আহমেদ ফরিদ
চেতনা শব্দটা আমরা প্রায়শই উচ্চারণ করে থাকি। কিন্তু আমরা চেতনা শব্দটির দ্বারা কী বুঝে থাকি তা কি কখনো ভেবে দেখেছি? চেতনা কোথা থেকে সৃষ্টি হয়, কীভাবে চেতনা কাজ করে? সাধারণভাবে বলা যায় চেতনা হচ্ছে একটি মানসিক ধর্ম। একে আমরা মনের দর্শন বলে ধরে নিতে পারি। নিজের সত্তা আর পরিবেশের মধ্যকার বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক আমাদের চেতনা বিকাশের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
চেতনা তাহলে একদিনে সৃষ্টি হয় না। চেতনা সৃষ্টির জন্য একটা পরিবেশ লাগে, অনুভূতি লাগে আর লাগে সময়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মাঝে একটা চেতনা সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতবর্ষের সার্বিক ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে এ উপমহাদেশ বার বার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জর্জরিত হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ এসব দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে, আশ্রয়হীন হয়েছে অনেক মানুষ, উদ্বাস্তু হয়ে দেশান্তরী হয়েছে অনেক পরিবার, ইজ্জত হারিয়েছে অনেক মা-বোন। সাম্প্রদায়িকতা যেনো আমাদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু এসব সাম্প্রদায়িকতার জন্য সাধারণ মানুষ কতটা দায়ী? নাকি এর পিছনে শুধুই মতলবাজদের হাত ছিল? এ নিয়ে কি কোনো গবেষণা হয়েছে? আমার তা মনে হয় না। শত শত বছর ধরে এ উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বাস করে আসছে। হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায় ছিল বাংলায়, এ উপমহাদেশে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এমনটা বলা যায় না। আমাদের গ্রামে অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ছিল। তারা কখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে কিংবা নিজেদেরকে সংখ্যলঘু ভেবেছে এরকম আমাদের মনে হয়নি। হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু কিছু লোককে দেখেছি তাঁরা মুসলমানদের চেয়েও বেশি দাপট দেখিয়েছে। হিন্দুদের পূজা-পার্বণে আমরা মুসলমান ছেলেমেয়েরাও আনন্দের ভাগীদার হয়েছি। আমরা হিন্দু বাড়িতে কীর্তন শুনতে যেতাম, তাদের হরিলুটের বাতাসায় আমরাও ভাগ বসাতাম। আমাদের ধার্মিক মা-বাবা কখনো আমাদেরকে এ সকল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে বারন করেনি। তারা প্রকৃত ধার্মিক ছিলেন। নিজেদের ধর্মের প্রতি তাদের সম্মানবোধ ছিল, অন্যদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ধর্ম কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিমদের বিরুদ্ধে এদেশের মুসলিমগণ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, হিন্দু-মুসলমান একত্রিতভাবে অত্যাচারী পাকিস্তানি মুসলিম সেনাদের বিরুদ্ধে লড়েছে। সেখানে ধর্মের পার্থক্য হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে কোনো ফাটল ধরাতে পারেনি।
স্বাধীনতার অর্ধশতবর্ষ আমরা উদযাপন করেছি। আমরা যে চেতনা নিয়ে হিন্দু মুসলিম ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়েছিলাম আমাদের সেই চেতনাবোধ এখন কোথায়? আমাদের চেতনাবোধ কি ভোঁতা হয়ে গিয়েছে? আমারা কি তা হারিয়ে ফেলেছি?
এখনো কেনো রামুতে, নাসিরনগরে, কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক হামলা হয়? দেশের আনাচে-কানাচে কেনো সাম্প্রদায়িক শক্তি ফণা তুলে ছোবল মারে? নানা অছিলায় এখনো কেনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন হেনস্তার শিকার হয়? এর পিছনে কি ধর্মীয় চেতনাবোধ, ধর্মের নামে ব্যবসা, সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল করা, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার না কি অন্য কোনো ধান্দা কাজ করছে তা আমাদের খুঁজে বার করতে হব?
ষাটের দশকে আমাদের দেশে একটা বড়ো সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্ম হয়। জন্ম হয় ছায়ানটের, পালন শুরু হয় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। এসময় নববর্ষ উদযাপনও আমরা শুরু করি। এ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল অসম্প্রদায়িকতা। আন্দোলনে মূল ভূমিকা পালন করে আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতি। আমাদের স্বাধীনতা অসম্প্রদায়িক এ সাংস্কৃতিক চেতনা আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল বলেই আমরা অত্যাচারী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করতে সক্ষম হই।
আমাদের সংস্কৃতি কি আজ বিপদের সম্মুখীন? এটি নানা ষড়যন্ত্রের শিকার? মৌলবাদ, কূপম-ূকতা আর ধান্ধবাজির শিকার?
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের মধ্যে এক মহান ঐক্যবোধ আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্ম দিয়েছিল যা অতীতে দেখা যায়নি আর ভবিষ্যতে দেখা যাবে কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কেন মানুষ এরকম ঐক্যবোধ আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনার বাঁধনে আবদ্ধ হয়েছিল তা ব্যাখা করা কি খুব দুরূহ কাজ? আমার তা মনে হয় না। আবহমান কাল থেকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। বিপদে আপদে একে অপরকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছে। মানুষের মধ্যে নিজ নিজ ধর্মের চেতনাবোধ কাজ করেছে- হিন্দু হিন্দুর ধর্ম পালন করেছে, মুসলমান মুসলমানের ধর্ম। ধর্ম নিয়ে তেমন বড় ধরনের সমস্যা হয়েছে তেমন কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
অসম্প্রদায়িকতার একটা উদাহরণ নিচের বাস্তব গল্পটিতে পাওয়া যাবে অন্ততপক্ষে এদেশের সাধারণ মানুষ যে সাম্প্রদায়িক নয় তার বড় একটি প্রমাণ মিলবে।
যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে। আমরা ধরে নিয়েছিলাম পাকিস্তানি সৈন্যরা আর আমাদের গ্রামে আসবে না। কয়েকবার তারা আসবে আসবে করেও আসেনি। আমাদের গ্রামটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সর্ব উত্তর- পূর্ব দিকে যোগাযোহবিহীন একটি দুর্গম গ্রাম। এদুর্গম গ্রামটিতে তাদের আসার কারণ- গ্রামটি তখন মুক্তিযোদ্ধার গ্রাম হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে শায়েস্তা করার জন্যই তাদের আসতে হবে। এর পিছনে ইন্ধন জুগিয়েছেন এক মুসলিম লীগ নেতা।
তারিখটা সম্ভবত চৌদ্দ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। পাকিস্তানি সৈন্যরা নেমেছে আমাদের গ্রাম থেকে দুই কেিলামিটার দূরে চৈয়ারকুড়ি বাজার ঘাটে। বাজারের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বহমান সিংড়া নদী। এর সংযোগ ঘটেছে তিতাসের সাথে হরিণবেড় নামক একটি ব্যবসা কেন্দ্রের সাথে। ওখান থেকে মাধবপুর কাছেই। পাকিস্তানি সৈন্যরা মাধবপুর থেকেই এসেছে লঞ্চে করে। চৈয়ারকুড়ি বাজার ঘাট থেকে আমাদের গ্রামের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটারের মতো। সেখান থেকে আসার একমাত্র পথ হলো ভাঙা মাধবপুর নাসিরনগর সড়কটি। তাদের অস্ত্রশস্ত্র আর গোলা-বারুদ বহন করার জন্য লোক দরকার। তারা সাথে করে কিছু লোক নিয়ে এসেছে। আরো কিছু লোক দরকার। রাস্তাঘাটে যাদেরকে পেয়েছে তাদের অনেককেই মেরে ফেলার পরিবর্তে বোঝা বহন করার কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়।
চান মিয়া চাচাদের বাড়িটা রাস্তার ধারে। বাড়ি থেকে তাকে ধরে নিয়ে বোঝা বহনের কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়। সাথে গ্রামের আরো বেশ কিছু লোক। আলগা বাড়ির কাছে গিয়ে হঠাৎ করে সৈন্যদলের নেতাটির মনে হয় গোলাবারুদের বাক্সপেঁটরা বহন করা লোকগুলোর মুসলমানিত্ব পরীক্ষা করা দরকার।
তুম মুসলমান? চান মিয়া চাচাকে লক্ষ করে দলপতিটি প্রশ্ন করে।
চান মিয়া চাচা এদিক ওদিক তাকায়। তাকেই কি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে ষাঁড়ের মতো খাকি পোশাক পরা বিশাল দেহী লোকটা?
তুম মুসলমান? আবার খাকিওয়ালা চান মিয়া চাচাকে লক্ষ করে প্রশ্ন করে। চান মিয়া চাচা এবার বুঝতে পারে তাকেই প্রশ্ন করা হচ্ছে।
চান মিয়া চাচা মক্তবে আরবির সাথে কিছুদিন উর্দুও পড়েছে। প্রশ্নটা বুঝতেও তার কোনো অসুবিধা হয়নি। এর উত্তরে কী বলতে হবে উর্দুতে সেটিও মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু এখন গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই যেন বের হতে চাচ্ছে না। চান মিয়া চাচা মাথা নাড়ে।
কলমা বোল। সৈন্যটি আদেশ করে।
চান মিয়া চাচা গড় গড় করে সবকটি কলমা বলে ফেলে। সৈনিকটি অবাক হয়। সৈনিকটি নিজেও তো মুসলমান। পাকিস্তানের সাচ্চা মুসলমান। কলমা তৈয়ব ছাড়া অন্য কোনো কলমা তারও জানা নেই। এককালে সবকটি কলমা শিখেছিল মুসলমানের বাচ্চা হিসেবে। এখন সব ভুলে বেসেছে।
সৈনিকটি ‘সাচ্চা’ মুসলমান বলে চাচার পিঠ চাপড়ে দেয়। চাচা সামনের দিকে পা বাড়াবে এমন সময় আবারো তাকে প্রশ্ন করে সৈনিক নেতাটি। সে জানতে চায় তার পিছনে যে লোকটি আছে সে মুসলমান কি না। প্রশ্নটি চান মিয়া চাচাকে সৈনিকটি কেনো করল বোঝা গেল না। চান মিয়া চাচা কোনো কিছু না ভেবেই জবাবে বলল, মুসলমান। সৈনকটি দলটিকে চলে যাওয়ার জন্য বলেও কী মনে করে আবার থামার ইঙ্গিত দিল।
‘ইধার আও’ দলের দ্বিতীয় লোকটিকে ডাকল সৈনিকটি।
লোকটি ভয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
‘উতারো’ সৈনিকটি আদেশ করে।
উতারো শব্দটার মানে তার জানা আছে। উতারো শব্দটি শুনে লোকটির বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। উতারো আর মৃত্যু তার কাছে সমার্থক। কারণ তার ঐ জিনিসের অগ্রভাগ কর্তিত নয়। সে মুসলমানের সন্তান নয়। কী ভয়াবহ বিপদ। ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে চেনার একটি উত্তম উপায় হলো তার বিশেষ অঙ্গটার চামড়া কর্তিত কি কর্তিত নয়! লোকটা কী করবে এখন? দৌঁড়ে পালানোর মতো হিম্মত নেই বুকে। যে কলমা কয়টা শিখেছিল সে তাও ভুলে গিয়েছে এখন। তার হাঁটু জোড়া কাঁপছে থর থর করে। সৈনিক তাকে আবারো ধমক লাগায়, উতারো। লোকটা তার লুঙ্গিটি দুহাতে ধরে কোমরের উপরে তুলে ধরতে বাধ্য হয়। সৈনিকটির মুখে পৈশাচিক ক্রূর একটা হাসি ফুটে উঠে।
সাচ্চা মুসলমান ইধার আও- বলে চান মিয়া চাচাকে ডাকে সৈনিকটি। চান মিয়া চাচা যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো সৈনিকটির দিকে এগিয়ে যায়। মধ্য দুপুরের নেতানো রোদে রাইফেলের আগায় লাগানো বেয়নেটটি চকচক করছিল রক্ত পান করার জন্যই বোধ হয়। সৈনিকটি শীতল চোখে ধীরে সুস্থে বেয়নেটটি চান মিয়া চাচার বুকে চার্জ করে। চান মিয়া চাচা যেনো মনে হয় এর জন্য প্রস্তুতই ছিলেন। তিনি বুক পেতে দেন। সৈনিকটি প্রচ- আক্রোশে একাধিক বার সঙ্গিন চালিয়ে দেয় চান মিয়া চাচার বুকে। সবুজ দূর্বাঘাসের উপর লাল টকটকে রক্ত একটি বৃত্ত একে জমা হতে থাকে। সবুজের বুকে লাল। আমাদের পতাকার সমার্থক একটা কিছু!
চান মিয়া চাচাকে আমরা একজন অত্যন্ত ভালো মানুষ হিসেবেই জানতাম। তিনি নামাজ কাজা করতেন না, রোজা ভঙ্গ করতেন না। তিনি কখনো মিথ্যা বলেছেন এমন নজির কেউ দিতে পারবে না। তার সততা আর ধার্মিকতার জন্য ছেলে বুড়ো সবাই তাকে সম্মানের চোখে দেখতো। তিনি মিথ্যা বলার লোক নন। এটাই বোধ হয় তার জীবনে প্রথম আর শেষ মিথ্যা ছিল।
তিনি কেন এ মিথ্যার আশ্রয় নিলেন? তাও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কয়জনের বুকের পাটা এমন যে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন মানুষকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলতে পারে।
চান মিয়া চাচা জানতেন লোকটা হিন্দু। কারণ লোকটার বাড়ি ছিল একই পাড়ার। তার একটা মিথ্যা যদি একজন মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে তাহলে কি সেই মিথ্যাটা বলাই তার কাছে জরুরি মনে হয়েছিল? এই মিথ্যায় কি কোনো পাপ ছিল? কে বড়, সত্য না কি মানবতা, মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা, অসম্প্রদায়িকতা?
বুধবার, ০৩ আগস্ট ২০২২
আহমেদ ফরিদ
চেতনা শব্দটা আমরা প্রায়শই উচ্চারণ করে থাকি। কিন্তু আমরা চেতনা শব্দটির দ্বারা কী বুঝে থাকি তা কি কখনো ভেবে দেখেছি? চেতনা কোথা থেকে সৃষ্টি হয়, কীভাবে চেতনা কাজ করে? সাধারণভাবে বলা যায় চেতনা হচ্ছে একটি মানসিক ধর্ম। একে আমরা মনের দর্শন বলে ধরে নিতে পারি। নিজের সত্তা আর পরিবেশের মধ্যকার বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক আমাদের চেতনা বিকাশের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
চেতনা তাহলে একদিনে সৃষ্টি হয় না। চেতনা সৃষ্টির জন্য একটা পরিবেশ লাগে, অনুভূতি লাগে আর লাগে সময়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মাঝে একটা চেতনা সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতবর্ষের সার্বিক ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে এ উপমহাদেশ বার বার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জর্জরিত হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ এসব দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে, আশ্রয়হীন হয়েছে অনেক মানুষ, উদ্বাস্তু হয়ে দেশান্তরী হয়েছে অনেক পরিবার, ইজ্জত হারিয়েছে অনেক মা-বোন। সাম্প্রদায়িকতা যেনো আমাদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু এসব সাম্প্রদায়িকতার জন্য সাধারণ মানুষ কতটা দায়ী? নাকি এর পিছনে শুধুই মতলবাজদের হাত ছিল? এ নিয়ে কি কোনো গবেষণা হয়েছে? আমার তা মনে হয় না। শত শত বছর ধরে এ উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বাস করে আসছে। হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায় ছিল বাংলায়, এ উপমহাদেশে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এমনটা বলা যায় না। আমাদের গ্রামে অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ছিল। তারা কখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে কিংবা নিজেদেরকে সংখ্যলঘু ভেবেছে এরকম আমাদের মনে হয়নি। হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু কিছু লোককে দেখেছি তাঁরা মুসলমানদের চেয়েও বেশি দাপট দেখিয়েছে। হিন্দুদের পূজা-পার্বণে আমরা মুসলমান ছেলেমেয়েরাও আনন্দের ভাগীদার হয়েছি। আমরা হিন্দু বাড়িতে কীর্তন শুনতে যেতাম, তাদের হরিলুটের বাতাসায় আমরাও ভাগ বসাতাম। আমাদের ধার্মিক মা-বাবা কখনো আমাদেরকে এ সকল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে বারন করেনি। তারা প্রকৃত ধার্মিক ছিলেন। নিজেদের ধর্মের প্রতি তাদের সম্মানবোধ ছিল, অন্যদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ধর্ম কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিমদের বিরুদ্ধে এদেশের মুসলিমগণ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, হিন্দু-মুসলমান একত্রিতভাবে অত্যাচারী পাকিস্তানি মুসলিম সেনাদের বিরুদ্ধে লড়েছে। সেখানে ধর্মের পার্থক্য হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে কোনো ফাটল ধরাতে পারেনি।
স্বাধীনতার অর্ধশতবর্ষ আমরা উদযাপন করেছি। আমরা যে চেতনা নিয়ে হিন্দু মুসলিম ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়েছিলাম আমাদের সেই চেতনাবোধ এখন কোথায়? আমাদের চেতনাবোধ কি ভোঁতা হয়ে গিয়েছে? আমারা কি তা হারিয়ে ফেলেছি?
এখনো কেনো রামুতে, নাসিরনগরে, কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক হামলা হয়? দেশের আনাচে-কানাচে কেনো সাম্প্রদায়িক শক্তি ফণা তুলে ছোবল মারে? নানা অছিলায় এখনো কেনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন হেনস্তার শিকার হয়? এর পিছনে কি ধর্মীয় চেতনাবোধ, ধর্মের নামে ব্যবসা, সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল করা, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার না কি অন্য কোনো ধান্দা কাজ করছে তা আমাদের খুঁজে বার করতে হব?
ষাটের দশকে আমাদের দেশে একটা বড়ো সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্ম হয়। জন্ম হয় ছায়ানটের, পালন শুরু হয় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। এসময় নববর্ষ উদযাপনও আমরা শুরু করি। এ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল অসম্প্রদায়িকতা। আন্দোলনে মূল ভূমিকা পালন করে আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতি। আমাদের স্বাধীনতা অসম্প্রদায়িক এ সাংস্কৃতিক চেতনা আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল বলেই আমরা অত্যাচারী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করতে সক্ষম হই।
আমাদের সংস্কৃতি কি আজ বিপদের সম্মুখীন? এটি নানা ষড়যন্ত্রের শিকার? মৌলবাদ, কূপম-ূকতা আর ধান্ধবাজির শিকার?
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের মধ্যে এক মহান ঐক্যবোধ আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্ম দিয়েছিল যা অতীতে দেখা যায়নি আর ভবিষ্যতে দেখা যাবে কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কেন মানুষ এরকম ঐক্যবোধ আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনার বাঁধনে আবদ্ধ হয়েছিল তা ব্যাখা করা কি খুব দুরূহ কাজ? আমার তা মনে হয় না। আবহমান কাল থেকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। বিপদে আপদে একে অপরকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছে। মানুষের মধ্যে নিজ নিজ ধর্মের চেতনাবোধ কাজ করেছে- হিন্দু হিন্দুর ধর্ম পালন করেছে, মুসলমান মুসলমানের ধর্ম। ধর্ম নিয়ে তেমন বড় ধরনের সমস্যা হয়েছে তেমন কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
অসম্প্রদায়িকতার একটা উদাহরণ নিচের বাস্তব গল্পটিতে পাওয়া যাবে অন্ততপক্ষে এদেশের সাধারণ মানুষ যে সাম্প্রদায়িক নয় তার বড় একটি প্রমাণ মিলবে।
যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে। আমরা ধরে নিয়েছিলাম পাকিস্তানি সৈন্যরা আর আমাদের গ্রামে আসবে না। কয়েকবার তারা আসবে আসবে করেও আসেনি। আমাদের গ্রামটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সর্ব উত্তর- পূর্ব দিকে যোগাযোহবিহীন একটি দুর্গম গ্রাম। এদুর্গম গ্রামটিতে তাদের আসার কারণ- গ্রামটি তখন মুক্তিযোদ্ধার গ্রাম হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে শায়েস্তা করার জন্যই তাদের আসতে হবে। এর পিছনে ইন্ধন জুগিয়েছেন এক মুসলিম লীগ নেতা।
তারিখটা সম্ভবত চৌদ্দ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। পাকিস্তানি সৈন্যরা নেমেছে আমাদের গ্রাম থেকে দুই কেিলামিটার দূরে চৈয়ারকুড়ি বাজার ঘাটে। বাজারের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বহমান সিংড়া নদী। এর সংযোগ ঘটেছে তিতাসের সাথে হরিণবেড় নামক একটি ব্যবসা কেন্দ্রের সাথে। ওখান থেকে মাধবপুর কাছেই। পাকিস্তানি সৈন্যরা মাধবপুর থেকেই এসেছে লঞ্চে করে। চৈয়ারকুড়ি বাজার ঘাট থেকে আমাদের গ্রামের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটারের মতো। সেখান থেকে আসার একমাত্র পথ হলো ভাঙা মাধবপুর নাসিরনগর সড়কটি। তাদের অস্ত্রশস্ত্র আর গোলা-বারুদ বহন করার জন্য লোক দরকার। তারা সাথে করে কিছু লোক নিয়ে এসেছে। আরো কিছু লোক দরকার। রাস্তাঘাটে যাদেরকে পেয়েছে তাদের অনেককেই মেরে ফেলার পরিবর্তে বোঝা বহন করার কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়।
চান মিয়া চাচাদের বাড়িটা রাস্তার ধারে। বাড়ি থেকে তাকে ধরে নিয়ে বোঝা বহনের কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়। সাথে গ্রামের আরো বেশ কিছু লোক। আলগা বাড়ির কাছে গিয়ে হঠাৎ করে সৈন্যদলের নেতাটির মনে হয় গোলাবারুদের বাক্সপেঁটরা বহন করা লোকগুলোর মুসলমানিত্ব পরীক্ষা করা দরকার।
তুম মুসলমান? চান মিয়া চাচাকে লক্ষ করে দলপতিটি প্রশ্ন করে।
চান মিয়া চাচা এদিক ওদিক তাকায়। তাকেই কি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে ষাঁড়ের মতো খাকি পোশাক পরা বিশাল দেহী লোকটা?
তুম মুসলমান? আবার খাকিওয়ালা চান মিয়া চাচাকে লক্ষ করে প্রশ্ন করে। চান মিয়া চাচা এবার বুঝতে পারে তাকেই প্রশ্ন করা হচ্ছে।
চান মিয়া চাচা মক্তবে আরবির সাথে কিছুদিন উর্দুও পড়েছে। প্রশ্নটা বুঝতেও তার কোনো অসুবিধা হয়নি। এর উত্তরে কী বলতে হবে উর্দুতে সেটিও মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু এখন গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই যেন বের হতে চাচ্ছে না। চান মিয়া চাচা মাথা নাড়ে।
কলমা বোল। সৈন্যটি আদেশ করে।
চান মিয়া চাচা গড় গড় করে সবকটি কলমা বলে ফেলে। সৈনিকটি অবাক হয়। সৈনিকটি নিজেও তো মুসলমান। পাকিস্তানের সাচ্চা মুসলমান। কলমা তৈয়ব ছাড়া অন্য কোনো কলমা তারও জানা নেই। এককালে সবকটি কলমা শিখেছিল মুসলমানের বাচ্চা হিসেবে। এখন সব ভুলে বেসেছে।
সৈনিকটি ‘সাচ্চা’ মুসলমান বলে চাচার পিঠ চাপড়ে দেয়। চাচা সামনের দিকে পা বাড়াবে এমন সময় আবারো তাকে প্রশ্ন করে সৈনিক নেতাটি। সে জানতে চায় তার পিছনে যে লোকটি আছে সে মুসলমান কি না। প্রশ্নটি চান মিয়া চাচাকে সৈনিকটি কেনো করল বোঝা গেল না। চান মিয়া চাচা কোনো কিছু না ভেবেই জবাবে বলল, মুসলমান। সৈনকটি দলটিকে চলে যাওয়ার জন্য বলেও কী মনে করে আবার থামার ইঙ্গিত দিল।
‘ইধার আও’ দলের দ্বিতীয় লোকটিকে ডাকল সৈনিকটি।
লোকটি ভয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
‘উতারো’ সৈনিকটি আদেশ করে।
উতারো শব্দটার মানে তার জানা আছে। উতারো শব্দটি শুনে লোকটির বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। উতারো আর মৃত্যু তার কাছে সমার্থক। কারণ তার ঐ জিনিসের অগ্রভাগ কর্তিত নয়। সে মুসলমানের সন্তান নয়। কী ভয়াবহ বিপদ। ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে চেনার একটি উত্তম উপায় হলো তার বিশেষ অঙ্গটার চামড়া কর্তিত কি কর্তিত নয়! লোকটা কী করবে এখন? দৌঁড়ে পালানোর মতো হিম্মত নেই বুকে। যে কলমা কয়টা শিখেছিল সে তাও ভুলে গিয়েছে এখন। তার হাঁটু জোড়া কাঁপছে থর থর করে। সৈনিক তাকে আবারো ধমক লাগায়, উতারো। লোকটা তার লুঙ্গিটি দুহাতে ধরে কোমরের উপরে তুলে ধরতে বাধ্য হয়। সৈনিকটির মুখে পৈশাচিক ক্রূর একটা হাসি ফুটে উঠে।
সাচ্চা মুসলমান ইধার আও- বলে চান মিয়া চাচাকে ডাকে সৈনিকটি। চান মিয়া চাচা যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো সৈনিকটির দিকে এগিয়ে যায়। মধ্য দুপুরের নেতানো রোদে রাইফেলের আগায় লাগানো বেয়নেটটি চকচক করছিল রক্ত পান করার জন্যই বোধ হয়। সৈনিকটি শীতল চোখে ধীরে সুস্থে বেয়নেটটি চান মিয়া চাচার বুকে চার্জ করে। চান মিয়া চাচা যেনো মনে হয় এর জন্য প্রস্তুতই ছিলেন। তিনি বুক পেতে দেন। সৈনিকটি প্রচ- আক্রোশে একাধিক বার সঙ্গিন চালিয়ে দেয় চান মিয়া চাচার বুকে। সবুজ দূর্বাঘাসের উপর লাল টকটকে রক্ত একটি বৃত্ত একে জমা হতে থাকে। সবুজের বুকে লাল। আমাদের পতাকার সমার্থক একটা কিছু!
চান মিয়া চাচাকে আমরা একজন অত্যন্ত ভালো মানুষ হিসেবেই জানতাম। তিনি নামাজ কাজা করতেন না, রোজা ভঙ্গ করতেন না। তিনি কখনো মিথ্যা বলেছেন এমন নজির কেউ দিতে পারবে না। তার সততা আর ধার্মিকতার জন্য ছেলে বুড়ো সবাই তাকে সম্মানের চোখে দেখতো। তিনি মিথ্যা বলার লোক নন। এটাই বোধ হয় তার জীবনে প্রথম আর শেষ মিথ্যা ছিল।
তিনি কেন এ মিথ্যার আশ্রয় নিলেন? তাও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কয়জনের বুকের পাটা এমন যে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন মানুষকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলতে পারে।
চান মিয়া চাচা জানতেন লোকটা হিন্দু। কারণ লোকটার বাড়ি ছিল একই পাড়ার। তার একটা মিথ্যা যদি একজন মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে তাহলে কি সেই মিথ্যাটা বলাই তার কাছে জরুরি মনে হয়েছিল? এই মিথ্যায় কি কোনো পাপ ছিল? কে বড়, সত্য না কি মানবতা, মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা, অসম্প্রদায়িকতা?