নারীর পুষ্টি ও টেকসই উন্নয়ন

ছামিউল ইসলাম

দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ১ কোটি ৭০ লাখ নারী অপুষ্টির শিকার। তাদের মধ্যে ৫০ লাখ নারীর ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম, অর্থাৎ তারা অপুষ্টিতে ভুগছেন। অন্যদিকে ১ কোটি ২০ লাখ নারীর ওজন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থাৎ তারা স্থুলকায়। অপুষ্টির কারণেই তারা স্থূল। এর অর্থ হচ্ছে দেশে ঐ বয়সী বিবাহিত মোট নারীর ৪৫ শতাংশই অপুষ্টিতে ভুগছেন। দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির এ ভয়াবহ চিত্র বুঝিয়ে দিয়েছে নারীদের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা কতটা পিছিয়ে আছি।

গত ১৬ আগস্ট আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআর,বি), ইউএসএআইডি এবং ডেটা ফর ইমপ্যাক্ট আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেশের নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে এ তথ্য দেওয়া হয়। কম ওজন এবং বেশি ওজন বা স্থুলতা যখন একই সঙ্গে কোন সমাজে বা রাষ্ট্রে থাকে তখন এটাকে অপুষ্টির দ্বি-মুখী সংকট বলা হয়। এর সঙ্গে অনুপুষ্টির অভাবজনিত সমস্যা যোগ হলে অপুষ্টির ত্রি-মুখী সংকট সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০১৮ রিপোর্টটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বিবাহিত নারীদের মধ্যে ওজন স্বল্পতাজনিত অপুষ্টি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে (৩০% থেকে কমে ১৩%)।

অন্যদিকে স্থুলকায় নারীদের সংখ্যা ১২% থেকে বেড়ে ৩২% হয়েছে। অর্থাৎ বিগত ১০ বছরের ব্যবধানে ওজন স্বল্পতাজনিত অপুষ্টি কমলেও সার্বিকভাবে স্থুলতা পরিস্থিতির বেশ অবনতি হয়েছে। উল্লেখ্য যে, গ্রামাঞ্চলে নারীদের মাঝে ওজন স্বল্পতাজনিত অপুষ্টি বেশি, অন্যদিকে শহরে স্থুলকায় নারীর সংখ্যা বেশি। কম ওজন এবুং স্থুলতা উভয়ের সঙ্গেই অনুপুষ্টি ঘাটতির একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, এ দেশের ৩৭ শতাংশ প্রজননক্ষম নারী আয়রন ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। রক্তস্বল্পতা গর্ভপাত, অকাল জন্ম ও কম জন্মওজনের শিশু জন্মদানের ঝুঁকি বাড়ায়, শিশুদের বৃদ্ধি ও মেধা বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। রক্তস্বল্পতা চরম ক্লান্তি সৃষ্টি করে, কার্যক্ষমতা হ্রাস করে এবং অসুস্থ স্বাস্থ্যের বোঝাকে বাডড়য়েতোলে। ২০১৯-২০ জাতীয় অনুপুষ্টি জরিপে (ন্যাশনাল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সার্ভে) বাংলাদেশে ৩০ ভাগ প্রজননক্ষম নারীদের মাঝে আয়োডিনের ঘাটতি পাওয়া গেছে। আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েডের বিভিন্ন সমস্যা এবং শিশুদের মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ৯.৭ শতাংশ প্রজননক্ষম নারীর ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব রয়েছে। অপর্যাপ্ত ভিটামিন ‘এ’ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে কাজ করতে দেয় না এবং গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতার জন্যও দায়ী। এছাড়াও এদেশের নারীরা অন্যান্য অনেক অনুপুষ্টি উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম, জিংক ইত্যাদির ঘাটতিতে ভুগছেন।

সব মিলিয়ে বাংলদেশে এখন অপুষ্টির ত্রি-মুখী সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি অপুষ্টির সমস্যাকে আরো প্রকট করতে পারে। অপুষ্টি নামক অভিশাপের পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও অধিকাংশ মানুষই পুষ্টি বিষয়ে সচেতন নয়। পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে মা ও শিশুদের সঠিক পুষ্টি ও যতœ নিশ্চিত হচ্ছে না। পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে, ও সামাজিক নানা বৈষম্যের কারণে বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের নারীরা প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। পাশাপাশি, প্রতিদিন যে খাদ্যবৈচিত্র্য মেনে খাবার খাওয়া উচিত তা মেনে চলা হয় না। অন্যদিকে, আরেক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা ফাস্টফুড, প্রক্রিয়াজাতকৃত ও রেস্টুরেন্টের খাবার অনেক পছন্দ করে। অধিক শর্করা জাতীয় ও তেল-চর্বি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমায়, যা দীর্ঘমেয়াদে ওজন বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে। বিশ্বায়নের এই যুগে মানুষ এখন শহরমুখী, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সুযোগ কাজে লাগিয়ে মানুষ অল্প দূরত্বেও হাঁটতে চায় না, অন্যদিকে ব্যস্ততা বা অলসতার কারণে নিয়মিত ব্যায়াম করাও হয়ে ওঠে না। প্রতিদিনকার খাদ্যাভ্যাস, বিলাসিতা ও অলসতা স্থুলতার অন্যতম প্রধান কারণ।

অপুষ্টির অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নিরাপদ পানি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যকর পয়ঃনিষ্কাশনের অভাব। সেই সঙ্গে একটি শিশুর পুষ্টি অবস্থা কেমন হবে তা তার জীবনের শুরুতেই অনেকটা নির্ধারিত হয়। গর্ভাবস্থার আগে এবং গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের অপুষ্টি শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। অপুষ্টির অবস্থা ও কারণ যাই হোক না কেন, এর ফলাফলগুলো কিন্তু খুবই ভয়ংকর ও নেতিবাচক। শৈশবকালীন অপুষ্টি শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি করে এবং শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। আবার, অতিরিক্ত ওজন বা স্থুলতা দীর্ঘস্থায়ী অসংক্রামক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনির সমস্যা ইত্যাদির অন্যতম কারণ। নারীদের অতিরিক্ত ওজন কিংবা কম ওজন দুটোই গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন জটিলতা এবং সেইসঙ্গে গর্ভস্থ শিশুর নানা সমস্যা তৈরি করে। কম জন্মওজনের শিশুরা পরবর্তী জীবনেও অপুষ্টিসহ নানা ধরণের রোগে ভুগতে থাকে। আবার শৈশবকালীন অপুষ্টিতে ভুগলে পরবর্তীতে অধিক পুষ্টি গ্রহণ শরীরে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না, যার কারণেও স্থুলতা হতে পারে। স্থুলকায় নারীদের গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি বেশি এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়ে থাকে; যা পরবর্তীতে কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়। নারীরা অপুষ্টিতে ভুগলে পরবর্তী প্রজন্মেও তা চক্রাকারে চলতে থাকে।

সর্বোপরি অপুষ্টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতিতে বাধার সৃষ্টি করে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বেশ কিছু অর্জনের কথা উঠে এসেছে। তবে পুষ্টি খাতে উন্নয়ন আশাব্যঞ্জক নয়। এখনো বিভিন্ন বয়স শ্রেণীর জনগোষ্ঠী বহুমাত্রিক অপুষ্টিতে ভুগছে। এর পেছনে নানা ফ্যাক্টর কাজ করছে। অপুষ্টির দ্বি-মুখী বা ত্রি-মুখী সংকট উত্তরণে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনার (২০১৬-২০২৫) আলোকে দেশব্যাপী পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একযোগে কাজ করে যাচ্ছে।

পুষ্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের কার্যক্রমে কম ওজন বা কমপুষ্টির পাশাপাশি অতিপুষ্টি বা স্থুলতা নিয়েও ভাবতে হবে এবং আরো অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে সরকারের বিশেষ পরিকল্পনা থাকতে হবে যাতে তারা দ্রুত ভালো অবস্থায় আসতে পারে। রাজনৈতিক নেতাসহ সরকারের নীতি নির্ধারণী গোষ্ঠীকে পুষ্টির ওপর আরো গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। মোটকথা, অপুষ্টির সংকট নিরসনে প্রয়োজন সরকারি বিভিন্ন বিভাগ, দাতা গোষ্ঠী ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রয়াস। সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের কর্মকান্ডের প্রত্যেকটি পর্যায়ে সঠিক অংশীদারিত্ব, জবাবদিহিতা ও সমন্বয় সাধন। সেই সঙ্গে, টেকসইভাবে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য এখন সময় এসেছে সমতল ভূমির চেয়ে সামুদ্রিক ও স্বাদু পানির জলজ উৎপাদনের (যেমন- মাছ ও অন্যান্য প্রাণী, শৈবাল ও অন্যান্য উদ্ভিদ এবং অণুজীব) প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া।

পুষ্টি অবস্থার উন্নয়নে, বিশেষ করে নারীদের পুষ্টি অবস্থার উন্নয়নে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), বাংলাদেশের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং রূপকল্প-২০৪১ এর লক্ষ্য।

[লেখক : সিনিয়র নিউট্রিশন স্পেশালিস্ট, ইউএসএআইডি, ইকোফিশ-২ অ্যাক্টিভিটি, ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশ]

শুক্রবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ২৫ ভাদ্র ১৪২৯ ১২ সফর ১৪৪৪

নারীর পুষ্টি ও টেকসই উন্নয়ন

ছামিউল ইসলাম

দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ১ কোটি ৭০ লাখ নারী অপুষ্টির শিকার। তাদের মধ্যে ৫০ লাখ নারীর ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম, অর্থাৎ তারা অপুষ্টিতে ভুগছেন। অন্যদিকে ১ কোটি ২০ লাখ নারীর ওজন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থাৎ তারা স্থুলকায়। অপুষ্টির কারণেই তারা স্থূল। এর অর্থ হচ্ছে দেশে ঐ বয়সী বিবাহিত মোট নারীর ৪৫ শতাংশই অপুষ্টিতে ভুগছেন। দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির এ ভয়াবহ চিত্র বুঝিয়ে দিয়েছে নারীদের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা কতটা পিছিয়ে আছি।

গত ১৬ আগস্ট আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআর,বি), ইউএসএআইডি এবং ডেটা ফর ইমপ্যাক্ট আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেশের নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে এ তথ্য দেওয়া হয়। কম ওজন এবং বেশি ওজন বা স্থুলতা যখন একই সঙ্গে কোন সমাজে বা রাষ্ট্রে থাকে তখন এটাকে অপুষ্টির দ্বি-মুখী সংকট বলা হয়। এর সঙ্গে অনুপুষ্টির অভাবজনিত সমস্যা যোগ হলে অপুষ্টির ত্রি-মুখী সংকট সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০১৮ রিপোর্টটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বিবাহিত নারীদের মধ্যে ওজন স্বল্পতাজনিত অপুষ্টি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে (৩০% থেকে কমে ১৩%)।

অন্যদিকে স্থুলকায় নারীদের সংখ্যা ১২% থেকে বেড়ে ৩২% হয়েছে। অর্থাৎ বিগত ১০ বছরের ব্যবধানে ওজন স্বল্পতাজনিত অপুষ্টি কমলেও সার্বিকভাবে স্থুলতা পরিস্থিতির বেশ অবনতি হয়েছে। উল্লেখ্য যে, গ্রামাঞ্চলে নারীদের মাঝে ওজন স্বল্পতাজনিত অপুষ্টি বেশি, অন্যদিকে শহরে স্থুলকায় নারীর সংখ্যা বেশি। কম ওজন এবুং স্থুলতা উভয়ের সঙ্গেই অনুপুষ্টি ঘাটতির একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, এ দেশের ৩৭ শতাংশ প্রজননক্ষম নারী আয়রন ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। রক্তস্বল্পতা গর্ভপাত, অকাল জন্ম ও কম জন্মওজনের শিশু জন্মদানের ঝুঁকি বাড়ায়, শিশুদের বৃদ্ধি ও মেধা বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। রক্তস্বল্পতা চরম ক্লান্তি সৃষ্টি করে, কার্যক্ষমতা হ্রাস করে এবং অসুস্থ স্বাস্থ্যের বোঝাকে বাডড়য়েতোলে। ২০১৯-২০ জাতীয় অনুপুষ্টি জরিপে (ন্যাশনাল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সার্ভে) বাংলাদেশে ৩০ ভাগ প্রজননক্ষম নারীদের মাঝে আয়োডিনের ঘাটতি পাওয়া গেছে। আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েডের বিভিন্ন সমস্যা এবং শিশুদের মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ৯.৭ শতাংশ প্রজননক্ষম নারীর ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব রয়েছে। অপর্যাপ্ত ভিটামিন ‘এ’ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে কাজ করতে দেয় না এবং গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতার জন্যও দায়ী। এছাড়াও এদেশের নারীরা অন্যান্য অনেক অনুপুষ্টি উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম, জিংক ইত্যাদির ঘাটতিতে ভুগছেন।

সব মিলিয়ে বাংলদেশে এখন অপুষ্টির ত্রি-মুখী সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি অপুষ্টির সমস্যাকে আরো প্রকট করতে পারে। অপুষ্টি নামক অভিশাপের পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও অধিকাংশ মানুষই পুষ্টি বিষয়ে সচেতন নয়। পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে মা ও শিশুদের সঠিক পুষ্টি ও যতœ নিশ্চিত হচ্ছে না। পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে, ও সামাজিক নানা বৈষম্যের কারণে বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের নারীরা প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। পাশাপাশি, প্রতিদিন যে খাদ্যবৈচিত্র্য মেনে খাবার খাওয়া উচিত তা মেনে চলা হয় না। অন্যদিকে, আরেক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা ফাস্টফুড, প্রক্রিয়াজাতকৃত ও রেস্টুরেন্টের খাবার অনেক পছন্দ করে। অধিক শর্করা জাতীয় ও তেল-চর্বি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমায়, যা দীর্ঘমেয়াদে ওজন বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে। বিশ্বায়নের এই যুগে মানুষ এখন শহরমুখী, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সুযোগ কাজে লাগিয়ে মানুষ অল্প দূরত্বেও হাঁটতে চায় না, অন্যদিকে ব্যস্ততা বা অলসতার কারণে নিয়মিত ব্যায়াম করাও হয়ে ওঠে না। প্রতিদিনকার খাদ্যাভ্যাস, বিলাসিতা ও অলসতা স্থুলতার অন্যতম প্রধান কারণ।

অপুষ্টির অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নিরাপদ পানি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যকর পয়ঃনিষ্কাশনের অভাব। সেই সঙ্গে একটি শিশুর পুষ্টি অবস্থা কেমন হবে তা তার জীবনের শুরুতেই অনেকটা নির্ধারিত হয়। গর্ভাবস্থার আগে এবং গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের অপুষ্টি শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। অপুষ্টির অবস্থা ও কারণ যাই হোক না কেন, এর ফলাফলগুলো কিন্তু খুবই ভয়ংকর ও নেতিবাচক। শৈশবকালীন অপুষ্টি শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি করে এবং শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। আবার, অতিরিক্ত ওজন বা স্থুলতা দীর্ঘস্থায়ী অসংক্রামক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনির সমস্যা ইত্যাদির অন্যতম কারণ। নারীদের অতিরিক্ত ওজন কিংবা কম ওজন দুটোই গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন জটিলতা এবং সেইসঙ্গে গর্ভস্থ শিশুর নানা সমস্যা তৈরি করে। কম জন্মওজনের শিশুরা পরবর্তী জীবনেও অপুষ্টিসহ নানা ধরণের রোগে ভুগতে থাকে। আবার শৈশবকালীন অপুষ্টিতে ভুগলে পরবর্তীতে অধিক পুষ্টি গ্রহণ শরীরে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না, যার কারণেও স্থুলতা হতে পারে। স্থুলকায় নারীদের গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি বেশি এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়ে থাকে; যা পরবর্তীতে কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়। নারীরা অপুষ্টিতে ভুগলে পরবর্তী প্রজন্মেও তা চক্রাকারে চলতে থাকে।

সর্বোপরি অপুষ্টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতিতে বাধার সৃষ্টি করে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বেশ কিছু অর্জনের কথা উঠে এসেছে। তবে পুষ্টি খাতে উন্নয়ন আশাব্যঞ্জক নয়। এখনো বিভিন্ন বয়স শ্রেণীর জনগোষ্ঠী বহুমাত্রিক অপুষ্টিতে ভুগছে। এর পেছনে নানা ফ্যাক্টর কাজ করছে। অপুষ্টির দ্বি-মুখী বা ত্রি-মুখী সংকট উত্তরণে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনার (২০১৬-২০২৫) আলোকে দেশব্যাপী পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একযোগে কাজ করে যাচ্ছে।

পুষ্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের কার্যক্রমে কম ওজন বা কমপুষ্টির পাশাপাশি অতিপুষ্টি বা স্থুলতা নিয়েও ভাবতে হবে এবং আরো অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে সরকারের বিশেষ পরিকল্পনা থাকতে হবে যাতে তারা দ্রুত ভালো অবস্থায় আসতে পারে। রাজনৈতিক নেতাসহ সরকারের নীতি নির্ধারণী গোষ্ঠীকে পুষ্টির ওপর আরো গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। মোটকথা, অপুষ্টির সংকট নিরসনে প্রয়োজন সরকারি বিভিন্ন বিভাগ, দাতা গোষ্ঠী ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রয়াস। সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের কর্মকান্ডের প্রত্যেকটি পর্যায়ে সঠিক অংশীদারিত্ব, জবাবদিহিতা ও সমন্বয় সাধন। সেই সঙ্গে, টেকসইভাবে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য এখন সময় এসেছে সমতল ভূমির চেয়ে সামুদ্রিক ও স্বাদু পানির জলজ উৎপাদনের (যেমন- মাছ ও অন্যান্য প্রাণী, শৈবাল ও অন্যান্য উদ্ভিদ এবং অণুজীব) প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া।

পুষ্টি অবস্থার উন্নয়নে, বিশেষ করে নারীদের পুষ্টি অবস্থার উন্নয়নে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), বাংলাদেশের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং রূপকল্প-২০৪১ এর লক্ষ্য।

[লেখক : সিনিয়র নিউট্রিশন স্পেশালিস্ট, ইউএসএআইডি, ইকোফিশ-২ অ্যাক্টিভিটি, ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশ]