শুক্রবার, ০৫ আগস্ট ২০২২, ২১ শ্রাবণ ১৪২৯ ৬ মহররম ১৪৪৪

মানব পাচারে প্রযুক্তির অপব্যবহার

মতিউর রহমান

২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রতি বছর ৩০ জুলাই সারা বিশ্বে “মানব পাচারবিরোধী দিবস” হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দিবসটির উদ্দেশ্য পাচারেরর শিকার মানুষদের অধিকার সুরক্ষা ও প্রচার করা। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো ‘প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অপব্যবহার’। এই বছরের থিম প্রযুক্তির ভূমিকাকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ফোকাস করেছে, যা মানব পাচারে সহায়ক ও বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে।

ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম উল্লেখ করেছে যে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণ এবং কভিড-১৯ মহামারীতে এর ব্যবহার বেশি হওয়ার কারণে আমাদের দৈনন্দিন জীবন এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে স্থানান্তরিত হয়েছে- মানব পাচারের অপরাধ সাইবার স্পেসকে জয় করেছে। ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো পাচারকারীদের পাচারের যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ, শোষণ এবং পাচারের শিকারদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অসংখ্য সরঞ্জাম সরবরাহ করে; তাদের পরিবহন এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করে; পাচারের শিকার মানুষের বিজ্ঞাপন এবং সম্ভাব্য ক্লায়েন্টদের কাছে পৌঁছান; অপরাধীদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ; এবং অপরাধমূলক আয় লুকান- এবং এই সমস্ত কিছু দ্রুত, কম খরচে এবং পরিচয় গোপন রাখতে সহায়তা করছে।

সংস্থাটি আরও উল্লেখ করেছে যে প্রযুক্তি মানব পাচারে জড়িত অপরাধীদের আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করতে এবং তাদের শনাক্তকরণ এড়াতে অনেক সময় সহায়ক হয়। পাচারকারীরা শিশুসহ নারী ও পুরুষ ভিকটিমদের শনাক্ত করতে, তাদের এজেন্ট নিয়োগ করতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। ই-মেইল এবং মেসেজিং এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে পাচারযোগ্য ব্যক্তিদের প্রলুব্ধ করা ও সম্ভাব্য এজেন্টদের পাচারযোগ্য ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানতে বিজ্ঞাপন দেয়ার সুবিধা দেয়।

বাংলাদেশে মানব পাচার একটি অতি সাধারণ ঘটনা। বেকারত্ব, সীমিত আয়, জীবিকার অনিশ্চয়তা এবং সমৃদ্ধির লোভ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা মানব পাচারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। মানব পাচারের মূল কারণগুলো তীব্রতর হচ্ছে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে যে আগামী দিনে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। সাম্প্রতিক প্রবণতা এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলোর ধরন দেখলে এটা সহজেই বোঝা যায় যে পাচারকারীরা মানব পাচারের সম্ভাব্য শিকারদের প্রলুব্ধ করার জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যেমন : টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে আসছে। মাস কয়েক আগে ভারতে আটক টিকটক হৃদয় গ্যাংসহ অন্যদের ঘটনা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে বছরে হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু বিদেশে পাচার হচ্ছে। কিন্তু প্রতি বছর কত মানুষ পাচার হয় তার কোন সঠিক রেকর্ড বা পরিসংখ্যান নেই। মানুষ জীবিকার তাগিদে ও উন্নত জীবনের আশায় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে পাড়ি জমাতে চায়। পাচারকারীরা এই সমস্ত মানুষের সরলতার সুযোগ নেয়। এসব মানুষ পাচারের পাশাপাশি আরও কিছু অপরাধের শিকার হয়।

যেমন প্রতারণা, জোরপূর্বক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, জোরপূর্বক যৌনতা, জোরপূর্বক শ্রম, মুক্তিপণ, মাদক পাচার, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রয়, বিপজ্জনক খেলায় নিয়োজন, এমনকি মুক্তিপণের টাকা না পেলে অনেককে হত্যা করা হয়। মানব পাচারকে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় কারণ এর মাধ্যমে অনেকগুলো অপরাধ একসঙ্গে সংগঠিত হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ‘৩৯ ট্রাফিকিং ইন পারসনস ২০২২’ সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সবমান পরিমাপ করে বাংলাদেশকে টায়ার ২-এ রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার মানব পাচার রোধে বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও, পাচারের ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের চিহ্নিত করতে বিগত বছরের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এখনো অভিবাসী কর্মীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি নিয়ে থাকে এবং অবৈধভাবে কর্মী প্রেরণকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

মানব পাচারের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, একজন মানুষ এই জঘন্য অপরাধ করতে পারে না। এ অপরাধের পেছনে রয়েছে একটি বিশাল চক্র। যেসব দেশে মানব পাচার হয় সেসব দেশের দালালদের মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। গ্রুপ পরিকল্পনার মাধ্যমে এই অপরাধ সংঘটিত হয়। বিভিন্ন তদন্তে উঠে এসেছে যে যারা সমুদ্রপথে মানব পাচার করে তারা মৌসুম হিসেব করে মানব পাচার করে। পাচারকারীরা একটি মৌসুম বেছে নেয় এবং সেই অনুযায়ী লোক পাচার করে। তারা শরৎ ও শীতকে পাচারের ঋতু হিসেবে বিবেচনা করে, কারণ এই সময়ে সমুদ্র তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকে। তাই তারা ছোট নৌকায় করে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে মানুষ পাচার করে। প্রতি বছরই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে মানব পাচার সে সঙ্গে পাচারের শিকার মানুষের প্রাণহানি।

নারী-পুরুষ ও শিশুদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য মানব পাচার বন্ধ করতে হবে এবং এর জন্য সমাজের সচেতন মহলকে শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাচার রোধে দেশব্যাপী জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম ও সামাজিক আন্দোলন করা খুবই জরুরি। মানব পাচার প্রতিরোধে জাতীয় ও গ্রাম পর্যায়ে সভা, সমাবেশ, সেমিনার, আলোচনা ও মতবিনিময়ের আয়োজন করা যেতে পারে। এতে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, স্থানীয় নেতা, শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে। তারা নিজ নিজ

এলাকায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে।

মানব পাচার রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা রাখতে পারে। গণমাধ্যম নিয়মিত জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান ও সতর্কতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। কয়েক বছর ধরে গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করছে যেমন নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নিয়মিত

বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, ফিচার ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। তবে মানব পাচার ও এর পরিণাম সম্পর্কিত বিষয়টি চলচ্চিত্র ও নাটকে এখনো ব্যাপকভাবে উঠে আসেনি। মানব পাচারের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে চলচ্চিত্র ও নাটক সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।

অনলাইনে পাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকি কমাতে ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার নিরাপদ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা এবং মানব পাচার প্রতিরোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি

টঘউঙঈ যেমন উল্লেখ করেছে, মানব পাচার প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহারেরও একটি দুর্দান্ত সুযোগ রয়েছে। মানব পাচার নির্মূলে ভবিষ্যৎ সাফল্য নির্ভর করবে কীভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা এবং অন্যরা তাদের কার্যাবলিতে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারছে, যার মধ্যে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পাচারকারীদের গতিবিধি নজরদারিতে রাখা, পাচারকারী নেটওয়ার্কের পদ্ধতির ওপর নজর রাখা, পাচারের ঘটনা তদন্তে প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া; ফৌজদারি মামলায় ভিকটিমদের সহায়তা করার জন্য ডিজিটাল প্রমাণের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া বৃদ্ধি করা; এবং পাচারের শিকার বেঁচে থাকা উদ্ধারকৃত ব্যক্তিদের সহায়তা পরিষেবা প্রদান করা।

অনলাইনে পাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকি কমাতে ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার নিরাপদ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা এবং মানব পাচার প্রতিরোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি। মানব পাচার প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় সহায়তার জন্য টেকসই প্রযুক্তিভিত্তিক সমাধান বাড়ানোর জন্য উদ্ভাবন এবং দক্ষতাকে কাজে লাগানোর জন্য বেসরকারি খাতের সঙ্গে সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ।

মানব পাচার আধুনিক সভ্যতার অন্যতম জঘন্য অপরাধ। বিদ্যমান মানব পাচার আইন-২০১২ এর যথাযথ প্রয়োগ, সরকারের সক্রিয় পদক্ষেপ এবং এনজিও এবং গণমাধ্যমগুলোর সচেতনতামূলক কার্যক্রম নিঃসন্দেহে অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা কমাতে পারে। মানুষকে সচেতন করতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার মানব পাচার রোধেও সাহায্য করতে পারে। এ ছাড়া এ ধরনের জঘন্য অপরাধ নির্মূলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সর্বদা সক্রিয় ও কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে মানব পাচার বন্ধ হবে না।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

শুক্রবার, ০৫ আগস্ট ২০২২ , ২১ শ্রাবণ ১৪২৯ ৬ মহররম ১৪৪৪

মানব পাচারে প্রযুক্তির অপব্যবহার

মতিউর রহমান

২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রতি বছর ৩০ জুলাই সারা বিশ্বে “মানব পাচারবিরোধী দিবস” হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দিবসটির উদ্দেশ্য পাচারেরর শিকার মানুষদের অধিকার সুরক্ষা ও প্রচার করা। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো ‘প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অপব্যবহার’। এই বছরের থিম প্রযুক্তির ভূমিকাকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ফোকাস করেছে, যা মানব পাচারে সহায়ক ও বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে।

ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম উল্লেখ করেছে যে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণ এবং কভিড-১৯ মহামারীতে এর ব্যবহার বেশি হওয়ার কারণে আমাদের দৈনন্দিন জীবন এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে স্থানান্তরিত হয়েছে- মানব পাচারের অপরাধ সাইবার স্পেসকে জয় করেছে। ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো পাচারকারীদের পাচারের যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ, শোষণ এবং পাচারের শিকারদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অসংখ্য সরঞ্জাম সরবরাহ করে; তাদের পরিবহন এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করে; পাচারের শিকার মানুষের বিজ্ঞাপন এবং সম্ভাব্য ক্লায়েন্টদের কাছে পৌঁছান; অপরাধীদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ; এবং অপরাধমূলক আয় লুকান- এবং এই সমস্ত কিছু দ্রুত, কম খরচে এবং পরিচয় গোপন রাখতে সহায়তা করছে।

সংস্থাটি আরও উল্লেখ করেছে যে প্রযুক্তি মানব পাচারে জড়িত অপরাধীদের আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করতে এবং তাদের শনাক্তকরণ এড়াতে অনেক সময় সহায়ক হয়। পাচারকারীরা শিশুসহ নারী ও পুরুষ ভিকটিমদের শনাক্ত করতে, তাদের এজেন্ট নিয়োগ করতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। ই-মেইল এবং মেসেজিং এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে পাচারযোগ্য ব্যক্তিদের প্রলুব্ধ করা ও সম্ভাব্য এজেন্টদের পাচারযোগ্য ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানতে বিজ্ঞাপন দেয়ার সুবিধা দেয়।

বাংলাদেশে মানব পাচার একটি অতি সাধারণ ঘটনা। বেকারত্ব, সীমিত আয়, জীবিকার অনিশ্চয়তা এবং সমৃদ্ধির লোভ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা মানব পাচারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। মানব পাচারের মূল কারণগুলো তীব্রতর হচ্ছে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে যে আগামী দিনে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। সাম্প্রতিক প্রবণতা এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলোর ধরন দেখলে এটা সহজেই বোঝা যায় যে পাচারকারীরা মানব পাচারের সম্ভাব্য শিকারদের প্রলুব্ধ করার জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যেমন : টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে আসছে। মাস কয়েক আগে ভারতে আটক টিকটক হৃদয় গ্যাংসহ অন্যদের ঘটনা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে বছরে হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু বিদেশে পাচার হচ্ছে। কিন্তু প্রতি বছর কত মানুষ পাচার হয় তার কোন সঠিক রেকর্ড বা পরিসংখ্যান নেই। মানুষ জীবিকার তাগিদে ও উন্নত জীবনের আশায় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে পাড়ি জমাতে চায়। পাচারকারীরা এই সমস্ত মানুষের সরলতার সুযোগ নেয়। এসব মানুষ পাচারের পাশাপাশি আরও কিছু অপরাধের শিকার হয়।

যেমন প্রতারণা, জোরপূর্বক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, জোরপূর্বক যৌনতা, জোরপূর্বক শ্রম, মুক্তিপণ, মাদক পাচার, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রয়, বিপজ্জনক খেলায় নিয়োজন, এমনকি মুক্তিপণের টাকা না পেলে অনেককে হত্যা করা হয়। মানব পাচারকে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় কারণ এর মাধ্যমে অনেকগুলো অপরাধ একসঙ্গে সংগঠিত হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ‘৩৯ ট্রাফিকিং ইন পারসনস ২০২২’ সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সবমান পরিমাপ করে বাংলাদেশকে টায়ার ২-এ রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার মানব পাচার রোধে বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও, পাচারের ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের চিহ্নিত করতে বিগত বছরের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এখনো অভিবাসী কর্মীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি নিয়ে থাকে এবং অবৈধভাবে কর্মী প্রেরণকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

মানব পাচারের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, একজন মানুষ এই জঘন্য অপরাধ করতে পারে না। এ অপরাধের পেছনে রয়েছে একটি বিশাল চক্র। যেসব দেশে মানব পাচার হয় সেসব দেশের দালালদের মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। গ্রুপ পরিকল্পনার মাধ্যমে এই অপরাধ সংঘটিত হয়। বিভিন্ন তদন্তে উঠে এসেছে যে যারা সমুদ্রপথে মানব পাচার করে তারা মৌসুম হিসেব করে মানব পাচার করে। পাচারকারীরা একটি মৌসুম বেছে নেয় এবং সেই অনুযায়ী লোক পাচার করে। তারা শরৎ ও শীতকে পাচারের ঋতু হিসেবে বিবেচনা করে, কারণ এই সময়ে সমুদ্র তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকে। তাই তারা ছোট নৌকায় করে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে মানুষ পাচার করে। প্রতি বছরই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে মানব পাচার সে সঙ্গে পাচারের শিকার মানুষের প্রাণহানি।

নারী-পুরুষ ও শিশুদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য মানব পাচার বন্ধ করতে হবে এবং এর জন্য সমাজের সচেতন মহলকে শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাচার রোধে দেশব্যাপী জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম ও সামাজিক আন্দোলন করা খুবই জরুরি। মানব পাচার প্রতিরোধে জাতীয় ও গ্রাম পর্যায়ে সভা, সমাবেশ, সেমিনার, আলোচনা ও মতবিনিময়ের আয়োজন করা যেতে পারে। এতে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, স্থানীয় নেতা, শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে। তারা নিজ নিজ

এলাকায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে।

মানব পাচার রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা রাখতে পারে। গণমাধ্যম নিয়মিত জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান ও সতর্কতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। কয়েক বছর ধরে গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করছে যেমন নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নিয়মিত

বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, ফিচার ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। তবে মানব পাচার ও এর পরিণাম সম্পর্কিত বিষয়টি চলচ্চিত্র ও নাটকে এখনো ব্যাপকভাবে উঠে আসেনি। মানব পাচারের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে চলচ্চিত্র ও নাটক সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।

অনলাইনে পাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকি কমাতে ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার নিরাপদ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা এবং মানব পাচার প্রতিরোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি

টঘউঙঈ যেমন উল্লেখ করেছে, মানব পাচার প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহারেরও একটি দুর্দান্ত সুযোগ রয়েছে। মানব পাচার নির্মূলে ভবিষ্যৎ সাফল্য নির্ভর করবে কীভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা এবং অন্যরা তাদের কার্যাবলিতে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারছে, যার মধ্যে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পাচারকারীদের গতিবিধি নজরদারিতে রাখা, পাচারকারী নেটওয়ার্কের পদ্ধতির ওপর নজর রাখা, পাচারের ঘটনা তদন্তে প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া; ফৌজদারি মামলায় ভিকটিমদের সহায়তা করার জন্য ডিজিটাল প্রমাণের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া বৃদ্ধি করা; এবং পাচারের শিকার বেঁচে থাকা উদ্ধারকৃত ব্যক্তিদের সহায়তা পরিষেবা প্রদান করা।

অনলাইনে পাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকি কমাতে ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার নিরাপদ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা এবং মানব পাচার প্রতিরোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি। মানব পাচার প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় সহায়তার জন্য টেকসই প্রযুক্তিভিত্তিক সমাধান বাড়ানোর জন্য উদ্ভাবন এবং দক্ষতাকে কাজে লাগানোর জন্য বেসরকারি খাতের সঙ্গে সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ।

মানব পাচার আধুনিক সভ্যতার অন্যতম জঘন্য অপরাধ। বিদ্যমান মানব পাচার আইন-২০১২ এর যথাযথ প্রয়োগ, সরকারের সক্রিয় পদক্ষেপ এবং এনজিও এবং গণমাধ্যমগুলোর সচেতনতামূলক কার্যক্রম নিঃসন্দেহে অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা কমাতে পারে। মানুষকে সচেতন করতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার মানব পাচার রোধেও সাহায্য করতে পারে। এ ছাড়া এ ধরনের জঘন্য অপরাধ নির্মূলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সর্বদা সক্রিয় ও কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে মানব পাচার বন্ধ হবে না।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]