সাক্ষরতা ও শিক্ষা

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এই ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ মানুষ কতটা শিক্ষিত বা সাক্ষর তা জানার বিষয়। সাক্ষরতা কি বা কাকে বলে, আভিধানিক অর্থে সাক্ষরতা হলো অক্ষর পরিচিতি, লেখা ও পড়ার ক্ষমতা। যদি কোন ব্যক্তি লেখা কোন বিষয় পড়ে তা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে সক্ষম হয় তাকে সাক্ষর বলে। সাক্ষরতা শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়, একটি ব্যবহারিক সাক্ষরতা আরেকটি আনুষ্ঠানিক সাক্ষরতা। ব্যবহারিক সাক্ষরতা বলতে বোঝায়, লেখা পড়া ও গণিতের বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান অর্জন করা। আর আনুষ্ঠানিক সাক্ষরতা হলো, স্কুল কলেজে পড়ে যে জ্ঞান অর্জন করা হয়। শিক্ষা ও সাক্ষরতার মধ্যে পার্থক্য কতটুকু। অনেকেই বলবেন তেমন একটা না তবে এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য ব্যাপক।

আসলে শিক্ষা কি? সক্রেটিসের ভাষায়, “মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ”, এরিষ্টেটলের মতে “সুস্থ দেহ ও সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা”। রবিন্দ্র নাথের ভাষায় “শিক্ষা হলো তাই যা আমাদের শুধু তথ্যই পরিবেশনই করে না বিশ্বসত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।” প্রকৃতার্থের শিক্ষা হলো একটি প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ায় কোন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলির পূর্ণ বিকাশের উৎসাহ দেয়া এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য যে সব দক্ষতার প্রয়োজন সেগুলো অর্জনের সহায়তা করা হয়। সাধারণ অর্থে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করাই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা হলো সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন সাক্ষরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সরকার বেশ তৃৃপ্তিবোধ করছে, তবে এ ধরনের সাক্ষরতার কারণে দেশের আপামর জনসাধারণের নৈতিক উন্নয়ন হয়নি। কারণ দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা অনেক ব্যক্তিকে শুধু সাক্ষর বলতে হয় কারণ তাদের শিক্ষার পরিমাপক সূচককে পরিমাপ করলে শিক্ষিত বলা যায় না। কারণ, তাদের যে ধারাটি বিকশিত হয়েছে, তা তাতে এদের সাক্ষর বলা যায়। এখানে দুটি বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি, এক. সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ব্যক্তি একজন সাংবাদিক এবং একজন উপসম্পাদকীয় পাতায় লিখেন, এই দুজনের মধ্যে পেশাদারিত্বের বিষয়টির পার্থক্য নিরুপণ করতে পারেন না। তার মতে দুটো একই কাজ। এই পেশাটির উন্নতিকল্পে তিনি নানা উপদেশ দিলেন। যে ব্যক্তি সাংবাদিক এবং উপসম্পাদকীয় পাতায় যারা লিখেন তাদের কাজ ও দায়িত্ব নিরুপণ করার যোগ্যতা নেই তাকে কি শিক্ষিত বলা যায়। আসলে তিনি একজন সাক্ষর। আর এই সাক্ষর ব্যক্তি যদি গণমাধ্যম পেশার উন্নয়নে জ্ঞান দেন, এই জ্ঞান সমাজের কতটা কাজে লাগবে। এ রকম কথিত শিক্ষিতের মাধ্যমে আজ সামাজিক কিছু কাজকর্ম পরিচালিত হয়। এ ধরনের সাক্ষররা সমাজের কথিত জ্ঞানীর আসনে উপবিষ্ট হওয়ায় আজকের সামাজিক অস্থিরতা এবং পশ্চাৎপদতা দূর হচ্ছে না।

দ্ধিতীয় উদাহরণ, আরেকজন কথিত শিক্ষিত ব্যক্তি বললেন, কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের প্রধান শিক্ষককে অধ্যক্ষ বলাটা ভুল। প্রশ্ন হচ্ছে, অধ্যক্ষ শব্দটির অর্থ কি? সেটা কি তিনি জানেন? না জেনেই তিনি অধ্যক্ষ যিনি লিখেছেন তার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য ছুড়ে দিলেন, এবং বললেন কিন্ডারগার্ডেনের প্রধান অধ্যক্ষ লিখতে পারেন না। বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা যা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেয়া হয়, এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যা শেখানো হয়, তা অনেকটা আনুষ্ঠানিক সাক্ষরতারই বলা যায়। কারণ, এই প্রাতিষ্ঠানিক এইটুকু জ্ঞান অর্জন করে সাক্ষরা ছুটে চাকরির দিকে। চাকরি পাওয়ার পদ্ধতিটা হলো। এই সাক্ষরতার জ্ঞানার্জনের মতোই। সাধারণ জ্ঞান ও চাকরি পরীক্ষার কিছু বিষয় মুখস্থ করে চাকরির পরীক্ষায় বসলেই চাকরি হয়ে যায়। বর্তমানে মামু, চাচা, আত্মীয় ও রাজনৈতিক তদবিরের চাকরিও হচ্ছে। আদিকালে বাংলা জনপদে শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়, জ্ঞানার্জনের জন্য। indigenous knowledge বিষয়টি ছিল এ দেশের শিক্ষার অন্যতম অংশ।

প্রাচীন বাংলার যে শিক্ষাব্যবস্থাটি ছিল তা এখন আর নেই। প্রাচীন বাংলায় শিক্ষার মুল লক্ষ্য ছিল নৈতিক মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়ন সাধন করা।। পাহাড়পুর ও ময়নামতির পুরাকীর্তির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার নির্দশন। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে নৈতিক ও বাস্তবমুখী শিক্ষাটাই ছিল মুখ্য। মুসলিম শাসকদের বিজয় ও ব্রিটিশ শাসনামলে এগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। ব্রিটিশ শাসকরা এ দেশে শিক্ষার প্রচলন শুরু করেন তাদের কাজকর্মে সহায়তা করার জন্য কিছু লোকবল তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে। প্রকৃত শিক্ষিত করাটা ব্রিটিশদের মূল্য লক্ষ্য ছিল না। ব্রিটিশ শিক্ষা ধারাটাই পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে কিছুটা সংস্কার করে চালানো হচ্ছে। বর্তমানে শিক্ষাটা হয়ে গেছে জ্ঞানার্জনের পরিবর্তে অর্থ উপার্জনের পাথেয় হিসেবে। তাই যেনতেন করে একটি পাস দিতে পারলে আর সেই পাসের সার্টিফিকেটের বিনিময়ে একটি চাকরি জোগার করাটা হলো শিক্ষা গ্রহণকারীর উদ্দেশ্য। ফলে দেখা যায় যে, জ্ঞানার্জনের চেয়ে পরীক্ষায় কীভাবে ভালো নম্বর পাওয়া যায়, তার জন্য কোচিংসহ নানা জায়গায় শিক্ষা গ্রহণ করতে। এমনকি প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রক্সি পরীক্ষা দেয়ার ঘটনা বিরাজ করছে শিক্ষাঙ্গনে। বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায়, কে কতটা শিক্ষিত, তা মূলত নিরুপণ করা হয়। শিক্ষিত মানুষটি কি চাকরি করে তার নিরীক্ষে। পেশায় নিয়োজিত বিষয়টিই একমাত্র শিক্ষা নিরুপণের মূল মাপকাঠি হয়ে গেছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, যে কোন প্রকারে হোক একটা ভালো চাকরি জোগার করাটাই লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। এ রকম পরিমাপক সূচকে শিক্ষিত নিরুপণ করা হয় বলেই শিক্ষার গুণগত মান কমছে। বুয়েটসহ প্রকৌশল বিদ্যা, বাকৃবি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটিও বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারের জন্য পরীক্ষা দেয়। কারণ, বর্তমানে একজন আমলা সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর ব্যক্তি। দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোটা ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হয়। তাই সাধারণ মানুষ এখনো মনে করে প্রশাসনিক ক্ষমতাবান মানেই শিক্ষিত ও জ্ঞানী। কর্ম ও শিক্ষার সঙ্গে কোন সামজ্ঞস্য থাকছে না। কৃষি, প্রকৌশল, চিকিৎসা বিদ্যা অর্জনকারী তাদের সংশ্লিষ্ট পেশায় যোগদান করলেও কোন দিন তদসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি হতে পারেন না। তাই তারা আহরিত বিদ্যার সঙ্গে সামজ্ঞস্যহীন চাকরি প্রশাসন ক্যাডারে দিকে ছুটে। ফলে ওই ব্যক্তি মূলত সাক্ষরেই পরিণত হয়।

তাই শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে একটি মিল তৈরি করতে না পারলে দেশে প্রকৃক শিক্ষায় মানুষ শিক্ষিত হবে না। সৃষ্টি হবে কিছু সাক্ষরের। শিক্ষাসহ সরকারি কর্মক্ষেত্রের নিয়মগুলোর পরিবর্তন করা প্রয়োজন।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

সোমবার, ০৮ আগস্ট ২০২২ , ২৪ শ্রাবণ ১৪২৯ ৯ মহররম ১৪৪৪

সাক্ষরতা ও শিক্ষা

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এই ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ মানুষ কতটা শিক্ষিত বা সাক্ষর তা জানার বিষয়। সাক্ষরতা কি বা কাকে বলে, আভিধানিক অর্থে সাক্ষরতা হলো অক্ষর পরিচিতি, লেখা ও পড়ার ক্ষমতা। যদি কোন ব্যক্তি লেখা কোন বিষয় পড়ে তা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে সক্ষম হয় তাকে সাক্ষর বলে। সাক্ষরতা শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়, একটি ব্যবহারিক সাক্ষরতা আরেকটি আনুষ্ঠানিক সাক্ষরতা। ব্যবহারিক সাক্ষরতা বলতে বোঝায়, লেখা পড়া ও গণিতের বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান অর্জন করা। আর আনুষ্ঠানিক সাক্ষরতা হলো, স্কুল কলেজে পড়ে যে জ্ঞান অর্জন করা হয়। শিক্ষা ও সাক্ষরতার মধ্যে পার্থক্য কতটুকু। অনেকেই বলবেন তেমন একটা না তবে এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য ব্যাপক।

আসলে শিক্ষা কি? সক্রেটিসের ভাষায়, “মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ”, এরিষ্টেটলের মতে “সুস্থ দেহ ও সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা”। রবিন্দ্র নাথের ভাষায় “শিক্ষা হলো তাই যা আমাদের শুধু তথ্যই পরিবেশনই করে না বিশ্বসত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।” প্রকৃতার্থের শিক্ষা হলো একটি প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ায় কোন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলির পূর্ণ বিকাশের উৎসাহ দেয়া এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য যে সব দক্ষতার প্রয়োজন সেগুলো অর্জনের সহায়তা করা হয়। সাধারণ অর্থে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করাই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা হলো সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন সাক্ষরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সরকার বেশ তৃৃপ্তিবোধ করছে, তবে এ ধরনের সাক্ষরতার কারণে দেশের আপামর জনসাধারণের নৈতিক উন্নয়ন হয়নি। কারণ দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা অনেক ব্যক্তিকে শুধু সাক্ষর বলতে হয় কারণ তাদের শিক্ষার পরিমাপক সূচককে পরিমাপ করলে শিক্ষিত বলা যায় না। কারণ, তাদের যে ধারাটি বিকশিত হয়েছে, তা তাতে এদের সাক্ষর বলা যায়। এখানে দুটি বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি, এক. সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ব্যক্তি একজন সাংবাদিক এবং একজন উপসম্পাদকীয় পাতায় লিখেন, এই দুজনের মধ্যে পেশাদারিত্বের বিষয়টির পার্থক্য নিরুপণ করতে পারেন না। তার মতে দুটো একই কাজ। এই পেশাটির উন্নতিকল্পে তিনি নানা উপদেশ দিলেন। যে ব্যক্তি সাংবাদিক এবং উপসম্পাদকীয় পাতায় যারা লিখেন তাদের কাজ ও দায়িত্ব নিরুপণ করার যোগ্যতা নেই তাকে কি শিক্ষিত বলা যায়। আসলে তিনি একজন সাক্ষর। আর এই সাক্ষর ব্যক্তি যদি গণমাধ্যম পেশার উন্নয়নে জ্ঞান দেন, এই জ্ঞান সমাজের কতটা কাজে লাগবে। এ রকম কথিত শিক্ষিতের মাধ্যমে আজ সামাজিক কিছু কাজকর্ম পরিচালিত হয়। এ ধরনের সাক্ষররা সমাজের কথিত জ্ঞানীর আসনে উপবিষ্ট হওয়ায় আজকের সামাজিক অস্থিরতা এবং পশ্চাৎপদতা দূর হচ্ছে না।

দ্ধিতীয় উদাহরণ, আরেকজন কথিত শিক্ষিত ব্যক্তি বললেন, কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের প্রধান শিক্ষককে অধ্যক্ষ বলাটা ভুল। প্রশ্ন হচ্ছে, অধ্যক্ষ শব্দটির অর্থ কি? সেটা কি তিনি জানেন? না জেনেই তিনি অধ্যক্ষ যিনি লিখেছেন তার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য ছুড়ে দিলেন, এবং বললেন কিন্ডারগার্ডেনের প্রধান অধ্যক্ষ লিখতে পারেন না। বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা যা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেয়া হয়, এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যা শেখানো হয়, তা অনেকটা আনুষ্ঠানিক সাক্ষরতারই বলা যায়। কারণ, এই প্রাতিষ্ঠানিক এইটুকু জ্ঞান অর্জন করে সাক্ষরা ছুটে চাকরির দিকে। চাকরি পাওয়ার পদ্ধতিটা হলো। এই সাক্ষরতার জ্ঞানার্জনের মতোই। সাধারণ জ্ঞান ও চাকরি পরীক্ষার কিছু বিষয় মুখস্থ করে চাকরির পরীক্ষায় বসলেই চাকরি হয়ে যায়। বর্তমানে মামু, চাচা, আত্মীয় ও রাজনৈতিক তদবিরের চাকরিও হচ্ছে। আদিকালে বাংলা জনপদে শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়, জ্ঞানার্জনের জন্য। indigenous knowledge বিষয়টি ছিল এ দেশের শিক্ষার অন্যতম অংশ।

প্রাচীন বাংলার যে শিক্ষাব্যবস্থাটি ছিল তা এখন আর নেই। প্রাচীন বাংলায় শিক্ষার মুল লক্ষ্য ছিল নৈতিক মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়ন সাধন করা।। পাহাড়পুর ও ময়নামতির পুরাকীর্তির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার নির্দশন। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে নৈতিক ও বাস্তবমুখী শিক্ষাটাই ছিল মুখ্য। মুসলিম শাসকদের বিজয় ও ব্রিটিশ শাসনামলে এগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। ব্রিটিশ শাসকরা এ দেশে শিক্ষার প্রচলন শুরু করেন তাদের কাজকর্মে সহায়তা করার জন্য কিছু লোকবল তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে। প্রকৃত শিক্ষিত করাটা ব্রিটিশদের মূল্য লক্ষ্য ছিল না। ব্রিটিশ শিক্ষা ধারাটাই পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে কিছুটা সংস্কার করে চালানো হচ্ছে। বর্তমানে শিক্ষাটা হয়ে গেছে জ্ঞানার্জনের পরিবর্তে অর্থ উপার্জনের পাথেয় হিসেবে। তাই যেনতেন করে একটি পাস দিতে পারলে আর সেই পাসের সার্টিফিকেটের বিনিময়ে একটি চাকরি জোগার করাটা হলো শিক্ষা গ্রহণকারীর উদ্দেশ্য। ফলে দেখা যায় যে, জ্ঞানার্জনের চেয়ে পরীক্ষায় কীভাবে ভালো নম্বর পাওয়া যায়, তার জন্য কোচিংসহ নানা জায়গায় শিক্ষা গ্রহণ করতে। এমনকি প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রক্সি পরীক্ষা দেয়ার ঘটনা বিরাজ করছে শিক্ষাঙ্গনে। বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায়, কে কতটা শিক্ষিত, তা মূলত নিরুপণ করা হয়। শিক্ষিত মানুষটি কি চাকরি করে তার নিরীক্ষে। পেশায় নিয়োজিত বিষয়টিই একমাত্র শিক্ষা নিরুপণের মূল মাপকাঠি হয়ে গেছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, যে কোন প্রকারে হোক একটা ভালো চাকরি জোগার করাটাই লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। এ রকম পরিমাপক সূচকে শিক্ষিত নিরুপণ করা হয় বলেই শিক্ষার গুণগত মান কমছে। বুয়েটসহ প্রকৌশল বিদ্যা, বাকৃবি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটিও বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারের জন্য পরীক্ষা দেয়। কারণ, বর্তমানে একজন আমলা সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর ব্যক্তি। দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোটা ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হয়। তাই সাধারণ মানুষ এখনো মনে করে প্রশাসনিক ক্ষমতাবান মানেই শিক্ষিত ও জ্ঞানী। কর্ম ও শিক্ষার সঙ্গে কোন সামজ্ঞস্য থাকছে না। কৃষি, প্রকৌশল, চিকিৎসা বিদ্যা অর্জনকারী তাদের সংশ্লিষ্ট পেশায় যোগদান করলেও কোন দিন তদসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি হতে পারেন না। তাই তারা আহরিত বিদ্যার সঙ্গে সামজ্ঞস্যহীন চাকরি প্রশাসন ক্যাডারে দিকে ছুটে। ফলে ওই ব্যক্তি মূলত সাক্ষরেই পরিণত হয়।

তাই শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে একটি মিল তৈরি করতে না পারলে দেশে প্রকৃক শিক্ষায় মানুষ শিক্ষিত হবে না। সৃষ্টি হবে কিছু সাক্ষরের। শিক্ষাসহ সরকারি কর্মক্ষেত্রের নিয়মগুলোর পরিবর্তন করা প্রয়োজন।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]