐতিহ্যবাহী গানে।

image
আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
সংবাদ এবং আমার শৈশব
আমার বাতিঘর
শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা
নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
চলছে লড়াই, চলবে লড়াই
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
আমার ‘সংবাদ’
দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান
বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন
দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী
নতুন সময়ের গণমাধ্যম
‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’
মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন

সঞ্জীব কুমার দেবনাথ

image

সংগীত উৎপত্তির প্রারম্ভিক লগ্নে আমাদের এই ভারতীয় উপ-মহাদেশে সামগান, নাথগীতি, চর্যাগীতি প্রভৃতি প্রকীর্ণ শ্রেণির প্রবন্ধসংগীত গীত হতো। পর্যায়ক্রমে কাঠামোগত পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে সেই গানগুলো বর্তমান সাংগীতিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই পরিবর্তন সর্বপ্রথম শুরু হয় রামনিধি গুপ্ত ওরফে নিধুবাবুর হাতে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে পাঞ্জাব অঞ্চলের শোরি মিয়া নামে একজন সংগীতজ্ঞ কর্তৃক উদ্ভাবিত ‘টপ্পা’ গায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করে তিনি বাংলা গানে ‘টপ্পা’র প্রচলন করেন। নিধুবাবু প্রবর্তিত এই সংগীতধারা ঊনবিংশ শতাব্দীজুড়ে বাংলা গানকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তাঁর গানে আধুনিক যুগের রোমান্টিক চেতনার উন্মেষ ঘটে এবং আধুনিক বাংলা গীতধারা সূচিত হয়। সংগীতের ভাব ও রূপের ক্ষেত্রে নব-চিন্তা আনায়নে নিধুবাবুর পরই আসেন বিভাসা প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে নিধুবাবু-উত্তর বাংলা গানের বিকাশ সাধিত হয়েছে মূলত ব্রাহ্মধর্মান্দোলন, দেশোদ্দীপনা ও নাট্যমঞ্চ এই ত্রি-ধারায়। প্রথমত, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সংগীতবিজ্ঞানী কৃষ্ণধন বন্দোপাধ্যায় কর্তৃক বাংলা গানের স্বরলিপির পদ্ধতি প্রণয়নের পর বিষ্ণুপুরের ধ্রুপদকে ব্যবহার করে বাংলা গানে ভাব ও বন্দিশের গাম্ভীর্য আনতে উদ্যোগ নেয় ব্রাহ্মসমাজ। দ্বিতীয়ত, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গরোধ আন্দোলনকালে রাখিবন্ধন উৎসবকে কেন্দ্র করে রচিত হয় অসংখ্য স্বদেশি গান, জেগে ওঠে বাংলা গানে দেশভাবনার অনুচ্চ ইঙ্গিত। তৃতীয়ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ বাংলা নাটকে ব্যবহার করতে থাকেন সমসাময়িক কালের চাহিদানুযায়ী প্রাণবন্ত বাংলা গান।

মোটামুটিভাবে বলা যায়- ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের সেই ত্রি-ধারার গীতরীতিই সতর্ক অনুধাবনে সমীকৃত হয়েছে নতুন ভাবনা রূপায়ণে। এই চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলা গান একটি পরিপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করে। যুগ যুগ ধরে এ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত অনেক কবি-সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকারের মধ্যে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উলেখযোগ্য হলেন- পঞ্চপ্রদীপ খ্যাত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন এবং কাজী নজরুল ইসলাম। এই পাঁচ অলৌকিক কিন্নর পর পর আভির্ভূত হয়ে বাংলা গানে অনির্ণীত রূপায়বব সংগঠনে ও বাঙালির বাণীময় আত্মোদঘাটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত অনুভূতিকে নিজের মতো করে প্রকাশ করেছেন নিজেদের বাণী ও সুর সৃজনে, যেগুলো যুগ যুগ ধরে চিরায়ত বাংলার সারস্বত সাধনার শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্যরূপে নিবেদিত হয়ে আসছে।

এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনপ্রণালি ও সংস্কৃতি নিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় যেসব বাণী ও সুর রচনা করেছিলেন, সেগুলো লোকগীতি নামে বাংলা গানের বিশেষ আদর্শ হিসেবে সমাদৃত, যা এখনও আমাদের দেশে বহমান রয়েছে। লোকগীতি বাঙালি জাতির শেকড়- যা এদেশে স্বাভাবিকভাবে জন্ম নিয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই বিকশিত হচ্ছে, কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি, বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো অবকাশও নেই। তাছাড়া বাংলাদেশের নদী-সংলগ্ন এলাকায় রচিত ভাটিয়ালি, রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়া, চাপইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের মাটি ও মানুষের গানসহ মরমিয়া সাধকদের বাউলগান এদেশের সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে। ফলে তাঁরা খুঁজে পায় তাদের শেকড়ের ঠিকানা। এসময় বাউলসংগীতের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা কুষ্টিয়ার লালন ফকির, ফিকির চাঁদ নামে সমধিক পরিচিত কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, গগন হরকরা, মরমিসংগীতে সুনামগঞ্জের হাছন রাজা, রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক সংগীতে রাধারমণ এবং এর পরবর্তী পর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনোমোহন দত্ত, যশোহরের বিজয় সরকার, সুনামগঞ্জের আব্দুল করিম প্রমুখের অধ্যাত্মিক, ভাব-সংগীত, লোকসংগীত, এবং বাংলাদেশের গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী গান এদেশের জনচিত্ত জয় করতে সমর্থ হয়। তখন আমাদের দেশে গণসংগীত নামে আরও একটি সংগীতধারার প্রচলন শুরু হয়। এর রূপকার ছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। মূলত শ্রমজীবী মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা এবং তাদের সংগ্রামের সমন্বিত রূপই হলো গণসংগীত বা জীবনের গান। এ জাতীয় গানের মর্মার্থে থাকে স্বদেশচিন্তা এবং সমাজের অন্যায়, অবিচার ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এসব গান চল্লিশের দশক থেকে আধুনিক গানের গীতিকার ও সুরকারগণই সৃষ্টি করে আসছে।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পঞ্চপ্রদীপের পঞ্চম প্রদীপ নজরুল পরবর্তী বাংলা গানে সুরের চলনে ও গীত রচনায় আসে নানা বিভাজন। গীতিকার গান লেখেন, সুরকার সুর দেন, কণ্ঠে রূপায়ণ করেন আরেকজন। আবার এগুলো সমন্বয়ের জন্য তথা গানের পরিপূর্ণ রূপ প্রকাশ করার জন্য থাকেন অ্যারেঞ্জার নামে এক নতুন ব্যক্তি। এ সময়টাতে গ্রামফোন কোম্পানি, বেতার কেন্দ্র এবং সবাক চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে বাংলা গানের চাহিদা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়, সৃষ্টি হয় নতুন শ্রুতৃম-লীর। পাশাপাশি নজরুলের কথা অনুসরণ ও অনুকরণ করে অবির্ভাব ঘটে বেশকিছু গীতিকবি ও সুর¯্রষ্টার। তাদের মধ্যে অনেকেই প্রার্থিত মান রক্ষা করতে পারেনি। এমতাবস্থায়, আধুনিক গানের সমান্তরাল সম্প্রসারণরূপে ‘রাগপ্রধান গান’ নামে আরও একটি ভিন্ন সংগীতধারার গোড়াপত্তন করেন সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী, যা এখনও সজীব রয়েছে।

এ সময় বাংলা গীত রচনায় যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে সজনীকান্ত দাস (১৯০০-১৯৬২), হীরেন বসু (১৯০৩-১৯৮৭), শৈলেন রায় (১৯০৫-১৯৬৩), অজয় ভট্টাচার্য (১৯০৬-১৯৪৩), সুরোধ পুরকায়স্থ (১৯০৭-১৯৮৪), প্রণব রায় (১৯১১-১৯৭৫) প্রমুখ। সুর রচয়িতাদের মধ্যে কৃষ্ণ চন্দ্র দে (১৮৯৩-১৯৬২), দিলীপ কুমার রায় (১৮৯৬-১৯৮০), শচীন দেববর্মণ (১৯০৬-১৯৭৫), হিমাংশু দত্ত (১৯০৮-১৯৪৪), রাইচাঁদ বড়াল (১৯০৩-১৯৮১), কমল দাশগুপ্ত (১৯১২-১৯৭৪), শৈলেশ দত্তগুপ্ত (?- ১৯৬৩), সলিল চৌধুরী ( ১৯২৩-১৯৯৫) প্রমুখ এবং গায়ক-গায়িকাদের মধ্যে কৃষ্ণ চন্দ্র দে (১৮৯৩-১৯৬২), জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী (১৯০২-১৯৪৭), সায়গল (১৯০৪-১৯৪৭), পঙ্কজ কুমার মলি¬ক (১৯০৫-১৯৭৮), শচীন দেববর্মণ, আঙুরবালা (১৯০৭-১৯৮৩), সাহানা দেবী (১৯০৭-১৯৯০), কানন বালা (১৯১৬-১৯৯২), জগন্ময় মিত্র (১৯১৮-২০০৩) প্রমুখ শিল্পীর নাম উলে¬খযোগ্য। এসব গীতিকার, সুরকার এবং কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে প্রকাশের মৌলিকতা ও ভাবনায় নতুনত্ব ছিল, যা সর্বজনস্বীকৃত। এর পরবর্তী পর্যায়ে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার (১৯২৫-১৯৮৬), শ্যামল গুপ্ত (১৯২২-২০১০), পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৪-১৯৯৯) এবং মোহিনী চৌধুরীর (১৯২০-১৯৮৭) মতো গীতিকার, জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (১৯২০-১৯৮৯) মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৯৩১-১৯৯২), মান্না দে (১৯১৯-২০১৪), সতীনাথ মুখোপাধ্যায় (১৯২৫-১৯৯২), উৎপলা সেন (১৯২৪-২০০৫)), সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় (১৯৩১-২০২২), প্রতিমা বন্দোপাধ্যায় (১৯৩৪-২০০৪), নির্মলা মিশ্র, আরতী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ কণ্ঠশিল্পীর কণ্ঠে আশ্রয় করে বাংলা গান পুরো ষাটের দশক বাংলা ভাষা-ভাষীদের আদর কুড়োতে সমর্থ হয়েছে এবং এখনও গানগুলো মানুষের কাছে বরণীয় হয়ে আছে।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সাতচলি¬শ পরবর্তী দেশ বিভাগের পর ধর্মীয় ঐক্যসূত্রের বাঁধনে পাকিস্তানের ভাবাদর্শ ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তানি স্বৈরশাসক সংগীতচর্চাসহ বাঙালি সংস্কৃতির ওপর ক্রমাগত আঘাত হানতে শুরু করে। এদেশীয় কিছু বাঙালি অনুচরের সহযোগিতায় এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সরকার রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। অথচ রবীন্দ্রসংগীত নবসৃষ্ট পাকিস্তানি বাংলাভাষীদের অনুভূতিকে গভীরতা ও তীক্ষèতা দান করেছে এবং তাদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। শেষ পর্যন্ত সেনা শাসনের সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এদেশের বিভিন্ন জায়গায় পালিত হয় রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী। ওয়াহিদুল হক এবং সন্জীদা খাতুনের নেতৃত্বে তখন গড়ে ওঠে রবীন্দ্রসংগীত চর্চার একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফরম। পরবর্তীতে এটি ‘ছায়নট সংগীতবিদ্যায়তন’ নামে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার শিক্ষালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলা সংগীতের প্রচার, প্রসার ও বিকাশে ছায়ানটের অবদান সর্বজনবিদিত। ছায়ানটের সফল কর্মযজ্ঞের ফলেই রবীন্দ্রসংগীত চর্চা স্বাভাবিক হয়ে এর বাণী ও সুর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কলিম শরাফী, জাহিদুর রহিম, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, অদিতি মহসিন, মিতা হক, পাপিয়া সারওয়ার, সাদী মোহাম্মদ, কাদেরী কিবরিয়া প্রমুখ রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, শত বাধাবিপত্তির পরও সাতচলি¬শ পরবর্তী দেশ বিভাগ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং আমাদের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এ দেশে বেশকিছ উৎকৃষ্ট দেশাত্মবোধক, উদ্দীপনামূলক সংগ্রামী গানের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক গান রচিত হয়েছে। এ সময়ে ঢাকাকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে নতুন সংস্কৃতি চর্চার উদ্ভব ঘটে। ফলে এদেশের গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পীরাও ক্রমান্বয়ে নিজ নিজ প্রতিভা দিয়ে জনচিত্ত জয় করার উদ্যোগ নেয়। তখন গীতিকার হিসেবে সিকান্দার আবু জাফর, খান আতাউর রহমান, গোবিন্দ হালদার, জহির রায়হান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, জিয়া হায়দার, গাজী মাজহারুল আনোয়ার প্রমুখ। সুরকার হিসেবে সত্য সাহা, বারীন মজুমদার, সমর দাস, আলতাফ মাহমুদ, আব্দুল আহাদ, খান আতাউর রহমান, সুবল দাস, খন্দকার নুরুল আলম, শেখ লুৎফর রহমান, আব্দুল লতিফ, আনোয়ার পারভেজ, আপেল মাহমুদ, সুজেয় শ্যাম প্রমুখ এবং কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আব্বাসউদ্দিন আহমেদ, লায়লা আর্জুমান্দ বানু, ফিরোজা বেগম, আব্দুল আলীম, আলতাফ মাহমুদ, মাহমুদুন্নবী, আব্দুল জব্বার, বশীর আহমেদ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, আঞ্জুমানআরা বেগম, নিলুফার ইয়াসমীন, রুণা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, সুবীর নন্দী প্রমুখের নাম উলে¬খযোগ্য।

উল্লিখিত গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের কালজয়ী গানগুলো এদেশের সংগ্রামী মানুষকে নিরন্তর প্রেরণা যুগিয়েছে এবং বাংলা গানকে অনেকাংশে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু সে ধরনের গান এখন আর রচিত হয় না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঘুরেফিরে পুরানো একই গান গীত হয়ে থাকে। কারণ, প্রযোজক/ রেকর্ড কোম্পানিগুলো নাকি এসব গান উৎপাদনে তেমন বাণিজ্য করতে পারে না।

অর্থাৎ উদার সাংস্কৃতিক মনোভাব এখন হারিয়ে যাচ্ছে। গীতিকার, সুরকার, শিল্পী ও কলা-কুশলিদের পারস্পরিক চিন্তা-ভাবনায় সমন্বয়হীনতার এহেন অভাবই বাংলা গানে এঁকে দিচ্ছে মানহীনতার এক অমার্জনীয় কলঙ্ক। ভালো অর্থপ্রাপ্তির আশায় অসাধু প্রযোজক কিংবা রেকর্ড কোম্পানিগুলো এখন চায় প্রণয়-সর্বস্ব সস্তা চপলতা বা সাজানো বেদনাসংবলিত বাংলাগান। এই প্রফেসনাল দৃষ্টিভঙ্গি এবং অর্ডারি গান তৈরির নতুন ধারা শিল্পী ও কলা-কুশলির সৃজনাবেগ ও মৌলিকতা অনেকটাই ভ্রষ্ট করছে। চাকচিক্যহীন পরিকল্পনাশূন্য উদ্ভট বাণীর এসব অবান্তর সুরে মেলডির চেয়ে হাজার রকমের যন্ত্রই যেন মুখ্য। ফলে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা গানের বৈশিষ্ট্য। এদিকে বাজার মাত করা অভিনেতা অভিনেত্রীরা টেলিভিশনের পর্দায় ঠোঁট নাড়িয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে অর্থহীন গানগুলো আরও জমিয়ে দিতে।

এই জাতীয় গান যত সাফল্য পায়, যত জনপ্রিয় হয়, ততই প্রকট হয় আধুনিক গানের দৈন্যদশা। ফলে পঞ্চাশ বা ষাট দশকে বাংলা গান যেভাবে শ্রোতাদের মন জয় করেছিল আজ তা পারছে না। সে গানগুলো তৈরি হতো কাব্যধর্মী কথা ও সুরের সমন্বয়ে, রেকর্ড করা হতো গানের সাথে সম্পৃক্ত সবার উপস্থিতিতে, থাকতো সবার আন্তরিকতা, চলতো পারস্পরিক মতবিনিময় এবং দীর্ঘক্ষণের মহড়া। কিন্তু বর্তমান উন্নততর নিষ্প্রাণ টেকনোলজির সুবাদে সংশি্লষ্ট কারোর সঙ্গে নিজ নিজ বিষয় নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন পড়ে না। একতারা, দোতারা, তবলা, হারমনিয়াম, ঢোল, মৃদঙ্গ, পাখওয়াজ, বাঁশের বাঁশি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র থাকতো বাংলা গানের অনুষঙ্গ হিসেবে। কিন্তু এসব বাদ্যযন্ত্র ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। ফলে বাংলা গানের স্বতন্ত্র মেজাজ ও মানব হৃদয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আবেগ ও অনুভূতি আজ লোপ পেতে বসেছে, চলছে পেছনে যাবার পালা। কিন্তু এখনও ‘হারানো দিনের গান’ নামে সেই গানগুলো শ্রোতাদের কাছে অনেক প্রিয়।

অনেকটা বাধ্য হয়ে অভিজাত রেকর্ডিং কোম্পানিগুলো প্রকাশ করে চলেছে পুরনো হিট গান বা তার রিমেক। তবে এখন আর ক্যাসেট বের করতে হয় না। ইউ টিউবে আপলোড করে চলেছে চলি¬শ থেকে সত্তরের দশকে গাওয়া শিল্পীদের আধুনিক গান। ১লা বৈশাখ, বর্ষামঙ্গল, বসন্ত উৎসব, ঈদ কিংবা পূজা উপলক্ষে এখন আর নতুন গান রচিত হয় না। পঞ্চপ্রদীপের গানেই সে কাজ মিটে যায়। তবে একটা কুচক্রি মহল কিছু কিছু যৌনগন্ধী শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে সস্তা, দুর্বল ও অর্থহীন কিছু গান রচনা করছে। সেগুলোকে অনেক সময় ঐতিহ্যবাহী বাউল নাম দিয়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে কিংবা স্টেজে প্রচার করছে। তারা গানের মৌলিকত্ব নষ্ট করার অপতৎপরতা চালাচ্ছে, যা একেবারেই অনভিপ্রেত। এ ধরনের অনৈতিক কর্মকা- সরকারকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। একথা সত্য যে, মানুষকে আত্মস্থ করতে, উদ্বুদ্ধ করতে এবং উৎসের দিকে ফেরাবার জন্য সমসাময়িক গানের ভূমিকা সবচেয়ে কার্যকর। সুতরাং নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন ভাবনার, নতুন সুরের গান দিতেই হবে। তবে তা অবশ্যই হতে হবে আমাদেও বাঙালি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যথায় তারা পথভ্রষ্ট হয়ে চলে যাবে চিৎকৃত স্ববিরোধে।

আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি এবং মুক্তিযুদ্ধের মতো গৌরবময় অধ্যায় পাড়ি দিয়েছি- সেই গৌরবে আমরা সবাই গৌরবান্বিত। কিন্তু সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে গান গাওয়ার নামে যখন আমাদের তরুণ প্রজন্মকে মঞ্চে লম্ফ-ঝম্প করতে দেখি, তখন নিজেকে অপরাধী মনে হয় এই ভেবে যে, আমরা আমাদের সন্তানকে আমাদের নিজস্ব সংগীতের ভাবসম্পদ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারিনি। এটা আমাদেরই ব্যর্থতা।

এরপরও বলতে হয় বাংলা গান থেমে নেই। যুগ যুগ ধরে চলছে এবং চলবে সেই চিরায়ত সারস্বত সাধনা। মনে রাখতে হবে, বাংলা গান বাঙালি জাতির বিচিত্র সম্পদ এবং এক মহান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য; বাংলা গান বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুতরাং বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, দর্শন, শ্রেণিসাম্য, সমাজের প্রতিচ্ছবি- সবকিছুই এই বাংলা গানের মাধ্যমে লালন করতে হবে এবং তা করতে হবে আমাদের জাতীয় স্বার্থে। এদেশের মাটি ও মানুষের সেই অমূল্য সম্পদকে এবং বাঙালি সংস্কৃতিকে মনেপ্রাণে ভালবাসতে হবে; প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের সামনে তা তুলে ধরতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে মৌলিক গান সৃষ্টির পরিকল্পনা করা এবং তা ছড়িয়ে দেওয়া প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এ লক্ষ্য নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের নতুন গীতিকার ও সুরকারের গান প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের দিয়ে গাওয়াতে হবে, কাব্যধর্মী গান লেখাতে হবে, মেলোডিবহুল সুরারোপ করতে হবে। বাংলা সংগীতের বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ কথা ও সুরের সমন্বয়কে সমুন্নত রাখতে হবে। তবেই বাঙালি আবার নিজেকে খুঁজে পাবে বাংলার আবহমান সেই ঐতিহ্যবাহী গানে।