ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়, গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা

রাজধানীতে গণপরিবহনের ভাড়া যা বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি আদায় করছে পরিবহন শ্রমিকরা। কোথাও কোথাও আদায় করা হচ্ছে দেড় গুণের বেশি। অথচ মহানগর পর্যায়ে বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ১৬ শতাংশ। কিন্তু বাস কর্মচারী তা আদায় করছে ৫০ শতাংশ। এ নিয়ে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন রুটে যাত্রী ও বাস শ্রমিকদের মধ্যে বাগবিত-া হয়েছে।

রাজধানীর গুলিস্তান থেকে মিরপুরে আগে ভাড়া ছিল ৩০ টাকা। এখন ৫০ টাকায় আদায় করছে বলে যাত্রীরা জানান। রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় জামাল নামের মিরপুরের এক যাত্রী সংবাদকে বলেন, ‘গত শুক্রবার শিকড় পরিবহনে গুলিস্তান থেকে মিরপুর গেছি ৩০ টাকায়। এখন নেয়া হচ্ছে ৫০ টাকা। ১৬ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। সে হিসাবে মিরপুরের ভাড়া হওয়ার কথা ৩৬ টাকা। কিন্তু বাসওয়ারা নিচ্ছে ৫০ টাকা।’

একই অবস্থা অন্যান্য রুটেও। তবে গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধির প্রথমদিন গতকাল কোন বাস-মিনিবাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা দেখা যায়নি। তাই অনেক গণপরিবহন ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে বলে অভিযোগ করেন যাত্রীরা। বাস ও মিনিবাসে সর্বনি¤œ ভাড়া ১০ টাকা ও ৮ টাকা নির্ধারণ করা হলেও তা মানছে অনেক পরিবহন চালকরা। ১০ টাকার ভাড়া ১৫-২০ নেয়ার অভিযোগ করেন যাত্রীরা। তবে গতকাল রাজধানী গণপরিবহনের সংখ্যা কিছুটা কম দেখা গেছে। আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার বাসে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে পরিবহন কোম্পানি। ভাড়া নির্ধারণের সরকারি তালিকা ছিল না কোন বাসে।

গতকাল এক প্রজ্ঞাপনে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার রুটে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি সর্বোচ্চ ভাড়া এক টাকা ৮০ পয়সার জায়গায় ২ টাকা ২০ পয়সা; ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী বাসের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটার যাত্রীপ্রতি ভাড়া ২ টাকা ১৫ পয়সার স্থলে ২ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করেছে সরকার। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী মিনিবাস এবং ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) আওতাধীন জেলার (নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা) অভ্যন্তরে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি ভাড়া ২ টাকা ০৫ পয়সার স্থলে ২ টাকা ৪০ পয়সা। যা গতকাল থেকে কার্যকর করা হয়েছে।

ভাড়া বৃদ্ধির প্রথমদিন সরেজমিন বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, ‘গতকাল সকালে রাজধানীর থেকে বিভিন্ন সড়কে বাস-মিনিবাসের চেয়ে যাত্রীদের চাপ বেশি ছিল। যাত্রীদের তুলনায় গণপরিবহন সংখ্যা কিছুটা কম দেখা গেছে। প্রতিটি বাস যাত্রী পূর্ণ অবস্থা চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার বেশি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেন যাত্রীরা।

মাসুদ নামের অন্য এক যাত্রী বলেন, ‘সব বাসেরই আগে ফার্মগেট থেকে গুলিস্তান নেয়া হতো ১০ টাকা। এখন নেয় ১৫ টাকা। অথচ বাসের সর্বনি¤œ ১০ টাকা ভাড়া কিন্তু বাড়ানো হয়নি। বাসের উঠলে এখন ১৫ টাকা দিতে হচ্ছে।’ একই অবস্থা অন্যান্য রুটেও। যাত্রাবাড়ী এলাকায় মিলন নামের এক যাত্রী সংবাদকে বলেন, ‘ট্রান্স সিলভা পরিবহন আগে যাত্রাবাড়ী-মিরপুরের ভাড়া নেয়া হতো ৪০ টাকা। এখন নিচ্ছে ৫০ টাকা। এছাড়া বাসও কম। গাদাগাদি বাসে উঠতে হয়।’

বন্ধ রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি

গণপরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির প্রথমদিন গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন রুটে বাস বন্ধ রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে মলিকরা। তাই বিভিন্ন রুটে বাসের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে দেখা গেছে যাত্রীদের। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা জানান, আবদুল্লাহপুর থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত আমাদের ভাড়া হয় ৯০ টাকা কিন্তু যাত্রীরা ৭০-৮০ টাকার বেশি দিতে চাচ্ছে না। এ নিয়ে প্রায় সবখানেই যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে ঝগড়ার সৃষ্টি হচ্ছে। মূলত সেই কারণে সড়কে গণপরিবহনের সংখ্যা কম। তাই রাজধানীতে গণপরিবহনের সংখ্যা কম থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে যাত্রীদের। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, মিরপুর, রামপুরা, উত্তরা, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, বনানী মহাখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়কের পাশে গণপরিবহনের অপেক্ষায় যাত্রীদের অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। যদিও কিছু সংখ্যক গণপরিবহন সড়কে চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে যাত্রীর তুলনায় এর সংখ্যা অনেক কম বলে জানিয়েছে যাত্রী ও পথচারীরা। অনেকেই বলছেন, যখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম নি¤œমুখী তখন আমাদের দেশে তেলের দাম বেড়ে আকাশচুম্বী। সব দিক থেকে আমরা মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তের সব জ্বালা সহ্য করতে হচ্ছে। এদিকে সবকিছুরই দাম বাড়তি, কিন্তু আমাদের বেতন বাড়ছে না। খরচের পরিমাণ বেড়েছে। এখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

গণপরিবহন মনজিল এক্সপ্রেস পরিবহন বাসের সুপারভাইজার মো. সুমন বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহনের ভাড়াও বেড়েছে। কিন্তু যাত্রীরা তা দিতে চায় না। এদিকে ডিপো থেকে গাড়ি বের করে চালালে ওই তেলের খচর উঠে না। বাড়তি ভাড়া নিয়ে প্রায় বিভিন্ন জায়গাতে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের ঝামেলা লাগছে। তাই আমরা সব পরিবহন সড়কে বের করিনি।’ তিনি বলেন, ‘মনজিল এক্সপ্রেস পরিবহনের ৭০টি বাস রয়েছে। গতকাল মাত্র ১১টি পরিবহন সড়কে চলাচল করছে। বাকিগুলো ডিপোতে পড়ে আছে। আমরা কোন ঝামেলা চাই না তাই সড়কে পরিবহন কম বের করেছি।’

সাইফুল নামের এক যাত্রী বলেন, ‘গেল দফায় গণপরিবহনের ভাড়া বাড়লো। এবার আমার গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ালো। আমাদের খরচ প্রতিদিনই বাড়ছে কিন্তু আয় তো বাড়ছে না। অফিস তো বেতন বাড়ায় না। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় আমাদেরই পকেট কাঁটা যাচ্ছে। দুই টাকা সঞ্চয় করবো কোথায়, পাঁচ টাকা ধার করে চলতে হচ্ছে।’

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘আমাদের সব মিলিয়ে ব্যয় ৭০ শতাংশ বাড়লেও জনগণের কথা মাথায় নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। কেউ যদি অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবস্থা নেবে। মালিক সমিতিও কঠোর আছে এ বিষয়ে।’

দূরপাল্লার বাসে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার বাসে ২২ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি হলেও তারা ভাড়া আদায় করছে ইচ্ছেমতো। যাত্রী পাওয়ার জন্য অনেক বাসে আবার সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও কম নেয়া হচ্ছে। তবে দূরপাল্লার বাসে এত বেশি ভাড়া বাড়নো ঠিক হয় না। কারণ এই ভাড়া তারা উঠাতে পারবে না। প্রতিযোগিতা করে এরচেয়ে কম নিতে হবে বলে বাস মালিকরা জানান।

সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, একেক বাসে এক এক রকম ভাড়া নিতে দেখা গেছে। কোন বাসে আগের থেকে ৫০ টাকা বেশি। কাউকে আবার ৭০ টাকা বেশি নিতে দেখা গেছে। তবে যাত্রী পাওয়ার অনেককে তার চেয়েও কম নিতে দেখা গেছে। তবে কোন বাসেই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা দেখা যায়নি।

শ্যামলী কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নন-এসি বাসের টিকেটের দাম রাখা হচ্ছে ৬৫০ টাকা। আগে এই টিকেটের দাম ছিল ৫৮০ টাকা। এসি বাসের টিকেটের দাম ছিল ৮০০ টাকা, গতকাল থেকে তা নেয়া হচ্ছে ৯০০ টাকা। শ্যামলী বাসে ঢাকা থেকে কক্সবাজার নন-এসি বাসের ভাড়া ছিল ৯০০ টাকা, গতকাল তা নেয়া হচ্ছে ১০০০ টাকা। এসি বাসের ভাড়া ছিল ১২০০ টাকা, গতকাল তা নেয়া হচ্ছে ১৩০০ টাকা। ঢাকা থেকে সিলেট নন-এসি বাসের ভাড়া ছিল ৫৭০ টাকা, গতকাল থেকে তা বিক্রি হয়েছে ৬৫০ টাকা। এসি বাসের ভাড়া ছিল ৭০০ টাকা, গতকাল থেকে নেয়া হচ্ছে ৮০০ টাকা। শ্যামলী কাউন্টারের টিকেট বিক্রেতা সোহরাব মিয়া বলেন, ‘আমরা প্রতি টিকেটে ৬০-৭০ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। এখনও সরকারি তালিকা পাইনি। সরকারি তালিকা পেলে এই ভাড়া আরও বাড়তে পারে।’

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নন-এসি হানিফ বাসের ৫৮০ টাকার ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৭০০ টাকা। কক্সবাজারের ৯০০ টাকার টিকেট ১০০০ টাকা এবং সিলেটের ৫৭০ টাকার টিকেট নেয়া হচ্ছে ৭০০ টাকা। এ বিষয়ে কাউন্টারের টিকেট বিক্রেতা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘একেক বাসে একেক ভাড়া। সরকারিভাবে এখনও ভাড়ার চার্ট করা হয়নি। সেটি হয়ে গেলে সবার কাছে চার্ট চলে যাবে, আমরাও সে অনুযায়ী ভাড়া নেব।’

সেন্ট মার্টিন ট্রাভেলসে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসি বাসের টিকেটের দাম ৭৫০ টাকা ছিল, গতকাল ১৫০ টাকা বাড়িয়ে ৯০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। কক্সবাজারের ভাড়া ছিল ১২০০ টাকা, ২০০ টাকা বাড়িয়ে গতকাল তা নেয়া হচ্ছে ১৪০০ টাকা। আর বরিশালের এসি বাসের ভাড়া ৬৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৭৫০ টাকা করা হয়েছে। এস আলম পরিবহনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের নন-এসি বাসের টিকেট ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৬৮০ টাকা আর কক্সবাজারের এসি বাসের ৯০০ টাকার টিকেটের দাম গতকাল ১০০০ টাকা বিক্রি করা হয়।

ঢাকা থেকে নোয়াখালীগামী বাসে সবচেয়ে বেশি ভাড়া বাড়িয়েছে ইকোনো সার্ভিস। কাউন্টারে গিয়ে জানা যায়, ঢাকা থেকে নোয়াখালীর ভাড়া আগে ছিল ৪৫০ টাকা, গতকাল ২০০ টাকা ভাড়া বাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে ৬৫০ টাকা। ইকোনো বাস কাউন্টারের টিকেট বিক্রেতা শরীফুল ইসলাম জানান, তেলের দাম বাড়ছে। সকাল থেকে যাত্রী কম, ভাড়া না বাড়ালে তেলের পয়সাও উঠবে না। নোয়াখালীগামী একুশে এক্সপ্রেসে ৫০ টাকা বাড়িয়ে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৫০০ টাকা। ড্রিম লাইনে ঢাকা থেকে বসুরহাট (নোয়াখালী) নন-এসি বাসের ভাড়া ছিল ৩৬০ টাকা। গতকাল ৯০ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪৫০ টাকা। এসি বাসের ভাড়া ছিল ৩৮০ টাকা, ১০০ টাকা বাড়িয়ে গতকাল তারা বিক্রি করে ৪৮০ টাকায়।

image

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও গণপরিবহনে ভাড়া-নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে গতকাল শাহবাগ মোড়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভে পুলিশের লাঠিচার্জ -সংবাদ

আরও খবর
জ্বালানি তেলের দামের প্রভাব : জীবনযাত্রার ব্যয়ে চাপ, ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ
একেক দিন একেক এলাকায় শিল্প-কারখানা বন্ধ
বাংলাদেশ ‘এক চীন’ নীতিতে বিশ্বাস করে
পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার সুযোগ কালো টাকার মালিকদের নয় এনবিআর চেয়ারম্যান
ভোগান্তি দূরপাল্লার যাত্রীদের
চলন্ত বাস থেকে স্বামীকে ফেলে দিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণ, ৫ আসামির স্বীকারোক্তি
‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ও পরিবীক্ষণ ইউনিট’ গুটানোর উদ্যোগ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, জ¦রের সঙ্গে চোখ রাঙাচ্ছে ডায়রিয়া

সোমবার, ০৮ আগস্ট ২০২২ , ২৪ শ্রাবণ ১৪২৯ ৯ মহররম ১৪৪৪

ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়, গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা

image

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও গণপরিবহনে ভাড়া-নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে গতকাল শাহবাগ মোড়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভে পুলিশের লাঠিচার্জ -সংবাদ

রাজধানীতে গণপরিবহনের ভাড়া যা বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি আদায় করছে পরিবহন শ্রমিকরা। কোথাও কোথাও আদায় করা হচ্ছে দেড় গুণের বেশি। অথচ মহানগর পর্যায়ে বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ১৬ শতাংশ। কিন্তু বাস কর্মচারী তা আদায় করছে ৫০ শতাংশ। এ নিয়ে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন রুটে যাত্রী ও বাস শ্রমিকদের মধ্যে বাগবিত-া হয়েছে।

রাজধানীর গুলিস্তান থেকে মিরপুরে আগে ভাড়া ছিল ৩০ টাকা। এখন ৫০ টাকায় আদায় করছে বলে যাত্রীরা জানান। রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় জামাল নামের মিরপুরের এক যাত্রী সংবাদকে বলেন, ‘গত শুক্রবার শিকড় পরিবহনে গুলিস্তান থেকে মিরপুর গেছি ৩০ টাকায়। এখন নেয়া হচ্ছে ৫০ টাকা। ১৬ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। সে হিসাবে মিরপুরের ভাড়া হওয়ার কথা ৩৬ টাকা। কিন্তু বাসওয়ারা নিচ্ছে ৫০ টাকা।’

একই অবস্থা অন্যান্য রুটেও। তবে গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধির প্রথমদিন গতকাল কোন বাস-মিনিবাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা দেখা যায়নি। তাই অনেক গণপরিবহন ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে বলে অভিযোগ করেন যাত্রীরা। বাস ও মিনিবাসে সর্বনি¤œ ভাড়া ১০ টাকা ও ৮ টাকা নির্ধারণ করা হলেও তা মানছে অনেক পরিবহন চালকরা। ১০ টাকার ভাড়া ১৫-২০ নেয়ার অভিযোগ করেন যাত্রীরা। তবে গতকাল রাজধানী গণপরিবহনের সংখ্যা কিছুটা কম দেখা গেছে। আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার বাসে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে পরিবহন কোম্পানি। ভাড়া নির্ধারণের সরকারি তালিকা ছিল না কোন বাসে।

গতকাল এক প্রজ্ঞাপনে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার রুটে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি সর্বোচ্চ ভাড়া এক টাকা ৮০ পয়সার জায়গায় ২ টাকা ২০ পয়সা; ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী বাসের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটার যাত্রীপ্রতি ভাড়া ২ টাকা ১৫ পয়সার স্থলে ২ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করেছে সরকার। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী মিনিবাস এবং ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) আওতাধীন জেলার (নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা) অভ্যন্তরে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি ভাড়া ২ টাকা ০৫ পয়সার স্থলে ২ টাকা ৪০ পয়সা। যা গতকাল থেকে কার্যকর করা হয়েছে।

ভাড়া বৃদ্ধির প্রথমদিন সরেজমিন বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, ‘গতকাল সকালে রাজধানীর থেকে বিভিন্ন সড়কে বাস-মিনিবাসের চেয়ে যাত্রীদের চাপ বেশি ছিল। যাত্রীদের তুলনায় গণপরিবহন সংখ্যা কিছুটা কম দেখা গেছে। প্রতিটি বাস যাত্রী পূর্ণ অবস্থা চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার বেশি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেন যাত্রীরা।

মাসুদ নামের অন্য এক যাত্রী বলেন, ‘সব বাসেরই আগে ফার্মগেট থেকে গুলিস্তান নেয়া হতো ১০ টাকা। এখন নেয় ১৫ টাকা। অথচ বাসের সর্বনি¤œ ১০ টাকা ভাড়া কিন্তু বাড়ানো হয়নি। বাসের উঠলে এখন ১৫ টাকা দিতে হচ্ছে।’ একই অবস্থা অন্যান্য রুটেও। যাত্রাবাড়ী এলাকায় মিলন নামের এক যাত্রী সংবাদকে বলেন, ‘ট্রান্স সিলভা পরিবহন আগে যাত্রাবাড়ী-মিরপুরের ভাড়া নেয়া হতো ৪০ টাকা। এখন নিচ্ছে ৫০ টাকা। এছাড়া বাসও কম। গাদাগাদি বাসে উঠতে হয়।’

বন্ধ রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি

গণপরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির প্রথমদিন গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন রুটে বাস বন্ধ রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে মলিকরা। তাই বিভিন্ন রুটে বাসের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে দেখা গেছে যাত্রীদের। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা জানান, আবদুল্লাহপুর থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত আমাদের ভাড়া হয় ৯০ টাকা কিন্তু যাত্রীরা ৭০-৮০ টাকার বেশি দিতে চাচ্ছে না। এ নিয়ে প্রায় সবখানেই যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে ঝগড়ার সৃষ্টি হচ্ছে। মূলত সেই কারণে সড়কে গণপরিবহনের সংখ্যা কম। তাই রাজধানীতে গণপরিবহনের সংখ্যা কম থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে যাত্রীদের। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, মিরপুর, রামপুরা, উত্তরা, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, বনানী মহাখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়কের পাশে গণপরিবহনের অপেক্ষায় যাত্রীদের অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। যদিও কিছু সংখ্যক গণপরিবহন সড়কে চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে যাত্রীর তুলনায় এর সংখ্যা অনেক কম বলে জানিয়েছে যাত্রী ও পথচারীরা। অনেকেই বলছেন, যখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম নি¤œমুখী তখন আমাদের দেশে তেলের দাম বেড়ে আকাশচুম্বী। সব দিক থেকে আমরা মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তের সব জ্বালা সহ্য করতে হচ্ছে। এদিকে সবকিছুরই দাম বাড়তি, কিন্তু আমাদের বেতন বাড়ছে না। খরচের পরিমাণ বেড়েছে। এখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

গণপরিবহন মনজিল এক্সপ্রেস পরিবহন বাসের সুপারভাইজার মো. সুমন বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহনের ভাড়াও বেড়েছে। কিন্তু যাত্রীরা তা দিতে চায় না। এদিকে ডিপো থেকে গাড়ি বের করে চালালে ওই তেলের খচর উঠে না। বাড়তি ভাড়া নিয়ে প্রায় বিভিন্ন জায়গাতে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের ঝামেলা লাগছে। তাই আমরা সব পরিবহন সড়কে বের করিনি।’ তিনি বলেন, ‘মনজিল এক্সপ্রেস পরিবহনের ৭০টি বাস রয়েছে। গতকাল মাত্র ১১টি পরিবহন সড়কে চলাচল করছে। বাকিগুলো ডিপোতে পড়ে আছে। আমরা কোন ঝামেলা চাই না তাই সড়কে পরিবহন কম বের করেছি।’

সাইফুল নামের এক যাত্রী বলেন, ‘গেল দফায় গণপরিবহনের ভাড়া বাড়লো। এবার আমার গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ালো। আমাদের খরচ প্রতিদিনই বাড়ছে কিন্তু আয় তো বাড়ছে না। অফিস তো বেতন বাড়ায় না। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় আমাদেরই পকেট কাঁটা যাচ্ছে। দুই টাকা সঞ্চয় করবো কোথায়, পাঁচ টাকা ধার করে চলতে হচ্ছে।’

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘আমাদের সব মিলিয়ে ব্যয় ৭০ শতাংশ বাড়লেও জনগণের কথা মাথায় নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। কেউ যদি অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবস্থা নেবে। মালিক সমিতিও কঠোর আছে এ বিষয়ে।’

দূরপাল্লার বাসে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার বাসে ২২ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি হলেও তারা ভাড়া আদায় করছে ইচ্ছেমতো। যাত্রী পাওয়ার জন্য অনেক বাসে আবার সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও কম নেয়া হচ্ছে। তবে দূরপাল্লার বাসে এত বেশি ভাড়া বাড়নো ঠিক হয় না। কারণ এই ভাড়া তারা উঠাতে পারবে না। প্রতিযোগিতা করে এরচেয়ে কম নিতে হবে বলে বাস মালিকরা জানান।

সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, একেক বাসে এক এক রকম ভাড়া নিতে দেখা গেছে। কোন বাসে আগের থেকে ৫০ টাকা বেশি। কাউকে আবার ৭০ টাকা বেশি নিতে দেখা গেছে। তবে যাত্রী পাওয়ার অনেককে তার চেয়েও কম নিতে দেখা গেছে। তবে কোন বাসেই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা দেখা যায়নি।

শ্যামলী কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নন-এসি বাসের টিকেটের দাম রাখা হচ্ছে ৬৫০ টাকা। আগে এই টিকেটের দাম ছিল ৫৮০ টাকা। এসি বাসের টিকেটের দাম ছিল ৮০০ টাকা, গতকাল থেকে তা নেয়া হচ্ছে ৯০০ টাকা। শ্যামলী বাসে ঢাকা থেকে কক্সবাজার নন-এসি বাসের ভাড়া ছিল ৯০০ টাকা, গতকাল তা নেয়া হচ্ছে ১০০০ টাকা। এসি বাসের ভাড়া ছিল ১২০০ টাকা, গতকাল তা নেয়া হচ্ছে ১৩০০ টাকা। ঢাকা থেকে সিলেট নন-এসি বাসের ভাড়া ছিল ৫৭০ টাকা, গতকাল থেকে তা বিক্রি হয়েছে ৬৫০ টাকা। এসি বাসের ভাড়া ছিল ৭০০ টাকা, গতকাল থেকে নেয়া হচ্ছে ৮০০ টাকা। শ্যামলী কাউন্টারের টিকেট বিক্রেতা সোহরাব মিয়া বলেন, ‘আমরা প্রতি টিকেটে ৬০-৭০ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। এখনও সরকারি তালিকা পাইনি। সরকারি তালিকা পেলে এই ভাড়া আরও বাড়তে পারে।’

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নন-এসি হানিফ বাসের ৫৮০ টাকার ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৭০০ টাকা। কক্সবাজারের ৯০০ টাকার টিকেট ১০০০ টাকা এবং সিলেটের ৫৭০ টাকার টিকেট নেয়া হচ্ছে ৭০০ টাকা। এ বিষয়ে কাউন্টারের টিকেট বিক্রেতা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘একেক বাসে একেক ভাড়া। সরকারিভাবে এখনও ভাড়ার চার্ট করা হয়নি। সেটি হয়ে গেলে সবার কাছে চার্ট চলে যাবে, আমরাও সে অনুযায়ী ভাড়া নেব।’

সেন্ট মার্টিন ট্রাভেলসে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসি বাসের টিকেটের দাম ৭৫০ টাকা ছিল, গতকাল ১৫০ টাকা বাড়িয়ে ৯০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। কক্সবাজারের ভাড়া ছিল ১২০০ টাকা, ২০০ টাকা বাড়িয়ে গতকাল তা নেয়া হচ্ছে ১৪০০ টাকা। আর বরিশালের এসি বাসের ভাড়া ৬৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৭৫০ টাকা করা হয়েছে। এস আলম পরিবহনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের নন-এসি বাসের টিকেট ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৬৮০ টাকা আর কক্সবাজারের এসি বাসের ৯০০ টাকার টিকেটের দাম গতকাল ১০০০ টাকা বিক্রি করা হয়।

ঢাকা থেকে নোয়াখালীগামী বাসে সবচেয়ে বেশি ভাড়া বাড়িয়েছে ইকোনো সার্ভিস। কাউন্টারে গিয়ে জানা যায়, ঢাকা থেকে নোয়াখালীর ভাড়া আগে ছিল ৪৫০ টাকা, গতকাল ২০০ টাকা ভাড়া বাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে ৬৫০ টাকা। ইকোনো বাস কাউন্টারের টিকেট বিক্রেতা শরীফুল ইসলাম জানান, তেলের দাম বাড়ছে। সকাল থেকে যাত্রী কম, ভাড়া না বাড়ালে তেলের পয়সাও উঠবে না। নোয়াখালীগামী একুশে এক্সপ্রেসে ৫০ টাকা বাড়িয়ে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৫০০ টাকা। ড্রিম লাইনে ঢাকা থেকে বসুরহাট (নোয়াখালী) নন-এসি বাসের ভাড়া ছিল ৩৬০ টাকা। গতকাল ৯০ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪৫০ টাকা। এসি বাসের ভাড়া ছিল ৩৮০ টাকা, ১০০ টাকা বাড়িয়ে গতকাল তারা বিক্রি করে ৪৮০ টাকায়।