গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’

মহাদেব সাহা

সংবাদ এদেশে এখনো গণমানুষের নিজের পত্রিকা, সর্বদাই তার পক্ষে, একই সঙ্গে সে আধুনিক বাঙালি সমাজের পূর্ণাঙ্গ দর্পণ, তার মুক্তচিন্তা অসাম্প্রদায়িকতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার বিশ্বস্ত মুখপত্র। কিন্তু সংবাদ তার আত্মপ্রকাশের সময়, যে পরিবেশে সে প্রকাশিত হয়, এই পরিচয় তার ছিল না, হওয়ার কথাও ছিল না। তখন উজিরে আজম উজিরে আলা ছদরে রিয়াছত এই পাক জবানই ছিল বেশিরভাগ সংবাদপত্র এমনকি সাহিত্যেরও ভাষা। আহমদুল কবির ও তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা খায়রুল কবির সংবাদ গ্রহণ করেই তার এই রূপ ও রূপান্তর সাধন করেন। সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক প্রগতির পক্ষে আধুনিক চিন্তার প্রকাশক ও ধারক। সংবাদই এদেশে প্রথম বাংলা নামের দৈনিক পত্রিকা, আধুনিক বাঙালি জীবনের মুখচ্ছবি। এই আধুনিকতাকে এই অগ্রসরমানতাকে বুদ্ধিচর্চার প্রসারকে আজও মর্মে ধারণ করে আছে সংবাদ, যত দুঃসময়ের মধ্য দিয়েই হোক। সংবাদ তার এই আদর্শ এই চেতনা এই অঙ্গীকার কখনোই ত্যাগ করেনি। আজীবন সংবাদের এই হচ্ছে প্রকৃত সংগ্রাম। এই সংগ্রামের জন্য তাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, সে রমরমা হয়ে উঠতে পারেনি, বিত্তে বৈভবে চাকচিক্যে মনোহরণ করার উপযোগীও হয়তো সে হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু তাতে কী! বাঙালির এমন দর্পণ আর কয়টি আছে। এই দুর্লভ অর্জনই সংবাদের কৃতিত্ব ও গৌরব। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর এদেশে সাহিত্যে ও সমাজ চিন্তায় যে আধুনিক জীবন দর্শনের প্রতিফলন ঘটে, কবিতা হয়ে ওঠে তিরিশোত্তর কবিতার মতোই আধুনিক ও উন্নত; একইভাবে সংবাদের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের সেই আধুনিকতারও বিস্তার ঘটতে থাকে। এর আগ পর্যন্ত আমাদের কবিতা ছিল পশ্চাৎমুখী, সমাজের নানা স্তরে ছিল অন্ধতা ও কুসংস্কার, সেসব বর্জনের দায়িত্ব গ্রহণ করে সংবাদ- ভাষায় বানানে বাক্য গঠনে তার পরিচয় পরিস্ফুট হয়ে আছে। আজ ৬৫ বছরেরও বেশি সময় পর তা ঠিক বুঝে ওঠা যাবে না। সংবাদ-এর সেই ভূমিকা, সংবাদ-এর সেই প্রতিবাদ, সংবাদ-এর সেই দৃঢ়তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। তখন সময় এমন ছিল না, পাকিস্তানী স্বৈরাচারী সামরিক দুঃশাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে সমাজ, নিগৃহীত হয়েছে গণতন্ত্র সকল অগ্রসরশীল চিন্তাকে রুদ্ধ করার জন্য সেই পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি কীভাবে কতটা সক্রিয় ছিল আমরা যারা তা চোখে দেখেছি তার মধ্যে বেড়ে উঠেছি তারাই বোধহয় সম্যক অনুভব করতে পারি। সংবাদ-এর এইসব কৃতিত্ব দুই চার লাইনে লিখে শেষ

করা যাবে না। আমার মনে পড়ে সংবাদ ছিল সেই দুর্দিনে গণতন্ত্রের পক্ষে প্রতিক্রিয়াশীলতার বিপক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, দৃঢ়, অপ্রতিরোধ্য, অনমনীয়। আমি ভুলে গিয়েছিলাম এরকম দুঃসময়ে সেই ১৯৬৫ সালেই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বছর সংবাদ আমার একটি কবিতা, যেখানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিবাদ ছিল, সাহসের সঙ্গে ছাপে। আমার তখন তরুণ বয়স। এই কবিতার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আমি, সেই সময়ের প্রগতিশীল ছাত্রনেতা পরে বাম চিন্তাবিদ শেখর দত্ত ঊনসত্তরের ছাত্র আন্দোলনের একটি গ্রন্থ প্রকাশের জন্য নিজে পুরাতন সংবাদ ঘেঁটে এই কবিতাটি আবিষ্কার করে। এরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে সংবাদের সাহিত্যে সংবাদ-এর সংস্কৃতি চিন্তায়। বাঙালি সংস্কৃতির আজ যে বিকাশ আজ যে আধুনিক রূপ তার সবচেয়ে বড় প্রেরণাদাতা ও পোষক সংবাদ।

আমি সংবাদ-এ স্থায়ীভাবে চাকরি করিনি সত্য, কিন্তু আমি হয়তো চাকরি না করে সংবাদ-এরই ছিলাম। মনে পড়ে পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক শাসনের আমলে যখন রাতে সাংবাদিক পরিচয় পত্রের কার্ড ছাড়া চলাফেরা করা যেতো না, অধিক রাত পর্যন্ত সংবাদ-এ বজলু ভাইয়ের ঘরে বজলু ভাইয়ের সাথে থেকে কথা বলে আড্ডা দিয়ে আমার কার্ড না থাকা সত্ত্বেও সংবাদ-এর স্কুটারে বাসায় গিয়েছি। শুভাকাক্সক্ষীরা সবাই নিষেধ করেছেন। আমি বলেছি ওরা বুঝবে, আমি সংবাদ-এরই মানুষ।

সংবাদ-এ বহু প্রিয় ও আপনজন ছিল আমার। বজলু ভাই (বজলুর রহামান) তখন তিনি সংবাদ-এর সম্পাদক হননি। কিন্তু তখনো তিনি অনেক দায়িত্ব পালন করেন। কতবার কতভাবেই যে তিনি আমাকে সংবাদ-এ নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন, তা কেবল আমিই জানি। এখন বড় মনে হয় জীবনের এই মুহূর্তে যদি সংবাদ-এর সাথে জড়িয়ে থাকতাম, সেই বোধহয় হতো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। বাস্তবে তা হয়তো আর হলো না, কিন্তু আমি দূরে থেকেও খুব কাছে থাকলাম সংবাদ-এর। চিরদিন সংবাদ আমার আপন হয়ে থাকল, কতটা আপন সে কেবল ‘মনই জানে’। সংবাদ-এ ছিলেন শহীদুল্লা কায়সার, সেই তরুণ বয়সে আমি তাঁর সঙ্গে দেশের বাইরেও গিয়েছি, ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, তোহা খান, সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত, বজলু ভাইয়ের কথা তো আগেই বলেছি, আমি অন্য কাগজে কাজ করলেও বজলু ভাই আমাকে সংবাদ-এর লোক ভাবতেন, ভাবতে সুখ বোধ করতেন। আরো পরে কাশেম হুমায়ূন, কাশেম তখন সংবাদ-এর চিফ রিপোর্টার, জীবন চৌধুরী, কার্তিক চ্যাটার্জী, অল্প কিছুদিন হলো হাসান ফেরদৌস তাদের সবার সঙ্গে আমার কত যে মধুর সময় কেটেছে। নিয়মিত কলাম লিখতেন প্রবীণ সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দিন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সংবাদ লেখালেখির ক্ষেত্রে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল সেসব নিয়ে কথা বলতে কতদিন বজলু ভাই, সন্তোষদা, মোনায়েম সরকার, আমি জাফর ভাইয়ের বাসায় একত্রিত হয়েছি। এই সভায় আরো থাকতেন বাংলা একাডেমিতে চাকরি করা সত্ত্বেও শামসুজ্জামান খান ও উদয়ন ভাই (ইসমাইল মোহাম্মদ)। মোনায়েম সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সর্বদা বিশেষভাবে উদ্যোগী ও সক্রিয় ছিলেন। নানা নিপীড়ন ও নির্যাতনের মাঝেও সংবাদ, সেসময়ের আরো একটি পত্রিকা দৈনিক খবর ও সাপ্তাহিক মুক্তিবাণী বিশেষভাবে সোচ্চার থাকে। মাসিক সমকালও এই প্রতিবাদের সঙ্গে সমভাবে যুুুক্ত হয়। পত্রপত্রিকায় তখন বঙ্গবন্ধু লেখা নিষিদ্ধ, কিন্তু এই নিষেধ উপেক্ষা করে সংবাদ সাহসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখতে শুরু করে। আজ সেইসব দুঃসময়ের কথা হয়তো আমাদের অনেকেরই মনে নেই। কিন্তু এই সত্য জানি যে, সংবাদ ও সংবাদের সাহসী ব্যক্তিরা বজলু ভাই, সন্তোষ গুপ্ত, কলাম লেখার মধ্য দিয়ে জাফর ভাই কী অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন! বহুদিন এসব বিষয় আলোচনার জন্য আমরা বজলু ভাইয়ের বাসায়ও বসেছি। সকালের খাবার খেয়েছি মতিয়া আপার (বর্তমান কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী) হাতের তৈরি সুস্বাদু পিঠায়। অনেকেই জানেন না, মতিয়া আপা চমৎকার পিঠাও তৈরি করেন। সেই সময়ের এই সব ইতিহাস মতিয়া আপা আরো ভালো জানেন।

সংবাদ-এ আমি যখন সারথি নামে সপ্তাহে দুটি কলাম লিখি, তখন কতদিন যে কবির ভাইয়ের সাথে দুপুরের খাবার খেয়েছি, কবির ভাইয়ের মতো আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক মানুষ খুব কম দেখা যায়। আধুনিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞানচিন্তা ছিল তাঁর চেতনার প্রধান অংশ। এসবের সঙ্গে তিনি কখনোই আপস করেননি। সংবাদ-এর ওপর দিয়ে কত ঝড় গেছে, দুর্যোগ গেছে, আঘাত গেছে কিন্তু তিনি থেকেছেন অবিচল অটল। পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পর সংবাদ-এর পৃষ্ঠাগুলি আমাদের খুলে পড়া দরকার। এই চরম দুর্যোগের মধ্যেও কী জ্বলন্ত ভূমিকা ছিল তার! যেসব লেখা ও কবিতা আর কোথাও ছাপার উপায় ছিল না, তা প্রকাশের একমাত্র স্থান ছিল সংবাদ। পঁচাত্তরের পর আমার আলস্য প্রহর দেশপ্রেম ও আরো কিছুদিন পরে বোধহয় ‘আমি কি বলতে পেরেছিলাম’ কবিতাটিও সংবাদ-এই ছাপা হয়। অনেক কবিতা কম্পোজ করেও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ছাপা সম্ভব হয় নি। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ পাঁচ বছর পর সেই প্রতিকূল ও বৈরি পরিবেশে দেশে ফিরে আসেন। সেদিন ছিল প্রবল ঝড়বৃষ্টি, আমি নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলাম, এই লেখাটিও আমি লিখেছিলাম সংবাদ-এর জন্যেই। সংবাদ আমাদের আধুনিকতার ইতিবৃত্ত নতুন সাহিত্য ও সংস্কৃতির নতুন কবিতার উদগাতা। সংবাদ-এর সাহিত্য পৃষ্ঠাই প্রথম আধুনিক উন্নত মানের পরিচয় ধারণ করেছে। তখন থেকেই সংবাদ-এর সাহিত্য বিশেষভাবে বিদগ্ধ সমাজের মনোযোগ ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। আমার মনে পড়ে একসময় কিছুদিনের জন্য রণেশদাও এই সাহিত্যপৃষ্ঠার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। কিছুদিন বজলু ভাইও, যিনি আগাগোড়াই খেলাঘর সম্পাদনা করতেন। পরে সাহিত্য সম্পাদনার দায়িত্বে আসেন আবুল হাসনাত। তিনি নিজে শিল্পমনস্ক কবি, সর্বোতোভাবেই শিল্পানুরাগী। তার হাতে সংবাদ-এর সাহিত্য আরো ঋদ্ধ ও বিকশিত হয়ে ওঠে। সংবাদ-এর সাহিত্য এখনো এই ধারা সাফল্যের সঙ্গে বহন করে চলেছে। এখনো সংবাদ-এর সাহিত্য তার পুরনো গৌরব বহন করে যাচ্ছে। আরো স্পষ্ট করে বলা যায় সংবাদ-এর সাহিত্যপাতা আধুনিক সাহিত্য ও কবিতাচর্চার সবচেয়ে বড় বাহন। সংবাদ সাহিত্যই আমাদের দেশে সাহিত্যের নতুন সাহিত্য আন্দোলনের প্রবর্তক। সব সময় সে তরুণদের কণ্ঠস্বর, এখন বোধহয় আর একটু বেশি, সযতেœ তুলে ধরার চেষ্টা করে আসছে। সংবাদ রবীন্দ্রনাথ নজরুল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার মুখচ্ছবি পরম যতেœ ধারণ করে আছে, এই ছবি কখনো ম্লান হবার নয়। আমার বিশ্বাস সংবাদ শতাব্দীর পর শতাব্দী তার এই অনন্য ভূমিকা অক্ষুণœ রাখবে, জয়ী হবে।

image
আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
সংবাদ এবং আমার শৈশব
আমার বাতিঘর
শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা
নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
চলছে লড়াই, চলবে লড়াই
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
আমার ‘সংবাদ’
দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান
বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন
দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন
নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী
নতুন সময়ের গণমাধ্যম
‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’

মহাদেব সাহা

image

সংবাদ এদেশে এখনো গণমানুষের নিজের পত্রিকা, সর্বদাই তার পক্ষে, একই সঙ্গে সে আধুনিক বাঙালি সমাজের পূর্ণাঙ্গ দর্পণ, তার মুক্তচিন্তা অসাম্প্রদায়িকতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার বিশ্বস্ত মুখপত্র। কিন্তু সংবাদ তার আত্মপ্রকাশের সময়, যে পরিবেশে সে প্রকাশিত হয়, এই পরিচয় তার ছিল না, হওয়ার কথাও ছিল না। তখন উজিরে আজম উজিরে আলা ছদরে রিয়াছত এই পাক জবানই ছিল বেশিরভাগ সংবাদপত্র এমনকি সাহিত্যেরও ভাষা। আহমদুল কবির ও তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা খায়রুল কবির সংবাদ গ্রহণ করেই তার এই রূপ ও রূপান্তর সাধন করেন। সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক প্রগতির পক্ষে আধুনিক চিন্তার প্রকাশক ও ধারক। সংবাদই এদেশে প্রথম বাংলা নামের দৈনিক পত্রিকা, আধুনিক বাঙালি জীবনের মুখচ্ছবি। এই আধুনিকতাকে এই অগ্রসরমানতাকে বুদ্ধিচর্চার প্রসারকে আজও মর্মে ধারণ করে আছে সংবাদ, যত দুঃসময়ের মধ্য দিয়েই হোক। সংবাদ তার এই আদর্শ এই চেতনা এই অঙ্গীকার কখনোই ত্যাগ করেনি। আজীবন সংবাদের এই হচ্ছে প্রকৃত সংগ্রাম। এই সংগ্রামের জন্য তাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, সে রমরমা হয়ে উঠতে পারেনি, বিত্তে বৈভবে চাকচিক্যে মনোহরণ করার উপযোগীও হয়তো সে হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু তাতে কী! বাঙালির এমন দর্পণ আর কয়টি আছে। এই দুর্লভ অর্জনই সংবাদের কৃতিত্ব ও গৌরব। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর এদেশে সাহিত্যে ও সমাজ চিন্তায় যে আধুনিক জীবন দর্শনের প্রতিফলন ঘটে, কবিতা হয়ে ওঠে তিরিশোত্তর কবিতার মতোই আধুনিক ও উন্নত; একইভাবে সংবাদের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের সেই আধুনিকতারও বিস্তার ঘটতে থাকে। এর আগ পর্যন্ত আমাদের কবিতা ছিল পশ্চাৎমুখী, সমাজের নানা স্তরে ছিল অন্ধতা ও কুসংস্কার, সেসব বর্জনের দায়িত্ব গ্রহণ করে সংবাদ- ভাষায় বানানে বাক্য গঠনে তার পরিচয় পরিস্ফুট হয়ে আছে। আজ ৬৫ বছরেরও বেশি সময় পর তা ঠিক বুঝে ওঠা যাবে না। সংবাদ-এর সেই ভূমিকা, সংবাদ-এর সেই প্রতিবাদ, সংবাদ-এর সেই দৃঢ়তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। তখন সময় এমন ছিল না, পাকিস্তানী স্বৈরাচারী সামরিক দুঃশাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে সমাজ, নিগৃহীত হয়েছে গণতন্ত্র সকল অগ্রসরশীল চিন্তাকে রুদ্ধ করার জন্য সেই পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি কীভাবে কতটা সক্রিয় ছিল আমরা যারা তা চোখে দেখেছি তার মধ্যে বেড়ে উঠেছি তারাই বোধহয় সম্যক অনুভব করতে পারি। সংবাদ-এর এইসব কৃতিত্ব দুই চার লাইনে লিখে শেষ

করা যাবে না। আমার মনে পড়ে সংবাদ ছিল সেই দুর্দিনে গণতন্ত্রের পক্ষে প্রতিক্রিয়াশীলতার বিপক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, দৃঢ়, অপ্রতিরোধ্য, অনমনীয়। আমি ভুলে গিয়েছিলাম এরকম দুঃসময়ে সেই ১৯৬৫ সালেই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বছর সংবাদ আমার একটি কবিতা, যেখানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিবাদ ছিল, সাহসের সঙ্গে ছাপে। আমার তখন তরুণ বয়স। এই কবিতার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আমি, সেই সময়ের প্রগতিশীল ছাত্রনেতা পরে বাম চিন্তাবিদ শেখর দত্ত ঊনসত্তরের ছাত্র আন্দোলনের একটি গ্রন্থ প্রকাশের জন্য নিজে পুরাতন সংবাদ ঘেঁটে এই কবিতাটি আবিষ্কার করে। এরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে সংবাদের সাহিত্যে সংবাদ-এর সংস্কৃতি চিন্তায়। বাঙালি সংস্কৃতির আজ যে বিকাশ আজ যে আধুনিক রূপ তার সবচেয়ে বড় প্রেরণাদাতা ও পোষক সংবাদ।

আমি সংবাদ-এ স্থায়ীভাবে চাকরি করিনি সত্য, কিন্তু আমি হয়তো চাকরি না করে সংবাদ-এরই ছিলাম। মনে পড়ে পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক শাসনের আমলে যখন রাতে সাংবাদিক পরিচয় পত্রের কার্ড ছাড়া চলাফেরা করা যেতো না, অধিক রাত পর্যন্ত সংবাদ-এ বজলু ভাইয়ের ঘরে বজলু ভাইয়ের সাথে থেকে কথা বলে আড্ডা দিয়ে আমার কার্ড না থাকা সত্ত্বেও সংবাদ-এর স্কুটারে বাসায় গিয়েছি। শুভাকাক্সক্ষীরা সবাই নিষেধ করেছেন। আমি বলেছি ওরা বুঝবে, আমি সংবাদ-এরই মানুষ।

সংবাদ-এ বহু প্রিয় ও আপনজন ছিল আমার। বজলু ভাই (বজলুর রহামান) তখন তিনি সংবাদ-এর সম্পাদক হননি। কিন্তু তখনো তিনি অনেক দায়িত্ব পালন করেন। কতবার কতভাবেই যে তিনি আমাকে সংবাদ-এ নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন, তা কেবল আমিই জানি। এখন বড় মনে হয় জীবনের এই মুহূর্তে যদি সংবাদ-এর সাথে জড়িয়ে থাকতাম, সেই বোধহয় হতো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। বাস্তবে তা হয়তো আর হলো না, কিন্তু আমি দূরে থেকেও খুব কাছে থাকলাম সংবাদ-এর। চিরদিন সংবাদ আমার আপন হয়ে থাকল, কতটা আপন সে কেবল ‘মনই জানে’। সংবাদ-এ ছিলেন শহীদুল্লা কায়সার, সেই তরুণ বয়সে আমি তাঁর সঙ্গে দেশের বাইরেও গিয়েছি, ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, তোহা খান, সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত, বজলু ভাইয়ের কথা তো আগেই বলেছি, আমি অন্য কাগজে কাজ করলেও বজলু ভাই আমাকে সংবাদ-এর লোক ভাবতেন, ভাবতে সুখ বোধ করতেন। আরো পরে কাশেম হুমায়ূন, কাশেম তখন সংবাদ-এর চিফ রিপোর্টার, জীবন চৌধুরী, কার্তিক চ্যাটার্জী, অল্প কিছুদিন হলো হাসান ফেরদৌস তাদের সবার সঙ্গে আমার কত যে মধুর সময় কেটেছে। নিয়মিত কলাম লিখতেন প্রবীণ সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দিন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সংবাদ লেখালেখির ক্ষেত্রে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল সেসব নিয়ে কথা বলতে কতদিন বজলু ভাই, সন্তোষদা, মোনায়েম সরকার, আমি জাফর ভাইয়ের বাসায় একত্রিত হয়েছি। এই সভায় আরো থাকতেন বাংলা একাডেমিতে চাকরি করা সত্ত্বেও শামসুজ্জামান খান ও উদয়ন ভাই (ইসমাইল মোহাম্মদ)। মোনায়েম সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সর্বদা বিশেষভাবে উদ্যোগী ও সক্রিয় ছিলেন। নানা নিপীড়ন ও নির্যাতনের মাঝেও সংবাদ, সেসময়ের আরো একটি পত্রিকা দৈনিক খবর ও সাপ্তাহিক মুক্তিবাণী বিশেষভাবে সোচ্চার থাকে। মাসিক সমকালও এই প্রতিবাদের সঙ্গে সমভাবে যুুুক্ত হয়। পত্রপত্রিকায় তখন বঙ্গবন্ধু লেখা নিষিদ্ধ, কিন্তু এই নিষেধ উপেক্ষা করে সংবাদ সাহসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখতে শুরু করে। আজ সেইসব দুঃসময়ের কথা হয়তো আমাদের অনেকেরই মনে নেই। কিন্তু এই সত্য জানি যে, সংবাদ ও সংবাদের সাহসী ব্যক্তিরা বজলু ভাই, সন্তোষ গুপ্ত, কলাম লেখার মধ্য দিয়ে জাফর ভাই কী অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন! বহুদিন এসব বিষয় আলোচনার জন্য আমরা বজলু ভাইয়ের বাসায়ও বসেছি। সকালের খাবার খেয়েছি মতিয়া আপার (বর্তমান কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী) হাতের তৈরি সুস্বাদু পিঠায়। অনেকেই জানেন না, মতিয়া আপা চমৎকার পিঠাও তৈরি করেন। সেই সময়ের এই সব ইতিহাস মতিয়া আপা আরো ভালো জানেন।

সংবাদ-এ আমি যখন সারথি নামে সপ্তাহে দুটি কলাম লিখি, তখন কতদিন যে কবির ভাইয়ের সাথে দুপুরের খাবার খেয়েছি, কবির ভাইয়ের মতো আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক মানুষ খুব কম দেখা যায়। আধুনিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞানচিন্তা ছিল তাঁর চেতনার প্রধান অংশ। এসবের সঙ্গে তিনি কখনোই আপস করেননি। সংবাদ-এর ওপর দিয়ে কত ঝড় গেছে, দুর্যোগ গেছে, আঘাত গেছে কিন্তু তিনি থেকেছেন অবিচল অটল। পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পর সংবাদ-এর পৃষ্ঠাগুলি আমাদের খুলে পড়া দরকার। এই চরম দুর্যোগের মধ্যেও কী জ্বলন্ত ভূমিকা ছিল তার! যেসব লেখা ও কবিতা আর কোথাও ছাপার উপায় ছিল না, তা প্রকাশের একমাত্র স্থান ছিল সংবাদ। পঁচাত্তরের পর আমার আলস্য প্রহর দেশপ্রেম ও আরো কিছুদিন পরে বোধহয় ‘আমি কি বলতে পেরেছিলাম’ কবিতাটিও সংবাদ-এই ছাপা হয়। অনেক কবিতা কম্পোজ করেও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ছাপা সম্ভব হয় নি। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ পাঁচ বছর পর সেই প্রতিকূল ও বৈরি পরিবেশে দেশে ফিরে আসেন। সেদিন ছিল প্রবল ঝড়বৃষ্টি, আমি নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলাম, এই লেখাটিও আমি লিখেছিলাম সংবাদ-এর জন্যেই। সংবাদ আমাদের আধুনিকতার ইতিবৃত্ত নতুন সাহিত্য ও সংস্কৃতির নতুন কবিতার উদগাতা। সংবাদ-এর সাহিত্য পৃষ্ঠাই প্রথম আধুনিক উন্নত মানের পরিচয় ধারণ করেছে। তখন থেকেই সংবাদ-এর সাহিত্য বিশেষভাবে বিদগ্ধ সমাজের মনোযোগ ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। আমার মনে পড়ে একসময় কিছুদিনের জন্য রণেশদাও এই সাহিত্যপৃষ্ঠার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। কিছুদিন বজলু ভাইও, যিনি আগাগোড়াই খেলাঘর সম্পাদনা করতেন। পরে সাহিত্য সম্পাদনার দায়িত্বে আসেন আবুল হাসনাত। তিনি নিজে শিল্পমনস্ক কবি, সর্বোতোভাবেই শিল্পানুরাগী। তার হাতে সংবাদ-এর সাহিত্য আরো ঋদ্ধ ও বিকশিত হয়ে ওঠে। সংবাদ-এর সাহিত্য এখনো এই ধারা সাফল্যের সঙ্গে বহন করে চলেছে। এখনো সংবাদ-এর সাহিত্য তার পুরনো গৌরব বহন করে যাচ্ছে। আরো স্পষ্ট করে বলা যায় সংবাদ-এর সাহিত্যপাতা আধুনিক সাহিত্য ও কবিতাচর্চার সবচেয়ে বড় বাহন। সংবাদ সাহিত্যই আমাদের দেশে সাহিত্যের নতুন সাহিত্য আন্দোলনের প্রবর্তক। সব সময় সে তরুণদের কণ্ঠস্বর, এখন বোধহয় আর একটু বেশি, সযতেœ তুলে ধরার চেষ্টা করে আসছে। সংবাদ রবীন্দ্রনাথ নজরুল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার মুখচ্ছবি পরম যতেœ ধারণ করে আছে, এই ছবি কখনো ম্লান হবার নয়। আমার বিশ্বাস সংবাদ শতাব্দীর পর শতাব্দী তার এই অনন্য ভূমিকা অক্ষুণœ রাখবে, জয়ী হবে।