কৃষকের সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

মিহির কুমার রায়

সম্প্রতি ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। এবার আমন মৌসুমে বৃষ্টি কম হওয়ায় সেচের ব্যয়ও বেড়েছে। এরপর রয়েছে-বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট। সবকিছু মিলে কৃষি খাতে উৎপাদনের খরচ বাড়বে। অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী মৌসুমে চালসহ কৃষিপণ্য এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পপণ্যের দাম বাড়বে। তবে কেউ কেউ বলছেন, উৎপাদন খরচ কিছুটা বাড়লেও খুব বেশি আশঙ্কার কারণ নেই।

ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। যার ফলে প্রতি কেজি সার ১৬ টাকার পরিবর্তে কিনতে হবে ২২ টাকায়। সরকার বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের বর্তমান দাম ৮১ টাকা, এর ফলে ৬ টাকা দাম বাড়ানোর পরও সরকারকে প্রতি কেজিতে ৫৯ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। ডিএপি সারে শতকরা ১৮ শতাংশ নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সারের উপাদান রয়েছে। সে জন্য ডিএপির ব্যবহার বাড়িয়ে ইউরিয়া সারের অপ্রয়োজনীয় ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য সরকার ডিএপি সারের মূল্য প্রতি কেজি ৯০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকা করে কৃষকদের দিয়ে যাচ্ছে। এ উদ্যোগের ফলে বিগত কয়েক বছরে ডিএপি সারের ব্যবহার দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে ডিএপি ব্যবহার হতো ৮ লাখ টন, বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে ১৬ লাখ টন। ডিএপি সারের ব্যবহার বাড়ার ফলে ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমার কথা। কিন্তু বাস্তবে ইউরিয়ার বেড়েছে। ২০১৯ সালে ইউরিয়া ব্যবহার হতো ২৫ লাখ টন, বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন।

বাংলাদেশে তিন ধরনের পণ্যের আমদানি, মোট আমদানি ব্যয়ের ৩০ শতাংশের বেশি। এগুলো জ্বালানি, খাদ্য এবং সার। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে তিন ধরনের পণ্যের দামই অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এতে সারে সরকারের ভর্তুকিও বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত সাড়ে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিয়েছে সরকার।

সমস্যা হচ্ছে, সরকারের বেঁধে দেয়া দামে অনেক স্থানেই কৃষক সার কিনতে পারছেন না। সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পণ্যের দামে প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এ ছাড়া দাম বাড়বে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন শিল্পপণ্যের। সামগ্রিকভাবে যা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে।

কৃষকরা বলছেন, চলতি আমন মৌসুমে উৎপাদন ব্যয় উঠবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বেশি সমস্যায় আছেন বর্গাচাষিরা। তারা বলছেন, সারের দাম বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টিসহ শ্রমিক ব্যয় ও আনুষঙ্গিক যে ব্যয় হবে, তাতে চলতি মৌসুমে আমন চাষে নির্ঘাত লোকসান হবে। এর সঙ্গে তাদের নিজেদের শ্রমের মূল্য যুক্ত করলে লোকসানের পাল্লা আরও ভারী হবে।

যেসব জেলায় বেশি ধান উৎপাদন হয়, তার মধ্যে দিনাজপুর অন্যতম। কিন্তু সারের দাম বাড়ানোয় দুশ্চিন্তার কথা বলছেন জেলার কৃষকরা। তাদের মতে, এক একর জমিতে এবার আমন আবাদ করতে খরচ বাড়বে ৫০০ টাকা এবং বোরো আরও বেশি, প্রতি একর জমিতে আমন আবাদ করতে ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয় ৮০ থেকে ৯০ কেজি, টিএসপি সার লাগে ৪০ কেজি, পটাশ ৪০ কেজি, জিংক ৪ কেজি এবং সালফারের প্রয়োজন হয় ২ কেজি। আর কীটনাশক প্রয়োগ করতে খরচ হয় ৪ হাজার ২০০ টাকা থেকে ৪ হাজার ৩০০ টাকা। জমিতে হালচাষ, ধান রোপণ থেকে কর্তন পর্যন্ত সারসহ সব মিলিয়ে প্রতি একর জমিতে আমন আবাদ করতে খরচ হতো ৩৪ থেকে ৩৬ হাজার টাকা। আর আমন আবাদ হয় প্রতি একরে ৪০ থেকে ৪৫ মণ। ধান বিক্রি করে অধিকাংশ টাকাই চলে যায় এই উৎপাদন খরচে। কিন্তু হঠাৎ ইউরিয়া সারের দাম বৃদ্ধিতে প্রতি একর জমিতে বাড়তি খরচ গুনতে হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। তাই ধানের দাম ভালো না পেলে লোকসান গুনতে হবে তাদের।

কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা বলছেন কৃষকরা বরাবরই মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার করে থাকেন। এ বিষয়ে কৃষকদের সচেতন করার চেষ্টা করা হলেও কাজ হয় না। তাই দাম কিছুটা বৃদ্ধির মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সারের ব্যবহারের প্রবণতা কমবে। এতে জমির উর্বরা শক্তিও ঠিক থাকবে।

ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে সারের দাম বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে দেশের বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকারের কাছে বিকল্প ছিল ভর্তুকি বাড়ানো। সারের দাম না বাড়িয়ে সরকারের সামনে বিকল্প ছিল ভর্তুকি বাড়ানো, যা বাজেটেও বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে ভর্তুকি বাড়ানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতির যে অবস্থা সেখানে ভর্তুকি বাড়ানো কঠিন। এ কারণে বাড়তি চাপ কমাতেই সারের দাম বাড়ানো হয়েছে।

এক হিসাব অনুযায়ী, সারের দাম বাড়ানোর ফলে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ২০ পয়সা বাড়তি ব্যয় হবে। অন্যদিকে যেহেতু চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী এরপর সারের দাম বাড়ানোয়, আগামী মৌসুমে যে চাল বাজারে আসবে, তার মূল্যে কিছুটা প্রভাব পড়বে।

প্রতি বছর সার, বিদ্যুৎ, ডিজেলসহ কৃষি সরঞ্জামের দাম বাড়ে, আর চাষাবাদে নিজের পারিশ্রমিক হিসাব করলে লোকসান হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হলে কৃষকের উপায় থাকে না। সরকারি যেসব বরাদ্দ আসে, সেগুলো প্রকৃত কৃষকের কাছে পৌঁছায় না।

ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইনস কাউন্সিল (আইজিসি) বলছে, ২০২২-২৩ সালে বৈশ্বিক খাদ্যোৎপাদন কমে যাবে, মজুদও গত আট-নয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হবে। বিশ্বে খাদ্যোৎপাদন যে কমে যাবে, তা নিয়ে কোন সংশয় নেই। আর এর পেছনে রয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ। প্রত্যক্ষ কারণ হলোÑযুদ্ধের কারণে দেশ দুটির খাদ্যশস্য রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় গুদামে খাদ্যশস্য পচে যাচ্ছে এবং পচে যাওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে যুদ্ধরত দেশ দুটির চাষিরা স্বাভাবিকভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হবে। ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে যাবে।

অন্যদিকে রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারী দেশ এবং বিশ্বে গ্যাস রপ্তানিতে অন্যতম। রাশিয়া ইউরোপের গ্যাসের মোট চাহিদার ৪০ শতাংশের জোগানদাতা। আমেরিকাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়া ইউরোপে তাদের জ্বালানি তেল ও গ্যাস রপ্তানি কমিয়ে দিয়েছে। এতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের চাহিদার ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানিকারক বিভিন্ন দেশের সেচ ও কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার খরচ বাডছে, যা পরোক্ষভাবে ওইসব দেশে খাদ্যোৎপাদন হ্রাসে ভূমিকা রাখছে।

জাতিসংঘের খাদ্যবিষয়ক সংস্থাÑডব্লিউএফপি বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এতবড় খাদ্যসংকটের মুখোমুখি হয়নি বিশ্ব। সামনে খারাপ সময় অপেক্ষা করছে বলেও সতর্ক করছে সংস্থাটি। ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকি আরও প্রকট হলে আমদানি-নির্ভর দেশগুলো বেকায়দায় পড়বে। এমতাবস্থায়, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করারটা অতি জরুরি। বিশ্ববাসীর খাদ্যচাহিদা পূরণে বিশ্বনেতারা যুদ্ধ বন্ধসহ খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেই প্রত্যাশা। বাংলাদেশও এই সংকট কাটিয়ে সামনের দিকে যাবেÑএই কামনা করি।

[লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ]

বৃহস্পতিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ৪ ভাদ্র ১৪২৯ ১১ সফর ১৪৪৪

কৃষকের সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

মিহির কুমার রায়

image

সম্প্রতি ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। এবার আমন মৌসুমে বৃষ্টি কম হওয়ায় সেচের ব্যয়ও বেড়েছে। এরপর রয়েছে-বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট। সবকিছু মিলে কৃষি খাতে উৎপাদনের খরচ বাড়বে। অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী মৌসুমে চালসহ কৃষিপণ্য এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পপণ্যের দাম বাড়বে। তবে কেউ কেউ বলছেন, উৎপাদন খরচ কিছুটা বাড়লেও খুব বেশি আশঙ্কার কারণ নেই।

ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। যার ফলে প্রতি কেজি সার ১৬ টাকার পরিবর্তে কিনতে হবে ২২ টাকায়। সরকার বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের বর্তমান দাম ৮১ টাকা, এর ফলে ৬ টাকা দাম বাড়ানোর পরও সরকারকে প্রতি কেজিতে ৫৯ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। ডিএপি সারে শতকরা ১৮ শতাংশ নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সারের উপাদান রয়েছে। সে জন্য ডিএপির ব্যবহার বাড়িয়ে ইউরিয়া সারের অপ্রয়োজনীয় ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য সরকার ডিএপি সারের মূল্য প্রতি কেজি ৯০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকা করে কৃষকদের দিয়ে যাচ্ছে। এ উদ্যোগের ফলে বিগত কয়েক বছরে ডিএপি সারের ব্যবহার দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে ডিএপি ব্যবহার হতো ৮ লাখ টন, বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে ১৬ লাখ টন। ডিএপি সারের ব্যবহার বাড়ার ফলে ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমার কথা। কিন্তু বাস্তবে ইউরিয়ার বেড়েছে। ২০১৯ সালে ইউরিয়া ব্যবহার হতো ২৫ লাখ টন, বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন।

বাংলাদেশে তিন ধরনের পণ্যের আমদানি, মোট আমদানি ব্যয়ের ৩০ শতাংশের বেশি। এগুলো জ্বালানি, খাদ্য এবং সার। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে তিন ধরনের পণ্যের দামই অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এতে সারে সরকারের ভর্তুকিও বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত সাড়ে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিয়েছে সরকার।

সমস্যা হচ্ছে, সরকারের বেঁধে দেয়া দামে অনেক স্থানেই কৃষক সার কিনতে পারছেন না। সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পণ্যের দামে প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এ ছাড়া দাম বাড়বে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন শিল্পপণ্যের। সামগ্রিকভাবে যা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে।

কৃষকরা বলছেন, চলতি আমন মৌসুমে উৎপাদন ব্যয় উঠবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বেশি সমস্যায় আছেন বর্গাচাষিরা। তারা বলছেন, সারের দাম বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টিসহ শ্রমিক ব্যয় ও আনুষঙ্গিক যে ব্যয় হবে, তাতে চলতি মৌসুমে আমন চাষে নির্ঘাত লোকসান হবে। এর সঙ্গে তাদের নিজেদের শ্রমের মূল্য যুক্ত করলে লোকসানের পাল্লা আরও ভারী হবে।

যেসব জেলায় বেশি ধান উৎপাদন হয়, তার মধ্যে দিনাজপুর অন্যতম। কিন্তু সারের দাম বাড়ানোয় দুশ্চিন্তার কথা বলছেন জেলার কৃষকরা। তাদের মতে, এক একর জমিতে এবার আমন আবাদ করতে খরচ বাড়বে ৫০০ টাকা এবং বোরো আরও বেশি, প্রতি একর জমিতে আমন আবাদ করতে ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয় ৮০ থেকে ৯০ কেজি, টিএসপি সার লাগে ৪০ কেজি, পটাশ ৪০ কেজি, জিংক ৪ কেজি এবং সালফারের প্রয়োজন হয় ২ কেজি। আর কীটনাশক প্রয়োগ করতে খরচ হয় ৪ হাজার ২০০ টাকা থেকে ৪ হাজার ৩০০ টাকা। জমিতে হালচাষ, ধান রোপণ থেকে কর্তন পর্যন্ত সারসহ সব মিলিয়ে প্রতি একর জমিতে আমন আবাদ করতে খরচ হতো ৩৪ থেকে ৩৬ হাজার টাকা। আর আমন আবাদ হয় প্রতি একরে ৪০ থেকে ৪৫ মণ। ধান বিক্রি করে অধিকাংশ টাকাই চলে যায় এই উৎপাদন খরচে। কিন্তু হঠাৎ ইউরিয়া সারের দাম বৃদ্ধিতে প্রতি একর জমিতে বাড়তি খরচ গুনতে হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। তাই ধানের দাম ভালো না পেলে লোকসান গুনতে হবে তাদের।

কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা বলছেন কৃষকরা বরাবরই মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার করে থাকেন। এ বিষয়ে কৃষকদের সচেতন করার চেষ্টা করা হলেও কাজ হয় না। তাই দাম কিছুটা বৃদ্ধির মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সারের ব্যবহারের প্রবণতা কমবে। এতে জমির উর্বরা শক্তিও ঠিক থাকবে।

ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে সারের দাম বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে দেশের বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকারের কাছে বিকল্প ছিল ভর্তুকি বাড়ানো। সারের দাম না বাড়িয়ে সরকারের সামনে বিকল্প ছিল ভর্তুকি বাড়ানো, যা বাজেটেও বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে ভর্তুকি বাড়ানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতির যে অবস্থা সেখানে ভর্তুকি বাড়ানো কঠিন। এ কারণে বাড়তি চাপ কমাতেই সারের দাম বাড়ানো হয়েছে।

এক হিসাব অনুযায়ী, সারের দাম বাড়ানোর ফলে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ২০ পয়সা বাড়তি ব্যয় হবে। অন্যদিকে যেহেতু চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী এরপর সারের দাম বাড়ানোয়, আগামী মৌসুমে যে চাল বাজারে আসবে, তার মূল্যে কিছুটা প্রভাব পড়বে।

প্রতি বছর সার, বিদ্যুৎ, ডিজেলসহ কৃষি সরঞ্জামের দাম বাড়ে, আর চাষাবাদে নিজের পারিশ্রমিক হিসাব করলে লোকসান হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হলে কৃষকের উপায় থাকে না। সরকারি যেসব বরাদ্দ আসে, সেগুলো প্রকৃত কৃষকের কাছে পৌঁছায় না।

ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইনস কাউন্সিল (আইজিসি) বলছে, ২০২২-২৩ সালে বৈশ্বিক খাদ্যোৎপাদন কমে যাবে, মজুদও গত আট-নয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হবে। বিশ্বে খাদ্যোৎপাদন যে কমে যাবে, তা নিয়ে কোন সংশয় নেই। আর এর পেছনে রয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ। প্রত্যক্ষ কারণ হলোÑযুদ্ধের কারণে দেশ দুটির খাদ্যশস্য রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় গুদামে খাদ্যশস্য পচে যাচ্ছে এবং পচে যাওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে যুদ্ধরত দেশ দুটির চাষিরা স্বাভাবিকভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হবে। ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে যাবে।

অন্যদিকে রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারী দেশ এবং বিশ্বে গ্যাস রপ্তানিতে অন্যতম। রাশিয়া ইউরোপের গ্যাসের মোট চাহিদার ৪০ শতাংশের জোগানদাতা। আমেরিকাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়া ইউরোপে তাদের জ্বালানি তেল ও গ্যাস রপ্তানি কমিয়ে দিয়েছে। এতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের চাহিদার ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানিকারক বিভিন্ন দেশের সেচ ও কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার খরচ বাডছে, যা পরোক্ষভাবে ওইসব দেশে খাদ্যোৎপাদন হ্রাসে ভূমিকা রাখছে।

জাতিসংঘের খাদ্যবিষয়ক সংস্থাÑডব্লিউএফপি বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এতবড় খাদ্যসংকটের মুখোমুখি হয়নি বিশ্ব। সামনে খারাপ সময় অপেক্ষা করছে বলেও সতর্ক করছে সংস্থাটি। ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকি আরও প্রকট হলে আমদানি-নির্ভর দেশগুলো বেকায়দায় পড়বে। এমতাবস্থায়, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করারটা অতি জরুরি। বিশ্ববাসীর খাদ্যচাহিদা পূরণে বিশ্বনেতারা যুদ্ধ বন্ধসহ খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেই প্রত্যাশা। বাংলাদেশও এই সংকট কাটিয়ে সামনের দিকে যাবেÑএই কামনা করি।

[লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ]