বিপিসির লোকসান কমাতে চাইলে বাড়বে পিডিবির

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করেছে। এ সময় দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে যাচ্ছে সরকার। দাম বৃদ্ধির এই ঘোষণা আসতে পারে যেকোন সময়। এই প্রেক্ষাপটে পিডিবি বলছে, তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভর্তুকিও বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বেশকিছু দিন ধরে তেলের দাম বাড়ানোর জন্য দেন-দরবার করছে। জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি বলছে, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে তেল কিনে দেশে কম দামে বিক্রি করায় প্রতিদিন তাদের শতকোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। সরকার বলছে, এত টাকা ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি সরবরাহ করা কঠিন। তাই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে বিপিসির লোকসান কমানোর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। পিডিবি বলছে, তেলের দাম ২০ শতাংশ বাড়ানো হলে পিডিবির দৈনিক খরচ বাড়বে প্রায় ৩১৯ কোটি টাকা। এখন সরকার বিপিসির লোকসান কমাতে চাইলে পিডিবির লোকসান বেড়ে যাবে।

পিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকার আমাদের ভর্তুকি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বেড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে আমাদের ভর্তুকিও বাড়ানো প্রয়োজন। নয়তো পিডিবির লোকসান বেড়ে যাবে।’

গত ১ থেকে ৭ জুলাই তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গ্যাস, তেল, কয়লা, হাইড্রো, সৌর ও আমদানিসহ দৈনিক গড়ে ২৮৩ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ব্যয় হয়েছে ১৮৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে তেলভিত্তিক ১১০ মিলিয়ন কিলোওয়াট/ঘণ্টা (ইউনিট) বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পিডিবির ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। তেল দিয়ে গড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১১০ মিলিয়ন ইউনিট বা ৪ হাজার ৫৮৬ মেগাওয়াট। সে হিসাবে পিডিবি বলছে, এখন তেলের দাম যদি ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়, তাহলে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবির দৈনিক খরচ বাড়বে প্রায় ৮০ কোটি টাকা। একইভাবে তেলের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে খরচ বাড়বে দৈনিক ১৬০ কোটি টাকা, ১৫ শতাংশ বাড়লে খরচ বাড়বে ২৩৯ কোটি টাকা এবং তেলের দাম ২০ শতাংশ বাড়লে পিডিবির দৈনিক খরচ বাড়বে প্রায় ৩১৯ কোটি টাকা। এই টাকা ভর্তুকি হিসেবে না পেলে পিডিবিকে নির্দিষ্ট ভর্তুকির মধ্যে থাকতে হবে। অন্যথায়, তেলের দাম ৫ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে ২২৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাবে। তেলের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাবে ৪৫৯ মেগাওয়াট, ১৫ শতাংশ বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমবে ৬৮৮ মেগাওয়াট এবং ২০ শতাংশ তেলের দাম বাড়ানো হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমবে প্রায় ৯১৭ মেগাওয়াট।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় কমাতে দেশে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাধা পড়েছে। এই ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে দেশব্যাপী লোডশেডিং দিয়ে। তবে ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চলছে।

এদিকে বিতরণ কোম্পানিগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুতের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। তাই রুটিন মাফিক লোডশেডিং করতে পারছে না বিতরণ কোম্পানিগুলো।

সরকার বলছে, সেপ্টেম্বরের পর বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে। এই সময়টুকু বিদ্যুৎ সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ লক্ষ্যে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহ সংক্রান্ত একটি রোডম্যাপ (পরিকল্পনা) তৈরি করা হয়েছে। দেশে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল গত ১৬ এপ্রিল। পিডিবি বলছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা থাকবে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। গ্যাস সংকটের কারণে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে অনেক দিন ধরে।

পিডিবির তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের মে মাসের একদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবি সর্বোচ্চ গ্যাস পেয়েছিল এক হাজার ৪৩৪ এমএমসিএফ (মিলিয়ন ঘনফুট)। ওই মাসে দৈনিক গড়ে গ্যাস পেয়েছে এক হাজার ৩২০ এমএমডিএফ। ওই বছর দৈনিক গড়ে গ্যাস পেয়েছে এক হাজার ২০১ এমএমসিএফ।

২০২০ সালে পিডিবি দৈনিক গড়ে গ্যাস পেয়েছে এক হাজার ৮২ এমএমসিএফ, ২০২১ সালে পেয়েছে এক হাজার ৭৯ এমএমসিএফ এবং ২০২২ সালে পিডিবি দৈনিক গড়ে গ্যাস পেয়েছে এক হাজার ৯৯ এমএমসিএফ।

গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও চলমান গ্যাস সংকটের কারণে দৈনিক গড়ে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এই চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে ব্যয়বহুল তেল দিয়ে।

বৃহস্পতিবার, ০৪ আগস্ট ২০২২ , ২০ শ্রাবণ ১৪২৯ ৫ মহররম ১৪৪৪

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তুতি

বিপিসির লোকসান কমাতে চাইলে বাড়বে পিডিবির

ফয়েজ আহমেদ তুষার

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করেছে। এ সময় দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে যাচ্ছে সরকার। দাম বৃদ্ধির এই ঘোষণা আসতে পারে যেকোন সময়। এই প্রেক্ষাপটে পিডিবি বলছে, তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভর্তুকিও বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বেশকিছু দিন ধরে তেলের দাম বাড়ানোর জন্য দেন-দরবার করছে। জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি বলছে, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে তেল কিনে দেশে কম দামে বিক্রি করায় প্রতিদিন তাদের শতকোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। সরকার বলছে, এত টাকা ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি সরবরাহ করা কঠিন। তাই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে বিপিসির লোকসান কমানোর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। পিডিবি বলছে, তেলের দাম ২০ শতাংশ বাড়ানো হলে পিডিবির দৈনিক খরচ বাড়বে প্রায় ৩১৯ কোটি টাকা। এখন সরকার বিপিসির লোকসান কমাতে চাইলে পিডিবির লোকসান বেড়ে যাবে।

পিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকার আমাদের ভর্তুকি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বেড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে আমাদের ভর্তুকিও বাড়ানো প্রয়োজন। নয়তো পিডিবির লোকসান বেড়ে যাবে।’

গত ১ থেকে ৭ জুলাই তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গ্যাস, তেল, কয়লা, হাইড্রো, সৌর ও আমদানিসহ দৈনিক গড়ে ২৮৩ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ব্যয় হয়েছে ১৮৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে তেলভিত্তিক ১১০ মিলিয়ন কিলোওয়াট/ঘণ্টা (ইউনিট) বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পিডিবির ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। তেল দিয়ে গড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১১০ মিলিয়ন ইউনিট বা ৪ হাজার ৫৮৬ মেগাওয়াট। সে হিসাবে পিডিবি বলছে, এখন তেলের দাম যদি ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়, তাহলে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবির দৈনিক খরচ বাড়বে প্রায় ৮০ কোটি টাকা। একইভাবে তেলের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে খরচ বাড়বে দৈনিক ১৬০ কোটি টাকা, ১৫ শতাংশ বাড়লে খরচ বাড়বে ২৩৯ কোটি টাকা এবং তেলের দাম ২০ শতাংশ বাড়লে পিডিবির দৈনিক খরচ বাড়বে প্রায় ৩১৯ কোটি টাকা। এই টাকা ভর্তুকি হিসেবে না পেলে পিডিবিকে নির্দিষ্ট ভর্তুকির মধ্যে থাকতে হবে। অন্যথায়, তেলের দাম ৫ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে ২২৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাবে। তেলের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাবে ৪৫৯ মেগাওয়াট, ১৫ শতাংশ বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমবে ৬৮৮ মেগাওয়াট এবং ২০ শতাংশ তেলের দাম বাড়ানো হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমবে প্রায় ৯১৭ মেগাওয়াট।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় কমাতে দেশে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাধা পড়েছে। এই ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে দেশব্যাপী লোডশেডিং দিয়ে। তবে ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চলছে।

এদিকে বিতরণ কোম্পানিগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুতের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। তাই রুটিন মাফিক লোডশেডিং করতে পারছে না বিতরণ কোম্পানিগুলো।

সরকার বলছে, সেপ্টেম্বরের পর বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে। এই সময়টুকু বিদ্যুৎ সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ লক্ষ্যে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহ সংক্রান্ত একটি রোডম্যাপ (পরিকল্পনা) তৈরি করা হয়েছে। দেশে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল গত ১৬ এপ্রিল। পিডিবি বলছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা থাকবে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। গ্যাস সংকটের কারণে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে অনেক দিন ধরে।

পিডিবির তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের মে মাসের একদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবি সর্বোচ্চ গ্যাস পেয়েছিল এক হাজার ৪৩৪ এমএমসিএফ (মিলিয়ন ঘনফুট)। ওই মাসে দৈনিক গড়ে গ্যাস পেয়েছে এক হাজার ৩২০ এমএমডিএফ। ওই বছর দৈনিক গড়ে গ্যাস পেয়েছে এক হাজার ২০১ এমএমসিএফ।

২০২০ সালে পিডিবি দৈনিক গড়ে গ্যাস পেয়েছে এক হাজার ৮২ এমএমসিএফ, ২০২১ সালে পেয়েছে এক হাজার ৭৯ এমএমসিএফ এবং ২০২২ সালে পিডিবি দৈনিক গড়ে গ্যাস পেয়েছে এক হাজার ৯৯ এমএমসিএফ।

গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও চলমান গ্যাস সংকটের কারণে দৈনিক গড়ে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এই চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে ব্যয়বহুল তেল দিয়ে।