‘সাইবার ক্রীতদাস’ হিসেবে ৫শ’র বেশি বাংলাদেশি কম্বোডিয়ায় জিম্মি

একটি সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্র উচ্চ বেতনের প্রলোভন দিয়ে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি দেয়ার কথা বলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নারী-পুরুষদের কম্বোডিয়ায় পাঠাচ্ছে। এজন্য প্রতিজনের কাছ থেকে নিচ্ছে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা।

কম্বোডিয়ায় পৌঁছার পর তাদের বিমানবন্দর থেকে দালাল চক্র গ্রহণ করে। এরপর একটি হোটেলে নিয়ে রাখা হয়। সেখান থেকে তাদের বিদেশি মানব পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। এরপর তাদের একটি আস্তানায় জিম্মি করে নানা ধরনের সাইবার অপরাধে বাধ্য করা হয়। এতে কেউ রাজি না হলে তার ওপর চলে নির্যাতন।

ওই নির্যাতনের আস্তানা থেকে বেরিয়ে দেশে ফিরে কয়েকজন র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করার পর র‌্যাব-৩ রাজধানীর পল্টন থেকে তিন মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করে। তাদের স্বীকারোক্তিতে মানবপাচার ও ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহার করার নানা কাহিনী বেরিয়ে এসেছে।

র‌্যাব-৩ জানায়, নির্যাতিতদের অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব তদন্তে নেমেছে। পল্টন এলাকার একটি মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা কম্বোডিয়ায় উচ্চ বেতনে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি দেয়ার মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে বিদেশ গমনেচ্ছু নারী-পুরুষের কাছ থেকে প্রথমে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। বিদেশ যাওয়ার পর তারা চরম হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হন।

গত ৫ সেপ্টম্বর রাতে পল্টনে অভিযান চালিয়ে কম্বোডিয়ায় মানব পাচার চক্রের মূল হোতা নাজমুল ইসলাম, তার সহযোগী নূর ইসলাম সাজ্জাদ ও সিরাজুল ইসলাম পঞ্চায়েতকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৩টি পাসপোর্ট, ৪টি মোবাইল ফোন, রেজিস্টার ১টি, মানব পাচার সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র ২৫০ পাতা ও নগদ ৫০১৬ টাকা উদ্ধার করা হয়।

প্রাথমিক অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, আসামিরা সংঘবদ্ধ মানব পাচার চক্রের সদস্য। চক্রের মূল হোতা কম্বোডিয়াপ্রবাসী নাজমুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে চাকরি দেয়ার নামে টার্গেট করে যুবক ও তাদের অভিভাবকদের প্রলুদ্ধ করে। এরপর কম্বোডিয়ায় পাঠানোর খরচ বাবদ প্রথমে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা করে নেয়। আর আগ্রহী বেকার যুবক ও যুবতীদের প্রথমে কম্পিউটার বিষয়ে পরীক্ষা নেয়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে কম্বোডিয়াপ্রবাসী আলীম ও শরিফুলের সহায়তায় তাদের জন্য কম্বোডিয়ান ট্যুরিস্ট-ই ভিসা করা হয়। তারপর তাদের বিমানযোগে কম্বোডিয়া পাঠানো হয়।

পাচারের শিকার যুবকরা কম্বোডিয়া যাওয়ার পর অভিযুক্ত নাজমুল তার সহযোগী কম্বোডিয়াপ্রবাসী আরিফের হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেয়া হয়। উক্ত হোটেলে কিছুদিন থাকার পর তাদের কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য কম্বোডিয়াপ্রবাসী কামাল ওরফে লায়ন কামাল ও আতিকের সহায়তায় একটি বিদেশি ট্রেনিং সংস্থায় নিয়ে যায়।

সেখানে বিদেশি প্রশিক্ষকরা পাচার হওয়া নারী-পুরুষকে গুগল ট্রান্সলেটরের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছদ্মনামে একাউন্ট পরিচালনা করে অন্যদের কীভাবে প্রতারণা করা যায় সে বিষয়ে শেখান।

ভুয়া ক্লোন ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা আত্মসাৎ করার কৌশল, ভুয়া নম্বর থেকে ফোন দিয়ে বা চ্যাটিং করে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার নামে কৌশলে ডিপোজিট হাতিয়ে নেয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভয়েস কল ও ভিডিও কল রেকডিং করে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আত্মসাৎ করার কৌশল শেখানো হয়। মানব পাচারকারীদের ভাষায় সাইবার প্রতারণার বিষয়টি স্ক্যামার হিসেবে পরিচিত।

টেনিং শেষে ওই কর্মীদের বিদেশি কোম্পানির কাছে দুই থেকে তিন হাজার ডলারে বিক্রি করে দেয় চক্রটি।

বিক্রি করা নারী-পুরুষকে একটি সুরক্ষিত ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঢোকার পর তাদের দেহ তল্লাশি করে সব ধরনের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস তাদের হেফাজতে নিয়ে নেয়া হয়। সেখানে তাদের একটি কম্পিউটার ল্যাবে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ল্যাবে ৩০০ থেকে ৪০০ ডেস্কটপ কস্পিউটার সাজানো থাকে। মানব পাচারকারীদের ভাষায় এ ল্যাবকে ক্যাসিনো বা প্ল্যাটফর্ম বলা হয়।

এরপর প্রতারক চক্র কম্পিউটার ব্যবহার করে পাচারের শিকার নারী-পুরুষকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুরুষদের সঙ্গে ছদ্মনামীয় নারী একাউন্ট ব্যবহার করে। নারীদের সঙ্গে ছদ্মনামী পুরুষ একাউন্ট ব্যবহার করে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য বাধ্য করা হয়। আর ভাষাগত বাধা দূর করার জন্য গুগল ট্রান্সলেটের সাহায্য নেয়া হয়। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পর ভিডিও কল দিয়ে আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি ও কথাবার্তা রেকর্ড করা হয়। আবার কখনো উপহার পাঠানো ও দেখা করার জন্য যাতায়াত খরচ ইত্যাদি প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এসব কাজে এমটি-৪, এমটি-৫, টিকটক, বিটকয়েন, ফেক ওয়েবসাইটের সহায়তা নেয়া হয়।

চাকরির লোভে যাওয়া তরুণ-তরুণীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হতাগ্রস্ত অপেক্ষাকৃত ধনাঢ্য ব্যক্তিদের টার্গেট করতে বলে চক্রটি। আবার কখনো বিভিন্ন দেশ থেকে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় যেসব ব্যক্তি ব্যাংক বা এনজিও থেকে ঋণ গ্রহণ করেছেন বা ঋণ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাউন্ট বা মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করা হয়। তারপর তাদের চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে কম সুদে আকর্ষণীয় ঋণের প্রস্তাব দেয়া হয়। ওই প্রস্তাবে রাজি হলে ডিপোজিট বাবদ শতকরা ৫ ভাগ মোবাইল ব্যাংকিং বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করতে বলা হয়। অর্থ আত্মসাৎ করার পর ওই একাউন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রতারক চক্র এভাবে ৬ থেকে ৭ মাসে একটি ক্যাসিনো বা প্ল্যাটফর্ম চালিয়ে যাওয়ার পর ঠিকানা, ফেইসবুক একাউন্ট, ডোমেইন ও ডিভাইস পরিবর্তন করে থাকে। এভাবে এক একটি প্ল্যাটফর্মে পাচারের শিকার একজন ভুক্তভোগীকে বিরতিহীনভাবে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা কম্পিউটারে কাজ করতে হয়।

পাচারের শিকাররা টার্গেট সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে বা কাজ করতে অস্বীকার করলে তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। আর তাদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। ওই ক্যাসিনো বা প্ল্যাটফর্মগুলো কঠোর নিরাপত্তায় আবৃত থাকে বিধায় কারো পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

আর কেউ ওই কাজ থেকে অব্যাহতি চাইলে তাকে ক্রীতদাস হিসেবে ক্রয় করতে যে ডলার খরচ হয়েছে তার দ্বিগুণ অর্থ ফেরত দিতে বলা হয়। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এ সম্পর্কে কোন অভিযোগ করবে না বলে অঙ্গীকারনামা নেয়া হয়। তখন পাচারের শিকার ব্যক্তি বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করে ওই অর্থ ফেরত দিয়ে বাংলাদেশের দালাল চক্রের কাছে আশ্রয় নেয়। তখন দালালরা পাচারের শিকার ব্যক্তিদের আরেকটি সাইবার প্রতারক চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। আর যদি কেউ দেশে ফিরে আসতে চায় তখন শর্ত দেয় আবার গ্রাহক সংগ্রহ করার। আর ওই সময় কম্বোডিয়া থাকা-খাওয়ার খরচ প্রতারিত বা পাচারে শিকার ব্যক্তিকে বহন করতে হয়। আর অর্থ রোজগারের কোন ব্যবস্থা না থাকলে তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবৈধ কাজ করতে বাধ্য করা হয়। অথবা দেশ থেকে স্বজনরা টাকা পাঠালে সেই টাকা খরচ করতে হয়। এভাবে পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সাইবার ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেয় প্রতারক চক্র।

এ চক্র দেশ থেকে ৫শ’র বেশি বাংলাদেশিকে সাইবার ক্রীতদাস হিসেবে কম্বোডিয়ায় পাঠিয়েছে। এই প্রতারণা জালিয়াতির ঘটনায় দেশি পাচারকারী চক্র ধরা পড়লেও কম্বোডিয়াপ্রবাসী দালাল চক্র ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

কম্বোডিয়াফেরত নারায়ণগঞ্জের মিলন দেওয়ান জানান, চলতি বছরের গত ২৭ জানুয়ারি তিনি এলাকার মোজাম্মেল নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে কম্বোডিয়া যান। সেখানে শপিংমলে ৮০ হাজার টাকা বেতন দেয়ার কথা বলে তাকে নেয়া হয়। সেখানে যাওয়ার পর প্রবাসী (চাইনিজ) প্রতারক চক্রের হাতে তাকে সোপর্দ করা হয়। তাদের ইচ্ছায় কাজ করতে রাজি না হওয়ায় তাকে গলাটিপে ধরে মারপিট ও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে চক্রটি। এরপর তাকে টানা ১৪ দিন আটকে রাখে। কম্পিউটার অনলাইনে প্রতারণা করতে বললে সে অস্বীকার করায় নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। এরপর সে নানা কৌশলে পরিবারের সহায়তায় দেশে ফিরে আসে। তার মতে, প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি ক্রীতদাস হিসেবে কম্বোডিয়ায় প্রতারক চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে কাজ করছেন।

এ সম্পর্কে র‌্যাব-৩ এর পুলিশ সুপার বীণা রানী দাস জানান, দেশে এ ধরনের ১০ থেকে ১২টি চক্র আছে। দেশব্যাপী এদের নেটওয়ার্ক আছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।

বুধবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ৩ ভাদ্র ১৪২৯ ১০ সফর ১৪৪৪

‘সাইবার ক্রীতদাস’ হিসেবে ৫শ’র বেশি বাংলাদেশি কম্বোডিয়ায় জিম্মি

বাকী বিল্লাহ

একটি সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্র উচ্চ বেতনের প্রলোভন দিয়ে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি দেয়ার কথা বলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নারী-পুরুষদের কম্বোডিয়ায় পাঠাচ্ছে। এজন্য প্রতিজনের কাছ থেকে নিচ্ছে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা।

কম্বোডিয়ায় পৌঁছার পর তাদের বিমানবন্দর থেকে দালাল চক্র গ্রহণ করে। এরপর একটি হোটেলে নিয়ে রাখা হয়। সেখান থেকে তাদের বিদেশি মানব পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। এরপর তাদের একটি আস্তানায় জিম্মি করে নানা ধরনের সাইবার অপরাধে বাধ্য করা হয়। এতে কেউ রাজি না হলে তার ওপর চলে নির্যাতন।

ওই নির্যাতনের আস্তানা থেকে বেরিয়ে দেশে ফিরে কয়েকজন র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করার পর র‌্যাব-৩ রাজধানীর পল্টন থেকে তিন মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করে। তাদের স্বীকারোক্তিতে মানবপাচার ও ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহার করার নানা কাহিনী বেরিয়ে এসেছে।

র‌্যাব-৩ জানায়, নির্যাতিতদের অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব তদন্তে নেমেছে। পল্টন এলাকার একটি মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা কম্বোডিয়ায় উচ্চ বেতনে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি দেয়ার মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে বিদেশ গমনেচ্ছু নারী-পুরুষের কাছ থেকে প্রথমে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। বিদেশ যাওয়ার পর তারা চরম হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হন।

গত ৫ সেপ্টম্বর রাতে পল্টনে অভিযান চালিয়ে কম্বোডিয়ায় মানব পাচার চক্রের মূল হোতা নাজমুল ইসলাম, তার সহযোগী নূর ইসলাম সাজ্জাদ ও সিরাজুল ইসলাম পঞ্চায়েতকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৩টি পাসপোর্ট, ৪টি মোবাইল ফোন, রেজিস্টার ১টি, মানব পাচার সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র ২৫০ পাতা ও নগদ ৫০১৬ টাকা উদ্ধার করা হয়।

প্রাথমিক অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, আসামিরা সংঘবদ্ধ মানব পাচার চক্রের সদস্য। চক্রের মূল হোতা কম্বোডিয়াপ্রবাসী নাজমুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে চাকরি দেয়ার নামে টার্গেট করে যুবক ও তাদের অভিভাবকদের প্রলুদ্ধ করে। এরপর কম্বোডিয়ায় পাঠানোর খরচ বাবদ প্রথমে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা করে নেয়। আর আগ্রহী বেকার যুবক ও যুবতীদের প্রথমে কম্পিউটার বিষয়ে পরীক্ষা নেয়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে কম্বোডিয়াপ্রবাসী আলীম ও শরিফুলের সহায়তায় তাদের জন্য কম্বোডিয়ান ট্যুরিস্ট-ই ভিসা করা হয়। তারপর তাদের বিমানযোগে কম্বোডিয়া পাঠানো হয়।

পাচারের শিকার যুবকরা কম্বোডিয়া যাওয়ার পর অভিযুক্ত নাজমুল তার সহযোগী কম্বোডিয়াপ্রবাসী আরিফের হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেয়া হয়। উক্ত হোটেলে কিছুদিন থাকার পর তাদের কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য কম্বোডিয়াপ্রবাসী কামাল ওরফে লায়ন কামাল ও আতিকের সহায়তায় একটি বিদেশি ট্রেনিং সংস্থায় নিয়ে যায়।

সেখানে বিদেশি প্রশিক্ষকরা পাচার হওয়া নারী-পুরুষকে গুগল ট্রান্সলেটরের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছদ্মনামে একাউন্ট পরিচালনা করে অন্যদের কীভাবে প্রতারণা করা যায় সে বিষয়ে শেখান।

ভুয়া ক্লোন ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা আত্মসাৎ করার কৌশল, ভুয়া নম্বর থেকে ফোন দিয়ে বা চ্যাটিং করে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার নামে কৌশলে ডিপোজিট হাতিয়ে নেয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভয়েস কল ও ভিডিও কল রেকডিং করে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আত্মসাৎ করার কৌশল শেখানো হয়। মানব পাচারকারীদের ভাষায় সাইবার প্রতারণার বিষয়টি স্ক্যামার হিসেবে পরিচিত।

টেনিং শেষে ওই কর্মীদের বিদেশি কোম্পানির কাছে দুই থেকে তিন হাজার ডলারে বিক্রি করে দেয় চক্রটি।

বিক্রি করা নারী-পুরুষকে একটি সুরক্ষিত ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঢোকার পর তাদের দেহ তল্লাশি করে সব ধরনের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস তাদের হেফাজতে নিয়ে নেয়া হয়। সেখানে তাদের একটি কম্পিউটার ল্যাবে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ল্যাবে ৩০০ থেকে ৪০০ ডেস্কটপ কস্পিউটার সাজানো থাকে। মানব পাচারকারীদের ভাষায় এ ল্যাবকে ক্যাসিনো বা প্ল্যাটফর্ম বলা হয়।

এরপর প্রতারক চক্র কম্পিউটার ব্যবহার করে পাচারের শিকার নারী-পুরুষকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুরুষদের সঙ্গে ছদ্মনামীয় নারী একাউন্ট ব্যবহার করে। নারীদের সঙ্গে ছদ্মনামী পুরুষ একাউন্ট ব্যবহার করে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য বাধ্য করা হয়। আর ভাষাগত বাধা দূর করার জন্য গুগল ট্রান্সলেটের সাহায্য নেয়া হয়। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পর ভিডিও কল দিয়ে আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি ও কথাবার্তা রেকর্ড করা হয়। আবার কখনো উপহার পাঠানো ও দেখা করার জন্য যাতায়াত খরচ ইত্যাদি প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এসব কাজে এমটি-৪, এমটি-৫, টিকটক, বিটকয়েন, ফেক ওয়েবসাইটের সহায়তা নেয়া হয়।

চাকরির লোভে যাওয়া তরুণ-তরুণীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হতাগ্রস্ত অপেক্ষাকৃত ধনাঢ্য ব্যক্তিদের টার্গেট করতে বলে চক্রটি। আবার কখনো বিভিন্ন দেশ থেকে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় যেসব ব্যক্তি ব্যাংক বা এনজিও থেকে ঋণ গ্রহণ করেছেন বা ঋণ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাউন্ট বা মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করা হয়। তারপর তাদের চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে কম সুদে আকর্ষণীয় ঋণের প্রস্তাব দেয়া হয়। ওই প্রস্তাবে রাজি হলে ডিপোজিট বাবদ শতকরা ৫ ভাগ মোবাইল ব্যাংকিং বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করতে বলা হয়। অর্থ আত্মসাৎ করার পর ওই একাউন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রতারক চক্র এভাবে ৬ থেকে ৭ মাসে একটি ক্যাসিনো বা প্ল্যাটফর্ম চালিয়ে যাওয়ার পর ঠিকানা, ফেইসবুক একাউন্ট, ডোমেইন ও ডিভাইস পরিবর্তন করে থাকে। এভাবে এক একটি প্ল্যাটফর্মে পাচারের শিকার একজন ভুক্তভোগীকে বিরতিহীনভাবে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা কম্পিউটারে কাজ করতে হয়।

পাচারের শিকাররা টার্গেট সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে বা কাজ করতে অস্বীকার করলে তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। আর তাদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। ওই ক্যাসিনো বা প্ল্যাটফর্মগুলো কঠোর নিরাপত্তায় আবৃত থাকে বিধায় কারো পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

আর কেউ ওই কাজ থেকে অব্যাহতি চাইলে তাকে ক্রীতদাস হিসেবে ক্রয় করতে যে ডলার খরচ হয়েছে তার দ্বিগুণ অর্থ ফেরত দিতে বলা হয়। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এ সম্পর্কে কোন অভিযোগ করবে না বলে অঙ্গীকারনামা নেয়া হয়। তখন পাচারের শিকার ব্যক্তি বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করে ওই অর্থ ফেরত দিয়ে বাংলাদেশের দালাল চক্রের কাছে আশ্রয় নেয়। তখন দালালরা পাচারের শিকার ব্যক্তিদের আরেকটি সাইবার প্রতারক চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। আর যদি কেউ দেশে ফিরে আসতে চায় তখন শর্ত দেয় আবার গ্রাহক সংগ্রহ করার। আর ওই সময় কম্বোডিয়া থাকা-খাওয়ার খরচ প্রতারিত বা পাচারে শিকার ব্যক্তিকে বহন করতে হয়। আর অর্থ রোজগারের কোন ব্যবস্থা না থাকলে তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবৈধ কাজ করতে বাধ্য করা হয়। অথবা দেশ থেকে স্বজনরা টাকা পাঠালে সেই টাকা খরচ করতে হয়। এভাবে পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সাইবার ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেয় প্রতারক চক্র।

এ চক্র দেশ থেকে ৫শ’র বেশি বাংলাদেশিকে সাইবার ক্রীতদাস হিসেবে কম্বোডিয়ায় পাঠিয়েছে। এই প্রতারণা জালিয়াতির ঘটনায় দেশি পাচারকারী চক্র ধরা পড়লেও কম্বোডিয়াপ্রবাসী দালাল চক্র ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

কম্বোডিয়াফেরত নারায়ণগঞ্জের মিলন দেওয়ান জানান, চলতি বছরের গত ২৭ জানুয়ারি তিনি এলাকার মোজাম্মেল নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে কম্বোডিয়া যান। সেখানে শপিংমলে ৮০ হাজার টাকা বেতন দেয়ার কথা বলে তাকে নেয়া হয়। সেখানে যাওয়ার পর প্রবাসী (চাইনিজ) প্রতারক চক্রের হাতে তাকে সোপর্দ করা হয়। তাদের ইচ্ছায় কাজ করতে রাজি না হওয়ায় তাকে গলাটিপে ধরে মারপিট ও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে চক্রটি। এরপর তাকে টানা ১৪ দিন আটকে রাখে। কম্পিউটার অনলাইনে প্রতারণা করতে বললে সে অস্বীকার করায় নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। এরপর সে নানা কৌশলে পরিবারের সহায়তায় দেশে ফিরে আসে। তার মতে, প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি ক্রীতদাস হিসেবে কম্বোডিয়ায় প্রতারক চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে কাজ করছেন।

এ সম্পর্কে র‌্যাব-৩ এর পুলিশ সুপার বীণা রানী দাস জানান, দেশে এ ধরনের ১০ থেকে ১২টি চক্র আছে। দেশব্যাপী এদের নেটওয়ার্ক আছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।