নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী

মামুন হুসাইন

এই উচ্চাকাক্সক্ষী শিরোনাম দেখে আমি নিজেও এখন যথেষ্ট ধন্দে। আমাদের চিরসখা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমার এই অশিক্ষিত-পটুতা দেখে নিশ্চিত ধমকে দিতেন- ‘ভাসাভাসা ধারণা নিয়ে একটি প্রবন্ধ ফেঁদে বসা বেয়াদবির শামিল, ...।’ অতএব শুরুতেই অশিষ্টাচারের শাস্তি লঘু করার জন্য বর্তমান লেখার কতিপয় খুঁত স্বীকার করে নেয়া যাক মহান আদালত বরাবর: প্রথমত, এই শিরোনাম জ্ঞান কাঠামোর এত অযুত বিষয়কে ছুঁয়ে যায় যে, সভার নির্দিষ্ট ঘড়ি-ঘণ্টার নিগড়ে তা সঠিকভাবে উপস্থাপন করা এক অসম্ভব ঘটনা বটে। দ্বিতীয়ত, বক্তব্যের প্রধানতম চাবি শব্দ, যেমন- নারী, মন, জগৎ ও বিভ্রম- এই শব্দগুলোর পেছনে আমাদের যে অনন্তকালের অভিজ্ঞতা, তর্ক, লড়াই, সে বিষয়েও যথেষ্ট সুবিচার করা হয়নি। তৃতীয়ত, ‘নারীর মনোজগৎ’- এই শব্দটি একসময় আড়াল করে নারীর মনোস্বাস্থ্যকে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি, সুখ্যাত ‘এ্যান্টি সাইকিয়াট্রি’ নামক একদা তৈরি হওয়া আন্দোলনের বাইরে দাঁড়িয়ে হালফিলের মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত তথ্য-তত্ত্বের নিরিখে। শেষত বিবিধ অমুখ্য উৎস থেকে ভাবনা-চিন্তা সুপ্রচুর নকল করার পরেও অচিরেই প্রমাণ হবে যে, এ বিষয়ে আদতে আমি কিছু জানি না।

এই বাস্তবতায় আমার অজ্ঞতা- শুরুতে মন, মনের ধারণা ও মনোদর্শন নিয়ে কিঞ্চিৎ বাচাল হওয়ার প্রণোদনা খুঁজে পায়। কেউ বলেন- মন নিশ্চয় কোনো ভৌত বস্তু নয়; মন স্থান জুড়ে থাকে না, স্থান জুড়ে থাকে দেহ। অথবা দেহ ও মনের ভেতর তৈরি হওয়া ইতিহাসের আলাদা ¯্রােতরেখা শেষ পর্যন্ত উপস্থাপন করে বিবিধ প্রাকৃতিক ও মনোজাগতিক ঘটনাবলী...। কেউ ভাবেন এই স্বীকৃত মতবাদকে নিশ্চয়ই প্রশ্ন করা যায় এক্ষণি। মনোদর্শনের আকর গ্রন্থ উল্টে আমরা এবার আমাদের আচরণের যুক্তি ও কারণ খুঁজি, দ্বৈতবাদ নিয়ে তর্ক করি; কথা বলি ইচ্ছা, অনুভূতি, বেদনা ও চিন্তার স্বরূপ

নিয়ে অথবা আলোচনা স্থির হয় জড়বাদে; আমাদের ধারণা, চিন্তা ও মানসিক সংযুক্তি শেষ পর্যন্ত আমাদের জড় আচরণের (material behavour) প্রত্যক্ষ নিঃসরণ (efflux) বৈ কিছু নয়। পিথাগোরীয়ানরা সেই যে ভাবতেন- আত্মা মৃত্যুর পর অপর দেহে প্রবিষ্ট হয় (transmigration)- কথাটি মনে করে এক ফাঁকে আত্মা ও মন নিয়ে নতুন আলোচনার শিরোনাম খুঁজি। দর্শনের মেধাবী বন্ধুরা, আমার বুদ্ধিহীনতা দূর করার জন্য ধীশক্তি, অভিপ্রায়, আবেগ, আত্মজ্ঞান, সংবেদন, কল্পনা ও প্রপঞ্চবাদ বিষয়ে সহজ পরিভাষা তৈরি করলেও আমি অতিদ্রুত ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চারে রূপান্তরিত হই।

আমার ইচ্ছাবৃত্তি এবার ‘মন পবনের দাঁড়’ হয়ে একবার সর্বজনীন স্কুলের চিরায়ত প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রনাথের পুণ্যাত্মা স্পর্শ করে, আরেকবার গড়িয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের পাদপদ্মে পৌঁছায়। রবীন্দ্রনাথের মতো মহাত্মাও দেখি, মনের তল খুঁজতে যেয়ে আতান্তরে পড়েছিলেন ভারি- ‘...মানুষের মনের যদি নির্দিষ্ট ঋতুভেদ থাকত তাহলে অনেক সুবিধে হতো। ... কিন্তু মনের ঋতু আবার ছ’টা নয়, একেবারে বাহান্নটি- এক প্যাকেট তাসের মতো- কখন কোনটা হাতে আসে তার কিছু ঠিক নেই- অন্তরে বসে-বসে কোন্ খামখেয়ালি খেলোয়াড় যে এই তাস ডিল করে এই খামখেয়ালি খেলা খেলে তার পরিচয় জানিনে।’ ওদিকে ত্রিসন্ধ্যা জপ-তপ করতে করতে শ্রীরামকৃষ্ণ টিপস দিচ্ছেন- ‘আগে মনটা শুদ্ধ করার চেষ্টা কর। ... জ্ঞানই বল আর অজ্ঞানতাই বল সবই মনের অবস্থা... মনই সব। মানুষ মনেই জন্ম, মনেই মৃত, মনেই সাধু, মনেই অসাধু, মনেই পাপী, মনেই পুণ্যবান।’

আমাদের অসাধু মন-অশুদ্ধ মন মনের গঠন-মনের দর্শন ভুলো হয়ে এবার মনে-মনে ‘মন’ শব্দটি জোড়াতালি দিয়ে কথা বানায়- হয়ত বলি: এই লোকটি বলিষ্ঠ-মনা, কঠিনমনা, দুর্বলমনা, ক্ষীণমনা, একমনা, বিশুদ্ধমনা, ক্রীড়ামনা, খোলামনা, সরলমনা, উচ্চমনা অথবা কুমনা। অথবা মনের চৌহদ্দিটা যেন তখনই হারিয়ে ফেললাম- হঠাৎ মনে নতুন কথা এল অথবা জেগে উঠল:‘মন’ শব্দ দিয়ে আমরা এবার এলোমেলো বাক্য তৈরির খেলা আবিষ্কার করি; ডুডুল করার মতো মিছেমিছে লিখি: মনে কালি পড়েছে, মনের গোলটা মেটানো দরকার, মন রক্ষা করা চাই, মন দেয়া-নেয়া চলছে, মন যোগানো চলছে, মন-কলা খাওয়া হলো, মনমরা হয়ে মনমাতানো দৃশ্য দেখছি; অথবা মনের মতো মানুষ না পেয়ে, মনে বিষ নিয়ে, অসুখ নিয়ে, মনপবনে চড়ে কেবলই মনছল আর মন রক্ষা।

এখন মনের এই বিচিত্র গতিক নিয়ে বিস্তর তত্ত্বচানের পরেও, যাঁরা জীববিজ্ঞানের সামান্য খবর রাখেন, তাঁরা স্বীকার করবেন- মানুষের ¯œায়ুতন্ত্র, অন্তঃক্ষরাতন্ত্র এবং রোগ প্রতিরোধতন্ত্র আসলে মিলেমিশে আমাদের যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিজ্ঞানীরা এখন আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়ের কার্যকারণ, আমাদের ভাষা, যুক্তি, কারিগরি দক্ষতা, অঙ্কজ্ঞান, সৃজনশীলতা, আবেগ, কল্পনা, ঘুম, স্বপ্ন, সংগীত, অর্ন্তদৃষ্টি, স্মৃতি ও বর্ণমালা তৈরির কৌশল বর্ণনা করতে সক্ষম। জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ এখন মলিকুলার বায়োলজি এবং তার শাখা-প্রশাখা; বানের জলের মতো বাড়তে-বাড়তে তা এখন কোয়ান্টাম বায়োলজি ও মলিকুলার মেডিসিন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। লক্ষ্য করবো: আমাদের অন্তর্গত অনিয়ম, ঘাত-প্রতিঘাত তো বটেই- এর সঙ্গে মানুষের বংশগতি, জিনের রকমফের, মস্তিষ্কের কর্মকা-, নিউরোট্রান্সমিটার নামক কতিপয় রাসায়নিক বস্তুর তারতম্য এবং ব্যক্তির সামাজিক হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত- তীব্র মিথস্ক্রিয়ায় মানুষের ভয়-আনন্দ-বেদনা-বিবমিষা নির্ধারণ করছে বলে, বিজ্ঞানীরা অনেকদিন থেকে বলা-কওয়া করছেন। আমাদের ধার-কর্জ করা জ্ঞান ‘স্বাস্থ্য’-এর একটি সংজ্ঞা খুঁজে পেতে আবিষ্কার করে ‘বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা’কে সাক্ষী মেনে- স্বাস্থ্য হলো শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক এবং সামাজিকভাবে ভাল থাকা- ... Health is a state of complete physical, spiritual, mental and social wellbeing and not more the absence of disease or infirmity ...

আমার অনেক অগ্রসর বন্ধু এই মর্মে প্রত্যয়ন করেন যে- ‘মনের অসুখ’ পুঁজিবাদী দুনিয়ার একটি প্রপাগা-া এবং কোনো শ্রমজীবী মানুষেরই মনোরোগ হয় না! ফলে ধনের সুষম বণ্টন হলেই মনোরোগ নিশ্চিহ্ন হয়ে জাদুঘরে আশ্রয় নিবে; কথাটি সর্বৈব সত্য নয়- কারণ সবচেয়ে স্থিত সফল জীবনযাপনের পরেও, শারীরিক রোগের মতো মনোরোগ দ্বারা যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন;- বলা হয়, প্রতি চারজনের একজন জীবদ্দশায় যে কোনো মুহূর্তে এই রোগ দ্বারা আক্রান্ত হন। তবে অপেক্ষাকৃত লঘু উদ্বেগ-বিষণœতায় ‘সামাজিক কার্যকারণ’ অনেকখানি প্রতিষ্ঠা করা গেলেও, গুরুতর মনোরোগ যেমন সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার, স্মৃতিভ্রংশ, তীব্র-বিষণœতা ইত্যাদিকে কেবলমাত্র ‘দারিদ্র্য ও পুঁজিবাদের বিকার’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না। এই বক্তব্যের উদ্দেশ্য- সা¤্রাজ্যবাদ বা আজকের বিশ্বায়নের লাগামছাড়া বিস্তারকে অগ্রাহ্য করা নয়, বরঞ্চ ‘সামাজিক স্বাস্থ্য’ নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিশ্বায়নের গোপন রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম সামগ্রিক কর্মযজ্ঞের যে অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ- তা আরো গুরুত্ব দিয়ে বলার চেষ্টা। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে- তথাকথিত উন্নত রাষ্ট্রগুলোতেও মনোরোগ নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি: কাজে অনুপস্থিতির ৩৫-৪৫% কারণ হলো মনোরোগ, মনোস্বাস্থ্যের বাজেট মোট স্বাস্থ্যখাতের ২% (যা বাংলাদেশে ০.৪৪% মাত্র), ৪১% দেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই, ৩৭% দেশে কমিউনিটি পর্যায়ে মনোস্বাস্থ্য সেবার কোনো সুযোগ নেই, এবং ৭০ ভাগ জনগোষ্ঠীর জন্য লাখে একজন মনোচিকিৎসক। তথ্যে দেখা যায়- জগতের ১৫০ মিলিয়ন মানুষ যে কোনো মুহূর্তে বিষণœতায় আক্রান্ত হন, প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষ আত্মহত্যা করেন প্রতিবছর, ২৫ মিলিয়ন আক্রান্ত হন সিজোফ্রেনিয়ায়, ৩৮ মিলিয়ন ভুগছেন মৃগীরোগে এবং নেশাসক্ত প্রায় ৯০ মিলিয়ন। কিন্তু এদের কাছে রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত চিকিৎসা পৌঁছাতে পারেনি। কাজেই মনোরোগ নিয়ে কথা বলার অর্থ প্রকারান্তরে, সামাজিক অনিয়ম, সামাজিক বাধা এবং আমাদের তৈরিকৃত ‘দারিদ্র্য’ নিয়ে কথা বলা। ‘মনোস্বাস্থ্য’ তাই অন্য অর্থে একটি ‘স্যোশাল ক্যাপিটাল’, যা এখন হাসপাতাল-অর্থনীতির প্রবক্তরা জোর গলায় বলছেন। দেখা যাবে- যদিওবা নারীর ‘প্রজননস্বাস্থ্য’ নিয়ে কেউ-কেউ কথা বলেন, কিন্তু প্রজননচক্রের সূত্র ধরে তৈরি হওয়া ‘নারীর মনোরোগ’ বিষয়ে আমাদের ধারণা এখনও যথেষ্ট অস্পষ্ট।

এই প্রেক্ষিত মাথায় নিয়ে নারীর মনোস্বাস্থ্যের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায়- পূর্বে উল্লিখিত মনোরোগের পাশাপাশি ঋতু¯্রাব, গর্ভকাল ও প্রসূতিকালে নারী যে বাড়তি কিছু মনোরোগের ঝুঁকিতে থাকেন, তা কদাচিৎ আলোচনায় আসে। দেখা যাচ্ছে ঋতু¯্রাবের প্রাক্কালে ২-৮% নারীর তীব্র বিষণœতা হয় এবং ২০-৩০% থাকে উদ্বেগাক্রান্ত: তখন অস্থিরতা হয়, বিরক্তি বাড়ে, মনোযোগ হ্রাস পায়, হৃদকম্পন বাড়ে, ক্ষুধা মন্দা হয়, বিষণœতা হয়, মাথাব্যথা হয়, মনভুলো হয়, একাকীত্ব বাড়ে এবং কান্নার অনুভূতি হয়। অপরদিকে, অকাল গর্ভপাত হলে বা বারবার গর্ভপাতের ঝুঁকি হলে পঞ্চাশ ভাগের অধিক ক্ষেত্রে তীব্র শোক এবং খাপ-খাওয়ানোর সমস্যা তৈরি হয়। তিন-চতুর্থাংশ মা সন্তান প্রসবের পরপর বিষাদময় থাকেন, যাকে বলা হয় ‘বেবি-ব্লু’। ১০-১৫% মা প্রসবের ৬ মাসের মধ্যে বিষণœ হয়ে পড়েন এবং প্রতি হাজারে এক দু’জন মা প্রসবের সপ্তাহ দুয়ের মাঝে ‘পোস্টপার্টাম সাইকোসিস’ নামক গুরুতর মনোরোগে আক্রান্ত হন- যেখানে উপসর্গগুলো সিজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলারের মতো হয় এবং অনেকক্ষেত্রে রোগী আত্মহত্যা অথবা শিশু হত্যায় জড়িয়ে পড়েন। লক্ষ্য করা গেছে- এই হঠাৎ মনোরোগের আর্বিভাবের কারণে অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক সম্পর্কহীনতা হয়েছে, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স হয়েছে, যা এমনকি বৈবাহিক সম্পর্কহীনতার দিকে তাড়িত করেছে। পাশাপাশি ‘বিউটি-মিথ এবং বিউটি ইন্ডাস্ট্রির’ প্ররোচনায়, গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন- খাদ্য গ্রহণ সংক্রান্ত অসুস্থতা, ইটিং ডিজঅর্ডার এবং শারীরিক ইমেজ বিষয়ক বিভ্রম (body dysmorphic disorder) বাড়ছে নারীর ভেতর। আর বাড়ছে সামাজিক-রাষ্ট্রিক সহিংসতার পর তীব্র স্ট্রেস ডিজঅর্ডার- অপহরণ, যুদ্ধ, ধর্ষণ, য্দ্ধু শিশুর জন্ম, গৃহচ্যুতি ইত্যাদি বহুকাল পর্যন্ত, হয়ত সারাজীবনই নারীর মনোজগতে এক আঁধার- ভয় এবং বেদনার্ত-স্মৃতির তা-ব জাগিয়ে রাখে। খুব মোটা দাগে, প্রাতিষ্ঠানিকবিদ্যার ক্ষমতা বলে নারীর মনোস্বাস্থ্য এইভাবে বর্ণনা করা গেলেও, নারীর বেড়ে ওঠা, নারীর সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত, নারীর অবস্থান, নারীর প্রতি অনন্তকালের সহিংসতা-অসম্মান-অবমাননা নারীর মনোজগতে অন্য এক তীব্র প্রতিঘাত তৈরি করে- যা আপাত বর্ণিত কাগুজে রোগ-শোকের বাইরে অচেনা জগত হয়ে আমাদের আড়ালে থেকে যায় এবং তৈরি করে এক ‘ভয়ের সংস্কৃতি’। অন্য কথায়, সকল ক্ষেত্রে পশ্চিমের জ্ঞান কাঠামোর মাপকাঠিতে মনোরোগ নির্ণিত না হলেও নারীর এই বেদনা-দাহ ও ক্ষরণ প্রতিমূহূর্তে তৈরি করে এক অজানা আশংকা।

সম্ভবত আলোচনার এই সূত্রমুখ ধরে নারীর অন্তর্জগতে বেড়ে ওঠা অপরাপর উদ্বেগ, ভয় এবং বিবমিষা নিয়ে দু’এক কথা যুক্ত করার প্রাসঙ্গিকতা তৈরি হয় এক্ষণে। লক্ষ্য করি- রাষ্ট্রের, ঘরের, অর্থনীতিতে বিরাট চালিকাশক্তি হওয়া সত্ত্বেও, নারী অচিরেই আবিষ্কার করে, তার ওপর আরোপ হয়েছে বিশেষ এক নিবর্তন ও রাষ্ট্রীয় সস্ত্রাস। নারী আবিষ্কার করে- বিউটি প্যারেডের ডামাডোলে টেলিভিশন জুড়ে বিবিধ সংঘর্ষ, মানববোমা ও হত্যাযজ্ঞের অপরূপ প্রতিস্থাপন। আবিষ্কৃত হয়- জগতে শান্তি বরাদ্দের জন্য ঈশ্বরের প্রতিরূপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র খড়ি Low Intensity warfare ছড়িয়ে চলেছে। আমরা তখন মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রির জাগরণ উপলক্ষে এমবেডেড জার্নালিজম’-এর সংজ্ঞা শিখি, পেটেন্ট সংস্কৃতির নিগড়ে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করি, বাণিজ্য ত্বরান্বিত করার জন্য সেক্সট্যুরিজম ও হসপিটালিটি গার্লস’-এর বন্দোবস্ত করি, যুদ্ধ আনন্দময় করার জন্য ‘কমফোর্ট-উইলিয়াম’-এর যোগানদার হই উন্নয়নের নামে ডেভেলপমেন্ট রিফিউজির বিস্তার ঘটাই, উইমেন ট্রাফিকিং করি নতুন-বানিজ্যের চিহ্ন হিসেবে, ভার্র্চুয়াল রিয়েলিটির ভেতর হেঁটে বেড়াই এবং বিজ্ঞাপনের ইমেজ পান করতে করতে ওনিওম্যানিক হই অথবা ব্যক্তি-জিহ্বার স্বাদ-গন্ধ, ম্যাগডোনাল্ড, নামক আপাত নিরীহ রসুই ঘরের কাছে বিসর্জন দিয়ে একবার ক্রেতা হই, বিক্রেতা হই, অথবা পুরো আয়োজনই রূপান্তরিত হয় নিরুপায় বিকিকিনির এক কূটকর্মে। মানুষ কেনাবেচার এই রকমফেরকেই হয়তো ভয়েরকাল (age of fear) হিসেবে ভেবেছিলেন আলেবেয়ার ক্যামু, আর উদ্বেগের কাল (age of anxiety) হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন অডেন; যখন রবীন্দ্রনাথ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এইভাবে, ‘... একসময় জিনিসই ছিল বৈশ্যের সম্পত্তি; এখন মানুষ তার সম্পত্তি হইয়াছে।’

বলতে কী, আমার মত ভুঁইফোঁড়ের মনোবিদ্যা চর্চার নমুনা এইভাবে আরো খানিকটা নিশ্চয় বিস্তার ঘটানো যায়: আমাদের প্রাচীনতম শাস্ত্র আর্য়ুবেদে যে মনোরোগকে ‘ভুতবিদ্যা’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে; বা, প্লেটোর কাছে উন্মাদনা ছিল প্রোফেটিক, টেলিস্টিক , পোয়েটিক ও ইরোটিক- এ সম্পর্কে দু’এক কথা বাড়তি বলার ঝোঁক তৈরি হয় তখনি। কিন্তু ভয় হয়- এই বাক্য-শব্দ-সংবাদ অপ্রাসঙ্গিক নয় তো? ভারতবর্ষের পটভূমিতে মনোচিকিৎসা, অথবা উন্মাদনা বিষয়ক জ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে প্রবন্ধের নতুন শিরোনাম নির্বাচন করি, অথবা তখন মনে হয়- ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় তৈরি হওয়া অ্যাসাইলামটি ছিল সেন্ট্রাল জেলের কাছে মুরলী বাজারের কাছে, যেখানে ১৮২৭-৩৭ পর্যন্ত সময়ে ৬৫২ জন কৃষিশ্রমিক ভর্তি ছিলেন। কিন্তু এইসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে শিরোনামের অন্যতম প্রধান চাবি শব্দ ‘নারীর মনোজগত’ চেনার জন্য আমি এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যার অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলি- ওঁরা মানবীবিদ্যার উদ্ভব ব্যাখ্যা করতে করতে নারীর বিকাশের সঙ্গে শ্রম, অর্থনীতি, উন্নয়ন, পরিবেশ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, আইন, ক্ষমতায়ন, গণমাধ্যম ও স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রবন্ধের জেরোক্স কপি আমার হাতে গুঁজে দেন: সুবিখ্যাত মেরি উলস্টোন ক্রাফট, মারী স্টোপস, বোভয়া, এঙ্গেলস, বেটি, ভার্জিনিয়া উলফ, গ্রিয়র হয়ে পায়রাবন্দের রোকেয়া ছুঁয়ে অনুভব করি ‘জেনেসিস’-এর সেই বিশিষ্ট শব্দ-বাক্য কানের ভেতর যেন এক ঘেঁয়ে সুরে কথা বলছে - ‘... women is her name because she was taken out of man.’। নারীর শ্রমশীলতাকে নিছক ছায়াকর্ম (shadow work) বিবেচনা করে আমি মনুস্মৃতি, অথর্ববেদ এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ থেকে নারী-শাসনের উপাদান সংগ্রহ করি: ‘স্ত্রীলোককে কুমারী অবস্থায় পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্র রক্ষা করবে, স্ত্রীলোক কখনও স্বাতন্ত্র লাভের যোগ্য নয়। ... হে নারী তুমি পুত্র সন্তান উৎপন্ন কর, ... উৎপন্ন পুত্রের পরেও পুত্র উৎপন্ন কর। ... স্ত্রী যদি স্বামীর কামনা পূরণ করতে অস্বীকার করে তাহলে তাকে কিনে নিতে হবে। ... এতেও যদি সে না রাজি হয় তাহলে লাঠি দিয়ে বা হাত দিয়ে মেরে বশে আনবে।’ কলকাতার নিষিদ্ধপল্লির আঁধার-ঘরে ১৮৬৩ সনে জন্ম নেয়া বিনোদিনী দাসী তাঁর বেদনার কথা বলেন- “পৃথিবীতে আমার কিছুই নাই, শুধুই অনন্ত নিরাশা, শুধুই দুঃখময় প্রাণের কাতরণ। কিন্তু তাহা শুনিবারও লোক নাই! মনের ব্যথা জানাইবার লোক জগতে নাই- কেননা আমি জগত মাঝে কলঙ্কিনী, পতিতা। আমার আত্মীয় নাই, সমাজ নাই, বন্ধু নাই, বান্ধব নাই, এই পৃথিবীতে আমার বলিতে এমন কেহই নাই।” ‘অবরোধ-বাসিনী’ নারীর হয়ে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর শৈশবের কথা আমাদেরকে বলেন- ...সবে মাত্র পাঁচ বৎসর বয়স হইতে আমাকে স্ত্রীলোকদের হইতেও পর্দ্দা করিতে হইত। ... পাড়ার স্ত্রীলোকেরা হঠাৎ বেড়াইতে আসিত; অমনি বাড়ির কোন লোকচক্ষুর ইশারা করিত, আমি যেন প্রাণ-ভয়ে যত্র-তত্র- কখনও রান্নাঘরের ঝাঁপির অন্তরাল, কখনও কোন চাকরাণীর গোল করিয়া জড়াইয়া রাখা পাটির অভ্যন্তরে, কখনও তক্তপোষের নিচে লুকাইতাম।’ ভাবি- সব মানুষ নিশ্চয় লুকোতে পারে না; সাতচল্লিশে দেশান্তরী হতে বাধ্য এক নারীর অন্তর্বয়ান শোনান নৃ-বিজ্ঞানী বীনা দাস, : ‘ধরা যাক ওঁর নাম আশা। স্বামী টাইফয়েডে মারা যান, যখন তাঁর বয়স কুড়ি।... সবখানেই আমি সংসারের কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করতাম।... কিন্তু সকলেই আমাকে ঠেস দিয়ে কথা বলত,... ওঁরা বলত, আমি যথেষ্ট সুন্দর নই বলে নাকি আমার স্বামীর বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই চলে গিয়েছিল।... ব্যাপারটা একেবারে অসহ্য হয়ে উঠল যখন বড় নন্দাই আমার দিকে নজর দিতে শুরু করলেন। দ্বিতীয় বিয়েটাতো করতে হলো এই পোড়া শরীরটার জন্য।... শুধু আমার নিজের তাড়নাই নয়, পুরুষেরা যখন আমার দিকে তাকাত, আমার তো তখন কিছু করার থাকত না। ওরা তো আমায় দেখত না, আমার এই শরীরটাকে দেখত, নন্দাই যদি আমার দিকে নজর না দিতেন, আমি হয়ত শুদ্ধ হয়েই থাকতে পারতাম, বিধবার যেমন থাকা উচিত। নারীর মনোজগৎ বোঝার এই আপাত-নিরীহ খেলায় বন্ধুরা আরো নতুন সব তত্ত্ব পাঠায়। আমি উল্টে উল্টে পড়ি: জ্যোতিমর্য়ী দেবীর লেখায় আমার চোখ স্থির হয়, শ্লেষ ঝরে পড়েছে- ‘মানুষ পৃথিবীতে একটা জাত। তাতে আবার দু’ভাগ- স্ত্রী ও পুরুষ। কিন্তু তাতে মানুষের সমস্যা মেটেনি, সে স্ত্রীজাতির মধ্যেও দাগ কেটে দু’ভাগ করেছে, একজন হলো পুরুষের ঘর-সংসারের গৃহিনী বা সন্তানের জননী-সেবিকা, তার নামই হলো সতী। আর অন্য হলো তার প্রমোদ-বিলাসের সঙ্গিনী, বহুবল্লভা, গৃহধর্মহীনা এক নিঃসঙ্গ নারী- তাকে অসতী বলা চলে।” বহু বছর পর জ্যোতির্ময়ী দেবী কথিত, ঢাকা শহরের এক ভাসমান গৃহধর্মহীনা নিঃসঙ্গ নারী নিজেকে উন্মোচিত করেছেন- : আমাদের আর কিছু বলার আছে? আমাদের একেবারে মেরে ফেলেন। পেটের ক্ষুধায়, অভাবের জ্বালায় খারাপ হয়েছি, যখন কোনো আর রাস্তা দেখে না, যখন আর কোনো উপায় থাকে না; তখনই তো মানুষ খারাপ হয়। আমার ৩৫-৩৬ বছর বয়স হলো। এটাই দেখে আসছি। আর আমার নিজের কথা শুনতে চান? সাতদিন-সাতরাত বললেও সেই ইতিহাস শেষ হবে না।

ইতিহাস বর্ণনার এই দায়, বেদনা ও দ্রোহ থেকে আমরা নিজেরাও এবার খানিকটা পলাতক হওয়ার আয়োজন খুঁজি। নারীর অর্ন্তজগত বোঝার জন্য যে গুটিকতক বয়ানের আশ্রয় নিয়েছি, অনুভব হয়- এখানেও বড় একটি খুঁত থেকে গেলো: বই লিখে কিম্বা ওরালহিস্ট্রির প্রোজেক্টে অংশগ্রহণকারী নারীর বাইরেও অজস্র নারী রয়ে গেলেন, যারা চিরকালের অচ্ছুত, নিখোঁজ, গৃহহীনা, মূক, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রান্তিক। এদিকে যুদ্ধ, ক্ষমতা, দারিদ্র্য ইত্যাদি মিলিয়ে তৈরি হওয়া আমাদের সময়ের sexualpolitics নিয়ে প্রায় কিছুই বলা হয়নি। বলা হয় না জেনেটিক প্রাইভেসি এবং কন্যা-শিশুর ভ্রুণহত্যা বিষয়ে। বলা হয় না ‘মানব বোমা’ হিসেবে নারীর তীব্র আত্মপ্রকাশ বিষয়ে। বলা হয় না যুদ্ধে ‘কমফোট গার্ল’ হিসেবে নারীর বাধ্যতামূলক উপস্থিতি প্রসঙ্গে। কিম্বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর গৃহচ্যুত নারীর ঘর-সংসার নিয়েও কিছুমাত্র উচ্চবাচ্য করা হয় না। বলা হয় না নারীর গোপন নেশাসক্তির অভ্যাস, যৌন নৈতিকতা ও পর্নোগ্রাফি নিয়ে। বলা হয় না নারী লেখনী নিয়ে। বলা হয় না নারীবাদ, আধুনিকতা ও প্রগতিবাদের তর্ক-ঝগড়া নিয়ে।

বক্তিমার আঁচ কমে গেলে এবার অনুভব হয়- শেষ পর্যন্ত অনেক বাগাড়ম্বরের পরেও প্রায় কিছুই বলা হয়নি যেন, আদতে হয়ত আমি কিছু জানি না। অস্পষ্ট ধারণা নিয়ে আমি এবার সারমর্ম করি- ‘নারীর মূল্য’ তৈরির জন্য, নারীর ‘নিজের একটি কামরা’ বন্দোবস্তের জন্য নারীর ক্ষমতায়নের লড়াইয়ে আমার মত ভয়-কাতুরে মানুষেরও, একেবারে শেষ পংক্তিতে হলেও অবশ্যই নাম অন্তর্ভুক্তি চাই। বালখিল্য ভয় তাড়ানোর জন্য এবেলা তেভাগার বেলাদত্তের সাক্ষাৎকার দেখি, একাত্তরের বীরাঙ্গনা বীর মাতার জবানি পাঠ করি, নকশাল আন্দোলনের অরুণা চৌধুরী, ইভা ও আরজা বেগম পাঠ করি। পাঠ করি অরণ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত লড়াকু আরণ্যক-কন্যার জয়গান; পাঠ করি টংক আন্দোলনে হাজং-নারীর অবিস্মরণীয় অংশগ্রহণ, পাঠ করি পোশাক শিল্পের অগুনতি কন্যার নিঃশব্দ-অভিজ্ঞতা, পাঠ করি কল্পনা চাকমা, পাঠ করি ফুলবাড়ি কয়লা খনির নারী-মহাচরিত, পাঠ করি চিংড়ি ঘেরের দুঃসাহসিক নারী-উপাখ্যান; আর পাঠ করি সুবিখ্যাত অগাস্ট বেবেল: ‘আমরা বাস করছি ক্রমাগ্রসরমান এক বিশাল সামাজিক রূপান্তরের যুগে।... বহু প্রশ্ন জাগছে আর তা নিয়ে সাগ্রহে আলোচনা হচ্ছে, পরিসর যার ক্রমেই বাড়ছে। এর মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর একটি হলো নারী প্রশ্ন, বারবার যা সামনে আসছে।... আমাদের দৃষ্টিতে এ প্রশ্নটি অন্য আরেকটি প্রশ্নের সাথে মিলে যায়: সমাজটা কীভাবে সংগঠিত হওয়া উচিত যাতে নির্যাতন, শোষণ, দুর্দশা ও অভাব দূর হয়, এবং সামগ্রিকভাবে ব্যক্তির ও সমাজের পারিবারিক মানসিক কল্যাণ সাধিত হয়? তাহলে আমাদের কাছে, নারী প্রশ্ন সকল চিন্তাশীল মস্তিষ্ক জুড়ে যে সাধারণ সামাজিক প্রশ্নটি রয়েছে তার একটি মাত্র পর্যায়: এর চূড়ান্ত সমাধান কেবল সকল সামাজিক চরমাবস্থা এবং তার ফলে সৃষ্ট সকল মন্দকে দূর করার মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব।’

আমি আমার মন্দ-আত্মাকে বশীভূত করার জন্য আমার অশিক্ষা ও কূপম-ূকতা এড়ানোর জন্য, পাপ স্বীকারের জন্য জন লেনন আওড়াই: নারী হলো এই পৃথিবীর নিগ্রো, হ্যাঁ সে তাই... ভেবে দেখো। নারী হলো এই পৃথিবীর নিগ্রো, ভেবে দেখো, পারলে এ নিয়ে কিছু করো তুমি। আমরা তাকে মুখে রঙ লাগাতে বাধ্য করি আর নাচতে। যদি সে না দাসী হয়, বলি ভালোবাসে না সে। যদি সে নিজ মূর্তি ধারণ করে, বলি পুরুষ হতে চলেছে। যখন নামাচ্ছি তাকে নিচে ভাব দেখাচ্ছি মাথায় করে রাখছি।... আমরা বলি গৃহই একমাত্র স্থান সেখানেই তার থাকা উচিত।... আমরা তাকে প্রতিদিনে টিভিতে অপমান করি, আর বিস্মিত হই তার সাহস আর নিজের প্রতি আস্থা নেই দেখে। যখন সে যুবতী আমরাই তাকে মুক্তি দিতে হত্যা করি। যখন বলছি বেশি স্মার্ট হওয়া ভাল না, করছি ঘৃণা, যাতে সে ভীষণ হাবাগোবা হয়।... নারী হলো এই পৃথিবীর নিগ্রো।

...আশার কথা, এতসব অপমান-অবমাননার পরেও নারী, শেষ পর্যন্ত নিজের মতো করে বাঁচে। দ্রোহে-ক্ষোভে-সব কিছুর বাইরে এসে দাঁড়ায়, প্রশ্নবিদ্ধ করে। যেমনটি হয় মহাত্মা হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখিতে: দেশভাগের গোপন রহস্য সেই বয়োবৃদ্ধা বুঝতে চায় না। সবাই দেশান্তরী হলেও তিনি অনড়- ‘আমি কি ঠিক করলাম? আমি কি ঠিক বোঝলাম? সোয়ামির কথা শোনলাম না, ছেলের কথা শোনলাম না, মেয়ের কথা শোনলাম না?... অনেক ভাবলাম। শ্যাষে একটি কথা মনে হলো, আমি আমাকে পাবার লেগেই এত কিছু ছেড়েছি,... আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলাদা একটা দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুধু মোসলমানরা থাকবে কিন্তু হিদু কেরেস্তানও থাকতে পারবে,... আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করব? আমি আর সোয়ামী তো একটি মানুষ লয় আলাদা মানুষ, খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ কিন্তুক আলাদা মানুষ। সকাল হোক, আলো ফুটুক, তখন পূর্বদিকে মুখ করে বসব। সুরুজের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াবো আমি। আমি একা। তা হোক, সবাইকে টানতে পারব আমি।’

... নারীর রক্তপাত, নারীর দ্রোহ, অনুভব করি, এই ভাবে আবার আমাদের জীবনের মৌল স্রোতে অবগাহন করার নেমন্তন্ন পাঠায় অনন্তকাল। আমরা জাড্য এড়িয়ে পথ হাঁটি এবং অচিরেই আবিষ্কৃত হয়- বিবিধ তত্ত্ব, গবেষণা, রাজনীতি, স্বাস্থ্যবার্তা শেষ পর্যন্ত পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত; মেডিকেল-নৃবিজ্ঞানী আর্থার ক্লেইনম্যানকে স্মরণ করে লিখি: what difference does it make for theory, for research, for policy, for societal ethics to change the border between a social and a health problem. Now pulling the edge toward the social side, later on pushing it toward medical margin– does that disclose a comparative advantage for ‘medicalization’ of human misery under certain conditions or for ‘socialization’ under others? The moral, the political, and the medical are culturally interrelated, but how do we best interpret that relationship and its implication? মোটা দাগে- এই মনস্বী সভায় উপস্থিত হওয়ার অনুমতি প্রাপ্তি এবং বক্তৃতায় উচ্চাভিলাষী শিরোনাম নির্বাচন শেষ পর্যন্ত আমাদের বিবিধ জ্ঞান কাঠামোয় অন্তর্গত যোগাযোগ ও আন্তঃপারস্পরিক সম্পর্ক বয়ান করার যৎকিঞ্চিত আয়োজন বৈ কিছু নয়; যখন চাবি শব্দগুলো ছিল আমাদের নড়বড়ে-টলমল পথ হাঁটার অবলম্বন, প্রত্মবীজ এবং সম্পর্ক বর্ণনার নিছক চিহ্ন বিশেষ।

image

শিল্পী : কামরুল হাসান

আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
সংবাদ এবং আমার শৈশব
আমার বাতিঘর
শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা
নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
চলছে লড়াই, চলবে লড়াই
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
আমার ‘সংবাদ’
দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান
বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন
দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন
নতুন সময়ের গণমাধ্যম
‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’
মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী

মামুন হুসাইন

image

শিল্পী : কামরুল হাসান

এই উচ্চাকাক্সক্ষী শিরোনাম দেখে আমি নিজেও এখন যথেষ্ট ধন্দে। আমাদের চিরসখা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমার এই অশিক্ষিত-পটুতা দেখে নিশ্চিত ধমকে দিতেন- ‘ভাসাভাসা ধারণা নিয়ে একটি প্রবন্ধ ফেঁদে বসা বেয়াদবির শামিল, ...।’ অতএব শুরুতেই অশিষ্টাচারের শাস্তি লঘু করার জন্য বর্তমান লেখার কতিপয় খুঁত স্বীকার করে নেয়া যাক মহান আদালত বরাবর: প্রথমত, এই শিরোনাম জ্ঞান কাঠামোর এত অযুত বিষয়কে ছুঁয়ে যায় যে, সভার নির্দিষ্ট ঘড়ি-ঘণ্টার নিগড়ে তা সঠিকভাবে উপস্থাপন করা এক অসম্ভব ঘটনা বটে। দ্বিতীয়ত, বক্তব্যের প্রধানতম চাবি শব্দ, যেমন- নারী, মন, জগৎ ও বিভ্রম- এই শব্দগুলোর পেছনে আমাদের যে অনন্তকালের অভিজ্ঞতা, তর্ক, লড়াই, সে বিষয়েও যথেষ্ট সুবিচার করা হয়নি। তৃতীয়ত, ‘নারীর মনোজগৎ’- এই শব্দটি একসময় আড়াল করে নারীর মনোস্বাস্থ্যকে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি, সুখ্যাত ‘এ্যান্টি সাইকিয়াট্রি’ নামক একদা তৈরি হওয়া আন্দোলনের বাইরে দাঁড়িয়ে হালফিলের মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত তথ্য-তত্ত্বের নিরিখে। শেষত বিবিধ অমুখ্য উৎস থেকে ভাবনা-চিন্তা সুপ্রচুর নকল করার পরেও অচিরেই প্রমাণ হবে যে, এ বিষয়ে আদতে আমি কিছু জানি না।

এই বাস্তবতায় আমার অজ্ঞতা- শুরুতে মন, মনের ধারণা ও মনোদর্শন নিয়ে কিঞ্চিৎ বাচাল হওয়ার প্রণোদনা খুঁজে পায়। কেউ বলেন- মন নিশ্চয় কোনো ভৌত বস্তু নয়; মন স্থান জুড়ে থাকে না, স্থান জুড়ে থাকে দেহ। অথবা দেহ ও মনের ভেতর তৈরি হওয়া ইতিহাসের আলাদা ¯্রােতরেখা শেষ পর্যন্ত উপস্থাপন করে বিবিধ প্রাকৃতিক ও মনোজাগতিক ঘটনাবলী...। কেউ ভাবেন এই স্বীকৃত মতবাদকে নিশ্চয়ই প্রশ্ন করা যায় এক্ষণি। মনোদর্শনের আকর গ্রন্থ উল্টে আমরা এবার আমাদের আচরণের যুক্তি ও কারণ খুঁজি, দ্বৈতবাদ নিয়ে তর্ক করি; কথা বলি ইচ্ছা, অনুভূতি, বেদনা ও চিন্তার স্বরূপ

নিয়ে অথবা আলোচনা স্থির হয় জড়বাদে; আমাদের ধারণা, চিন্তা ও মানসিক সংযুক্তি শেষ পর্যন্ত আমাদের জড় আচরণের (material behavour) প্রত্যক্ষ নিঃসরণ (efflux) বৈ কিছু নয়। পিথাগোরীয়ানরা সেই যে ভাবতেন- আত্মা মৃত্যুর পর অপর দেহে প্রবিষ্ট হয় (transmigration)- কথাটি মনে করে এক ফাঁকে আত্মা ও মন নিয়ে নতুন আলোচনার শিরোনাম খুঁজি। দর্শনের মেধাবী বন্ধুরা, আমার বুদ্ধিহীনতা দূর করার জন্য ধীশক্তি, অভিপ্রায়, আবেগ, আত্মজ্ঞান, সংবেদন, কল্পনা ও প্রপঞ্চবাদ বিষয়ে সহজ পরিভাষা তৈরি করলেও আমি অতিদ্রুত ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চারে রূপান্তরিত হই।

আমার ইচ্ছাবৃত্তি এবার ‘মন পবনের দাঁড়’ হয়ে একবার সর্বজনীন স্কুলের চিরায়ত প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রনাথের পুণ্যাত্মা স্পর্শ করে, আরেকবার গড়িয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের পাদপদ্মে পৌঁছায়। রবীন্দ্রনাথের মতো মহাত্মাও দেখি, মনের তল খুঁজতে যেয়ে আতান্তরে পড়েছিলেন ভারি- ‘...মানুষের মনের যদি নির্দিষ্ট ঋতুভেদ থাকত তাহলে অনেক সুবিধে হতো। ... কিন্তু মনের ঋতু আবার ছ’টা নয়, একেবারে বাহান্নটি- এক প্যাকেট তাসের মতো- কখন কোনটা হাতে আসে তার কিছু ঠিক নেই- অন্তরে বসে-বসে কোন্ খামখেয়ালি খেলোয়াড় যে এই তাস ডিল করে এই খামখেয়ালি খেলা খেলে তার পরিচয় জানিনে।’ ওদিকে ত্রিসন্ধ্যা জপ-তপ করতে করতে শ্রীরামকৃষ্ণ টিপস দিচ্ছেন- ‘আগে মনটা শুদ্ধ করার চেষ্টা কর। ... জ্ঞানই বল আর অজ্ঞানতাই বল সবই মনের অবস্থা... মনই সব। মানুষ মনেই জন্ম, মনেই মৃত, মনেই সাধু, মনেই অসাধু, মনেই পাপী, মনেই পুণ্যবান।’

আমাদের অসাধু মন-অশুদ্ধ মন মনের গঠন-মনের দর্শন ভুলো হয়ে এবার মনে-মনে ‘মন’ শব্দটি জোড়াতালি দিয়ে কথা বানায়- হয়ত বলি: এই লোকটি বলিষ্ঠ-মনা, কঠিনমনা, দুর্বলমনা, ক্ষীণমনা, একমনা, বিশুদ্ধমনা, ক্রীড়ামনা, খোলামনা, সরলমনা, উচ্চমনা অথবা কুমনা। অথবা মনের চৌহদ্দিটা যেন তখনই হারিয়ে ফেললাম- হঠাৎ মনে নতুন কথা এল অথবা জেগে উঠল:‘মন’ শব্দ দিয়ে আমরা এবার এলোমেলো বাক্য তৈরির খেলা আবিষ্কার করি; ডুডুল করার মতো মিছেমিছে লিখি: মনে কালি পড়েছে, মনের গোলটা মেটানো দরকার, মন রক্ষা করা চাই, মন দেয়া-নেয়া চলছে, মন যোগানো চলছে, মন-কলা খাওয়া হলো, মনমরা হয়ে মনমাতানো দৃশ্য দেখছি; অথবা মনের মতো মানুষ না পেয়ে, মনে বিষ নিয়ে, অসুখ নিয়ে, মনপবনে চড়ে কেবলই মনছল আর মন রক্ষা।

এখন মনের এই বিচিত্র গতিক নিয়ে বিস্তর তত্ত্বচানের পরেও, যাঁরা জীববিজ্ঞানের সামান্য খবর রাখেন, তাঁরা স্বীকার করবেন- মানুষের ¯œায়ুতন্ত্র, অন্তঃক্ষরাতন্ত্র এবং রোগ প্রতিরোধতন্ত্র আসলে মিলেমিশে আমাদের যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিজ্ঞানীরা এখন আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়ের কার্যকারণ, আমাদের ভাষা, যুক্তি, কারিগরি দক্ষতা, অঙ্কজ্ঞান, সৃজনশীলতা, আবেগ, কল্পনা, ঘুম, স্বপ্ন, সংগীত, অর্ন্তদৃষ্টি, স্মৃতি ও বর্ণমালা তৈরির কৌশল বর্ণনা করতে সক্ষম। জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ এখন মলিকুলার বায়োলজি এবং তার শাখা-প্রশাখা; বানের জলের মতো বাড়তে-বাড়তে তা এখন কোয়ান্টাম বায়োলজি ও মলিকুলার মেডিসিন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। লক্ষ্য করবো: আমাদের অন্তর্গত অনিয়ম, ঘাত-প্রতিঘাত তো বটেই- এর সঙ্গে মানুষের বংশগতি, জিনের রকমফের, মস্তিষ্কের কর্মকা-, নিউরোট্রান্সমিটার নামক কতিপয় রাসায়নিক বস্তুর তারতম্য এবং ব্যক্তির সামাজিক হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত- তীব্র মিথস্ক্রিয়ায় মানুষের ভয়-আনন্দ-বেদনা-বিবমিষা নির্ধারণ করছে বলে, বিজ্ঞানীরা অনেকদিন থেকে বলা-কওয়া করছেন। আমাদের ধার-কর্জ করা জ্ঞান ‘স্বাস্থ্য’-এর একটি সংজ্ঞা খুঁজে পেতে আবিষ্কার করে ‘বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা’কে সাক্ষী মেনে- স্বাস্থ্য হলো শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক এবং সামাজিকভাবে ভাল থাকা- ... Health is a state of complete physical, spiritual, mental and social wellbeing and not more the absence of disease or infirmity ...

আমার অনেক অগ্রসর বন্ধু এই মর্মে প্রত্যয়ন করেন যে- ‘মনের অসুখ’ পুঁজিবাদী দুনিয়ার একটি প্রপাগা-া এবং কোনো শ্রমজীবী মানুষেরই মনোরোগ হয় না! ফলে ধনের সুষম বণ্টন হলেই মনোরোগ নিশ্চিহ্ন হয়ে জাদুঘরে আশ্রয় নিবে; কথাটি সর্বৈব সত্য নয়- কারণ সবচেয়ে স্থিত সফল জীবনযাপনের পরেও, শারীরিক রোগের মতো মনোরোগ দ্বারা যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন;- বলা হয়, প্রতি চারজনের একজন জীবদ্দশায় যে কোনো মুহূর্তে এই রোগ দ্বারা আক্রান্ত হন। তবে অপেক্ষাকৃত লঘু উদ্বেগ-বিষণœতায় ‘সামাজিক কার্যকারণ’ অনেকখানি প্রতিষ্ঠা করা গেলেও, গুরুতর মনোরোগ যেমন সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার, স্মৃতিভ্রংশ, তীব্র-বিষণœতা ইত্যাদিকে কেবলমাত্র ‘দারিদ্র্য ও পুঁজিবাদের বিকার’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না। এই বক্তব্যের উদ্দেশ্য- সা¤্রাজ্যবাদ বা আজকের বিশ্বায়নের লাগামছাড়া বিস্তারকে অগ্রাহ্য করা নয়, বরঞ্চ ‘সামাজিক স্বাস্থ্য’ নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিশ্বায়নের গোপন রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম সামগ্রিক কর্মযজ্ঞের যে অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ- তা আরো গুরুত্ব দিয়ে বলার চেষ্টা। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে- তথাকথিত উন্নত রাষ্ট্রগুলোতেও মনোরোগ নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি: কাজে অনুপস্থিতির ৩৫-৪৫% কারণ হলো মনোরোগ, মনোস্বাস্থ্যের বাজেট মোট স্বাস্থ্যখাতের ২% (যা বাংলাদেশে ০.৪৪% মাত্র), ৪১% দেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই, ৩৭% দেশে কমিউনিটি পর্যায়ে মনোস্বাস্থ্য সেবার কোনো সুযোগ নেই, এবং ৭০ ভাগ জনগোষ্ঠীর জন্য লাখে একজন মনোচিকিৎসক। তথ্যে দেখা যায়- জগতের ১৫০ মিলিয়ন মানুষ যে কোনো মুহূর্তে বিষণœতায় আক্রান্ত হন, প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষ আত্মহত্যা করেন প্রতিবছর, ২৫ মিলিয়ন আক্রান্ত হন সিজোফ্রেনিয়ায়, ৩৮ মিলিয়ন ভুগছেন মৃগীরোগে এবং নেশাসক্ত প্রায় ৯০ মিলিয়ন। কিন্তু এদের কাছে রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত চিকিৎসা পৌঁছাতে পারেনি। কাজেই মনোরোগ নিয়ে কথা বলার অর্থ প্রকারান্তরে, সামাজিক অনিয়ম, সামাজিক বাধা এবং আমাদের তৈরিকৃত ‘দারিদ্র্য’ নিয়ে কথা বলা। ‘মনোস্বাস্থ্য’ তাই অন্য অর্থে একটি ‘স্যোশাল ক্যাপিটাল’, যা এখন হাসপাতাল-অর্থনীতির প্রবক্তরা জোর গলায় বলছেন। দেখা যাবে- যদিওবা নারীর ‘প্রজননস্বাস্থ্য’ নিয়ে কেউ-কেউ কথা বলেন, কিন্তু প্রজননচক্রের সূত্র ধরে তৈরি হওয়া ‘নারীর মনোরোগ’ বিষয়ে আমাদের ধারণা এখনও যথেষ্ট অস্পষ্ট।

এই প্রেক্ষিত মাথায় নিয়ে নারীর মনোস্বাস্থ্যের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায়- পূর্বে উল্লিখিত মনোরোগের পাশাপাশি ঋতু¯্রাব, গর্ভকাল ও প্রসূতিকালে নারী যে বাড়তি কিছু মনোরোগের ঝুঁকিতে থাকেন, তা কদাচিৎ আলোচনায় আসে। দেখা যাচ্ছে ঋতু¯্রাবের প্রাক্কালে ২-৮% নারীর তীব্র বিষণœতা হয় এবং ২০-৩০% থাকে উদ্বেগাক্রান্ত: তখন অস্থিরতা হয়, বিরক্তি বাড়ে, মনোযোগ হ্রাস পায়, হৃদকম্পন বাড়ে, ক্ষুধা মন্দা হয়, বিষণœতা হয়, মাথাব্যথা হয়, মনভুলো হয়, একাকীত্ব বাড়ে এবং কান্নার অনুভূতি হয়। অপরদিকে, অকাল গর্ভপাত হলে বা বারবার গর্ভপাতের ঝুঁকি হলে পঞ্চাশ ভাগের অধিক ক্ষেত্রে তীব্র শোক এবং খাপ-খাওয়ানোর সমস্যা তৈরি হয়। তিন-চতুর্থাংশ মা সন্তান প্রসবের পরপর বিষাদময় থাকেন, যাকে বলা হয় ‘বেবি-ব্লু’। ১০-১৫% মা প্রসবের ৬ মাসের মধ্যে বিষণœ হয়ে পড়েন এবং প্রতি হাজারে এক দু’জন মা প্রসবের সপ্তাহ দুয়ের মাঝে ‘পোস্টপার্টাম সাইকোসিস’ নামক গুরুতর মনোরোগে আক্রান্ত হন- যেখানে উপসর্গগুলো সিজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলারের মতো হয় এবং অনেকক্ষেত্রে রোগী আত্মহত্যা অথবা শিশু হত্যায় জড়িয়ে পড়েন। লক্ষ্য করা গেছে- এই হঠাৎ মনোরোগের আর্বিভাবের কারণে অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক সম্পর্কহীনতা হয়েছে, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স হয়েছে, যা এমনকি বৈবাহিক সম্পর্কহীনতার দিকে তাড়িত করেছে। পাশাপাশি ‘বিউটি-মিথ এবং বিউটি ইন্ডাস্ট্রির’ প্ররোচনায়, গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন- খাদ্য গ্রহণ সংক্রান্ত অসুস্থতা, ইটিং ডিজঅর্ডার এবং শারীরিক ইমেজ বিষয়ক বিভ্রম (body dysmorphic disorder) বাড়ছে নারীর ভেতর। আর বাড়ছে সামাজিক-রাষ্ট্রিক সহিংসতার পর তীব্র স্ট্রেস ডিজঅর্ডার- অপহরণ, যুদ্ধ, ধর্ষণ, য্দ্ধু শিশুর জন্ম, গৃহচ্যুতি ইত্যাদি বহুকাল পর্যন্ত, হয়ত সারাজীবনই নারীর মনোজগতে এক আঁধার- ভয় এবং বেদনার্ত-স্মৃতির তা-ব জাগিয়ে রাখে। খুব মোটা দাগে, প্রাতিষ্ঠানিকবিদ্যার ক্ষমতা বলে নারীর মনোস্বাস্থ্য এইভাবে বর্ণনা করা গেলেও, নারীর বেড়ে ওঠা, নারীর সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত, নারীর অবস্থান, নারীর প্রতি অনন্তকালের সহিংসতা-অসম্মান-অবমাননা নারীর মনোজগতে অন্য এক তীব্র প্রতিঘাত তৈরি করে- যা আপাত বর্ণিত কাগুজে রোগ-শোকের বাইরে অচেনা জগত হয়ে আমাদের আড়ালে থেকে যায় এবং তৈরি করে এক ‘ভয়ের সংস্কৃতি’। অন্য কথায়, সকল ক্ষেত্রে পশ্চিমের জ্ঞান কাঠামোর মাপকাঠিতে মনোরোগ নির্ণিত না হলেও নারীর এই বেদনা-দাহ ও ক্ষরণ প্রতিমূহূর্তে তৈরি করে এক অজানা আশংকা।

সম্ভবত আলোচনার এই সূত্রমুখ ধরে নারীর অন্তর্জগতে বেড়ে ওঠা অপরাপর উদ্বেগ, ভয় এবং বিবমিষা নিয়ে দু’এক কথা যুক্ত করার প্রাসঙ্গিকতা তৈরি হয় এক্ষণে। লক্ষ্য করি- রাষ্ট্রের, ঘরের, অর্থনীতিতে বিরাট চালিকাশক্তি হওয়া সত্ত্বেও, নারী অচিরেই আবিষ্কার করে, তার ওপর আরোপ হয়েছে বিশেষ এক নিবর্তন ও রাষ্ট্রীয় সস্ত্রাস। নারী আবিষ্কার করে- বিউটি প্যারেডের ডামাডোলে টেলিভিশন জুড়ে বিবিধ সংঘর্ষ, মানববোমা ও হত্যাযজ্ঞের অপরূপ প্রতিস্থাপন। আবিষ্কৃত হয়- জগতে শান্তি বরাদ্দের জন্য ঈশ্বরের প্রতিরূপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র খড়ি Low Intensity warfare ছড়িয়ে চলেছে। আমরা তখন মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রির জাগরণ উপলক্ষে এমবেডেড জার্নালিজম’-এর সংজ্ঞা শিখি, পেটেন্ট সংস্কৃতির নিগড়ে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করি, বাণিজ্য ত্বরান্বিত করার জন্য সেক্সট্যুরিজম ও হসপিটালিটি গার্লস’-এর বন্দোবস্ত করি, যুদ্ধ আনন্দময় করার জন্য ‘কমফোর্ট-উইলিয়াম’-এর যোগানদার হই উন্নয়নের নামে ডেভেলপমেন্ট রিফিউজির বিস্তার ঘটাই, উইমেন ট্রাফিকিং করি নতুন-বানিজ্যের চিহ্ন হিসেবে, ভার্র্চুয়াল রিয়েলিটির ভেতর হেঁটে বেড়াই এবং বিজ্ঞাপনের ইমেজ পান করতে করতে ওনিওম্যানিক হই অথবা ব্যক্তি-জিহ্বার স্বাদ-গন্ধ, ম্যাগডোনাল্ড, নামক আপাত নিরীহ রসুই ঘরের কাছে বিসর্জন দিয়ে একবার ক্রেতা হই, বিক্রেতা হই, অথবা পুরো আয়োজনই রূপান্তরিত হয় নিরুপায় বিকিকিনির এক কূটকর্মে। মানুষ কেনাবেচার এই রকমফেরকেই হয়তো ভয়েরকাল (age of fear) হিসেবে ভেবেছিলেন আলেবেয়ার ক্যামু, আর উদ্বেগের কাল (age of anxiety) হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন অডেন; যখন রবীন্দ্রনাথ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এইভাবে, ‘... একসময় জিনিসই ছিল বৈশ্যের সম্পত্তি; এখন মানুষ তার সম্পত্তি হইয়াছে।’

বলতে কী, আমার মত ভুঁইফোঁড়ের মনোবিদ্যা চর্চার নমুনা এইভাবে আরো খানিকটা নিশ্চয় বিস্তার ঘটানো যায়: আমাদের প্রাচীনতম শাস্ত্র আর্য়ুবেদে যে মনোরোগকে ‘ভুতবিদ্যা’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে; বা, প্লেটোর কাছে উন্মাদনা ছিল প্রোফেটিক, টেলিস্টিক , পোয়েটিক ও ইরোটিক- এ সম্পর্কে দু’এক কথা বাড়তি বলার ঝোঁক তৈরি হয় তখনি। কিন্তু ভয় হয়- এই বাক্য-শব্দ-সংবাদ অপ্রাসঙ্গিক নয় তো? ভারতবর্ষের পটভূমিতে মনোচিকিৎসা, অথবা উন্মাদনা বিষয়ক জ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে প্রবন্ধের নতুন শিরোনাম নির্বাচন করি, অথবা তখন মনে হয়- ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় তৈরি হওয়া অ্যাসাইলামটি ছিল সেন্ট্রাল জেলের কাছে মুরলী বাজারের কাছে, যেখানে ১৮২৭-৩৭ পর্যন্ত সময়ে ৬৫২ জন কৃষিশ্রমিক ভর্তি ছিলেন। কিন্তু এইসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে শিরোনামের অন্যতম প্রধান চাবি শব্দ ‘নারীর মনোজগত’ চেনার জন্য আমি এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যার অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলি- ওঁরা মানবীবিদ্যার উদ্ভব ব্যাখ্যা করতে করতে নারীর বিকাশের সঙ্গে শ্রম, অর্থনীতি, উন্নয়ন, পরিবেশ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, আইন, ক্ষমতায়ন, গণমাধ্যম ও স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রবন্ধের জেরোক্স কপি আমার হাতে গুঁজে দেন: সুবিখ্যাত মেরি উলস্টোন ক্রাফট, মারী স্টোপস, বোভয়া, এঙ্গেলস, বেটি, ভার্জিনিয়া উলফ, গ্রিয়র হয়ে পায়রাবন্দের রোকেয়া ছুঁয়ে অনুভব করি ‘জেনেসিস’-এর সেই বিশিষ্ট শব্দ-বাক্য কানের ভেতর যেন এক ঘেঁয়ে সুরে কথা বলছে - ‘... women is her name because she was taken out of man.’। নারীর শ্রমশীলতাকে নিছক ছায়াকর্ম (shadow work) বিবেচনা করে আমি মনুস্মৃতি, অথর্ববেদ এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ থেকে নারী-শাসনের উপাদান সংগ্রহ করি: ‘স্ত্রীলোককে কুমারী অবস্থায় পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্র রক্ষা করবে, স্ত্রীলোক কখনও স্বাতন্ত্র লাভের যোগ্য নয়। ... হে নারী তুমি পুত্র সন্তান উৎপন্ন কর, ... উৎপন্ন পুত্রের পরেও পুত্র উৎপন্ন কর। ... স্ত্রী যদি স্বামীর কামনা পূরণ করতে অস্বীকার করে তাহলে তাকে কিনে নিতে হবে। ... এতেও যদি সে না রাজি হয় তাহলে লাঠি দিয়ে বা হাত দিয়ে মেরে বশে আনবে।’ কলকাতার নিষিদ্ধপল্লির আঁধার-ঘরে ১৮৬৩ সনে জন্ম নেয়া বিনোদিনী দাসী তাঁর বেদনার কথা বলেন- “পৃথিবীতে আমার কিছুই নাই, শুধুই অনন্ত নিরাশা, শুধুই দুঃখময় প্রাণের কাতরণ। কিন্তু তাহা শুনিবারও লোক নাই! মনের ব্যথা জানাইবার লোক জগতে নাই- কেননা আমি জগত মাঝে কলঙ্কিনী, পতিতা। আমার আত্মীয় নাই, সমাজ নাই, বন্ধু নাই, বান্ধব নাই, এই পৃথিবীতে আমার বলিতে এমন কেহই নাই।” ‘অবরোধ-বাসিনী’ নারীর হয়ে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর শৈশবের কথা আমাদেরকে বলেন- ...সবে মাত্র পাঁচ বৎসর বয়স হইতে আমাকে স্ত্রীলোকদের হইতেও পর্দ্দা করিতে হইত। ... পাড়ার স্ত্রীলোকেরা হঠাৎ বেড়াইতে আসিত; অমনি বাড়ির কোন লোকচক্ষুর ইশারা করিত, আমি যেন প্রাণ-ভয়ে যত্র-তত্র- কখনও রান্নাঘরের ঝাঁপির অন্তরাল, কখনও কোন চাকরাণীর গোল করিয়া জড়াইয়া রাখা পাটির অভ্যন্তরে, কখনও তক্তপোষের নিচে লুকাইতাম।’ ভাবি- সব মানুষ নিশ্চয় লুকোতে পারে না; সাতচল্লিশে দেশান্তরী হতে বাধ্য এক নারীর অন্তর্বয়ান শোনান নৃ-বিজ্ঞানী বীনা দাস, : ‘ধরা যাক ওঁর নাম আশা। স্বামী টাইফয়েডে মারা যান, যখন তাঁর বয়স কুড়ি।... সবখানেই আমি সংসারের কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করতাম।... কিন্তু সকলেই আমাকে ঠেস দিয়ে কথা বলত,... ওঁরা বলত, আমি যথেষ্ট সুন্দর নই বলে নাকি আমার স্বামীর বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই চলে গিয়েছিল।... ব্যাপারটা একেবারে অসহ্য হয়ে উঠল যখন বড় নন্দাই আমার দিকে নজর দিতে শুরু করলেন। দ্বিতীয় বিয়েটাতো করতে হলো এই পোড়া শরীরটার জন্য।... শুধু আমার নিজের তাড়নাই নয়, পুরুষেরা যখন আমার দিকে তাকাত, আমার তো তখন কিছু করার থাকত না। ওরা তো আমায় দেখত না, আমার এই শরীরটাকে দেখত, নন্দাই যদি আমার দিকে নজর না দিতেন, আমি হয়ত শুদ্ধ হয়েই থাকতে পারতাম, বিধবার যেমন থাকা উচিত। নারীর মনোজগৎ বোঝার এই আপাত-নিরীহ খেলায় বন্ধুরা আরো নতুন সব তত্ত্ব পাঠায়। আমি উল্টে উল্টে পড়ি: জ্যোতিমর্য়ী দেবীর লেখায় আমার চোখ স্থির হয়, শ্লেষ ঝরে পড়েছে- ‘মানুষ পৃথিবীতে একটা জাত। তাতে আবার দু’ভাগ- স্ত্রী ও পুরুষ। কিন্তু তাতে মানুষের সমস্যা মেটেনি, সে স্ত্রীজাতির মধ্যেও দাগ কেটে দু’ভাগ করেছে, একজন হলো পুরুষের ঘর-সংসারের গৃহিনী বা সন্তানের জননী-সেবিকা, তার নামই হলো সতী। আর অন্য হলো তার প্রমোদ-বিলাসের সঙ্গিনী, বহুবল্লভা, গৃহধর্মহীনা এক নিঃসঙ্গ নারী- তাকে অসতী বলা চলে।” বহু বছর পর জ্যোতির্ময়ী দেবী কথিত, ঢাকা শহরের এক ভাসমান গৃহধর্মহীনা নিঃসঙ্গ নারী নিজেকে উন্মোচিত করেছেন- : আমাদের আর কিছু বলার আছে? আমাদের একেবারে মেরে ফেলেন। পেটের ক্ষুধায়, অভাবের জ্বালায় খারাপ হয়েছি, যখন কোনো আর রাস্তা দেখে না, যখন আর কোনো উপায় থাকে না; তখনই তো মানুষ খারাপ হয়। আমার ৩৫-৩৬ বছর বয়স হলো। এটাই দেখে আসছি। আর আমার নিজের কথা শুনতে চান? সাতদিন-সাতরাত বললেও সেই ইতিহাস শেষ হবে না।

ইতিহাস বর্ণনার এই দায়, বেদনা ও দ্রোহ থেকে আমরা নিজেরাও এবার খানিকটা পলাতক হওয়ার আয়োজন খুঁজি। নারীর অর্ন্তজগত বোঝার জন্য যে গুটিকতক বয়ানের আশ্রয় নিয়েছি, অনুভব হয়- এখানেও বড় একটি খুঁত থেকে গেলো: বই লিখে কিম্বা ওরালহিস্ট্রির প্রোজেক্টে অংশগ্রহণকারী নারীর বাইরেও অজস্র নারী রয়ে গেলেন, যারা চিরকালের অচ্ছুত, নিখোঁজ, গৃহহীনা, মূক, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রান্তিক। এদিকে যুদ্ধ, ক্ষমতা, দারিদ্র্য ইত্যাদি মিলিয়ে তৈরি হওয়া আমাদের সময়ের sexualpolitics নিয়ে প্রায় কিছুই বলা হয়নি। বলা হয় না জেনেটিক প্রাইভেসি এবং কন্যা-শিশুর ভ্রুণহত্যা বিষয়ে। বলা হয় না ‘মানব বোমা’ হিসেবে নারীর তীব্র আত্মপ্রকাশ বিষয়ে। বলা হয় না যুদ্ধে ‘কমফোট গার্ল’ হিসেবে নারীর বাধ্যতামূলক উপস্থিতি প্রসঙ্গে। কিম্বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর গৃহচ্যুত নারীর ঘর-সংসার নিয়েও কিছুমাত্র উচ্চবাচ্য করা হয় না। বলা হয় না নারীর গোপন নেশাসক্তির অভ্যাস, যৌন নৈতিকতা ও পর্নোগ্রাফি নিয়ে। বলা হয় না নারী লেখনী নিয়ে। বলা হয় না নারীবাদ, আধুনিকতা ও প্রগতিবাদের তর্ক-ঝগড়া নিয়ে।

বক্তিমার আঁচ কমে গেলে এবার অনুভব হয়- শেষ পর্যন্ত অনেক বাগাড়ম্বরের পরেও প্রায় কিছুই বলা হয়নি যেন, আদতে হয়ত আমি কিছু জানি না। অস্পষ্ট ধারণা নিয়ে আমি এবার সারমর্ম করি- ‘নারীর মূল্য’ তৈরির জন্য, নারীর ‘নিজের একটি কামরা’ বন্দোবস্তের জন্য নারীর ক্ষমতায়নের লড়াইয়ে আমার মত ভয়-কাতুরে মানুষেরও, একেবারে শেষ পংক্তিতে হলেও অবশ্যই নাম অন্তর্ভুক্তি চাই। বালখিল্য ভয় তাড়ানোর জন্য এবেলা তেভাগার বেলাদত্তের সাক্ষাৎকার দেখি, একাত্তরের বীরাঙ্গনা বীর মাতার জবানি পাঠ করি, নকশাল আন্দোলনের অরুণা চৌধুরী, ইভা ও আরজা বেগম পাঠ করি। পাঠ করি অরণ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত লড়াকু আরণ্যক-কন্যার জয়গান; পাঠ করি টংক আন্দোলনে হাজং-নারীর অবিস্মরণীয় অংশগ্রহণ, পাঠ করি পোশাক শিল্পের অগুনতি কন্যার নিঃশব্দ-অভিজ্ঞতা, পাঠ করি কল্পনা চাকমা, পাঠ করি ফুলবাড়ি কয়লা খনির নারী-মহাচরিত, পাঠ করি চিংড়ি ঘেরের দুঃসাহসিক নারী-উপাখ্যান; আর পাঠ করি সুবিখ্যাত অগাস্ট বেবেল: ‘আমরা বাস করছি ক্রমাগ্রসরমান এক বিশাল সামাজিক রূপান্তরের যুগে।... বহু প্রশ্ন জাগছে আর তা নিয়ে সাগ্রহে আলোচনা হচ্ছে, পরিসর যার ক্রমেই বাড়ছে। এর মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর একটি হলো নারী প্রশ্ন, বারবার যা সামনে আসছে।... আমাদের দৃষ্টিতে এ প্রশ্নটি অন্য আরেকটি প্রশ্নের সাথে মিলে যায়: সমাজটা কীভাবে সংগঠিত হওয়া উচিত যাতে নির্যাতন, শোষণ, দুর্দশা ও অভাব দূর হয়, এবং সামগ্রিকভাবে ব্যক্তির ও সমাজের পারিবারিক মানসিক কল্যাণ সাধিত হয়? তাহলে আমাদের কাছে, নারী প্রশ্ন সকল চিন্তাশীল মস্তিষ্ক জুড়ে যে সাধারণ সামাজিক প্রশ্নটি রয়েছে তার একটি মাত্র পর্যায়: এর চূড়ান্ত সমাধান কেবল সকল সামাজিক চরমাবস্থা এবং তার ফলে সৃষ্ট সকল মন্দকে দূর করার মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব।’

আমি আমার মন্দ-আত্মাকে বশীভূত করার জন্য আমার অশিক্ষা ও কূপম-ূকতা এড়ানোর জন্য, পাপ স্বীকারের জন্য জন লেনন আওড়াই: নারী হলো এই পৃথিবীর নিগ্রো, হ্যাঁ সে তাই... ভেবে দেখো। নারী হলো এই পৃথিবীর নিগ্রো, ভেবে দেখো, পারলে এ নিয়ে কিছু করো তুমি। আমরা তাকে মুখে রঙ লাগাতে বাধ্য করি আর নাচতে। যদি সে না দাসী হয়, বলি ভালোবাসে না সে। যদি সে নিজ মূর্তি ধারণ করে, বলি পুরুষ হতে চলেছে। যখন নামাচ্ছি তাকে নিচে ভাব দেখাচ্ছি মাথায় করে রাখছি।... আমরা বলি গৃহই একমাত্র স্থান সেখানেই তার থাকা উচিত।... আমরা তাকে প্রতিদিনে টিভিতে অপমান করি, আর বিস্মিত হই তার সাহস আর নিজের প্রতি আস্থা নেই দেখে। যখন সে যুবতী আমরাই তাকে মুক্তি দিতে হত্যা করি। যখন বলছি বেশি স্মার্ট হওয়া ভাল না, করছি ঘৃণা, যাতে সে ভীষণ হাবাগোবা হয়।... নারী হলো এই পৃথিবীর নিগ্রো।

...আশার কথা, এতসব অপমান-অবমাননার পরেও নারী, শেষ পর্যন্ত নিজের মতো করে বাঁচে। দ্রোহে-ক্ষোভে-সব কিছুর বাইরে এসে দাঁড়ায়, প্রশ্নবিদ্ধ করে। যেমনটি হয় মহাত্মা হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখিতে: দেশভাগের গোপন রহস্য সেই বয়োবৃদ্ধা বুঝতে চায় না। সবাই দেশান্তরী হলেও তিনি অনড়- ‘আমি কি ঠিক করলাম? আমি কি ঠিক বোঝলাম? সোয়ামির কথা শোনলাম না, ছেলের কথা শোনলাম না, মেয়ের কথা শোনলাম না?... অনেক ভাবলাম। শ্যাষে একটি কথা মনে হলো, আমি আমাকে পাবার লেগেই এত কিছু ছেড়েছি,... আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলাদা একটা দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুধু মোসলমানরা থাকবে কিন্তু হিদু কেরেস্তানও থাকতে পারবে,... আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করব? আমি আর সোয়ামী তো একটি মানুষ লয় আলাদা মানুষ, খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ কিন্তুক আলাদা মানুষ। সকাল হোক, আলো ফুটুক, তখন পূর্বদিকে মুখ করে বসব। সুরুজের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াবো আমি। আমি একা। তা হোক, সবাইকে টানতে পারব আমি।’

... নারীর রক্তপাত, নারীর দ্রোহ, অনুভব করি, এই ভাবে আবার আমাদের জীবনের মৌল স্রোতে অবগাহন করার নেমন্তন্ন পাঠায় অনন্তকাল। আমরা জাড্য এড়িয়ে পথ হাঁটি এবং অচিরেই আবিষ্কৃত হয়- বিবিধ তত্ত্ব, গবেষণা, রাজনীতি, স্বাস্থ্যবার্তা শেষ পর্যন্ত পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত; মেডিকেল-নৃবিজ্ঞানী আর্থার ক্লেইনম্যানকে স্মরণ করে লিখি: what difference does it make for theory, for research, for policy, for societal ethics to change the border between a social and a health problem. Now pulling the edge toward the social side, later on pushing it toward medical margin– does that disclose a comparative advantage for ‘medicalization’ of human misery under certain conditions or for ‘socialization’ under others? The moral, the political, and the medical are culturally interrelated, but how do we best interpret that relationship and its implication? মোটা দাগে- এই মনস্বী সভায় উপস্থিত হওয়ার অনুমতি প্রাপ্তি এবং বক্তৃতায় উচ্চাভিলাষী শিরোনাম নির্বাচন শেষ পর্যন্ত আমাদের বিবিধ জ্ঞান কাঠামোয় অন্তর্গত যোগাযোগ ও আন্তঃপারস্পরিক সম্পর্ক বয়ান করার যৎকিঞ্চিত আয়োজন বৈ কিছু নয়; যখন চাবি শব্দগুলো ছিল আমাদের নড়বড়ে-টলমল পথ হাঁটার অবলম্বন, প্রত্মবীজ এবং সম্পর্ক বর্ণনার নিছক চিহ্ন বিশেষ।