মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা

হারুন হাবীব

এই নিবন্ধে আমি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে দেশীয় সাংবাদিকতার স্বরূপ ও সংকট, যুদ্ধাঞ্চল বা রণাঙ্গনের সাংবাদিকতার বিবরণ এবং ভারতসহ পশ্চিমী দেশের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়ার চেষ্টা করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এম.এ. শেষপর্বের ছাত্র থাকাকালীন আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি, বিচরণ ক্ষেত্র ছিল ১১ নম্বর যুদ্ধ-সেক্টর, যা আমার স্মৃতির রণাঙ্গন। যুদ্ধকালীন দু’টি ক্যামেরাও হাতে পাই আমি; সে কারণে পেশাদার আলোকচিত্রী না হয়েও ঐতিহাসিক রণাঙ্গনের ছবি তোলারও সুযোগ ঘটে। একদিকে প্রিয় স্টেনগান, অন্যদিকে কলম ও ক্যামেরা হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে আমার প্রিয় সহচর।

নিবন্ধটির বিস্তৃত বয়ানের আগে একাত্তরের ঘটনাপ্রবাহের সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট তুলে ধরা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র কর্মকা- শুরু হয় কার্যত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত থেকে, যে কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে ঢাকা নগরীর বিভিন্ন অংশে হামলা চালায় এবং পরিকল্পিত বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু করে। সেদিনই মধ্যরাতে, অর্থাৎ ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর পরক্ষণেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তিনি গ্রেফতার হন এবং তাঁকে সেদিনকার পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিচারের উদ্যেশ্যে।

বলা যায়, ঠিক তখন থেকেই শুরু হয় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ, যা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধ চলে প্রথমত বিচ্ছিন্নভাবে এবং পরবর্তীতে সংঘবদ্ধভাবে। এ সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নির্বিচার বাঙালি নিধনযজ্ঞ ও নারী নির্যাতন চলতে থাকে। ফলে লাখো মানুষ দেশ ছেড়ে সীমান্তবর্তি ভারতীয় রাজ্যগুলিতে আশ্রয় নিতে থাকে, শুরু হয় মানব ইতিহাসের এক বৃহত্তম শরণার্থী সংকট।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্য এই যে, সামরিক বাহিনীর লাগাতার হস্তক্ষেপ ও গণতন্ত্রহীনতায় রাষ্ট্রের ভিত্তি উত্তরোত্তর নাজুক হতে থাকে। সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে দেশটির ২৩ বছরের যৌথ ইতিহাসের একমাত্র সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকেও সামরিক ও বেসামরিক শাষকচক্র সম্মান জানাতে ব্যর্থ হয়, ফলে পূর্ব অংশের নিপীড়িত-বঞ্ছিত বাঙালি জনতার বিদ্রোহ চূড়ান্ত ভাবে দানা বাঁধে, তারা সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

মুক্তিযুদ্ধে দেশীয় সাংবাদিকতা

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে, অর্থাৎ পাকিস্তানি আমলে, দেশীয় গণমাধ্যম ছিল মূলত সংবাদপত্র-কেন্দ্রিক, এবং মূলধারার প্রায় সব পত্রিকাগুলিই প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা নগরী থেকে। ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরুর পর সদ্য-স্বাধীনতা ঘোষিত বাংলাদেশের সকল সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যায়। ২৬ মার্চ দেশের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক বিধি জারি করে সকল গণমাধ্যমের ওপর কঠোর ‘সেন্সরসিপ’ আরোপ করে। সরকারি ছাড়পত্র ছাড়া কোনো রকম খবর মুদ্রণ বা প্রকাশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। এই আদেশ (৭৭ নম্বর সামরিক বিধি) অমান্যকারীর বিরুদ্ধে সশ্রম কারাদ-সহ বিভিন্ন কঠোর দ- নির্ধারিত হয়।

মূলত এই সামরিক ফরমান জারির মাধ্যম্যে দেশীয় সংবাদপত্রের স্বাধীন বিচরণ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা হয়। সামরিক ধারাই কেবল নয়, একের পর এক নতুন আইন ও বিধিনিষেধ চালু করা হয় সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার লক্ষ্যে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের ‘প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট’-এ (পিআইডি) বসানো হয় শক্তিশালী ‘সেন্সরসিপ সেল’, যাতে সামরিক ও বেসরকারি কর্মকর্তাগণ প্রতিটি খবর, সম্পাদকীয়, এমনকি সংবাদচিত্র পর্যন্ত সতর্কভাবে পরখ করে তারপর প্রকাশের অনুমতি দেন। সরকারি এই ‘সেন্সরসিপ’ কর্তৃপক্ষ এতোটাই নির্লজ্জ ছিল যে তারা পত্রিকাগুলির খবর ও সম্পাদকীয় নিবন্ধ-প্রবন্ধ পর্যন্ত পাল্টে দিয়েছে, বহু খবর ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছে।

দানবীয় এই ‘সেন্সরসিপ’ চলেছে মুক্তিযুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর ‘ইন্টার সার্ভিস পাবলিক রিলেসন্স’ বা ‘আইএসপিআর’-এর ঢাকা অফিস প্রধান সেনাবাহিনীর পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিক এই প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারা যখন-তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় চড়াও হয়েছেন সরেজমিনে তদারকির জন্য। কার্যত মুক্তিযুদ্ধ জুড়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে একটা ত্রাস বহাল রাখা হয়েছে।

পত্রপত্রিকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সামরিক সরকার এমন আদেশও জারি করে যে, কোনো সংবাদপত্র বা প্রচারমাধ্যম ‘জয় বাংলা’, ‘বাংলাদেশ’, ‘মুক্তিবাহিনী’, ‘মুক্তিফৌজ’- ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতে পারবে না। মুক্তি বাহিনী বা স্বাধীনতা যোদ্ধাদের বলতে হবে ‘দৃস্কৃতিকারী’, ‘ভারতীয় এজেন্ট’ কিংবা ‘ইসলামের দুষমন’। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পিতা-মাতা, পরিবার সম্পর্কে কোনো খবর প্রচার করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে এবং গণহত্যা ও ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের শরণার্থী সংক্রান্ত কোনো বিদেশি গণমাধ্যমের খবর উদ্ধৃতি করাও শক্তভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। মোটকথা, এসব বাধানিষেধের ফলে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দেশীয় পত্রপত্রিকা বা গণমাধ্যম পরিপূর্ণভাবে বন্দিত্ব বরণ করে।

২৫ ও ২৬ মার্চের বর্বরোচিত সেনা অভিযান বা গণহত্যা শুরুর পর স্বাভাবিকভাবেই দেশের অবস্থা অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনী যত্রতত্র তল্লাশি ও নির্যাতন চালাতে থাকে। নিরাপত্তার প্রশ্নে মানুষ ঢাকা নগরীসহ বড় বড় শহর ছাড়তে থাকে। এরই মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে বাঙালিদের প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অবস্থা স্বাভাবিক প্রমাণ করতে সামরিক সরকার ২৯ মার্চ ১৯৭১ থেকে ‘প্রেস ট্রাস্ট্র অব পাকিস্তান’-এর নিয়ন্ত্রণাধীন ইংরেজি দৈনিক ‘মর্নিং নিউজ’ ও ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকা দুটি পুনঃপ্রকাশ করে। প্রায় একই সময় প্রকাশ করা হয় ‘পাকিস্তান অবজারভার’, ‘পূর্বদেশ’, ‘দৈনিক আজাদ’ ও ‘দৈনিক পয়গাম’সহ অন্যান্য পত্রিকা।

বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, বিশেষত সংবাদপত্র জগতের মধ্যমণি যাঁরা, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে, প্রায় সকলেই ছিলেন পাকিস্তানি শাসকচক্রের ঘোরতর বিরোধী। এইসব সাংবাদিকদের বেশিরভাগই নিরাপত্তার প্রশ্নে হয় আত্মগোপন করেন, নয় দুর্গম পথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের মাটিতে, বিশেষত আগরতলা ও কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নিতে থাকেন। ফলে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ঘটা বাঙালি নিধনযজ্ঞ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বিচার নারী ধর্ষণ, গণহারে লুট ও ধ্বংসযজ্ঞ, কিংবা স্বাধীনতাযোদ্ধাদের সশস্ত্র তৎপরতার খবর প্রচারের কোনো সুযোগ থাকে না। দেশীয় পত্রপত্রিকাগুলি তখন পাকিস্তানের ‘অখ-তা রক্ষা’ এবং ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ এবং একই সঙ্গে ‘শত্রুদেশ’ ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে বাধ্য হয়।

মোটকথা, বাংলাদেশ বা সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের কোনো সংবাদপত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান সৈন্যদের বর্বরতা বা তাদের হাতে পরিচালিত হত্যা-নিপীড়নের খবর ছাপতে পারে নি। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে সরকারি খবর ছাড়া বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশিত হয়নি। সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান টেলিভিশন (পিটিভি) সে সময় বিনোদনমূলক প্রোগ্রামের বাইরে যেতে পারেনি।

চলমান ঘটনাপ্রবাহের এই সত্য নির্বাসন চলে ডিসেম্বর ১৬, ১৯৭১ পর্যন্ত। অথচ সাবেক পূব পাকিস্তানের এই পত্রপত্রিকাগুলিই ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত পেশাগত দক্ষতায় এবং অসীম সাহসে জাতির স্বাধিকার আন্দোলনকে সর্বাত্মক সমর্থন যুগিয়েছে। ‘ইত্তেফাক’, ‘দি পিপল’, ‘সংবাদ’, ‘পূর্বদেশ’, ‘ দৈনিক পাকিস্তান’, ‘গণবাংলা’, ‘আজাদ’ এবং ‘পাকিস্তান অবজারভার’ ঊনসত্তরের গণআন্দোলন ও ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। ষাটের দশকের সেই সাহসী সাংবাদিকতা, পুরোধা সাংবাদিকদের সেই দেশপ্রেম, সাহস ও পেশাদারিত্ব বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে বহুলাংশে বেগবান করেছে।

আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করতে না দেওয়ায় প্রতিবাদে রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেন্দ্রের সকল বাঙালি কলাকুশলি একযোগে তাঁদের কর্মস্থল থেকে বেরিয়ে আসে। অভাবিত এই প্রতিবাদে রেডিও পাকিস্তানের সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। উপায় না দেখে পাকিস্তান সরকার বাঙালি বেতারকর্মিদের সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি ৮ মার্চ রেডিও পাকিস্তান সম্প্রচার করে, ফলে সারাবিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়ে। এই সফল আন্দোলনের পর, ২৫ মার্চ পর্যন্ত (গণহত্যা শুরুর দিন পর্যন্ত), দেশের প্রধান রাজনৈতিক ঘটনার খবর সংক্ষিপ্তাকারে হলেও পরিবেশন করতে সক্ষম হয় বেতারকর্মিরা।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বাংলাদেশ ছিল অবরুদ্ধ ও রক্তাক্ত জনপদ। প্রধান বাংলা দৈনিক ‘ইত্তেফাক’ ও ‘সংবাদ’ পত্রিকার অফিসগুলিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। দৈনিক ‘গণবাংলা’ ও ‘দি পিপল’-এর অফিস ২৫ মার্চ রাতেই আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করে। ‘সংবাদ’ অফিসের আগুনে মারা যান প্রগতিশীল লেখক ও সাংবাদিক শহীদ সাবের। বন্ধ হয়ে যায় ‘স্বরাজ’, ‘আওয়াজ’ এবং ‘বাংলার বাণী’।

জামাতে ইসলামীর মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’ এবং ‘পয়গাম’-এর মতো এক-দুটি ব্যতিক্রম ছিল, যারা পাকিস্তানের পক্ষ ধারণ করে নারকীয় সামরিক বর্বরতাকে সমর্থন জুগিয়েছে। এসব পত্রিকা বাঙালি গণহত্যা ও নারী নির্যাতনকেও সমর্থন করেছে।

কিন্তু ইত্যকার বাধানিষেধের পরও কিছু কিছু পত্রিকা সুকৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতার খবর প্রচার করার চেষ্টা করেছে। যেমন ‘সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী’ হতো, কিংবা ‘ইসলামের দুষমণ’-এর সঙ্গে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর যুদ্ধ, ‘ভারতীয় দুষ্কৃতকারী’দের হাতে ‘অন্তর্ঘাতমূলক’ কর্মকা-- ইত্যাদি ধরনের হেডলাইন করেছে তারা। ফলে দেশবাসীর জানতে বাকি থাকেনি মুক্তি বাহিনীর যোদ্ধারা তৎপরতা জোরদার করছে এবং পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠছে।

তবে দুশো ছেষট্টি দিনের এই বন্দিত্বের বাঁধন টুটে যায় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, যেদিন বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমা- নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশের প্রতিটি সংবাদপত্র এবং বেতার-টিভি পরিপূর্ণ আবেগে সে ঘটনার ছবি ও খবর পরিবেশন করে। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই গোটা বাংলাদেশে প্রায় তিন শত দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যারা পরিপূর্ণ আবেগ এবং বস্তুনিষ্ঠতায় সদ্য-সমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে খবর, মন্তব্য, ফিচার ও ছবি প্রকাশ করে। নয় মাস অবরুদ্ধ বা বন্দি থাকার পর ১৬ ডিসেম্বর পরবর্তীকালের এই বিষ্ফোরণ এই জনপদের আরেক ইতিহাস।

রণাঙ্গনের সংবাদপত্র

মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকতার আরও একটি বিশেষ দিক উল্লেখের দাবি রাখে। বিভিন্ন মুক্তাঞ্চল ও সীমান্তবর্তি ভারতীয় এলাকা থেকে অসংখ্য পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে। আমার বিশ্বাস, প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রগুলি সরকারি বাধানিষেধ এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে যে-কাজটি করতে পারে নি, সে কাজটি সম্পন্ন করেছে সীমান্ত অঞ্চল থেকে প্রকাশিত অনিয়মিত এই প্রকাশনাগুলি। এ কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের নিষ্ঠাবান সহযোগীর কাজ, যা স্বাধীনতাকামীদের মনোবল বাড়িয়েছে এবং বিশ্ববাসীর সামনে বাঙালিকে আরেকবার আধুনিক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

একটি যুদ্ধে সমরাস্ত্র যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালাবার লক্ষ্যে প্রচারযন্ত্র। সে-কারণে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকারের নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’, যার পত্তন ঘটে চট্টগ্রামে কয়েকজন সাহসী বেতারকর্মির উদ্যোগে। পরবর্তিতে আগরতলা এবং কলকাতা থেকে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত এই বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম চলতে থাকে। বলাই বাহুল্য, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

মুজিবনগর সরকারের উদ্যোগে নিয়মিত প্রকাশিত হয় ‘জয় বাংলা’ সাপ্তাহিক, যা ছিল যুদ্ধকালীন সরকার বা আওয়ামী লীগের মুখপত্র। প্রকাশনাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যতম প্রধান দেশীয় সংবাদপত্রে পরিণত হয়। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই দুটি গণমাধ্যমের সঙ্গে রণাঙ্গণ থেকে যুক্ত থাকার। মুক্তিযুদ্ধে একজন গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করেও যুদ্ধ সাংবাদিকতার সাথে সামান্য যে যোগাযোগ- তা ব্যক্তি-জীবনের এক বড় সঞ্চয় আমার। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে আসাম হয়ে ত্রিপুরা পর্যন্ত চলতে হয়েছে, রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে ঘুরে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে হয়েছে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ ও ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার জন্যে। প্রচারপত্র লিখে ছাপিয়ে আনতে হয়েছে দূর-দূরান্ত, এমনকি আসামের গৌহাটি থেকে। কারণ নিরাপত্তাজনিত কারণে দেশীয় ছাপাখানা ব্যবহার করার সুযোগ ছিলো না তখন।

‘জয় বাংলা’ পত্রিকাটির সম্পাদক ম-লীর সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগের আব্দুল মান্নান, এমএনএ, যিনি মুজিবনগর সরকারের তথ্য, জনসংযোগ ও প্রচার বিভাগের প্রধান ছিলেন। যুদ্ধকালীন কৌশলগত কারণে পত্রিকায় তাঁর নাম ছাপা হয়েছে ‘আহমদ রফিক’। কাগজটি ছাপা হয়েছে কলকাতা থেকে। বিতরণ করা হয়েছে সীমান্তের শরণার্থী শিবিরসহ দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে। ‘জয় বাংলা’য় থাকতো যুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকারের কর্মকা-, যুদ্ধের অগ্রগতি, প্রচারধর্মী খবর, সংবাদ বিশ্লেষণ, প্রবন্ধ, ফিচার, কবিতা এবং যুদ্ধ-পরিস্থিতির মূল্যায়ন। আরও ছাপা হয়েছে পাকিস্তানি হত্যানির্যাতন ও প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর এবং দেশ-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনের সংবাদ। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টর কমান্ড, মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থী, কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম, বিএসএফ-এর জনসংযোগ বিভাগ- ইত্যাদি ছিল ‘জয় বাংলা’র মূল সংবাদসূত্র। এছাড়াও ভারত সরকার, বিবিসি, আকাশবাণী, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআই ও ইউএনআই, একই সঙ্গে সোভিয়েত বার্তা সংস্থা ‘তাস’ থেকে প্রয়োজনে বিভিন্ন খবর নেয়া হতো।

নিজের আগ্রহী সংগ্রহ, পরবর্তীকালের অনুসন্ধান ও দলিলপত্র থেকে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে প্রায় ৭০টি পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্যমান সময়ে এগুলির প্রকাশ সহজসাধ্য ছিলোনা। অর্থ ও কাগজের অপ্রতুলতা, প্রয়োজনীয় জনবল, ছাপাখানা ও আনুষঙ্গিক সুযোগসুবিধার অভাব এবং বিদ্যমান যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে প্রকাশনাগুলিকে টিকিয়ে রাখা রীতিমতো কঠিন ছিল। সে কারণে এদের বেশিরভাগই নিয়মিত হতে পারেনি। অনেকক্ষেত্রে পত্রিকা জগতের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও- রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, ছাত্র, সাধারণ কর্মজীবী হয়েও- এসব উদ্যোক্তাগণ পত্রিকা প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে নিজেদের দেশপ্রেম প্রকাশ করেছেন। এসব পত্রপত্রিকা কেবল সময়ের আবেগি চাহিদা মিটিয়েছে বললে ভুল বলা হবে, তারা যুদ্ধরত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের দিকেও নজর রেখেছে।

বিভিন্ন যুদ্ধাঞ্চল থেকে গোপনেও বেশ কিছু পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। এগুলি কোনোটি হাতের লেখা এবং সাইক্লোস্টাইলে ছাপা। এসব প্রকাশনার সিংহভাগ সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক; কয়েকটি দৈনিকও ছিল। এগুলির সবই মানোতীর্ণ ছিল বলা যাবে না, তবে এরা সময়ের গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা পূরণ করেছে।

আবার দেখা যায়, ‘জয় বাংলা’, ‘বাংলাদেশ’, ‘সোনার বাংলা’, ‘স্বাধীন বাংলা’- ইত্যাদি নামে একাধিক পত্রিকা বেরিয়েছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। এগুলির কিছু কিছু আবার মুজিবনগর সরকার থেকে নিবন্ধিতও হয়েছে। এদের পাঠক ছিলেন মূলত শরণার্থী ক্যাম্পগুলিতে আশ্রিত দেশত্যাগি মানুষ, মুক্তি বাহিনীর সদস্য ও মুক্তাঞ্চলসহ দেশের অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ মানুষ। গেরিলা দলগুলি যখন দেশের অভ্যন্তরে গেছে তখন তাদের হাতে এইসব পত্রিকার কপি পাঠানো হয়েছে। ফলে যুদ্ধের গতি প্রকৃতি ও সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষ জানতে পেরেছে।

আমার জানা মতে, কোনো জাতির মুক্তিযুদ্ধে, কিংবা কোনো যুদ্ধে, এত বিপুল সংখ্যক পত্রপত্রিকা কোনোকালে, কোনো ভূখ-ে প্রকাশিত হয়নি। বলাই বাহুল্য, সুবিশাল জাতীয় দুর্যোগেও এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশনাগুলি বাঙালিকে নতুন করে আধুনিক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এসব প্রতিটি প্রকাশনার পেছনে ছিল পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারী মানুষদের আবেগ ও দেশপ্রেম। এরা কেবল সময়ের আবেগি চাহিদা মিটিয়েছে বললে ভুল বলা হবে, যুদ্ধরত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের দিকেও নজর রেখেছে।

মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকতায় নিজের অংশগ্রহণ, ব্যক্তিগত সংগ্রহ ও বিভিন্ন দলিল ও প্রকাশনা থেকে এই রণাঙ্গন পত্রপত্রিকাগুলির নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আমি এ সংক্রান্ত একটি পুস্তকে সম্প্রতি লিপিবদ্ধ করেছি। তবে এই তালিকা পূর্ণাঙ্গ নয় বলেই আমার বিশ্বাস। অন্যদিকে এসব পত্রপত্রিকার নামও সময়ের চাহিদাকে পূরণ করেছে। যেমন- বিপ্লবী বাংলাদেশ, বাংলার বাণী, বঙ্গবাণী, রণাঙ্গন, সংগ্রামী বাংলা, বাংলার মুখ, সোনার বাংলা, জন্মভূমি, মুক্তবাংলা, স্বদেশ, দাবানল, সংগ্রামী বাংলা, অগ্রদূত, স্বাধীন বাংলা, জাগ্রত বাংলা, দেশ বাংলা, মায়ের ডাক, মুক্তি, দুর্জয় বাংলা, অভিযান, আমার দেশ, নতুন বাংলা, মুক্তিযুদ্ধ, অমর বাংলা, অনির্বাণ, ইশতেহার, উত্তাল পদ্মা, গণমুক্তি, গ্রেনেড, ধুমকেতু, বঙ্গবাণী, বাংলার কথা, বাংলার ডাক, রণাঙ্গন, লড়াই, স্বদেশ, স্বাধীনবাংলা, স্বাধীন বাংলা, সন্দ্বীপ থেকে ধলেশ্বরী ইত্যাদি।

এ ছাড়াও ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে The Nation, The People I Bangladesh Bulletin বিভিন্ন পশ্চিমী দেশ থেকে প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগেও বেশ কিছু পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে।

বিশ্ব গণমাধ্যম

পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমনের ছয়-দফা, ছাত্র সমাজের ১১ দফা এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিবাদে বাঙালি জনতার অবিস্মরণীয় গণবিস্ফোরণ ঘটে ১৯৬৯ সালে। প্রভাবশালী বিশ্ব গণমাধ্যমগুলি পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহের ওপর বেশি করে নজর রাখতে থাকে মূলত তখন থেকেই। এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় দক্ষিণাঞ্চলের ভয়ংকর গোর্কির তা-বের প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের হৃদয়হীন উদাসীনতা। ১৯৭০ সালের সেই ঘূর্ণিঝড়ে পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যায়, পূর্ববঙ্গের দক্ষিণাঞ্চল ধংসস্তূপে পরিণত হয়। কিন্তু দেশের সরকারের কাছে এই ধংসযজ্ঞ গুরুত্ব লাভ করে না। ফলে গণঅসন্তোষ আরও বেড়ে যায়।

তীব্র গণঅভ্যুত্থানে ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। ক্ষমতায় আসেন নতুন জেনারেল, ইয়াহিয়া খান। নতুন সামরিক প্রেসিডেন্ট, পরিস্থিতি সামলাবার কৌশলে, দেশে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কেবলই পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে না, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানের দুষ্ট রাজনৈতিক চক্র কোনো বাঙালির হাতে দেশের শাসনভার ন্যস্ত না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এতে পরিস্থিতি আরেক দফা উত্তপ্ত হয়। এরই মধ্যে ইয়াহিয়া খান ও সেনাবাহিনী শেখ মুজিব ও বাঙালি জাতিকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর অতর্কিতে এবং সর্বাত্মক আগ্রাসন চালায় দেশের সশস্ত্র বাহিনী, যাতে একমাত্র ঢাকা নগরীতেই হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়।

এই নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ বিশ্ব গণমাধ্যমের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ঢাকা নগরীতে ২৫-২৬ মার্চের ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ চালাবার সময় কয়েক ডজন বিদেশি সাংবাদিক ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞের খবর ও ছবি যেন ধামাচাঁপা দেওয়া যায় সে লক্ষে সামরিক কতৃপক্ষ সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা ২৫ মার্চ রাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ গিয়ে সব বিদেশি সাংবাদিককে পাকড়াও করে, তাদের জোড় করে দেশ থেকে বের করে দেয়। এরপরও কয়েকজন সাংবাদিক লুকিয়ে থেকে গণহত্যার খবর ও ছবি সংগ্রহ করেন। এরপর জীবন বিপন্ন করে তারা দেশের বাইরে চলে যান এবং বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর এবং নিরস্ত্র মানুষের ওপর সামরিক অভিযানের খবর প্রকাশ করেন।

ভারতীয় গণমাধ্যম

নারকীয় পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞ ও বাঙালি প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর প্রচারের ক্ষেত্রে বেশি অবদান রাখে ভারতের সংবাদপত্র এবং রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত আকাশবাণী রেডিও। দেশটির প্রতিটি অঞ্চলের প্রতিটি সংবাদপত্র কার্যত স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের সংবাদপত্রে পরিণত হয়। প্রথাগত সাংবাদিকতার বাইরে গিয়ে তারা পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলে এবং বাংলাদেশের জাতীয় যুদ্ধকে নিজেদের নৈতিক যুদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

কলকাতার প্রধান বাংলা দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘যুগান্তর’, ‘দৈনিক বসুমতি’, ‘দৈনিক সত্যযুগ’, ‘দৈনিক কালান্তর’, ‘গণবার্তা’, ‘দেশ’ সাময়িকী, ইংরেজি ‘দি স্টেট্সম্যান’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’সহ পান্নালাল দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘কম্পাস’; নতুন দিল্লির ইংরেজি পত্রিকা ‘টাইমস্ অব ইন্ডিয়া’, ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’; মাদ্রাজ বা চেন্নাই-এর প্রধান দৈনিক ‘দি হিন্দ’ আসামের ‘আসাম ট্রিবুন’, মেঘালয়ের ‘শিলং টাইমস’; বোম্বে বা মুম্বাই-এর ‘ব্লিৎস’, ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’; ত্রিপুরার প্রধান ‘দৈনিক সংবাদ’- এর ভূমিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে এসব জাতীয় ও আঞ্চলিক ভারতীয় পত্রিকাগুলি মুক্তিবাহিনী ও প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে সর্বাত্মক সমর্থন জুগিয়ে গেছে। তারা অকুণ্ঠচিত্তে বাংলাদেশের গণমানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সংবাদ সংস্থা ‘প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া’ বা ‘পিটিআই’ এবং ‘ইউনাইটেড নিউজ অব ইন্ডিয়া’ বা ‘ইউএনআই’ ব্যাপকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সংবাদ সরবরাহ করেছে। ‘আকাশবাণী’ কলকাতা কেন্দ্রের প্রাত্যহিক বাংলা সংবাদ ও ‘সংবাদ পর্যালোচনা’ মুক্তি বাহিনী ও বাংলাদেশের মানুষের মনোবল বাড়িয়েছে বহুগুণ।

১৯৭১ সালে ক্ষুদ্র ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরা হয়ে ওঠে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্ব গণমাধ্যমের কাছে আগরতলা হয়ে ওঠে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ‘ডেটলাইন’। যে-ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ লক্ষ, সেই ত্রিপুরাকে ঠাঁই দিতে হয় সেদিন ১৪ লাখের ওপর বাংলাদেশের শরণার্থী।

সেদিনের ত্রিপুরায় মূল পত্রিকা ‘দৈনিক সংবাদ’, সম্পাদক ভূপেন দত্ত ভৌমিক। এ কাগজটি সকল অর্থেই ত্রিপুরায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান দৈনিকে পরিণত হয়। আগরতলা থেকে ‘সাপ্তাহিক সমাচার’ নামে আরও একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যার সম্পাদক ছিলেন বাংলাদেশ অন্তপ্রাণ অনিল ভট্টাচার্য। টেবলয়েড সাইজের এই কাগজটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের জোরালো সমর্থক। তখনকার প্রধান বিরোধী দল সিপিআই (এম-এল)-এর মুখপত্র ‘দেশের কথা’ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। এ ছাড়াও ‘জাগরণ’ ও ‘দৈনিক গণরাজ’ পত্রিকা দুটির ভূমিকার প্রসংশাযোগ্য। ঠিক একইভাবে আসামের প্রধান ইংরেজি দৈনিক ‘আসাম ট্রিব্যুন’ এবং মেঘালয়ের দৈনিক ‘শিলং টাইম্স’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এখানে দু’জন ভারতীয় সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন, যাঁরা অবরুদ্ধ বাংলাদেশে এসে আর ঘরে ফিরে যাননি। এই দুই তরুণ ভারতীয় সাংবাদিকের একজন সুরজিৎ ঘোষাল, অন্যজন দীপক ব্যানার্জি। এঁরা নিজেদের পরিচয় গোপন করে যুদ্ধরত বাংলাদেশে প্রবেশ করেন গণহত্যার খবর সংগ্রহ করতে। বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে ঘুরে পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচারের ছবি ও খবর সংগ্রহ করেন। এক সময় কুমিল্লাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং নৃশংসভাবে তাঁরা নিহত হন।

পশ্চিমী সংবাদপত্র

যুক্তরাষ্ট্রের সরকার মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ ধারণ করে। কিন্তু দেশটির প্রধান গণমাধ্যমগুলি পাকিস্তানি গণহত্যা বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এছাড়াও ব্রিটেন, ফ্রান্স, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, হাঙ্গেরী, যুগোস্লাভিয়া, জাপান, জার্মানি, কানাডা, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সোভিয়েত সংবাদ সংস্থা ‘তাস’ বাংলাদেশের ঘটনাবলি নিয়ে ব্যাপক ও নিয়মিতভাবে রিপোর্ট করে।

পশ্চিমা বিশ্বের খ্যাতিমান যে-কাগজগুলি পাকিস্তানি বর্বরতাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে সমর্থন গড়ে তুলে, তাদের অন্যতম- ‘নিউইয়র্ক টাইমস’, ‘গার্ডিয়ান’, ‘সানডে টাইমস’, ‘নিউ স্টেটসম্যান’, ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’, ‘দি ইকোনমিস্ট’; ‘ইভিনিং স্টার’, বোস্টন গ্লোব’, ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’. ‘লস এঞ্জেলস্ টাইম্স’, ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ‘টাইম ম্যাগাজিন’ ও ‘নিউজউইক’। হংকং-এর ‘ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ’ পত্রিকাটিও বিশেষ ভূমিকা রাখে। লন্ডনের ‘বিবিসি- বাংলা সার্ভিস’ অসামান্য ভূমিকা রাখে। কার্যত ১৯৭১ সালের ভূমিকার কাণেই বাংলাদেশের শ্রোতাদের কাছে বিবিসি একটি বহুল পরিচিত গণমাধ্যমে পরিণিত হয়।

এ ছাড়াও নেপালের ‘রাইজিং স্টার’, ‘সিঙ্গাপুরের ‘নিউ নেশান’, যুগোস্লাভিযার ‘দি কমিউনিস্ট’, অস্ট্রেলিয়ার ‘দি এ্যজ’, ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’-এর ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। ‘লাইফ’ ম্যাগাজিন বাংলাদেশের ওপর বিশেষ প্রতিবেদন ছাপে। সরকারি অবস্থানের কারণে কমিউনিস্ট চীন ও আরব দুনিয়ার গণমাধ্যমগুলি ছিল পাকিস্তানের সমর্থক।

পশ্চিমি সাংবাদিকদের মধ্যে যাঁরা বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহসহ মুক্তিযুদ্ধের দৈনন্দিন কর্মকা- সরাসরি রিপোর্ট করেছেন তাঁদের অন্যতম সিডনি শ্যনবার্গ, ডেন কগিন, সাইমন ড্রিং, কলিন স্মিথ, পিটার হেজেলহার্স্ট, টনি ক্লিফটন, মাইকেল লোরাঁ (Laurent), মার্ক টালি, আরনল্ড জেটলিন, সিরিল জন, মিশেল রবার্ট, লুই হেরেন, নিকলাস টমালিন, ডিটার আর কান ও পিটার আর হেনরিস।

মার্কিন সাংবাদিক আর্নল্ড জেটলিন বার্তা সংস্থা এপি-র প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর সামরিক অভিযানের অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী। ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের ডেন কগিনকে ২৫ মার্চ রাতে সামরিক কতৃপক্ষ জোড় করে বেব করে দেয়। এরপর তিনি ভারতের মাটি হয়ে পুনরায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে নবগঠিত মুক্তি বাহিনীর ওপর বিস্তারিত প্রতিবেদন লেখেন। তাঁর লেখা ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের ১৯ এপ্রিল ১৯৭১-এর ‘দ্য ব্যাটেল অব কুষ্টিয়া’ প্রতিবেদনটি ছিল সাড়া জাগানো।

লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর তরুণ প্রতিবেদক সাইমন ড্রিং ৬ মার্চ, ১৯৭১ পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি রিপোর্ট করতে ঢাকায় আসেন। ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরু সাথে সাথে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকা থেকে বিদেশি সাংবাদিককে জোড় করে বের করে দিলেও তিনি ঢাকার ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের ছাদে এপি’র ফটোগ্রাফার মাইক্যাল লোঁরার সঙ্গে কোনোভাবে লুকিয়ে থাকেন। এরপর এই দুজন সম্ভাব্য বিপদ উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য এলাকায়, যেখানে সৈন্যরা গণহত্যা চালিয়েছে, সেখানে যান এবং ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করেন। সাইমন ড্রিং তাঁর পত্রিকার জন্য এরপর একটি বিস্তারিত রিপোর্ট লেখেন, যা ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত হয় ৩০ মার্চ ১৯৭১। ড্রিং-এর “God and a united Pakistan” রিপোর্টটি ছিল বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর প্রথম কোনো পশ্চিমী সাংবাদিকের ব্যাপক-ভিত্তিক রিপোর্ট।

এছাড়াও এন্থনি ম্যাসকারানহাসের সাহসী ভূমিকার কথা সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করতে হবে। এই পাকিস্তানি সাংবাদিক করাচির ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সামরিক সরকার পাকিস্তানের ৮ জন সাংবাদিককে তাদের পক্ষে লেখার জন্য ১০ দিনের এক সফরে ঢাকায় নিয়ে আসে এপ্রিল মাসে। কিন্তু সরেজমিন পর্যবেক্ষণের পর মাসকারনাহাস বিবেকের দংশনে ভুগতে থাকেন এবং ১৮ মে ঢাকা থেকে লন্ডন পালিয়ে যান। তিনি ‘সানডে টাইমস্’ পত্রিকার সম্পাদক হেরাল্ড ইভান্সের সঙ্গে দেখা করেন এবং নিজের অভিজ্ঞতার বর্ননা দেন। বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে Genocide শিরনামে ‘সানডে টাইম্স’-এ ১৩ জুন ১৯৭১ তাঁর বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা বিশেষভাবে বিশ্ব বিবেক নাড়িয়ে দেয়।

মুক্তিযুদ্ধের শহীদ সাংবাদিক

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দেশীয় অনুচরদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন অনেক কৃতি সাংবাদিক। এঁদের মধ্যে নিষ্ঠুর পন্থায় সর্বপ্রথম শহীদ হন দৈনিক ‘সংবাদ’-এর শহীদ সাবের। এরপর ‘বিবিসি’র সংবাদদাতা নিজামুদ্দিন আহমদ, ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন, বার্তা সংস্থা ‘পিপিআই’-এর চীফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হক, ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকার গোলাম মোস্তফা, ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এর খন্দকার আবু তালেব, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও ‘দৈনিক সংবাদ’-এর অন্যতম কর্ণধার শহীদুল্লা কায়সার। এঁদেরকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আরও কয়েকজন সাংবাদিককে আলবদর ও রাজাকার বাহিনী তুলে নিয়ে যায় এবং পর্যায়ক্রম তাঁদের হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধ ও গণমাধ্যম সংক্রান্ত আমার সাম্প্রতিক একটি গ্রন্থ আমি সেইসব বরেণ্য শহীদ সাংবাদিকদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদন করেছি।

image
আরও খবর
বাংলা নামের প্রথম দৈনিক
বাংলাদেশকেও সাবধানে পা ফেলতে হবে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতা
সংবাদ এবং আমার শৈশব
আমার বাতিঘর
শিক্ষার বিবর্তন কিংবা বিবর্তনের শিক্ষা
নয়া মাধ্যম: মিডিয়া ডায়েট ব্যক্তির স্বাধীনতা
সংবাদ-এর ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা
চলছে লড়াই, চলবে লড়াই
গণমাধ্যমের শক্তি ১৯৭১
সংবাদ ও রণেশ দাশগুপ্ত
আমার ‘সংবাদ’
দৈনিক সংবাদ আমার প্রতিষ্ঠান
বিভাগোত্তর কালে দুই বাংলায় গণমাধ্যমের বিবর্তন
দুর্ভিক্ষের পীড়া ও রবীন্দ্রনাথ
সংবাদ ও অর্থনীতি
ভবিষ্যতের গণমাধ্যম গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ
মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা
দুটি কবিতা : আহমদ সলীম
গোলাম কিবরিয়া পিনু
সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলা গানের বিবর্তন
নারীর মনোজগৎ: আমাদের বিভ্রম ও কল্পকাহিনী
নতুন সময়ের গণমাধ্যম
‘সংবাদ’ শুধু একটি সংবাদপত্র নয়
গৌরব এবং গর্বের সংবাদ
গণমাধ্যম কেবল আশার স্বপ্ন নয়
গণমানুষের নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ’
মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতা

বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২

মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতা

হারুন হাবীব

image

এই নিবন্ধে আমি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে দেশীয় সাংবাদিকতার স্বরূপ ও সংকট, যুদ্ধাঞ্চল বা রণাঙ্গনের সাংবাদিকতার বিবরণ এবং ভারতসহ পশ্চিমী দেশের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়ার চেষ্টা করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এম.এ. শেষপর্বের ছাত্র থাকাকালীন আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি, বিচরণ ক্ষেত্র ছিল ১১ নম্বর যুদ্ধ-সেক্টর, যা আমার স্মৃতির রণাঙ্গন। যুদ্ধকালীন দু’টি ক্যামেরাও হাতে পাই আমি; সে কারণে পেশাদার আলোকচিত্রী না হয়েও ঐতিহাসিক রণাঙ্গনের ছবি তোলারও সুযোগ ঘটে। একদিকে প্রিয় স্টেনগান, অন্যদিকে কলম ও ক্যামেরা হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে আমার প্রিয় সহচর।

নিবন্ধটির বিস্তৃত বয়ানের আগে একাত্তরের ঘটনাপ্রবাহের সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট তুলে ধরা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র কর্মকা- শুরু হয় কার্যত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত থেকে, যে কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে ঢাকা নগরীর বিভিন্ন অংশে হামলা চালায় এবং পরিকল্পিত বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু করে। সেদিনই মধ্যরাতে, অর্থাৎ ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর পরক্ষণেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তিনি গ্রেফতার হন এবং তাঁকে সেদিনকার পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিচারের উদ্যেশ্যে।

বলা যায়, ঠিক তখন থেকেই শুরু হয় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ, যা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধ চলে প্রথমত বিচ্ছিন্নভাবে এবং পরবর্তীতে সংঘবদ্ধভাবে। এ সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নির্বিচার বাঙালি নিধনযজ্ঞ ও নারী নির্যাতন চলতে থাকে। ফলে লাখো মানুষ দেশ ছেড়ে সীমান্তবর্তি ভারতীয় রাজ্যগুলিতে আশ্রয় নিতে থাকে, শুরু হয় মানব ইতিহাসের এক বৃহত্তম শরণার্থী সংকট।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্য এই যে, সামরিক বাহিনীর লাগাতার হস্তক্ষেপ ও গণতন্ত্রহীনতায় রাষ্ট্রের ভিত্তি উত্তরোত্তর নাজুক হতে থাকে। সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে দেশটির ২৩ বছরের যৌথ ইতিহাসের একমাত্র সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকেও সামরিক ও বেসামরিক শাষকচক্র সম্মান জানাতে ব্যর্থ হয়, ফলে পূর্ব অংশের নিপীড়িত-বঞ্ছিত বাঙালি জনতার বিদ্রোহ চূড়ান্ত ভাবে দানা বাঁধে, তারা সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

মুক্তিযুদ্ধে দেশীয় সাংবাদিকতা

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে, অর্থাৎ পাকিস্তানি আমলে, দেশীয় গণমাধ্যম ছিল মূলত সংবাদপত্র-কেন্দ্রিক, এবং মূলধারার প্রায় সব পত্রিকাগুলিই প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা নগরী থেকে। ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরুর পর সদ্য-স্বাধীনতা ঘোষিত বাংলাদেশের সকল সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যায়। ২৬ মার্চ দেশের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক বিধি জারি করে সকল গণমাধ্যমের ওপর কঠোর ‘সেন্সরসিপ’ আরোপ করে। সরকারি ছাড়পত্র ছাড়া কোনো রকম খবর মুদ্রণ বা প্রকাশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। এই আদেশ (৭৭ নম্বর সামরিক বিধি) অমান্যকারীর বিরুদ্ধে সশ্রম কারাদ-সহ বিভিন্ন কঠোর দ- নির্ধারিত হয়।

মূলত এই সামরিক ফরমান জারির মাধ্যম্যে দেশীয় সংবাদপত্রের স্বাধীন বিচরণ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা হয়। সামরিক ধারাই কেবল নয়, একের পর এক নতুন আইন ও বিধিনিষেধ চালু করা হয় সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার লক্ষ্যে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের ‘প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট’-এ (পিআইডি) বসানো হয় শক্তিশালী ‘সেন্সরসিপ সেল’, যাতে সামরিক ও বেসরকারি কর্মকর্তাগণ প্রতিটি খবর, সম্পাদকীয়, এমনকি সংবাদচিত্র পর্যন্ত সতর্কভাবে পরখ করে তারপর প্রকাশের অনুমতি দেন। সরকারি এই ‘সেন্সরসিপ’ কর্তৃপক্ষ এতোটাই নির্লজ্জ ছিল যে তারা পত্রিকাগুলির খবর ও সম্পাদকীয় নিবন্ধ-প্রবন্ধ পর্যন্ত পাল্টে দিয়েছে, বহু খবর ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছে।

দানবীয় এই ‘সেন্সরসিপ’ চলেছে মুক্তিযুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর ‘ইন্টার সার্ভিস পাবলিক রিলেসন্স’ বা ‘আইএসপিআর’-এর ঢাকা অফিস প্রধান সেনাবাহিনীর পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিক এই প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারা যখন-তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় চড়াও হয়েছেন সরেজমিনে তদারকির জন্য। কার্যত মুক্তিযুদ্ধ জুড়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে একটা ত্রাস বহাল রাখা হয়েছে।

পত্রপত্রিকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সামরিক সরকার এমন আদেশও জারি করে যে, কোনো সংবাদপত্র বা প্রচারমাধ্যম ‘জয় বাংলা’, ‘বাংলাদেশ’, ‘মুক্তিবাহিনী’, ‘মুক্তিফৌজ’- ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতে পারবে না। মুক্তি বাহিনী বা স্বাধীনতা যোদ্ধাদের বলতে হবে ‘দৃস্কৃতিকারী’, ‘ভারতীয় এজেন্ট’ কিংবা ‘ইসলামের দুষমন’। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পিতা-মাতা, পরিবার সম্পর্কে কোনো খবর প্রচার করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে এবং গণহত্যা ও ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের শরণার্থী সংক্রান্ত কোনো বিদেশি গণমাধ্যমের খবর উদ্ধৃতি করাও শক্তভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। মোটকথা, এসব বাধানিষেধের ফলে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দেশীয় পত্রপত্রিকা বা গণমাধ্যম পরিপূর্ণভাবে বন্দিত্ব বরণ করে।

২৫ ও ২৬ মার্চের বর্বরোচিত সেনা অভিযান বা গণহত্যা শুরুর পর স্বাভাবিকভাবেই দেশের অবস্থা অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনী যত্রতত্র তল্লাশি ও নির্যাতন চালাতে থাকে। নিরাপত্তার প্রশ্নে মানুষ ঢাকা নগরীসহ বড় বড় শহর ছাড়তে থাকে। এরই মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে বাঙালিদের প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অবস্থা স্বাভাবিক প্রমাণ করতে সামরিক সরকার ২৯ মার্চ ১৯৭১ থেকে ‘প্রেস ট্রাস্ট্র অব পাকিস্তান’-এর নিয়ন্ত্রণাধীন ইংরেজি দৈনিক ‘মর্নিং নিউজ’ ও ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকা দুটি পুনঃপ্রকাশ করে। প্রায় একই সময় প্রকাশ করা হয় ‘পাকিস্তান অবজারভার’, ‘পূর্বদেশ’, ‘দৈনিক আজাদ’ ও ‘দৈনিক পয়গাম’সহ অন্যান্য পত্রিকা।

বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, বিশেষত সংবাদপত্র জগতের মধ্যমণি যাঁরা, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে, প্রায় সকলেই ছিলেন পাকিস্তানি শাসকচক্রের ঘোরতর বিরোধী। এইসব সাংবাদিকদের বেশিরভাগই নিরাপত্তার প্রশ্নে হয় আত্মগোপন করেন, নয় দুর্গম পথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের মাটিতে, বিশেষত আগরতলা ও কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নিতে থাকেন। ফলে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ঘটা বাঙালি নিধনযজ্ঞ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বিচার নারী ধর্ষণ, গণহারে লুট ও ধ্বংসযজ্ঞ, কিংবা স্বাধীনতাযোদ্ধাদের সশস্ত্র তৎপরতার খবর প্রচারের কোনো সুযোগ থাকে না। দেশীয় পত্রপত্রিকাগুলি তখন পাকিস্তানের ‘অখ-তা রক্ষা’ এবং ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ এবং একই সঙ্গে ‘শত্রুদেশ’ ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে বাধ্য হয়।

মোটকথা, বাংলাদেশ বা সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের কোনো সংবাদপত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান সৈন্যদের বর্বরতা বা তাদের হাতে পরিচালিত হত্যা-নিপীড়নের খবর ছাপতে পারে নি। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে সরকারি খবর ছাড়া বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশিত হয়নি। সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান টেলিভিশন (পিটিভি) সে সময় বিনোদনমূলক প্রোগ্রামের বাইরে যেতে পারেনি।

চলমান ঘটনাপ্রবাহের এই সত্য নির্বাসন চলে ডিসেম্বর ১৬, ১৯৭১ পর্যন্ত। অথচ সাবেক পূব পাকিস্তানের এই পত্রপত্রিকাগুলিই ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত পেশাগত দক্ষতায় এবং অসীম সাহসে জাতির স্বাধিকার আন্দোলনকে সর্বাত্মক সমর্থন যুগিয়েছে। ‘ইত্তেফাক’, ‘দি পিপল’, ‘সংবাদ’, ‘পূর্বদেশ’, ‘ দৈনিক পাকিস্তান’, ‘গণবাংলা’, ‘আজাদ’ এবং ‘পাকিস্তান অবজারভার’ ঊনসত্তরের গণআন্দোলন ও ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। ষাটের দশকের সেই সাহসী সাংবাদিকতা, পুরোধা সাংবাদিকদের সেই দেশপ্রেম, সাহস ও পেশাদারিত্ব বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে বহুলাংশে বেগবান করেছে।

আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করতে না দেওয়ায় প্রতিবাদে রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেন্দ্রের সকল বাঙালি কলাকুশলি একযোগে তাঁদের কর্মস্থল থেকে বেরিয়ে আসে। অভাবিত এই প্রতিবাদে রেডিও পাকিস্তানের সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। উপায় না দেখে পাকিস্তান সরকার বাঙালি বেতারকর্মিদের সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি ৮ মার্চ রেডিও পাকিস্তান সম্প্রচার করে, ফলে সারাবিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়ে। এই সফল আন্দোলনের পর, ২৫ মার্চ পর্যন্ত (গণহত্যা শুরুর দিন পর্যন্ত), দেশের প্রধান রাজনৈতিক ঘটনার খবর সংক্ষিপ্তাকারে হলেও পরিবেশন করতে সক্ষম হয় বেতারকর্মিরা।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বাংলাদেশ ছিল অবরুদ্ধ ও রক্তাক্ত জনপদ। প্রধান বাংলা দৈনিক ‘ইত্তেফাক’ ও ‘সংবাদ’ পত্রিকার অফিসগুলিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। দৈনিক ‘গণবাংলা’ ও ‘দি পিপল’-এর অফিস ২৫ মার্চ রাতেই আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করে। ‘সংবাদ’ অফিসের আগুনে মারা যান প্রগতিশীল লেখক ও সাংবাদিক শহীদ সাবের। বন্ধ হয়ে যায় ‘স্বরাজ’, ‘আওয়াজ’ এবং ‘বাংলার বাণী’।

জামাতে ইসলামীর মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’ এবং ‘পয়গাম’-এর মতো এক-দুটি ব্যতিক্রম ছিল, যারা পাকিস্তানের পক্ষ ধারণ করে নারকীয় সামরিক বর্বরতাকে সমর্থন জুগিয়েছে। এসব পত্রিকা বাঙালি গণহত্যা ও নারী নির্যাতনকেও সমর্থন করেছে।

কিন্তু ইত্যকার বাধানিষেধের পরও কিছু কিছু পত্রিকা সুকৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতার খবর প্রচার করার চেষ্টা করেছে। যেমন ‘সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী’ হতো, কিংবা ‘ইসলামের দুষমণ’-এর সঙ্গে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর যুদ্ধ, ‘ভারতীয় দুষ্কৃতকারী’দের হাতে ‘অন্তর্ঘাতমূলক’ কর্মকা-- ইত্যাদি ধরনের হেডলাইন করেছে তারা। ফলে দেশবাসীর জানতে বাকি থাকেনি মুক্তি বাহিনীর যোদ্ধারা তৎপরতা জোরদার করছে এবং পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠছে।

তবে দুশো ছেষট্টি দিনের এই বন্দিত্বের বাঁধন টুটে যায় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, যেদিন বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমা- নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশের প্রতিটি সংবাদপত্র এবং বেতার-টিভি পরিপূর্ণ আবেগে সে ঘটনার ছবি ও খবর পরিবেশন করে। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই গোটা বাংলাদেশে প্রায় তিন শত দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যারা পরিপূর্ণ আবেগ এবং বস্তুনিষ্ঠতায় সদ্য-সমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে খবর, মন্তব্য, ফিচার ও ছবি প্রকাশ করে। নয় মাস অবরুদ্ধ বা বন্দি থাকার পর ১৬ ডিসেম্বর পরবর্তীকালের এই বিষ্ফোরণ এই জনপদের আরেক ইতিহাস।

রণাঙ্গনের সংবাদপত্র

মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকতার আরও একটি বিশেষ দিক উল্লেখের দাবি রাখে। বিভিন্ন মুক্তাঞ্চল ও সীমান্তবর্তি ভারতীয় এলাকা থেকে অসংখ্য পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে। আমার বিশ্বাস, প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রগুলি সরকারি বাধানিষেধ এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে যে-কাজটি করতে পারে নি, সে কাজটি সম্পন্ন করেছে সীমান্ত অঞ্চল থেকে প্রকাশিত অনিয়মিত এই প্রকাশনাগুলি। এ কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের নিষ্ঠাবান সহযোগীর কাজ, যা স্বাধীনতাকামীদের মনোবল বাড়িয়েছে এবং বিশ্ববাসীর সামনে বাঙালিকে আরেকবার আধুনিক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

একটি যুদ্ধে সমরাস্ত্র যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালাবার লক্ষ্যে প্রচারযন্ত্র। সে-কারণে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকারের নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’, যার পত্তন ঘটে চট্টগ্রামে কয়েকজন সাহসী বেতারকর্মির উদ্যোগে। পরবর্তিতে আগরতলা এবং কলকাতা থেকে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত এই বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম চলতে থাকে। বলাই বাহুল্য, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

মুজিবনগর সরকারের উদ্যোগে নিয়মিত প্রকাশিত হয় ‘জয় বাংলা’ সাপ্তাহিক, যা ছিল যুদ্ধকালীন সরকার বা আওয়ামী লীগের মুখপত্র। প্রকাশনাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যতম প্রধান দেশীয় সংবাদপত্রে পরিণত হয়। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই দুটি গণমাধ্যমের সঙ্গে রণাঙ্গণ থেকে যুক্ত থাকার। মুক্তিযুদ্ধে একজন গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করেও যুদ্ধ সাংবাদিকতার সাথে সামান্য যে যোগাযোগ- তা ব্যক্তি-জীবনের এক বড় সঞ্চয় আমার। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে আসাম হয়ে ত্রিপুরা পর্যন্ত চলতে হয়েছে, রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে ঘুরে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে হয়েছে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ ও ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার জন্যে। প্রচারপত্র লিখে ছাপিয়ে আনতে হয়েছে দূর-দূরান্ত, এমনকি আসামের গৌহাটি থেকে। কারণ নিরাপত্তাজনিত কারণে দেশীয় ছাপাখানা ব্যবহার করার সুযোগ ছিলো না তখন।

‘জয় বাংলা’ পত্রিকাটির সম্পাদক ম-লীর সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগের আব্দুল মান্নান, এমএনএ, যিনি মুজিবনগর সরকারের তথ্য, জনসংযোগ ও প্রচার বিভাগের প্রধান ছিলেন। যুদ্ধকালীন কৌশলগত কারণে পত্রিকায় তাঁর নাম ছাপা হয়েছে ‘আহমদ রফিক’। কাগজটি ছাপা হয়েছে কলকাতা থেকে। বিতরণ করা হয়েছে সীমান্তের শরণার্থী শিবিরসহ দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে। ‘জয় বাংলা’য় থাকতো যুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকারের কর্মকা-, যুদ্ধের অগ্রগতি, প্রচারধর্মী খবর, সংবাদ বিশ্লেষণ, প্রবন্ধ, ফিচার, কবিতা এবং যুদ্ধ-পরিস্থিতির মূল্যায়ন। আরও ছাপা হয়েছে পাকিস্তানি হত্যানির্যাতন ও প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর এবং দেশ-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনের সংবাদ। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টর কমান্ড, মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থী, কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম, বিএসএফ-এর জনসংযোগ বিভাগ- ইত্যাদি ছিল ‘জয় বাংলা’র মূল সংবাদসূত্র। এছাড়াও ভারত সরকার, বিবিসি, আকাশবাণী, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআই ও ইউএনআই, একই সঙ্গে সোভিয়েত বার্তা সংস্থা ‘তাস’ থেকে প্রয়োজনে বিভিন্ন খবর নেয়া হতো।

নিজের আগ্রহী সংগ্রহ, পরবর্তীকালের অনুসন্ধান ও দলিলপত্র থেকে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে প্রায় ৭০টি পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্যমান সময়ে এগুলির প্রকাশ সহজসাধ্য ছিলোনা। অর্থ ও কাগজের অপ্রতুলতা, প্রয়োজনীয় জনবল, ছাপাখানা ও আনুষঙ্গিক সুযোগসুবিধার অভাব এবং বিদ্যমান যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে প্রকাশনাগুলিকে টিকিয়ে রাখা রীতিমতো কঠিন ছিল। সে কারণে এদের বেশিরভাগই নিয়মিত হতে পারেনি। অনেকক্ষেত্রে পত্রিকা জগতের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও- রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, ছাত্র, সাধারণ কর্মজীবী হয়েও- এসব উদ্যোক্তাগণ পত্রিকা প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে নিজেদের দেশপ্রেম প্রকাশ করেছেন। এসব পত্রপত্রিকা কেবল সময়ের আবেগি চাহিদা মিটিয়েছে বললে ভুল বলা হবে, তারা যুদ্ধরত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের দিকেও নজর রেখেছে।

বিভিন্ন যুদ্ধাঞ্চল থেকে গোপনেও বেশ কিছু পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। এগুলি কোনোটি হাতের লেখা এবং সাইক্লোস্টাইলে ছাপা। এসব প্রকাশনার সিংহভাগ সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক; কয়েকটি দৈনিকও ছিল। এগুলির সবই মানোতীর্ণ ছিল বলা যাবে না, তবে এরা সময়ের গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা পূরণ করেছে।

আবার দেখা যায়, ‘জয় বাংলা’, ‘বাংলাদেশ’, ‘সোনার বাংলা’, ‘স্বাধীন বাংলা’- ইত্যাদি নামে একাধিক পত্রিকা বেরিয়েছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। এগুলির কিছু কিছু আবার মুজিবনগর সরকার থেকে নিবন্ধিতও হয়েছে। এদের পাঠক ছিলেন মূলত শরণার্থী ক্যাম্পগুলিতে আশ্রিত দেশত্যাগি মানুষ, মুক্তি বাহিনীর সদস্য ও মুক্তাঞ্চলসহ দেশের অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ মানুষ। গেরিলা দলগুলি যখন দেশের অভ্যন্তরে গেছে তখন তাদের হাতে এইসব পত্রিকার কপি পাঠানো হয়েছে। ফলে যুদ্ধের গতি প্রকৃতি ও সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষ জানতে পেরেছে।

আমার জানা মতে, কোনো জাতির মুক্তিযুদ্ধে, কিংবা কোনো যুদ্ধে, এত বিপুল সংখ্যক পত্রপত্রিকা কোনোকালে, কোনো ভূখ-ে প্রকাশিত হয়নি। বলাই বাহুল্য, সুবিশাল জাতীয় দুর্যোগেও এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশনাগুলি বাঙালিকে নতুন করে আধুনিক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এসব প্রতিটি প্রকাশনার পেছনে ছিল পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারী মানুষদের আবেগ ও দেশপ্রেম। এরা কেবল সময়ের আবেগি চাহিদা মিটিয়েছে বললে ভুল বলা হবে, যুদ্ধরত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের দিকেও নজর রেখেছে।

মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকতায় নিজের অংশগ্রহণ, ব্যক্তিগত সংগ্রহ ও বিভিন্ন দলিল ও প্রকাশনা থেকে এই রণাঙ্গন পত্রপত্রিকাগুলির নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আমি এ সংক্রান্ত একটি পুস্তকে সম্প্রতি লিপিবদ্ধ করেছি। তবে এই তালিকা পূর্ণাঙ্গ নয় বলেই আমার বিশ্বাস। অন্যদিকে এসব পত্রপত্রিকার নামও সময়ের চাহিদাকে পূরণ করেছে। যেমন- বিপ্লবী বাংলাদেশ, বাংলার বাণী, বঙ্গবাণী, রণাঙ্গন, সংগ্রামী বাংলা, বাংলার মুখ, সোনার বাংলা, জন্মভূমি, মুক্তবাংলা, স্বদেশ, দাবানল, সংগ্রামী বাংলা, অগ্রদূত, স্বাধীন বাংলা, জাগ্রত বাংলা, দেশ বাংলা, মায়ের ডাক, মুক্তি, দুর্জয় বাংলা, অভিযান, আমার দেশ, নতুন বাংলা, মুক্তিযুদ্ধ, অমর বাংলা, অনির্বাণ, ইশতেহার, উত্তাল পদ্মা, গণমুক্তি, গ্রেনেড, ধুমকেতু, বঙ্গবাণী, বাংলার কথা, বাংলার ডাক, রণাঙ্গন, লড়াই, স্বদেশ, স্বাধীনবাংলা, স্বাধীন বাংলা, সন্দ্বীপ থেকে ধলেশ্বরী ইত্যাদি।

এ ছাড়াও ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে The Nation, The People I Bangladesh Bulletin বিভিন্ন পশ্চিমী দেশ থেকে প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগেও বেশ কিছু পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে।

বিশ্ব গণমাধ্যম

পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমনের ছয়-দফা, ছাত্র সমাজের ১১ দফা এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিবাদে বাঙালি জনতার অবিস্মরণীয় গণবিস্ফোরণ ঘটে ১৯৬৯ সালে। প্রভাবশালী বিশ্ব গণমাধ্যমগুলি পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহের ওপর বেশি করে নজর রাখতে থাকে মূলত তখন থেকেই। এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় দক্ষিণাঞ্চলের ভয়ংকর গোর্কির তা-বের প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের হৃদয়হীন উদাসীনতা। ১৯৭০ সালের সেই ঘূর্ণিঝড়ে পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যায়, পূর্ববঙ্গের দক্ষিণাঞ্চল ধংসস্তূপে পরিণত হয়। কিন্তু দেশের সরকারের কাছে এই ধংসযজ্ঞ গুরুত্ব লাভ করে না। ফলে গণঅসন্তোষ আরও বেড়ে যায়।

তীব্র গণঅভ্যুত্থানে ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। ক্ষমতায় আসেন নতুন জেনারেল, ইয়াহিয়া খান। নতুন সামরিক প্রেসিডেন্ট, পরিস্থিতি সামলাবার কৌশলে, দেশে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কেবলই পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে না, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানের দুষ্ট রাজনৈতিক চক্র কোনো বাঙালির হাতে দেশের শাসনভার ন্যস্ত না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এতে পরিস্থিতি আরেক দফা উত্তপ্ত হয়। এরই মধ্যে ইয়াহিয়া খান ও সেনাবাহিনী শেখ মুজিব ও বাঙালি জাতিকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর অতর্কিতে এবং সর্বাত্মক আগ্রাসন চালায় দেশের সশস্ত্র বাহিনী, যাতে একমাত্র ঢাকা নগরীতেই হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়।

এই নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ বিশ্ব গণমাধ্যমের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ঢাকা নগরীতে ২৫-২৬ মার্চের ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ চালাবার সময় কয়েক ডজন বিদেশি সাংবাদিক ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞের খবর ও ছবি যেন ধামাচাঁপা দেওয়া যায় সে লক্ষে সামরিক কতৃপক্ষ সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা ২৫ মার্চ রাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ গিয়ে সব বিদেশি সাংবাদিককে পাকড়াও করে, তাদের জোড় করে দেশ থেকে বের করে দেয়। এরপরও কয়েকজন সাংবাদিক লুকিয়ে থেকে গণহত্যার খবর ও ছবি সংগ্রহ করেন। এরপর জীবন বিপন্ন করে তারা দেশের বাইরে চলে যান এবং বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর এবং নিরস্ত্র মানুষের ওপর সামরিক অভিযানের খবর প্রকাশ করেন।

ভারতীয় গণমাধ্যম

নারকীয় পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞ ও বাঙালি প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর প্রচারের ক্ষেত্রে বেশি অবদান রাখে ভারতের সংবাদপত্র এবং রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত আকাশবাণী রেডিও। দেশটির প্রতিটি অঞ্চলের প্রতিটি সংবাদপত্র কার্যত স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের সংবাদপত্রে পরিণত হয়। প্রথাগত সাংবাদিকতার বাইরে গিয়ে তারা পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলে এবং বাংলাদেশের জাতীয় যুদ্ধকে নিজেদের নৈতিক যুদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

কলকাতার প্রধান বাংলা দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘যুগান্তর’, ‘দৈনিক বসুমতি’, ‘দৈনিক সত্যযুগ’, ‘দৈনিক কালান্তর’, ‘গণবার্তা’, ‘দেশ’ সাময়িকী, ইংরেজি ‘দি স্টেট্সম্যান’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’সহ পান্নালাল দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘কম্পাস’; নতুন দিল্লির ইংরেজি পত্রিকা ‘টাইমস্ অব ইন্ডিয়া’, ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’; মাদ্রাজ বা চেন্নাই-এর প্রধান দৈনিক ‘দি হিন্দ’ আসামের ‘আসাম ট্রিবুন’, মেঘালয়ের ‘শিলং টাইমস’; বোম্বে বা মুম্বাই-এর ‘ব্লিৎস’, ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’; ত্রিপুরার প্রধান ‘দৈনিক সংবাদ’- এর ভূমিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে এসব জাতীয় ও আঞ্চলিক ভারতীয় পত্রিকাগুলি মুক্তিবাহিনী ও প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে সর্বাত্মক সমর্থন জুগিয়ে গেছে। তারা অকুণ্ঠচিত্তে বাংলাদেশের গণমানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সংবাদ সংস্থা ‘প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া’ বা ‘পিটিআই’ এবং ‘ইউনাইটেড নিউজ অব ইন্ডিয়া’ বা ‘ইউএনআই’ ব্যাপকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সংবাদ সরবরাহ করেছে। ‘আকাশবাণী’ কলকাতা কেন্দ্রের প্রাত্যহিক বাংলা সংবাদ ও ‘সংবাদ পর্যালোচনা’ মুক্তি বাহিনী ও বাংলাদেশের মানুষের মনোবল বাড়িয়েছে বহুগুণ।

১৯৭১ সালে ক্ষুদ্র ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরা হয়ে ওঠে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্ব গণমাধ্যমের কাছে আগরতলা হয়ে ওঠে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ‘ডেটলাইন’। যে-ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ লক্ষ, সেই ত্রিপুরাকে ঠাঁই দিতে হয় সেদিন ১৪ লাখের ওপর বাংলাদেশের শরণার্থী।

সেদিনের ত্রিপুরায় মূল পত্রিকা ‘দৈনিক সংবাদ’, সম্পাদক ভূপেন দত্ত ভৌমিক। এ কাগজটি সকল অর্থেই ত্রিপুরায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান দৈনিকে পরিণত হয়। আগরতলা থেকে ‘সাপ্তাহিক সমাচার’ নামে আরও একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যার সম্পাদক ছিলেন বাংলাদেশ অন্তপ্রাণ অনিল ভট্টাচার্য। টেবলয়েড সাইজের এই কাগজটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের জোরালো সমর্থক। তখনকার প্রধান বিরোধী দল সিপিআই (এম-এল)-এর মুখপত্র ‘দেশের কথা’ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। এ ছাড়াও ‘জাগরণ’ ও ‘দৈনিক গণরাজ’ পত্রিকা দুটির ভূমিকার প্রসংশাযোগ্য। ঠিক একইভাবে আসামের প্রধান ইংরেজি দৈনিক ‘আসাম ট্রিব্যুন’ এবং মেঘালয়ের দৈনিক ‘শিলং টাইম্স’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এখানে দু’জন ভারতীয় সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন, যাঁরা অবরুদ্ধ বাংলাদেশে এসে আর ঘরে ফিরে যাননি। এই দুই তরুণ ভারতীয় সাংবাদিকের একজন সুরজিৎ ঘোষাল, অন্যজন দীপক ব্যানার্জি। এঁরা নিজেদের পরিচয় গোপন করে যুদ্ধরত বাংলাদেশে প্রবেশ করেন গণহত্যার খবর সংগ্রহ করতে। বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে ঘুরে পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচারের ছবি ও খবর সংগ্রহ করেন। এক সময় কুমিল্লাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং নৃশংসভাবে তাঁরা নিহত হন।

পশ্চিমী সংবাদপত্র

যুক্তরাষ্ট্রের সরকার মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ ধারণ করে। কিন্তু দেশটির প্রধান গণমাধ্যমগুলি পাকিস্তানি গণহত্যা বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এছাড়াও ব্রিটেন, ফ্রান্স, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, হাঙ্গেরী, যুগোস্লাভিয়া, জাপান, জার্মানি, কানাডা, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সোভিয়েত সংবাদ সংস্থা ‘তাস’ বাংলাদেশের ঘটনাবলি নিয়ে ব্যাপক ও নিয়মিতভাবে রিপোর্ট করে।

পশ্চিমা বিশ্বের খ্যাতিমান যে-কাগজগুলি পাকিস্তানি বর্বরতাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে সমর্থন গড়ে তুলে, তাদের অন্যতম- ‘নিউইয়র্ক টাইমস’, ‘গার্ডিয়ান’, ‘সানডে টাইমস’, ‘নিউ স্টেটসম্যান’, ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’, ‘দি ইকোনমিস্ট’; ‘ইভিনিং স্টার’, বোস্টন গ্লোব’, ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’. ‘লস এঞ্জেলস্ টাইম্স’, ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ‘টাইম ম্যাগাজিন’ ও ‘নিউজউইক’। হংকং-এর ‘ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ’ পত্রিকাটিও বিশেষ ভূমিকা রাখে। লন্ডনের ‘বিবিসি- বাংলা সার্ভিস’ অসামান্য ভূমিকা রাখে। কার্যত ১৯৭১ সালের ভূমিকার কাণেই বাংলাদেশের শ্রোতাদের কাছে বিবিসি একটি বহুল পরিচিত গণমাধ্যমে পরিণিত হয়।

এ ছাড়াও নেপালের ‘রাইজিং স্টার’, ‘সিঙ্গাপুরের ‘নিউ নেশান’, যুগোস্লাভিযার ‘দি কমিউনিস্ট’, অস্ট্রেলিয়ার ‘দি এ্যজ’, ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’-এর ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। ‘লাইফ’ ম্যাগাজিন বাংলাদেশের ওপর বিশেষ প্রতিবেদন ছাপে। সরকারি অবস্থানের কারণে কমিউনিস্ট চীন ও আরব দুনিয়ার গণমাধ্যমগুলি ছিল পাকিস্তানের সমর্থক।

পশ্চিমি সাংবাদিকদের মধ্যে যাঁরা বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহসহ মুক্তিযুদ্ধের দৈনন্দিন কর্মকা- সরাসরি রিপোর্ট করেছেন তাঁদের অন্যতম সিডনি শ্যনবার্গ, ডেন কগিন, সাইমন ড্রিং, কলিন স্মিথ, পিটার হেজেলহার্স্ট, টনি ক্লিফটন, মাইকেল লোরাঁ (Laurent), মার্ক টালি, আরনল্ড জেটলিন, সিরিল জন, মিশেল রবার্ট, লুই হেরেন, নিকলাস টমালিন, ডিটার আর কান ও পিটার আর হেনরিস।

মার্কিন সাংবাদিক আর্নল্ড জেটলিন বার্তা সংস্থা এপি-র প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর সামরিক অভিযানের অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী। ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের ডেন কগিনকে ২৫ মার্চ রাতে সামরিক কতৃপক্ষ জোড় করে বেব করে দেয়। এরপর তিনি ভারতের মাটি হয়ে পুনরায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে নবগঠিত মুক্তি বাহিনীর ওপর বিস্তারিত প্রতিবেদন লেখেন। তাঁর লেখা ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের ১৯ এপ্রিল ১৯৭১-এর ‘দ্য ব্যাটেল অব কুষ্টিয়া’ প্রতিবেদনটি ছিল সাড়া জাগানো।

লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর তরুণ প্রতিবেদক সাইমন ড্রিং ৬ মার্চ, ১৯৭১ পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি রিপোর্ট করতে ঢাকায় আসেন। ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরু সাথে সাথে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকা থেকে বিদেশি সাংবাদিককে জোড় করে বের করে দিলেও তিনি ঢাকার ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের ছাদে এপি’র ফটোগ্রাফার মাইক্যাল লোঁরার সঙ্গে কোনোভাবে লুকিয়ে থাকেন। এরপর এই দুজন সম্ভাব্য বিপদ উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য এলাকায়, যেখানে সৈন্যরা গণহত্যা চালিয়েছে, সেখানে যান এবং ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করেন। সাইমন ড্রিং তাঁর পত্রিকার জন্য এরপর একটি বিস্তারিত রিপোর্ট লেখেন, যা ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত হয় ৩০ মার্চ ১৯৭১। ড্রিং-এর “God and a united Pakistan” রিপোর্টটি ছিল বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর প্রথম কোনো পশ্চিমী সাংবাদিকের ব্যাপক-ভিত্তিক রিপোর্ট।

এছাড়াও এন্থনি ম্যাসকারানহাসের সাহসী ভূমিকার কথা সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করতে হবে। এই পাকিস্তানি সাংবাদিক করাচির ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সামরিক সরকার পাকিস্তানের ৮ জন সাংবাদিককে তাদের পক্ষে লেখার জন্য ১০ দিনের এক সফরে ঢাকায় নিয়ে আসে এপ্রিল মাসে। কিন্তু সরেজমিন পর্যবেক্ষণের পর মাসকারনাহাস বিবেকের দংশনে ভুগতে থাকেন এবং ১৮ মে ঢাকা থেকে লন্ডন পালিয়ে যান। তিনি ‘সানডে টাইমস্’ পত্রিকার সম্পাদক হেরাল্ড ইভান্সের সঙ্গে দেখা করেন এবং নিজের অভিজ্ঞতার বর্ননা দেন। বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে Genocide শিরনামে ‘সানডে টাইম্স’-এ ১৩ জুন ১৯৭১ তাঁর বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা বিশেষভাবে বিশ্ব বিবেক নাড়িয়ে দেয়।

মুক্তিযুদ্ধের শহীদ সাংবাদিক

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দেশীয় অনুচরদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন অনেক কৃতি সাংবাদিক। এঁদের মধ্যে নিষ্ঠুর পন্থায় সর্বপ্রথম শহীদ হন দৈনিক ‘সংবাদ’-এর শহীদ সাবের। এরপর ‘বিবিসি’র সংবাদদাতা নিজামুদ্দিন আহমদ, ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন, বার্তা সংস্থা ‘পিপিআই’-এর চীফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হক, ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকার গোলাম মোস্তফা, ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এর খন্দকার আবু তালেব, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও ‘দৈনিক সংবাদ’-এর অন্যতম কর্ণধার শহীদুল্লা কায়সার। এঁদেরকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আরও কয়েকজন সাংবাদিককে আলবদর ও রাজাকার বাহিনী তুলে নিয়ে যায় এবং পর্যায়ক্রম তাঁদের হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধ ও গণমাধ্যম সংক্রান্ত আমার সাম্প্রতিক একটি গ্রন্থ আমি সেইসব বরেণ্য শহীদ সাংবাদিকদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদন করেছি।