নতুন সময়ের গণমাধ্যম

ইমতিয়ার শামীম

বাংলাদেশে গণমাধ্যম যে আগের অবস্থান হারাবে, কর্পোরেট পুঁজির সঙ্গে এর সংযোগ ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই এ বার্তা সবার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল; তবে তা এখন নিশ্চিত ও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে গণমাধ্যমের বিপরীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর আন্তর্জালিক বিকাশ একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে উপনীত হওয়াতে। প্রশ্ন হলো, এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে গণমাধ্যম কতটুকু প্রস্তুত, কীভাবেইবা এ চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করে তা সামনের দিকে এগুবে। এখন পর্যন্ত, এককথায় গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে কোনও পথনির্দেশনা তৈরি করতে পারেননি।

এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হলে অবশ্য গণমাধ্যমকে আরও দুটি বিষয় ভাবতে হবে- প্রথমত কর্পোরেট সেন্সরশিপ, দ্বিতীয়ত রাষ্ট্র বা সরকারের সেন্সরশিপ। যার একটি তার কাঁধের ওপর জেঁকে বসতে শুরু করেছে গণমাধ্যমে কর্পোরেট পুঁজি বিনিয়োগের প্রারম্ভ থেকে আর আরেকটিকে তা পেয়েছে ঐতিহ্যগতভাবে। আমরা মানি বা না মানি, কি প্রিন্ট কি স্যাটেলাইট উভয় গণমাধ্যমকেই এই সেন্সরপ্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। কিন্তু বিক্ষোভটা চোখে না পড়ার কারণ, অনেক সম্পাদক ও সংবাদকর্মীই স্বেচ্ছায় কিংবা রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে অবদমনের পথে হাঁটছেন। দেশে এখন যা চলছে, তা এককথায় অবদমিত সাংবাদিকতা; কারণ বিশেষ কোনো সংস্থা থেকে ফোন আসার প্রয়োজন পড়ছে না, সংবাদকর্মীই ‘আয় রে পাখি ল্যাজঝোলা’র লেজ কেটে দিচ্ছেন। আর গণমাধ্যমকে তো অর্থনৈতিক কারণে স্পষ্টতই নির্ভর করতে হচ্ছে কর্পোরেট শক্তির ওপরে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের রাজনৈতিক খবরাখবর কিংবা সম্পাদকীয় পাতা অনুসরণ করলেই বোঝা যায়, এক ধরনের সুশীল হাহাকার ছাড়া সত্যিকারের রাজনৈতিক চিত্র এতে নেই। তুলনায় অর্থনৈতিক খবরাখবর, প্রশাসনিক দুর্নীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে গণমাধ্যম অনেক বেশি সোচ্চার। আর তার কারণও আছে, কর্পোরেট শক্তিগুলো নিজেদের প্রয়োজনেই প্রতিদ্বন্দ্বি কর্পোরেট হাউজের দুর্নীতি-অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ করছেন, ক্ষেত্রবিশেষে লাগামছাড়া ও দৃষ্টিকটূ ভাবও থাকছে তাতে। কাজেই গণমাধ্যমকে যে প্রবল এক শক্তি হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার কারণ কর্পোরেট শক্তিগুলোর নিঃশব্দ সহিংসতা ও নোংরা প্রতিযোগিতা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা বিচক্ষণ নোংরামির পরিচয়ও দিচ্ছেন। যেমন, প্রতিদ্বন্দ্বি ব্যবসায়ীর ওপর নিঃশব্দ সহিংসতার সূত্র ধরে তাদের দুর্নীতি-অনিয়ম প্রকাশের জন্যে বেছে নিচ্ছে অন্য একাধিক গণমাধ্যমকে।

এই পরিস্থিতিতে পাঠক ও অনুসন্ধিৎসুরাও একধরনের বিচক্ষণতার পথ বেছে নিয়েছেন। ‘না- না- এইটার খবর তো এই পত্রিকায় পাওয়া যাবে না, ওইটা নিয়ে আসো, ওইটাতে এটা ভালো করে লিখেছে- এ রকম ভাসমান সংবাদপত্র পাঠকও একেবারে কম নন। বরং তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ফলে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় নামের পাতাটির ওপর মানুষের আস্থাও কমছে। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর বিষয়টি অবশ্য একটু আলাদা। কোনো ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট ও তার ফুটেজ যদি ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে প্রচার হয়, তার ধকল সামলাতে একটু সময় পার হয় বটে; কিন্তু নিউজরুমে এখন কেউ কেউ আছেন, যারা এসব ব্যাপারে পারঙ্গম। এত কিছুর পরও যেসব সংবাদ সেন্সরশিপের কাঁচিতে কাটা পড়ে অথবা নিউজ ডেস্ক পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারে না সেগুলোর জন্যে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। প্রযুক্তির বিকাশ এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনার ভিডিও পর্যন্ত এ মাধ্যমে চলে আসছে এবং গণমাধ্যম কিংবা আইনশৃক্সক্ষলা প্রয়োগকারী সংস্থা বাধ্য হচ্ছেন সক্রিয় হতে।

তবে গণমাধ্যম যে কারণেই হোক, এই যে ব্যর্থতা, স্থবিরতা কিংবা বন্দিত্বের পরিচয় দিচ্ছে, তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও বিশৃঙ্খল করে তুলছে। গুজব ছড়ানো সহজ; ভঙ্গুর, পর্যুদস্ত, অবক্ষয়দীর্ণ সমাজে অনেক মানুষ তা শুনতে আর বিশ্বাস করতেও আগ্রহী হয়ে ওঠে- যে গুজব ছড়ানোর ভয়ঙ্কর কাজটিও করে চলেছে সামাজিক গণমাধ্যম। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে ব্যক্তিমানুষ। একজন মানুষকে সামাজিকভাবে অপদস্থ করতে, দুঃসহ জীবনের দিকে ঠেলে দিতে কিংবা সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করতে খুব বেশি কিছুর আর দরকার নেই- দরকার একটি দায়দায়িত্বহীন, গুরুত্বহীন নিউজওয়েব এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি নামী বেনামী একাউন্ট। যে অপপ্রচার শুরু করা হয়, তা যে সত্য নয়, তা চোখকান খোলা রাখলেই বোঝা সম্ভব- কিন্তু চোখে ঠুলি পরে চলতে অভ্যস্ত মানুষও কম নয়; পাল্টা সত্যিকারের বার্তাটি নিশ্চয়ই পরিস্থিতিকে সামলাতে পারে; কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তার আগেই হয়ে যায়, মানুষটিকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়, মন্তব্যে মন্তব্যে বিপন্ন হয়ে পড়তে হয়, অথবা সামাজিক ও রাজনৈতিক সংঘাত শুরু হয়ে যায়। এমন কয়েকটি ঘটনা আমরা ইতিমধ্যেই ঘটতে দেখেছি। কিন্তু তার সমাধান আবার এ-ও নয় যে, ৫৭ ধারার মতো একটা কিছু করতে হবে, সেটা বাতিল করে আবার তারই আদলে আরও একটি কিছু করার চিন্তা করতে হবে। বাস্তবত আমাদের নীতিনির্ধারকরা এখন সে পথেই এগোচ্ছেন। তথ্য-প্রযুক্তি বিকাশের ফলে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নতুন যে পরিসর তৈরি হয়েছে, তার পথ নিষ্কণ্টক করার জন্য নয়, সরকারের মাথায় ৫৭ ধারাকে ‘যথাযথ’ করার চিন্তাও আসছে বোধকরি কর্পোরেট ধারার সাংবাদিকতাও এই বিধির জালে অংশত পেঁচিয়ে পড়ায়। কর্পোরেট ধারার সাংবাদিকতাকে নিরাপদ করে অনলাইন সাংবাদিকতা ও মুক্তচিন্তা চর্চাকে কী করে কার্যকর জালে আবদ্ধ করা যায়, বোধকরি সেই বিবেচনার দিকেই এগোচ্ছে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়।

আগেই বলা হয়েছে, সম্পাদক ও সংবাদকর্মীদের এই আত্মনিয়ন্ত্রণমূলক সাংবাদিকতা বা অবদমিত সাংবাদিকতা এতই কার্যকর যে রাষ্ট্র ও সরকারের তরফ থেকে প্রত্যক্ষ সেন্সরশিপের পরিসর এখন বেশ কমে এসেছে। এই পরিসর কমে আসার আরও একটি কারণ, সরকারি ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে রাজনৈতিকতার সূত্রে প্রযুক্ত ব্যক্তিদের পরিচালিত কর্পোরেট শক্তিই মূলত এ দেশের গণমাধ্যমে পুঁজি বিনিয়োগ করছে এবং ইতিমধ্যে তারা একটি ধারা গড়ে তুলতেও সক্ষম হয়েছে, আর তাই নিজেদের কর্পোরেট অবস্থান দিয়েই সরকারি সেন্সরশিপ নিশ্চিত করে চলেছে। পুঁজির শক্তির কারণে সাংবাদিকতা ও সংবাদকর্মীদের স্বাধীনতা আসলে তাই নির্ভর করছে সংবাদপত্র মালিকদের স্বাধীনতার ওপর, কর্পোরেট শক্তির নিজস্ব এজেন্ডার ওপর।

নির্মম হলেও সত্য, কার্যত সংবাদকর্মীরা কত অনিরাপদ হয়ে পড়েছেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কিংবা স্বাধীনতাহীনতার দিকে তাকিয়ে তা আর বোঝার উপায় নেই। কারণ, আমরা অহরহ দেখছি এক কর্পোরেটের সঙ্গে দ্বন্দ্বে আরেক কর্পোরেটের দুর্নীতি-অনিয়ম গণমাধ্যমে চলে আসছে, জনগণ সেসব জানতে পারছে এবং ভাবছে যে, কোনো না কোনোভাবে সে তথ্যপ্রবাহের মধ্যেই আছে। এই ভাবে তার অসন্তোষ বোঝার, পরিমাপের এবং প্রকাশের সুযোগ সে পাচ্ছে, তাকে আর অবদমিত থাকতে হচ্ছে না। এমনকি বড় বড় উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের দুর্নীতি-অনিয়মের সংবাদও আর চাপা পড়ে থাকছে না প্রতিযোগিতায় লিপ্ত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে। যদিও এইসব দুর্নীতি-অনিয়মের প্রতিকার বলতে গেলে হচ্ছেই না- এক কর্পোরেট শক্তির সঙ্গে অপর কর্পোরেটের এইসব দ্বন্দ্বের মূল হিসেব-নিকেশ হচ্ছে অন্য কোথাও, বোঝাপড়াও হচ্ছে বিচারালয়ে নয়, বরং অন্য কোথাও। মাঝেমধ্যে আমরা যতই ঢোল পিটাই না কেন, আমাদের সংবাদপত্রের পাতায় অমুক সংবাদ প্রকাশের সূত্রে অমুক প্রতিকার গ্রহণ করা হয়েছে, মানবিক কিছু ঘটনা বাদ দিলে এর ব্যাপক অংশেরই সুরাহা বা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়ার কারণ অন্য কোথাও লুকিয়ে থাকে। সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতা তাই যতটা না তার প্রকাশিত সংবাদের প্রতিক্রিয়া থেকে উদ্ভূত হচ্ছে, তারও চেয়ে বেশি দেখা দিচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে উটকো বিভিন্ন প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া বা না-হওয়ার মধ্যে দিয়ে। যেমন, সংবাদকর্মী তার আশপাশের বা স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সামাল দিচ্ছে কেমন করে সেটার ওপর নির্ভর করছে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। এমনকি তার অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও প্রচণ্ড ভঙ্গুর, যা ওয়েজ বোর্ডের চালচিত্রের দিকে অর্ধেক তাকিয়েই বলে দেওয়া যায়। অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু এই অনিরাপদ কর্মজীবনের কারণেই সে বরং আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে সাংবাদিকতাতে। সংবাদকর্মীদের নেতারা এখন নবম ওয়েজ বোর্ডের আহ্বান রাখছেন। কিন্তু কার্যত অনেক পত্রিকার কিংবা অনলাইন মিডিয়ার অধিকাংশ কর্মীরাই অনাগত নবম ওয়েজ বোর্ডের আওতায় বেতন পাওয়ার স্বপ্ন দেখা দূরে থাক- সপ্তম ওয়েজ বোর্ডের কাঠামোতেই বেতন পাচ্ছেন না। এ বাস্তবতা সাংবাদিক নেতাদের নিশ্চয়ই জানা আছে, কিন্তু তারাও এ নিয়ে বলতে গেলে নীরব।

গণমাধ্যম এখন এমন একটি অবস্থানে আছে যে, অতীতের সেই প্রবাদের মতো করে যদি বলা হয়, আসন্ন মহাযুদ্ধ হবে তেল কিংবা পানি নিয়ে নয়, বরং তথ্য নিয়ে, তা বোধকরি ভুল হবে না। গণমাধ্যমকে এ চ্যালেঞ্জ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে জনগণের দিকেই মুখ ফেরাতে হবে। এককথায় এ কথাটি শুনতে হয়তো পানসে লাগতে পারে। কিন্তু নতুন সময়ের এই জনগণকেই বোঝার চেষ্টা করা উচিত সর্বাগ্রে; আর সে ক্ষেত্রে গণমাধ্যম প্রকৃতার্থে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভেতর কত গভীরভাবে এবং কত দ্রুত নিজের দাঁত বসাতে পারছে, সেটার ওপর নির্ভর করছে তার ভবিষ্যত।

image

শিল্পী : শতাব্দী জাহিদ

আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
সংবাদ এবং আমার শৈশব
আমার বাতিঘর
শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা
নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
চলছে লড়াই, চলবে লড়াই
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
আমার ‘সংবাদ’
দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান
বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন
দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন
নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী
‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’
মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

নতুন সময়ের গণমাধ্যম

ইমতিয়ার শামীম

image

শিল্পী : শতাব্দী জাহিদ

বাংলাদেশে গণমাধ্যম যে আগের অবস্থান হারাবে, কর্পোরেট পুঁজির সঙ্গে এর সংযোগ ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই এ বার্তা সবার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল; তবে তা এখন নিশ্চিত ও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে গণমাধ্যমের বিপরীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর আন্তর্জালিক বিকাশ একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে উপনীত হওয়াতে। প্রশ্ন হলো, এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে গণমাধ্যম কতটুকু প্রস্তুত, কীভাবেইবা এ চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করে তা সামনের দিকে এগুবে। এখন পর্যন্ত, এককথায় গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে কোনও পথনির্দেশনা তৈরি করতে পারেননি।

এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হলে অবশ্য গণমাধ্যমকে আরও দুটি বিষয় ভাবতে হবে- প্রথমত কর্পোরেট সেন্সরশিপ, দ্বিতীয়ত রাষ্ট্র বা সরকারের সেন্সরশিপ। যার একটি তার কাঁধের ওপর জেঁকে বসতে শুরু করেছে গণমাধ্যমে কর্পোরেট পুঁজি বিনিয়োগের প্রারম্ভ থেকে আর আরেকটিকে তা পেয়েছে ঐতিহ্যগতভাবে। আমরা মানি বা না মানি, কি প্রিন্ট কি স্যাটেলাইট উভয় গণমাধ্যমকেই এই সেন্সরপ্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। কিন্তু বিক্ষোভটা চোখে না পড়ার কারণ, অনেক সম্পাদক ও সংবাদকর্মীই স্বেচ্ছায় কিংবা রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে অবদমনের পথে হাঁটছেন। দেশে এখন যা চলছে, তা এককথায় অবদমিত সাংবাদিকতা; কারণ বিশেষ কোনো সংস্থা থেকে ফোন আসার প্রয়োজন পড়ছে না, সংবাদকর্মীই ‘আয় রে পাখি ল্যাজঝোলা’র লেজ কেটে দিচ্ছেন। আর গণমাধ্যমকে তো অর্থনৈতিক কারণে স্পষ্টতই নির্ভর করতে হচ্ছে কর্পোরেট শক্তির ওপরে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের রাজনৈতিক খবরাখবর কিংবা সম্পাদকীয় পাতা অনুসরণ করলেই বোঝা যায়, এক ধরনের সুশীল হাহাকার ছাড়া সত্যিকারের রাজনৈতিক চিত্র এতে নেই। তুলনায় অর্থনৈতিক খবরাখবর, প্রশাসনিক দুর্নীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে গণমাধ্যম অনেক বেশি সোচ্চার। আর তার কারণও আছে, কর্পোরেট শক্তিগুলো নিজেদের প্রয়োজনেই প্রতিদ্বন্দ্বি কর্পোরেট হাউজের দুর্নীতি-অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ করছেন, ক্ষেত্রবিশেষে লাগামছাড়া ও দৃষ্টিকটূ ভাবও থাকছে তাতে। কাজেই গণমাধ্যমকে যে প্রবল এক শক্তি হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার কারণ কর্পোরেট শক্তিগুলোর নিঃশব্দ সহিংসতা ও নোংরা প্রতিযোগিতা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা বিচক্ষণ নোংরামির পরিচয়ও দিচ্ছেন। যেমন, প্রতিদ্বন্দ্বি ব্যবসায়ীর ওপর নিঃশব্দ সহিংসতার সূত্র ধরে তাদের দুর্নীতি-অনিয়ম প্রকাশের জন্যে বেছে নিচ্ছে অন্য একাধিক গণমাধ্যমকে।

এই পরিস্থিতিতে পাঠক ও অনুসন্ধিৎসুরাও একধরনের বিচক্ষণতার পথ বেছে নিয়েছেন। ‘না- না- এইটার খবর তো এই পত্রিকায় পাওয়া যাবে না, ওইটা নিয়ে আসো, ওইটাতে এটা ভালো করে লিখেছে- এ রকম ভাসমান সংবাদপত্র পাঠকও একেবারে কম নন। বরং তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ফলে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় নামের পাতাটির ওপর মানুষের আস্থাও কমছে। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর বিষয়টি অবশ্য একটু আলাদা। কোনো ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট ও তার ফুটেজ যদি ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে প্রচার হয়, তার ধকল সামলাতে একটু সময় পার হয় বটে; কিন্তু নিউজরুমে এখন কেউ কেউ আছেন, যারা এসব ব্যাপারে পারঙ্গম। এত কিছুর পরও যেসব সংবাদ সেন্সরশিপের কাঁচিতে কাটা পড়ে অথবা নিউজ ডেস্ক পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারে না সেগুলোর জন্যে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। প্রযুক্তির বিকাশ এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনার ভিডিও পর্যন্ত এ মাধ্যমে চলে আসছে এবং গণমাধ্যম কিংবা আইনশৃক্সক্ষলা প্রয়োগকারী সংস্থা বাধ্য হচ্ছেন সক্রিয় হতে।

তবে গণমাধ্যম যে কারণেই হোক, এই যে ব্যর্থতা, স্থবিরতা কিংবা বন্দিত্বের পরিচয় দিচ্ছে, তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও বিশৃঙ্খল করে তুলছে। গুজব ছড়ানো সহজ; ভঙ্গুর, পর্যুদস্ত, অবক্ষয়দীর্ণ সমাজে অনেক মানুষ তা শুনতে আর বিশ্বাস করতেও আগ্রহী হয়ে ওঠে- যে গুজব ছড়ানোর ভয়ঙ্কর কাজটিও করে চলেছে সামাজিক গণমাধ্যম। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে ব্যক্তিমানুষ। একজন মানুষকে সামাজিকভাবে অপদস্থ করতে, দুঃসহ জীবনের দিকে ঠেলে দিতে কিংবা সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করতে খুব বেশি কিছুর আর দরকার নেই- দরকার একটি দায়দায়িত্বহীন, গুরুত্বহীন নিউজওয়েব এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি নামী বেনামী একাউন্ট। যে অপপ্রচার শুরু করা হয়, তা যে সত্য নয়, তা চোখকান খোলা রাখলেই বোঝা সম্ভব- কিন্তু চোখে ঠুলি পরে চলতে অভ্যস্ত মানুষও কম নয়; পাল্টা সত্যিকারের বার্তাটি নিশ্চয়ই পরিস্থিতিকে সামলাতে পারে; কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তার আগেই হয়ে যায়, মানুষটিকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়, মন্তব্যে মন্তব্যে বিপন্ন হয়ে পড়তে হয়, অথবা সামাজিক ও রাজনৈতিক সংঘাত শুরু হয়ে যায়। এমন কয়েকটি ঘটনা আমরা ইতিমধ্যেই ঘটতে দেখেছি। কিন্তু তার সমাধান আবার এ-ও নয় যে, ৫৭ ধারার মতো একটা কিছু করতে হবে, সেটা বাতিল করে আবার তারই আদলে আরও একটি কিছু করার চিন্তা করতে হবে। বাস্তবত আমাদের নীতিনির্ধারকরা এখন সে পথেই এগোচ্ছেন। তথ্য-প্রযুক্তি বিকাশের ফলে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নতুন যে পরিসর তৈরি হয়েছে, তার পথ নিষ্কণ্টক করার জন্য নয়, সরকারের মাথায় ৫৭ ধারাকে ‘যথাযথ’ করার চিন্তাও আসছে বোধকরি কর্পোরেট ধারার সাংবাদিকতাও এই বিধির জালে অংশত পেঁচিয়ে পড়ায়। কর্পোরেট ধারার সাংবাদিকতাকে নিরাপদ করে অনলাইন সাংবাদিকতা ও মুক্তচিন্তা চর্চাকে কী করে কার্যকর জালে আবদ্ধ করা যায়, বোধকরি সেই বিবেচনার দিকেই এগোচ্ছে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়।

আগেই বলা হয়েছে, সম্পাদক ও সংবাদকর্মীদের এই আত্মনিয়ন্ত্রণমূলক সাংবাদিকতা বা অবদমিত সাংবাদিকতা এতই কার্যকর যে রাষ্ট্র ও সরকারের তরফ থেকে প্রত্যক্ষ সেন্সরশিপের পরিসর এখন বেশ কমে এসেছে। এই পরিসর কমে আসার আরও একটি কারণ, সরকারি ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে রাজনৈতিকতার সূত্রে প্রযুক্ত ব্যক্তিদের পরিচালিত কর্পোরেট শক্তিই মূলত এ দেশের গণমাধ্যমে পুঁজি বিনিয়োগ করছে এবং ইতিমধ্যে তারা একটি ধারা গড়ে তুলতেও সক্ষম হয়েছে, আর তাই নিজেদের কর্পোরেট অবস্থান দিয়েই সরকারি সেন্সরশিপ নিশ্চিত করে চলেছে। পুঁজির শক্তির কারণে সাংবাদিকতা ও সংবাদকর্মীদের স্বাধীনতা আসলে তাই নির্ভর করছে সংবাদপত্র মালিকদের স্বাধীনতার ওপর, কর্পোরেট শক্তির নিজস্ব এজেন্ডার ওপর।

নির্মম হলেও সত্য, কার্যত সংবাদকর্মীরা কত অনিরাপদ হয়ে পড়েছেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কিংবা স্বাধীনতাহীনতার দিকে তাকিয়ে তা আর বোঝার উপায় নেই। কারণ, আমরা অহরহ দেখছি এক কর্পোরেটের সঙ্গে দ্বন্দ্বে আরেক কর্পোরেটের দুর্নীতি-অনিয়ম গণমাধ্যমে চলে আসছে, জনগণ সেসব জানতে পারছে এবং ভাবছে যে, কোনো না কোনোভাবে সে তথ্যপ্রবাহের মধ্যেই আছে। এই ভাবে তার অসন্তোষ বোঝার, পরিমাপের এবং প্রকাশের সুযোগ সে পাচ্ছে, তাকে আর অবদমিত থাকতে হচ্ছে না। এমনকি বড় বড় উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের দুর্নীতি-অনিয়মের সংবাদও আর চাপা পড়ে থাকছে না প্রতিযোগিতায় লিপ্ত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে। যদিও এইসব দুর্নীতি-অনিয়মের প্রতিকার বলতে গেলে হচ্ছেই না- এক কর্পোরেট শক্তির সঙ্গে অপর কর্পোরেটের এইসব দ্বন্দ্বের মূল হিসেব-নিকেশ হচ্ছে অন্য কোথাও, বোঝাপড়াও হচ্ছে বিচারালয়ে নয়, বরং অন্য কোথাও। মাঝেমধ্যে আমরা যতই ঢোল পিটাই না কেন, আমাদের সংবাদপত্রের পাতায় অমুক সংবাদ প্রকাশের সূত্রে অমুক প্রতিকার গ্রহণ করা হয়েছে, মানবিক কিছু ঘটনা বাদ দিলে এর ব্যাপক অংশেরই সুরাহা বা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়ার কারণ অন্য কোথাও লুকিয়ে থাকে। সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতা তাই যতটা না তার প্রকাশিত সংবাদের প্রতিক্রিয়া থেকে উদ্ভূত হচ্ছে, তারও চেয়ে বেশি দেখা দিচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে উটকো বিভিন্ন প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া বা না-হওয়ার মধ্যে দিয়ে। যেমন, সংবাদকর্মী তার আশপাশের বা স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সামাল দিচ্ছে কেমন করে সেটার ওপর নির্ভর করছে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। এমনকি তার অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও প্রচণ্ড ভঙ্গুর, যা ওয়েজ বোর্ডের চালচিত্রের দিকে অর্ধেক তাকিয়েই বলে দেওয়া যায়। অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু এই অনিরাপদ কর্মজীবনের কারণেই সে বরং আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে সাংবাদিকতাতে। সংবাদকর্মীদের নেতারা এখন নবম ওয়েজ বোর্ডের আহ্বান রাখছেন। কিন্তু কার্যত অনেক পত্রিকার কিংবা অনলাইন মিডিয়ার অধিকাংশ কর্মীরাই অনাগত নবম ওয়েজ বোর্ডের আওতায় বেতন পাওয়ার স্বপ্ন দেখা দূরে থাক- সপ্তম ওয়েজ বোর্ডের কাঠামোতেই বেতন পাচ্ছেন না। এ বাস্তবতা সাংবাদিক নেতাদের নিশ্চয়ই জানা আছে, কিন্তু তারাও এ নিয়ে বলতে গেলে নীরব।

গণমাধ্যম এখন এমন একটি অবস্থানে আছে যে, অতীতের সেই প্রবাদের মতো করে যদি বলা হয়, আসন্ন মহাযুদ্ধ হবে তেল কিংবা পানি নিয়ে নয়, বরং তথ্য নিয়ে, তা বোধকরি ভুল হবে না। গণমাধ্যমকে এ চ্যালেঞ্জ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে জনগণের দিকেই মুখ ফেরাতে হবে। এককথায় এ কথাটি শুনতে হয়তো পানসে লাগতে পারে। কিন্তু নতুন সময়ের এই জনগণকেই বোঝার চেষ্টা করা উচিত সর্বাগ্রে; আর সে ক্ষেত্রে গণমাধ্যম প্রকৃতার্থে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভেতর কত গভীরভাবে এবং কত দ্রুত নিজের দাঁত বসাতে পারছে, সেটার ওপর নির্ভর করছে তার ভবিষ্যত।