‘কুশিয়ারা : একধাপ অগ্রগতি, যেতে হবে বহুদূর’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে যে সাতটি সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে তার একটি হচ্ছে সিলেটের কুশিয়ারা নদীর পানি উত্তোলন সম্পর্কিত। এই চুক্তির অধীনে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী কুশিয়ারা থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলন করবে বাংলাদেশ। এই সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টিতে পানি উত্তোলনের বিষয়টি নিষ্পত্তি হলো।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে যে সাতটি সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে তার একটি হচ্ছে সিলেটের কুশিয়ারা নদীর পানি উত্তোলন বিষয়ে।

পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত কুশিয়ারা নদীর সমঝোতা স্বাক্ষর নিয়ে বলেন, ‘হলোটা কি এইটাই বুঝলাম না। সাধারণত দুই পক্ষ মিলে চুক্তির শর্তাবলি পূরণ করে। আপনার শর্ত পূরণ করলেন অন্যজন কি করবে সেটাও জানাতে হবে। তবেই না চুক্তি! কুশিয়ারা চুক্তি হলো, নেগোসিয়েশনের পর চুক্তি। এখন সেই শর্তগুলো প্রতিপালন করবেন। কিভাবে প্রতিপালন করবেন তারও কথা বলা থাকে। প্রতিপালন না করলেও কী হবে কী করবেন তাও বলা থাকে। কিন্তু এখন বলা যাচ্ছে না দুই দেশের মধ্যে কী হয়েছে। তথাকথিত চুক্তির মাধ্যমে একটা বিরোধের সমাধান হয়েছে মাত্র, এই তো।

‘১৫৩ কিউসেক পানি বাংলাদেশ পাবে, ভারত কতটুকু পাবে সেটা কি আমরা জানি? তাহলে চুক্তি হলো কি করে। বলা যেতে পারে এইবার দুই দেশের মধ্যে একটা ‘মেমোরেন্ডাম আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ হয়েছে যা বাংলায় ‘চুক্তি’ না। আমি মনে করি এটা একটা অন্তবর্তকালীন চুক্তি, আপাতত আমাদের অনেকগুলো প্রবলেম (সমস্যা) এর একটা প্রবলেম সলভ (সমাধান) হলো। শীতের সময় মানে শুকনো মৌসুমে এই পানি ব্যবহার করে বোরো ধান চাষ করা যাবে।’

‘রহমতগঞ্জে একটা পাম্প বানিয়েছে। সেচ করবে মাত্র ৫ হাজার হেক্টর জমিতে খুব ছোট্ট এলাকা। এই পরিমাণ পানি যখন বাংলাদেশ নিতে গেছে খাল কেটে বিএসএফ এসে বাধা দিয়েছে। আমাদের এমন কোন ক্ষমতা নাই বিএসএফের সঙ্গে যুদ্ধ করি। অতএব আমরা কাউ মাউ করে কান্নাকাটি শুরু করলাম। এর ফলে আমরা ১৫৩ কিউসেক পানি পেলাম- এটাই হলো ‘কুশিয়ারার চুক্তি’। কুশিয়ারায় ‘বর্ষাকালে ৪০ থেকে ৫০ হাজার কিউসেক পানি থাকে আর শুকনা মৌসুমে থাকে ২ থেকে ৩ হাজার। এখান থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি কতটুকু।’ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে ৫৪টি যৌথ নদী রয়েছে সেগুলোর পানি বণ্টন প্রসঙ্গে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে। সেগুলো নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। সাধারণত তিস্তার পানি বণ্টনের প্রসঙ্গটি ঘুরে ফিরে এলেও প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে এই একটি নদী কুশিয়ারার পানি বণ্টনের বিষয়টি বাংলাদেশ বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।

বাংলাদেশের পক্ষে দিল্লিতে এই সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। যে সাতটি সমঝোতা চুক্তি গত মঙ্গলবার সই হয়েছে তার মধ্যে প্রথমটিই ছিল কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন সম্পর্কিত। এর আওতায় বাংলাদেশ সিলেটে কুশিয়ারা নদীর রহিমপুর খাল পয়েন্টে প্রতি সেকেন্ডে ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলন করবে।

১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ার এতদিন পর এই প্রথম কোন অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন প্রসঙ্গে সমঝোতা হলো জানিয়ে আইনুন নিশাত বলেন, ‘আমাদের নদীর অবস্থা নদীর আচরণ, নদী ব্যবস্থপনা সবকিছু নিয়ে ভাবতে হবে। সোজা ভাষায় বলে দেই, বরাক নামের একটা নদী আছে যে নদীটা পুরোপুরি ভারতের। ঠিক বাংলাদেশের সীমানায় যখন আসে এই নদী তখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। বাংলাদেশের সুরমা ও কুশিয়ারা নদী একত্রে ভারতের বরাক নদী। আবার কয়েকশ’ কিলোমিটার যাওয়ার পর সুরমা ও কুশিয়ারা মিলিত হয়ে হয়ে যায় মেঘনায়।

‘মেঘনায় একভাগ আসে সুরমা থেকে, একভাগ আসে কুশিয়ারা থেকে। এখন থেকে ১০০ বছর আগে এই দুটো ভাগ সমান ছিল প্রাকৃতিকভাবে। প্রকৃতি ওইভাবে অর্ধেক পানি সুরমাতে দিত অর্ধেক দিত কুশিয়ারায়। এখন প্রাকৃতিকভাবে বেশি পানি মানে ৮০ ভাগ আসে কুশিয়ারায়, ২০ ভাগ চলে যায় সুরমাতে। এজন্য ভারত কিছু করেনি। বর্ষাকালে প্রচুর পানি হয়। এই পানিতেই সৃষ্টি হয় বন্যার।

শুকনো মৌসুমে যখন পানি কমে যায় তখন মেইন (মূল) পানি আসে কুশিয়ারা থেকে। রেজাল্ট (ফল) হচ্ছে সুরমার চেয়ে কুশিয়ারা অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে যায়। তাহলে প্রথম সমস্যা হচ্ছে সুরমা আর কুশিয়ারা নদীর ব্যবস্থাপনা করতে গেলে বরাকের ব্যবস্থাপনা করতে হবে। আমাদের এভাবে না ভাবলে চলবে না।

‘আমাদের বন্যার প্রবলেম আছে, নদী ভাঙনের প্রবলেম আছে, নৌচলাচলের প্রবলেম আছে আরেকটা প্রবলেম আছে নদীটা যেখানে ভাগ হলো তারপর থেকে ২০-২৫ কিলোমিটার ভেঙে ভেতরে ঢুকছে। বাঁ পাশ ভারতের ডান পাশ বাংলাদেশের, তাহলে এখানে নদী শাসনটা খুবই গুরত্বপূর্ণ। যেখানে দুইপারই বাংলাদেশের যেমন গঙ্গা নদী, ফারাক্কার পর ১৫ কি.মি. দুই পার ভারতের, তারপর ১০০ কি.মি. ডান পার ভারতের বাম পার বাংলাদেশের। এখানে আমরা চাই নদী ভাঙনকে রোধ করে নদী অরিজিনাল যেখানে ছিল সেখানে মানে আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেয়া হোক। কাজেই আমি মনে করি এই ‘অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি’ আমাদের এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে। কুশিয়ারা সমঝোতা, এক ধাপ অগ্রগতি, যেতে হবে বহুদূর।’

বৃহস্পতিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ৪ ভাদ্র ১৪২৯ ১১ সফর ১৪৪৪

‘কুশিয়ারা : একধাপ অগ্রগতি, যেতে হবে বহুদূর’

জাহিদা পারভেজ ছন্দা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে যে সাতটি সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে তার একটি হচ্ছে সিলেটের কুশিয়ারা নদীর পানি উত্তোলন সম্পর্কিত। এই চুক্তির অধীনে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী কুশিয়ারা থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলন করবে বাংলাদেশ। এই সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টিতে পানি উত্তোলনের বিষয়টি নিষ্পত্তি হলো।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে যে সাতটি সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে তার একটি হচ্ছে সিলেটের কুশিয়ারা নদীর পানি উত্তোলন বিষয়ে।

পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত কুশিয়ারা নদীর সমঝোতা স্বাক্ষর নিয়ে বলেন, ‘হলোটা কি এইটাই বুঝলাম না। সাধারণত দুই পক্ষ মিলে চুক্তির শর্তাবলি পূরণ করে। আপনার শর্ত পূরণ করলেন অন্যজন কি করবে সেটাও জানাতে হবে। তবেই না চুক্তি! কুশিয়ারা চুক্তি হলো, নেগোসিয়েশনের পর চুক্তি। এখন সেই শর্তগুলো প্রতিপালন করবেন। কিভাবে প্রতিপালন করবেন তারও কথা বলা থাকে। প্রতিপালন না করলেও কী হবে কী করবেন তাও বলা থাকে। কিন্তু এখন বলা যাচ্ছে না দুই দেশের মধ্যে কী হয়েছে। তথাকথিত চুক্তির মাধ্যমে একটা বিরোধের সমাধান হয়েছে মাত্র, এই তো।

‘১৫৩ কিউসেক পানি বাংলাদেশ পাবে, ভারত কতটুকু পাবে সেটা কি আমরা জানি? তাহলে চুক্তি হলো কি করে। বলা যেতে পারে এইবার দুই দেশের মধ্যে একটা ‘মেমোরেন্ডাম আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ হয়েছে যা বাংলায় ‘চুক্তি’ না। আমি মনে করি এটা একটা অন্তবর্তকালীন চুক্তি, আপাতত আমাদের অনেকগুলো প্রবলেম (সমস্যা) এর একটা প্রবলেম সলভ (সমাধান) হলো। শীতের সময় মানে শুকনো মৌসুমে এই পানি ব্যবহার করে বোরো ধান চাষ করা যাবে।’

‘রহমতগঞ্জে একটা পাম্প বানিয়েছে। সেচ করবে মাত্র ৫ হাজার হেক্টর জমিতে খুব ছোট্ট এলাকা। এই পরিমাণ পানি যখন বাংলাদেশ নিতে গেছে খাল কেটে বিএসএফ এসে বাধা দিয়েছে। আমাদের এমন কোন ক্ষমতা নাই বিএসএফের সঙ্গে যুদ্ধ করি। অতএব আমরা কাউ মাউ করে কান্নাকাটি শুরু করলাম। এর ফলে আমরা ১৫৩ কিউসেক পানি পেলাম- এটাই হলো ‘কুশিয়ারার চুক্তি’। কুশিয়ারায় ‘বর্ষাকালে ৪০ থেকে ৫০ হাজার কিউসেক পানি থাকে আর শুকনা মৌসুমে থাকে ২ থেকে ৩ হাজার। এখান থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি কতটুকু।’ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে ৫৪টি যৌথ নদী রয়েছে সেগুলোর পানি বণ্টন প্রসঙ্গে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে। সেগুলো নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। সাধারণত তিস্তার পানি বণ্টনের প্রসঙ্গটি ঘুরে ফিরে এলেও প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে এই একটি নদী কুশিয়ারার পানি বণ্টনের বিষয়টি বাংলাদেশ বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।

বাংলাদেশের পক্ষে দিল্লিতে এই সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। যে সাতটি সমঝোতা চুক্তি গত মঙ্গলবার সই হয়েছে তার মধ্যে প্রথমটিই ছিল কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন সম্পর্কিত। এর আওতায় বাংলাদেশ সিলেটে কুশিয়ারা নদীর রহিমপুর খাল পয়েন্টে প্রতি সেকেন্ডে ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলন করবে।

১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ার এতদিন পর এই প্রথম কোন অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন প্রসঙ্গে সমঝোতা হলো জানিয়ে আইনুন নিশাত বলেন, ‘আমাদের নদীর অবস্থা নদীর আচরণ, নদী ব্যবস্থপনা সবকিছু নিয়ে ভাবতে হবে। সোজা ভাষায় বলে দেই, বরাক নামের একটা নদী আছে যে নদীটা পুরোপুরি ভারতের। ঠিক বাংলাদেশের সীমানায় যখন আসে এই নদী তখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। বাংলাদেশের সুরমা ও কুশিয়ারা নদী একত্রে ভারতের বরাক নদী। আবার কয়েকশ’ কিলোমিটার যাওয়ার পর সুরমা ও কুশিয়ারা মিলিত হয়ে হয়ে যায় মেঘনায়।

‘মেঘনায় একভাগ আসে সুরমা থেকে, একভাগ আসে কুশিয়ারা থেকে। এখন থেকে ১০০ বছর আগে এই দুটো ভাগ সমান ছিল প্রাকৃতিকভাবে। প্রকৃতি ওইভাবে অর্ধেক পানি সুরমাতে দিত অর্ধেক দিত কুশিয়ারায়। এখন প্রাকৃতিকভাবে বেশি পানি মানে ৮০ ভাগ আসে কুশিয়ারায়, ২০ ভাগ চলে যায় সুরমাতে। এজন্য ভারত কিছু করেনি। বর্ষাকালে প্রচুর পানি হয়। এই পানিতেই সৃষ্টি হয় বন্যার।

শুকনো মৌসুমে যখন পানি কমে যায় তখন মেইন (মূল) পানি আসে কুশিয়ারা থেকে। রেজাল্ট (ফল) হচ্ছে সুরমার চেয়ে কুশিয়ারা অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে যায়। তাহলে প্রথম সমস্যা হচ্ছে সুরমা আর কুশিয়ারা নদীর ব্যবস্থাপনা করতে গেলে বরাকের ব্যবস্থাপনা করতে হবে। আমাদের এভাবে না ভাবলে চলবে না।

‘আমাদের বন্যার প্রবলেম আছে, নদী ভাঙনের প্রবলেম আছে, নৌচলাচলের প্রবলেম আছে আরেকটা প্রবলেম আছে নদীটা যেখানে ভাগ হলো তারপর থেকে ২০-২৫ কিলোমিটার ভেঙে ভেতরে ঢুকছে। বাঁ পাশ ভারতের ডান পাশ বাংলাদেশের, তাহলে এখানে নদী শাসনটা খুবই গুরত্বপূর্ণ। যেখানে দুইপারই বাংলাদেশের যেমন গঙ্গা নদী, ফারাক্কার পর ১৫ কি.মি. দুই পার ভারতের, তারপর ১০০ কি.মি. ডান পার ভারতের বাম পার বাংলাদেশের। এখানে আমরা চাই নদী ভাঙনকে রোধ করে নদী অরিজিনাল যেখানে ছিল সেখানে মানে আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেয়া হোক। কাজেই আমি মনে করি এই ‘অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি’ আমাদের এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে। কুশিয়ারা সমঝোতা, এক ধাপ অগ্রগতি, যেতে হবে বহুদূর।’