পণ্যের দাম বাড়াতে প্রতিনিয়ত চালাকি করছে প্রতিষ্ঠানগুলো

পণ্যের ‘যৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি’ খতিয়ে দেখতে চায় ভোক্তা অধিকার পণ্যের দাম বাড়লে ভোক্তা হারানোর আশঙ্কা থাকে : কোম্পানি প্রতিনিধি

কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে বলে জানিয়েছে উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। কোম্পানির প্রতিনিধিরা জানান, উৎপাদন খরচের তুলনায় ভোক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে দাম সহনীয় রাখা হয়েছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দাবি, প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বাড়াতে প্রতিনিয়ত চালাকি করছে। পণ্যের দাম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত চতুরতার আশ্রয় নিচ্ছে উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলো। উৎপাদন বা পরিবহন খরচ যতটা বেড়েছে তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি বাড়ানো হয়েছে পণ্যের দাম।

এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নিত্যপণ্যের যৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে চায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সে লক্ষ্যে উৎপাদন কারখানাগুলো পরিদর্শন করে পণ্যের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা খুঁজে বের করা হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

গতকাল ভোক্তা ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে মতবিনিময় সভায় এ সিদ্ধান্তের কথা জানান ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান। ভোক্তা অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে এ সভায় নিত্য ব্যবহার্য পণ্য সাবান, ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, লিকুইড ক্লিনারের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এসব কথা বলা হয়।

মতবিনিময় সভায় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা দাবি করেন, ২০২০ সালের শেষ দিক থেকে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দামসহ উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে এর অর্ধেক। বিগত সময়ে দাম সমন্বয়ও করা হয়নি। এ অবস্থায় কোম্পানিগুলোর পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। এর কিছুটা চাপ পড়ছে ভোক্তাদের ঘাড়ে।

এ সময় ভোক্তা অধিদপ্তর বাজারের তথ্য তুলে ধরে জানায়, ২০২০ সালে আধা কেজির যে ডিটারজেন্টের দাম ছিল ৬০ টাকা, সেটি এখন ৯০ টাকা। ৫২ টাকার সাবানের দামও এখন ৭৫ টাকা। অর্থাৎ এ দুই পণ্যের দাম বেড়েছে ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত। এর কারণ হিসেবে কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা জানান, তাদের টয়লেট্রিজ পণ্যের ৮০ শতাংশ কাঁচামালই আমদানি করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত।

কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের মধ্যে ইউনিলিভার, স্কয়ার, এসিআইসহ অন্য প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। তারা জানান, পণ্যের দাম বাড়লে ভোক্তা হারানোর আশঙ্কা থাকে, তাই লোকসান দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে স্কয়ারের হেড অব অপারেশন মালিক সাইদ বলেন, ‘আমাদের কিন্তু স্থায়ী ভোক্তা রয়েছে। তারা যদি দাম বেশির কারণে ক্ষুব্ধ হন, তাহলে তারা অন্য পণ্যের দিকে ধাবিত হবেন। কারণ, বাংলাদেশে সাবান প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অনেক রয়েছে।’

ইউনিলিভারের সিএফও জাহিদ মালিতা বলেন, ‘আমরা যদি আরও দাম বাড়াতাম, আমাদের খরচটা বাজার থেকেই তুলে নিতাম, তাহলে দাম অনেক বেশি বাড়ানো লাগত। এতে ভোক্তা পর্যায়ে আরও প্রভাব পড়ত। সেটা কিন্তু আমরা করছি না।’

তিনি দাবি করেন, গত দুই বছরে পণ্যের দাম হয়ত ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এসব পণ্যের ৮০ ভাগ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এর একটা প্রভাব পড়েছে। যেমন ওয়াশিং পাউডারের দাম দুই বছরে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্ত এর সার্বিক খরচ বেড়েছে ৯৬ শতাংশ। প্রধান কাঁচামাল সালফিউরিক এসিডের দাম ৮৩ থেকে বেড়ে ১৯০ টাকা হয়েছে।

এসিআইয়ের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ পলাশ হোসাইন বলেন, ‘শুরুতে আমাদের কাঁচামালের দাম বাড়ায় আমরা আমাদের মুনাফা কমিয়ে দিয়ে আগের দামেই বিক্রি করেছি। কিন্তু দাম আরও বাড়ায় আমাদের ম্যানেজমেন্টকে খুব সতর্কতার সঙ্গে দাম নির্ধারণ করতে হয়। যেন বাজারে কোনরূপ অস্থিরতা সৃষ্টি না হয়।’

সভায় কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) প্রতিনিধি কাজী আবদুল হান্নান বলেন, ‘ব্র্যান্ড-ভ্যালু আর মানুষের ইমোশনকে পুঁজি করে বড় কোম্পানিগুলো ভোক্তাদের ব্ল্যাকমেইল করছে কি না, সে বিষয়ে নজরদারির সময় এসেছে।’

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘কোন পণ্যের দাম বাড়াতে হলে তার পক্ষে যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে কোম্পানিগুলোকে। সেজন্য তাদের ফ্যাক্টরিতে আমরা যাবো। কত দামে কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে, কোন পণ্য উৎপাদনে কত খরচ হচ্ছে এবং কোন পণ্য কী দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে সেগুলো আমরা বিশ্লেষণ করতে চাই।’

তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে আমরা পর্যবেক্ষণ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দেব। এরপর বিষয়গুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত আসবে।’

সফিকুজ্জামান আরও বলেন, ‘এখন বাড়তি দাম দিয়ে নিত্য ব্যবহার্য পণ্য কিনতে ভোক্তাদের কষ্ট হচ্ছে। বিশেষত সীমিত ও নিম্নআয়ের মানুষের কষ্ট বেশি হচ্ছে। সে কারণেই আমরা মতবিনিময় সভায় বসেছি। পণ্যের যৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে কি না, সেটা আমরা দেখতে চাই।’

এ সময় শীঘ্রই পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কারখানা পরিদর্শন করে দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

বৃহস্পতিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ৪ ভাদ্র ১৪২৯ ১১ সফর ১৪৪৪

পণ্যের দাম বাড়াতে প্রতিনিয়ত চালাকি করছে প্রতিষ্ঠানগুলো

পণ্যের ‘যৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি’ খতিয়ে দেখতে চায় ভোক্তা অধিকার পণ্যের দাম বাড়লে ভোক্তা হারানোর আশঙ্কা থাকে : কোম্পানি প্রতিনিধি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে বলে জানিয়েছে উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। কোম্পানির প্রতিনিধিরা জানান, উৎপাদন খরচের তুলনায় ভোক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে দাম সহনীয় রাখা হয়েছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দাবি, প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বাড়াতে প্রতিনিয়ত চালাকি করছে। পণ্যের দাম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত চতুরতার আশ্রয় নিচ্ছে উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলো। উৎপাদন বা পরিবহন খরচ যতটা বেড়েছে তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি বাড়ানো হয়েছে পণ্যের দাম।

এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নিত্যপণ্যের যৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে চায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সে লক্ষ্যে উৎপাদন কারখানাগুলো পরিদর্শন করে পণ্যের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা খুঁজে বের করা হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

গতকাল ভোক্তা ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে মতবিনিময় সভায় এ সিদ্ধান্তের কথা জানান ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান। ভোক্তা অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে এ সভায় নিত্য ব্যবহার্য পণ্য সাবান, ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, লিকুইড ক্লিনারের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এসব কথা বলা হয়।

মতবিনিময় সভায় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা দাবি করেন, ২০২০ সালের শেষ দিক থেকে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দামসহ উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে এর অর্ধেক। বিগত সময়ে দাম সমন্বয়ও করা হয়নি। এ অবস্থায় কোম্পানিগুলোর পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। এর কিছুটা চাপ পড়ছে ভোক্তাদের ঘাড়ে।

এ সময় ভোক্তা অধিদপ্তর বাজারের তথ্য তুলে ধরে জানায়, ২০২০ সালে আধা কেজির যে ডিটারজেন্টের দাম ছিল ৬০ টাকা, সেটি এখন ৯০ টাকা। ৫২ টাকার সাবানের দামও এখন ৭৫ টাকা। অর্থাৎ এ দুই পণ্যের দাম বেড়েছে ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত। এর কারণ হিসেবে কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা জানান, তাদের টয়লেট্রিজ পণ্যের ৮০ শতাংশ কাঁচামালই আমদানি করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত।

কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের মধ্যে ইউনিলিভার, স্কয়ার, এসিআইসহ অন্য প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। তারা জানান, পণ্যের দাম বাড়লে ভোক্তা হারানোর আশঙ্কা থাকে, তাই লোকসান দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে স্কয়ারের হেড অব অপারেশন মালিক সাইদ বলেন, ‘আমাদের কিন্তু স্থায়ী ভোক্তা রয়েছে। তারা যদি দাম বেশির কারণে ক্ষুব্ধ হন, তাহলে তারা অন্য পণ্যের দিকে ধাবিত হবেন। কারণ, বাংলাদেশে সাবান প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অনেক রয়েছে।’

ইউনিলিভারের সিএফও জাহিদ মালিতা বলেন, ‘আমরা যদি আরও দাম বাড়াতাম, আমাদের খরচটা বাজার থেকেই তুলে নিতাম, তাহলে দাম অনেক বেশি বাড়ানো লাগত। এতে ভোক্তা পর্যায়ে আরও প্রভাব পড়ত। সেটা কিন্তু আমরা করছি না।’

তিনি দাবি করেন, গত দুই বছরে পণ্যের দাম হয়ত ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এসব পণ্যের ৮০ ভাগ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এর একটা প্রভাব পড়েছে। যেমন ওয়াশিং পাউডারের দাম দুই বছরে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্ত এর সার্বিক খরচ বেড়েছে ৯৬ শতাংশ। প্রধান কাঁচামাল সালফিউরিক এসিডের দাম ৮৩ থেকে বেড়ে ১৯০ টাকা হয়েছে।

এসিআইয়ের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ পলাশ হোসাইন বলেন, ‘শুরুতে আমাদের কাঁচামালের দাম বাড়ায় আমরা আমাদের মুনাফা কমিয়ে দিয়ে আগের দামেই বিক্রি করেছি। কিন্তু দাম আরও বাড়ায় আমাদের ম্যানেজমেন্টকে খুব সতর্কতার সঙ্গে দাম নির্ধারণ করতে হয়। যেন বাজারে কোনরূপ অস্থিরতা সৃষ্টি না হয়।’

সভায় কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) প্রতিনিধি কাজী আবদুল হান্নান বলেন, ‘ব্র্যান্ড-ভ্যালু আর মানুষের ইমোশনকে পুঁজি করে বড় কোম্পানিগুলো ভোক্তাদের ব্ল্যাকমেইল করছে কি না, সে বিষয়ে নজরদারির সময় এসেছে।’

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘কোন পণ্যের দাম বাড়াতে হলে তার পক্ষে যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে কোম্পানিগুলোকে। সেজন্য তাদের ফ্যাক্টরিতে আমরা যাবো। কত দামে কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে, কোন পণ্য উৎপাদনে কত খরচ হচ্ছে এবং কোন পণ্য কী দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে সেগুলো আমরা বিশ্লেষণ করতে চাই।’

তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে আমরা পর্যবেক্ষণ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দেব। এরপর বিষয়গুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত আসবে।’

সফিকুজ্জামান আরও বলেন, ‘এখন বাড়তি দাম দিয়ে নিত্য ব্যবহার্য পণ্য কিনতে ভোক্তাদের কষ্ট হচ্ছে। বিশেষত সীমিত ও নিম্নআয়ের মানুষের কষ্ট বেশি হচ্ছে। সে কারণেই আমরা মতবিনিময় সভায় বসেছি। পণ্যের যৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে কি না, সেটা আমরা দেখতে চাই।’

এ সময় শীঘ্রই পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কারখানা পরিদর্শন করে দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।