অর্থনৈতিক সংকট : মুক্তি কোন পথে

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করে সারা দেশে বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা লোডশেডিংয়ের কারণে জনগণ ভোগান্তিতে পড়েছে। আমরা সবাই জানতাম যে দেশে তেমন বিদ্যুতের ঘাটতি নেই। তাই স্বাভাবিকভাবে জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। জানা যায় যে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি সংকট ও উচ্চমূল্যের কারণে একদিকে সরবরাহের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ফলে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিঘœ ঘটছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। অন্যদিকে অনেক তেলচালিত বিদ্যুতের প্লান্ট বন্ধ রাখতে হয়েছে উৎপাদনে সরকারি ভর্তুকি বা খরচ বাড়ার কারণে।

বিগত এক দশকে বিদ্যুৎ খাত যে সাফল্য অর্জন করেছে, জ্বালানি খাত সে তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। অথচ জ্বালানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় জ্বালানির অভাবে বড় অঙ্কের বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। তদুপরি, উৎপাদিত বিদ্যুতের সিংহভাগ নির্ভর করে আমদানি করা জ্বালানির ওপর, যার পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। ২০১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশীয় গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ, যা কিনা ২০২২ সালে কমে প্রায় ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। এর কারণ হলো দেশে নিজস্ব গ্যাস উৎপাদনের হার কমে গেছে। আর এর ফলে দেশীয় জ্বালানি তথা গ্যাসের পরিবর্তে ব্যবহার বাড়ছে আমদানি করা অতি উচ্চমূল্যের এলএনজির ব্যবহার। প্রতি ইউনিট দেশীয় গ্যাসের মূল্য যেখানে ২ থেকে ৩ ডলার, সেখানে প্রতি ইউনিট আমদানি করা গ্যাসের জন্য ব্যয় হয় ১২ ডলার থেকে ৩৫ ডলার পর্যন্ত। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের উচ্চমূল্যের ফলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে রিজার্ভে চাপ তৈরি করছে।

জ¦ালানি সংকট উত্তোরণের উপায় কী? সম্প্রতি ঘোষিত জাতীয় বাজেটে দেশে জ্বালানি সংকট মেটানোর কোনো দীর্ঘমেয়াদি বা স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থাপনার দিকনির্দেশনা নেই। কী রকম হবে দেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নের পথরেখা বা রোডম্যাপ? একটি জাতীয় বাজেট শুধু বিভিন্ন খাতে অর্থ বরাদ্দের নথি নয় বরং এটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের রূপরেখা, সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার দর্শন বটে। বিগত ২০ বছরে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে বা দেশীয় কয়লা উন্নয়নে যে ন্যূনতম কর্মধারা চলে, তাতে আর যাই হোক নিজস্ব জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানো অসম্ভব। প্রতি বছরের বাজেট ঘোষণায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তার একটি অল্প অংশ বরাদ্দ হয় জ্বালানি খাতে। আর এ বছরের বাজেটেও তার ব্যতিক্রম নেই। গ্যাস সরবরাহে একচেটিয়া আধিপত্য মার্কিন শেভরন তেল কোম্পানির। দেশে মোট উৎপাদিত গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৫০ শতাংশ উৎপাদন করে শেভরন। জ¦ালানি সংকট মোকাবিলায় বাপেক্স বা পেট্রোবাংলার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে নতুন নতুন গ্যাস কূপ অনুসন্ধান করা যেতে পারে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যতটা সম্ভব সাশ্রয়ী মূল্যে এলএনজি আমদানি করে সরবরাহের ঘাটতি পূরণ এবং মজুতের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে জ¦ালানি সংকটের পাশাপাশি দেশে ডলার ও রিজার্ভসংকটের কথা শোনা যাচ্ছে। কারণ, হিসাবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ভারসাম্য সংকটসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বা মেগা প্রকল্পে নেয়া বৈদেশিক ঋণের কিস্তি ডলারে পরিশোধের কারণে রিজার্ভে চাপ তৈরি হচ্ছে। গত অর্থবছরে দেশে মোট ৯০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি হয়েছে। ওদিকে রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ালেও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন। এ পার্থক্য সামনে আরও বড় হবে বৈদেশিক ঋণের সুদ এবং কিস্তি পরিশোধের কারণে। এটা বলা বাহুল্য দেশের অর্থনীতি কিছুটা সংকটকাল অতিক্রম করছে। ধারণা করা যায়, খুব শিগগির এ সংকট কাটবে না। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির নানা প্রতিকূলতার মধ্যে রিজার্ভ সংকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রিজার্ভ সংকটের কারণে দেশে ডলারের বিপরীতে টাকার মান প্রতিনিয়ত কমছে।

এ মুহূর্তে দেশের রিজার্ভ আসলে কত, তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আইএমএফের মতপার্থক্য আছে। আইএমএফের বক্তব্য গ্রহণ করলে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল নাম দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের প্রভাবশালী রপ্তানিকারকদের যে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিয়েছে, সেটা বাদ দিলে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ এখন ৩১ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি, যা দিয়ে আমাদের সর্বোচ্চ ৪ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে দেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০, ৫ বছরে পাচারকারীরা ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। যার মধ্যে শুধু ২০১৫ সালে ১ বছরেই দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে ৯৮ হাজার কোটি টাকা। এটি আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে করা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচারকৃত অর্থের হিসাব।

তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশার বাণী শুনিয়েছে বিশে^র শীর্ষ ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস। সংস্থাটি বলছে এই মহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধ্বস নামার কোনো আশঙ্কা নেই। বিশে^র বাণিজ্যবিষয়ক খ্যাতনামা সংবাদ মাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑযদিও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেকটাই কমে এসেছে কিন্তু তার পরেও এই মহূর্তে বাংলাদেশর অর্থনীতির সূচকগুলো সংকটের ঝুঁকির বাইরে। তবে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসার পাশাপাশি বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া সাম্প্রতিক বন্যায় দেশের চলতি হিসাব ঘাটতি চাপ সৃষ্টি করছে। বর্তমান টালামাটাল বৈশি^ক পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকার আশু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আমরা বিশ^াস করি।

জনপ্রশাসনে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি অনুসরণ এবং জনসাধারণকে মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য আহ্বান করেছে সরকার। ডলারের খরচ কমাতে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় কাটছাঁট করা হয়েছে ও বিদেশ যাওয়ার ওপর কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির খরচ সাশ্রয়ে সপ্তাহে এক দিন পেট্রোলপাম্প বন্ধ রাখা, এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংসহ বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছে রয়েছে। আমদানি ব্যয় কমাতে গাড়ি, টিভি, ফ্রিজসহ ২৭ পণ্যে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়। একইসঙ্গে বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়াতে ব্যাংক ও রপ্তানিকারকের ডলার ধারণের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। রপ্তানি আয় আসার এক দিনের মধ্যে ডলার নগদায়নের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আবার অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে নেয়া ঋণ স্থানীয় মুদ্রায় স্থানান্তরের সুযোগ দেয়া হয়েছে।

ইডিএফ থেকে নেয়া ঋণ শুধু রপ্তানিকারকের নিজস্ব আয় বা জমা বৈদেশিক মুদ্রা থেকে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। ইডিএফের সুদহার ১ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে করোনার সময়ে দেয়া শিথিলতার মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো। বিশ্বব্যাংকের ঢাকার আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দুটি সংকট দৃশ্যমান। প্রথম, বৈদেশিক মুদ্রা এবং দ্বিতীয় মূল্যস্ফীতি। মুদ্রার বিনিময় হারের আচরণ দেখলে বোঝা যায় চাহিদার তুলনায় জোগানের ঘাটতি আছে। বাণিজ্য ঘাটতি ২৩ বিলিয়নে ঠেকেছে। মোট ডলারের আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্যে যেখানে উদ্ধৃত্ত থাকত এখন আর নেই। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বারো মাসের গড় এবং মাসিক মূল্যস্ফীতির হার যেটিই বলা হোক বাস্তবতা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। অতীতের তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবন-জীবিকায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

সমগ্র বিশে^ জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোও সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎসেবা দেয়ার জন্য রেশনিং করছে। জাপানের মতো দেশ এখন পরিকল্পিতভাবে দিনে দুই ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যান্য দেশগুলোও জ্বালানি সাশ্রয়ের দিকে নজর দিয়েছে। বৈশি^ক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের অবস্থাও খারাপ। কারণ, আমাদের যে নিজস্ব গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তা চাহিদার অর্ধেকের চেয়ে কম। বাকিটা বেশির ভাগ উৎপাদন হয় জ্বালানি তেল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্টের মাধ্যমে। এখন যদি বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে এলএনজি ও জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়, তাহলে উৎপাদন খরচ তিন-চার গুণ বেড়ে যাবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে রাত ৮টা পর্যন্ত দোকানপাট বন্ধ রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেটি বাস্তবায়নসহ আরও বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। পরিশেষে এ কথা বলতে পারি যে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতিকে আমাদের গ্রহণযোগ্য হিসেবের খাতায় আনতে হবে। কেন রিজার্ভে টান? আর কেনই বা লোডশেডিং? এর পেছনে কোন মাফিয়াচক্র দেশপ্রেমের মুখোশ নিয়ে বা বৈদেশিক অস্থিরতার নাম করে বা নিজেদের ব্যর্থটাকে আড়াল করার নাম করে আমাদের অর্থনীতিকে অচল করার কোন দুরভিসন্ধি খেলছে কি না? অথবা এটা কি আমাদের কোন অদূরদর্শিতার ফল। মেগা প্রজেক্ট কি আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় ঋণের ফাঁদ না সহায়ক এবং সর্বোপরি আমাদের বাজেট ও পরিকল্পনা কতটা সংগতিপূর্ণ এ জাতীয় বিষয়সমূহকে বিবেচনায় এনে সংকট নিরসনে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

[লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

সোমবার, ০৮ আগস্ট ২০২২ , ২৪ শ্রাবণ ১৪২৯ ৯ মহররম ১৪৪৪

অর্থনৈতিক সংকট : মুক্তি কোন পথে

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করে সারা দেশে বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা লোডশেডিংয়ের কারণে জনগণ ভোগান্তিতে পড়েছে। আমরা সবাই জানতাম যে দেশে তেমন বিদ্যুতের ঘাটতি নেই। তাই স্বাভাবিকভাবে জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। জানা যায় যে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি সংকট ও উচ্চমূল্যের কারণে একদিকে সরবরাহের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ফলে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিঘœ ঘটছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। অন্যদিকে অনেক তেলচালিত বিদ্যুতের প্লান্ট বন্ধ রাখতে হয়েছে উৎপাদনে সরকারি ভর্তুকি বা খরচ বাড়ার কারণে।

বিগত এক দশকে বিদ্যুৎ খাত যে সাফল্য অর্জন করেছে, জ্বালানি খাত সে তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। অথচ জ্বালানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় জ্বালানির অভাবে বড় অঙ্কের বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। তদুপরি, উৎপাদিত বিদ্যুতের সিংহভাগ নির্ভর করে আমদানি করা জ্বালানির ওপর, যার পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। ২০১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশীয় গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ, যা কিনা ২০২২ সালে কমে প্রায় ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। এর কারণ হলো দেশে নিজস্ব গ্যাস উৎপাদনের হার কমে গেছে। আর এর ফলে দেশীয় জ্বালানি তথা গ্যাসের পরিবর্তে ব্যবহার বাড়ছে আমদানি করা অতি উচ্চমূল্যের এলএনজির ব্যবহার। প্রতি ইউনিট দেশীয় গ্যাসের মূল্য যেখানে ২ থেকে ৩ ডলার, সেখানে প্রতি ইউনিট আমদানি করা গ্যাসের জন্য ব্যয় হয় ১২ ডলার থেকে ৩৫ ডলার পর্যন্ত। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের উচ্চমূল্যের ফলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে রিজার্ভে চাপ তৈরি করছে।

জ¦ালানি সংকট উত্তোরণের উপায় কী? সম্প্রতি ঘোষিত জাতীয় বাজেটে দেশে জ্বালানি সংকট মেটানোর কোনো দীর্ঘমেয়াদি বা স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থাপনার দিকনির্দেশনা নেই। কী রকম হবে দেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নের পথরেখা বা রোডম্যাপ? একটি জাতীয় বাজেট শুধু বিভিন্ন খাতে অর্থ বরাদ্দের নথি নয় বরং এটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের রূপরেখা, সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার দর্শন বটে। বিগত ২০ বছরে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে বা দেশীয় কয়লা উন্নয়নে যে ন্যূনতম কর্মধারা চলে, তাতে আর যাই হোক নিজস্ব জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানো অসম্ভব। প্রতি বছরের বাজেট ঘোষণায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তার একটি অল্প অংশ বরাদ্দ হয় জ্বালানি খাতে। আর এ বছরের বাজেটেও তার ব্যতিক্রম নেই। গ্যাস সরবরাহে একচেটিয়া আধিপত্য মার্কিন শেভরন তেল কোম্পানির। দেশে মোট উৎপাদিত গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৫০ শতাংশ উৎপাদন করে শেভরন। জ¦ালানি সংকট মোকাবিলায় বাপেক্স বা পেট্রোবাংলার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে নতুন নতুন গ্যাস কূপ অনুসন্ধান করা যেতে পারে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যতটা সম্ভব সাশ্রয়ী মূল্যে এলএনজি আমদানি করে সরবরাহের ঘাটতি পূরণ এবং মজুতের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে জ¦ালানি সংকটের পাশাপাশি দেশে ডলার ও রিজার্ভসংকটের কথা শোনা যাচ্ছে। কারণ, হিসাবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ভারসাম্য সংকটসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বা মেগা প্রকল্পে নেয়া বৈদেশিক ঋণের কিস্তি ডলারে পরিশোধের কারণে রিজার্ভে চাপ তৈরি হচ্ছে। গত অর্থবছরে দেশে মোট ৯০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি হয়েছে। ওদিকে রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ালেও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন। এ পার্থক্য সামনে আরও বড় হবে বৈদেশিক ঋণের সুদ এবং কিস্তি পরিশোধের কারণে। এটা বলা বাহুল্য দেশের অর্থনীতি কিছুটা সংকটকাল অতিক্রম করছে। ধারণা করা যায়, খুব শিগগির এ সংকট কাটবে না। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির নানা প্রতিকূলতার মধ্যে রিজার্ভ সংকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রিজার্ভ সংকটের কারণে দেশে ডলারের বিপরীতে টাকার মান প্রতিনিয়ত কমছে।

এ মুহূর্তে দেশের রিজার্ভ আসলে কত, তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আইএমএফের মতপার্থক্য আছে। আইএমএফের বক্তব্য গ্রহণ করলে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল নাম দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের প্রভাবশালী রপ্তানিকারকদের যে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিয়েছে, সেটা বাদ দিলে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ এখন ৩১ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি, যা দিয়ে আমাদের সর্বোচ্চ ৪ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে দেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০, ৫ বছরে পাচারকারীরা ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। যার মধ্যে শুধু ২০১৫ সালে ১ বছরেই দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে ৯৮ হাজার কোটি টাকা। এটি আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে করা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচারকৃত অর্থের হিসাব।

তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশার বাণী শুনিয়েছে বিশে^র শীর্ষ ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস। সংস্থাটি বলছে এই মহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধ্বস নামার কোনো আশঙ্কা নেই। বিশে^র বাণিজ্যবিষয়ক খ্যাতনামা সংবাদ মাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑযদিও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেকটাই কমে এসেছে কিন্তু তার পরেও এই মহূর্তে বাংলাদেশর অর্থনীতির সূচকগুলো সংকটের ঝুঁকির বাইরে। তবে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসার পাশাপাশি বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া সাম্প্রতিক বন্যায় দেশের চলতি হিসাব ঘাটতি চাপ সৃষ্টি করছে। বর্তমান টালামাটাল বৈশি^ক পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকার আশু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আমরা বিশ^াস করি।

জনপ্রশাসনে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি অনুসরণ এবং জনসাধারণকে মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য আহ্বান করেছে সরকার। ডলারের খরচ কমাতে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় কাটছাঁট করা হয়েছে ও বিদেশ যাওয়ার ওপর কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির খরচ সাশ্রয়ে সপ্তাহে এক দিন পেট্রোলপাম্প বন্ধ রাখা, এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংসহ বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছে রয়েছে। আমদানি ব্যয় কমাতে গাড়ি, টিভি, ফ্রিজসহ ২৭ পণ্যে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়। একইসঙ্গে বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়াতে ব্যাংক ও রপ্তানিকারকের ডলার ধারণের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। রপ্তানি আয় আসার এক দিনের মধ্যে ডলার নগদায়নের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আবার অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে নেয়া ঋণ স্থানীয় মুদ্রায় স্থানান্তরের সুযোগ দেয়া হয়েছে।

ইডিএফ থেকে নেয়া ঋণ শুধু রপ্তানিকারকের নিজস্ব আয় বা জমা বৈদেশিক মুদ্রা থেকে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। ইডিএফের সুদহার ১ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে করোনার সময়ে দেয়া শিথিলতার মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো। বিশ্বব্যাংকের ঢাকার আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দুটি সংকট দৃশ্যমান। প্রথম, বৈদেশিক মুদ্রা এবং দ্বিতীয় মূল্যস্ফীতি। মুদ্রার বিনিময় হারের আচরণ দেখলে বোঝা যায় চাহিদার তুলনায় জোগানের ঘাটতি আছে। বাণিজ্য ঘাটতি ২৩ বিলিয়নে ঠেকেছে। মোট ডলারের আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্যে যেখানে উদ্ধৃত্ত থাকত এখন আর নেই। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বারো মাসের গড় এবং মাসিক মূল্যস্ফীতির হার যেটিই বলা হোক বাস্তবতা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। অতীতের তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবন-জীবিকায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

সমগ্র বিশে^ জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোও সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎসেবা দেয়ার জন্য রেশনিং করছে। জাপানের মতো দেশ এখন পরিকল্পিতভাবে দিনে দুই ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যান্য দেশগুলোও জ্বালানি সাশ্রয়ের দিকে নজর দিয়েছে। বৈশি^ক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের অবস্থাও খারাপ। কারণ, আমাদের যে নিজস্ব গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তা চাহিদার অর্ধেকের চেয়ে কম। বাকিটা বেশির ভাগ উৎপাদন হয় জ্বালানি তেল ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্টের মাধ্যমে। এখন যদি বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে এলএনজি ও জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়, তাহলে উৎপাদন খরচ তিন-চার গুণ বেড়ে যাবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে রাত ৮টা পর্যন্ত দোকানপাট বন্ধ রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেটি বাস্তবায়নসহ আরও বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। পরিশেষে এ কথা বলতে পারি যে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতিকে আমাদের গ্রহণযোগ্য হিসেবের খাতায় আনতে হবে। কেন রিজার্ভে টান? আর কেনই বা লোডশেডিং? এর পেছনে কোন মাফিয়াচক্র দেশপ্রেমের মুখোশ নিয়ে বা বৈদেশিক অস্থিরতার নাম করে বা নিজেদের ব্যর্থটাকে আড়াল করার নাম করে আমাদের অর্থনীতিকে অচল করার কোন দুরভিসন্ধি খেলছে কি না? অথবা এটা কি আমাদের কোন অদূরদর্শিতার ফল। মেগা প্রজেক্ট কি আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় ঋণের ফাঁদ না সহায়ক এবং সর্বোপরি আমাদের বাজেট ও পরিকল্পনা কতটা সংগতিপূর্ণ এ জাতীয় বিষয়সমূহকে বিবেচনায় এনে সংকট নিরসনে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

[লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]