বাবুল রবি দাস
সমাজ-বিজ্ঞান ও নৃ-তত্ত্বের ইতিহাস প্রায় একশ থেকে একশত পঞ্চাশ বছরের হবে। নৃ-বিজ্ঞানীদের মতে, মানবসমাজ কতগুলো পরিবর্তনের স্তর বা ধাপের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। পরিবর্তনের প্রত্যেকটি ধাপ; বলাবাহুল্য, বহু হাজার বছর স্থায়ী হয়েছে। নৃ-বিজ্ঞানীরা বিশেষ করে মর্গান দীর্ঘদিনের গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে, মানুষের বিভিন্ন স্তরের অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে তাদের সামাজিক রীতিনীতি, আচারবিধি এবং চিন্তাধারাও বিভিন্ন প্রকার ছিল এবং অধিকন্তু মানুষ যখন এক প্রকার অর্থনৈতিক জীবনধারণ থেকে পরবর্তী অর্থনৈতিক জীবনধারণের স্তরে এসেছে, তখন তার সামাজিক আচারবিধি, রীতিনীতি, চিন্তাধারাও পরিবর্তন হয়েছে।
পৃথিবীর অধিকাংশ আদিম অধিবাসী নানা পরিবর্তনের স্তরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সভ্য অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু কিছু সংখ্যক অধিবাসী পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের আদিম অবস্থায় রয়ে গেল, বা তাদের খুব সামান্যই পরিবর্তন হলো। এসব আদিম মানুষের অস্তিত্বের খবর যখন সভ্য মানুষ পেল, তখন নৃ-বিজ্ঞানীরা তাদের দেশে গিয়ে তাদের মতোই বাস করে আদিম মানুষের সমাজব্যবস্থা ও রীতিনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেন। এসব আদিম মানুষের জীবনধারণ, সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় বিশ্বাস ইত্যাদি সম্পর্কে যথার্থ খবর সংগ্রহ করা সহজ ছিল না। প্রধান অন্তরায় ছিল যাতায়াতের অসুবিধে, আদিম মানুষের দুর্বোধ্য ভাষা ও সভ্য মানুষের প্রতি তাদের ভয়। দুর্গম ও নিবিড় অরণ্যে অথবা ভয়সঙ্কুল মহাসাগরের বুকে ছোট দ্বীপে আদিম মানুষ নৃ-বিজ্ঞানীকে সাদরে গ্রহণ করেনিÑআদিম মানুষের সমাজ ব্যবস্থা জানতে গিয়ে অনেকে জীবন পর্যন্ত হারিয়েছেন; তবু মানুষ জ্ঞানের সাধনায় নিরস্ত হয়নি। বহু নৃ-বিজ্ঞানীর অমানুষিক কষ্ট স্বীকার, অপূর্ব ত্যাগ এবং এমনকি কারও কারও জীবনদানের ফলে আজ আমরা আমাদের পূর্বপুরুষ আদিম মানুষের কথা জানতে পেরেছি।
পৃথিবীর আদিম অধিবাসীদের জীবনযাত্রা, সমাজব্যবস্থা ও চিন্তাধারাকে নীচ বা খাটো করে দেখা অত্যন্ত অন্যায় হবে। আদিম মানুষের সামাজিক রীতিনীতি, আচারবিধি ও চিন্তাধারা সভ্য মানুষের মতো নয়, তার জন্য সময়ের ব্যবধান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ইত্যাদি নানা কারণ দায়ী; অধিকন্তু এই বিভিন্নতা মানবজাতির ইতিহাসে এক এক স্তরের এক একটা অবস্থা মাত্র-তার সঙ্গে ভালো বা মন্দের কোন সমন্ধ নেই। এ সত্যটি বর্তমান সমাজবিজ্ঞানী ও নৃ-বিজ্ঞানীদের মধ্যে স্বীকৃত। মানুষের ইতিহাসের বিভিন্ন সময় মানুষের প্রয়োজন ও প্রাকৃতিক পরিবেশের গুরুত্ব স্পষ্ট করে বলতে হলে কয়েকটি উদাহরণ দিতে হয়। শীতের দেশের মানুষ গরম কাপড় পরিধান করে, গরম দেশের মানুষ পাতলা সুতির কাপড় গায়ে দেয়, আবার যেসব সুতার বা কাপড়ের আবিষ্কার হয়নি তখন মানুষ উলঙ্গ থাকত। এই উলঙ্গ থাকা অবস্থাটি মানুষের দোষ নয়, মানব জাতির পরিবর্তনের ইতিহাসের সভ্যতার বিভিন্ন স্তরের একটি স্তর বা অবস্থা মাত্র।
তেমনি খাদ্য বা সামাজিক আচারবিধির ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। শীতের দেশের এস্কিমোরা কাঁচা মাংস খায়, আমরা সেদ্ধ মাংস খাই; সাপ, ব্যাঙ, ফড়িং সব কিছুই এক অঞ্চলের মানুষের খাদ্য, অন্য অঞ্চলের বা অন্য সমাজের মানুষের অখাদ্য। এ ধরনের বহুবিধ উদাহরণ রয়েছে।
মানুষের সমাজে পরিবর্তন এসেছে ঠিকই, তবে আদিম মানুষের ছিটেফোঁটা আচার বিধি ও রীতিনীতির কোথাও একটু বা পরিবর্তিত হয়ে, কোথাও বা পূর্বে অবস্থাই এখনো সভ্য মানুষের মধ্যে দেখা যায়। আমাদের আজকের সমাজেও তা রয়েছে। পৃথিবী পরিবর্তনশীল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতি বা আদিবাসী যে নামেই তাদের ডাকিনা কেন? সুযোগ সুবিধা বা শিক্ষা-দিক্ষার অনগ্রসর বলেই তাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আদিম মানুষ বলা হয়। তাদের প্রতি সব প্রকার সাহায্য সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে জ্ঞান বিজ্ঞানে অগ্রগামী করা হোক। বর্তমান সরকার নীতি হচ্ছে কাউকে পেছনে রেখে উন্নয়ন নয়। সব আদিবাসী বা দলিত বঞ্চিত, ব্রাত্যজন বা অন্ত্যজনগোষ্ঠী দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাক ও শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান গড়িমায় এগিয়ে আসুক এই প্রত্যাশা কামনা করি।
[লেখক : আইনজীবী]
সোমবার, ০৮ আগস্ট ২০২২ , ২৪ শ্রাবণ ১৪২৯ ৯ মহররম ১৪৪৪
বাবুল রবি দাস
সমাজ-বিজ্ঞান ও নৃ-তত্ত্বের ইতিহাস প্রায় একশ থেকে একশত পঞ্চাশ বছরের হবে। নৃ-বিজ্ঞানীদের মতে, মানবসমাজ কতগুলো পরিবর্তনের স্তর বা ধাপের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। পরিবর্তনের প্রত্যেকটি ধাপ; বলাবাহুল্য, বহু হাজার বছর স্থায়ী হয়েছে। নৃ-বিজ্ঞানীরা বিশেষ করে মর্গান দীর্ঘদিনের গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে, মানুষের বিভিন্ন স্তরের অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে তাদের সামাজিক রীতিনীতি, আচারবিধি এবং চিন্তাধারাও বিভিন্ন প্রকার ছিল এবং অধিকন্তু মানুষ যখন এক প্রকার অর্থনৈতিক জীবনধারণ থেকে পরবর্তী অর্থনৈতিক জীবনধারণের স্তরে এসেছে, তখন তার সামাজিক আচারবিধি, রীতিনীতি, চিন্তাধারাও পরিবর্তন হয়েছে।
পৃথিবীর অধিকাংশ আদিম অধিবাসী নানা পরিবর্তনের স্তরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সভ্য অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু কিছু সংখ্যক অধিবাসী পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের আদিম অবস্থায় রয়ে গেল, বা তাদের খুব সামান্যই পরিবর্তন হলো। এসব আদিম মানুষের অস্তিত্বের খবর যখন সভ্য মানুষ পেল, তখন নৃ-বিজ্ঞানীরা তাদের দেশে গিয়ে তাদের মতোই বাস করে আদিম মানুষের সমাজব্যবস্থা ও রীতিনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেন। এসব আদিম মানুষের জীবনধারণ, সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় বিশ্বাস ইত্যাদি সম্পর্কে যথার্থ খবর সংগ্রহ করা সহজ ছিল না। প্রধান অন্তরায় ছিল যাতায়াতের অসুবিধে, আদিম মানুষের দুর্বোধ্য ভাষা ও সভ্য মানুষের প্রতি তাদের ভয়। দুর্গম ও নিবিড় অরণ্যে অথবা ভয়সঙ্কুল মহাসাগরের বুকে ছোট দ্বীপে আদিম মানুষ নৃ-বিজ্ঞানীকে সাদরে গ্রহণ করেনিÑআদিম মানুষের সমাজ ব্যবস্থা জানতে গিয়ে অনেকে জীবন পর্যন্ত হারিয়েছেন; তবু মানুষ জ্ঞানের সাধনায় নিরস্ত হয়নি। বহু নৃ-বিজ্ঞানীর অমানুষিক কষ্ট স্বীকার, অপূর্ব ত্যাগ এবং এমনকি কারও কারও জীবনদানের ফলে আজ আমরা আমাদের পূর্বপুরুষ আদিম মানুষের কথা জানতে পেরেছি।
পৃথিবীর আদিম অধিবাসীদের জীবনযাত্রা, সমাজব্যবস্থা ও চিন্তাধারাকে নীচ বা খাটো করে দেখা অত্যন্ত অন্যায় হবে। আদিম মানুষের সামাজিক রীতিনীতি, আচারবিধি ও চিন্তাধারা সভ্য মানুষের মতো নয়, তার জন্য সময়ের ব্যবধান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ইত্যাদি নানা কারণ দায়ী; অধিকন্তু এই বিভিন্নতা মানবজাতির ইতিহাসে এক এক স্তরের এক একটা অবস্থা মাত্র-তার সঙ্গে ভালো বা মন্দের কোন সমন্ধ নেই। এ সত্যটি বর্তমান সমাজবিজ্ঞানী ও নৃ-বিজ্ঞানীদের মধ্যে স্বীকৃত। মানুষের ইতিহাসের বিভিন্ন সময় মানুষের প্রয়োজন ও প্রাকৃতিক পরিবেশের গুরুত্ব স্পষ্ট করে বলতে হলে কয়েকটি উদাহরণ দিতে হয়। শীতের দেশের মানুষ গরম কাপড় পরিধান করে, গরম দেশের মানুষ পাতলা সুতির কাপড় গায়ে দেয়, আবার যেসব সুতার বা কাপড়ের আবিষ্কার হয়নি তখন মানুষ উলঙ্গ থাকত। এই উলঙ্গ থাকা অবস্থাটি মানুষের দোষ নয়, মানব জাতির পরিবর্তনের ইতিহাসের সভ্যতার বিভিন্ন স্তরের একটি স্তর বা অবস্থা মাত্র।
তেমনি খাদ্য বা সামাজিক আচারবিধির ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। শীতের দেশের এস্কিমোরা কাঁচা মাংস খায়, আমরা সেদ্ধ মাংস খাই; সাপ, ব্যাঙ, ফড়িং সব কিছুই এক অঞ্চলের মানুষের খাদ্য, অন্য অঞ্চলের বা অন্য সমাজের মানুষের অখাদ্য। এ ধরনের বহুবিধ উদাহরণ রয়েছে।
মানুষের সমাজে পরিবর্তন এসেছে ঠিকই, তবে আদিম মানুষের ছিটেফোঁটা আচার বিধি ও রীতিনীতির কোথাও একটু বা পরিবর্তিত হয়ে, কোথাও বা পূর্বে অবস্থাই এখনো সভ্য মানুষের মধ্যে দেখা যায়। আমাদের আজকের সমাজেও তা রয়েছে। পৃথিবী পরিবর্তনশীল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতি বা আদিবাসী যে নামেই তাদের ডাকিনা কেন? সুযোগ সুবিধা বা শিক্ষা-দিক্ষার অনগ্রসর বলেই তাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আদিম মানুষ বলা হয়। তাদের প্রতি সব প্রকার সাহায্য সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে জ্ঞান বিজ্ঞানে অগ্রগামী করা হোক। বর্তমান সরকার নীতি হচ্ছে কাউকে পেছনে রেখে উন্নয়ন নয়। সব আদিবাসী বা দলিত বঞ্চিত, ব্রাত্যজন বা অন্ত্যজনগোষ্ঠী দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাক ও শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান গড়িমায় এগিয়ে আসুক এই প্রত্যাশা কামনা করি।
[লেখক : আইনজীবী]