‘যেমন কর্ম তেমন ফল’

বাবুল রবিদাস

সৃষ্টির প্রারম্ভিক স্তরে অসহায় মানুষ যখন হিংস্র প্রাণীর উপদ্রব ও বৈরী প্রকৃতির নির্মমতার হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য বুকফাটা আহাজারি শুরু করেছিল- সেই আহাজারির শব্দে তখন কোন দেবতা তাদের আহবানে সাড়া দেয়নি। চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে মানুষ চিন্তাভাবনা ও জ্ঞান-বুদ্ধি প্রয়োগ করে একে-অন্যের সাহাযার্থে এগিয়ে এসেছে এবং পরস্পরের সহযোগিতায় বৈরী প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে নিরলস সংগ্রাম করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। আজকে আমরা যা দেখছি, যেমন- টেলিভিশন, মোবাইল, কম্পিউটার, খাতা-কলম, বই-পুস্তক, কৃষি-কাজ, জামা-কাপড় ইত্যাদি তখন আবিষ্কার হয় নাই। পুরুষেরা শিকারে যখন যেত, তখন নারীরাই কৃষি-কাজের বিপ্লব ঘটিয়েছিল। এভাবেই আদিম প্রকৃতির মানুষেরা কঠোর পরিশ্রম ও দক্ষ কর্ম দিয়ে সুন্দর সুফলপ্রাপ্ত হয়েছিল। আমরা আজ তা আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাসে ব্যবহার করছি। কর্ম, পরিশ্রম ও বুদ্ধির জোরে সুফল পাওয়া যায়। এ কারণেই বলা হয় ‘যেমন কর্ম তেমন ফল।’

অথচ মানুষ পরিশ্রম ও কর্মকে প্রাধান্য না দিয়ে বলে ‘অদৃষ্টের ফল কে খন্ডাবে বলো।’ অদৃষ্ট সমস্ত কিছুর নিয়ন্তা এবং আমাদের অদৃষ্টের সমস্ত কিছুই আগে থেকে নির্ধারিত হয়েই রয়েছে বলে মনে করা হয়। তাহলে তো মানুষের সামনে সমস্যাই থাকে না। মানুষের করার জন্য কিছুই থাকে না। অদৃষ্টে বা ভাগ্যে যদি থাকে আমার সন্তান ডাক্তার হবে, তবে তা খন্ডাবে কে? আমার ছেলে পড়লেও ডাক্তার হবে, না পড়লেও ডাক্তার হবে। স্কুলে ভর্তির জন্য আগের রাতে লাইন দেওয়ার প্রয়োজন তো দেখি না। আবার আরেক দিক থেকে ভেবে দেখুন, অদৃষ্টে স্কুলে ভর্তির ফরম পাওয়ার থাকলে পাবই, যেখান থেকে হোক স্কুল ভর্তি ফরম নেচে-নেচে আমার কাছে আসবে- এমনকি হয় কখনো? উত্তর হচ্ছে- না।

এই পৃথিবীতে মানুষ সৎ কর্ম, সুকর্ম, অপরের উপকার, বৈষম্য ভেদাভেদ না করা, সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করা, ছোট-বড় মনে না করা, অস্পৃশ্যতা সমাজ থেকে দূর করা ইত্যাদির মাধ্যমে শ্রমিক, দিনমজুর, দলিত, উপজাতি, ব্রাত্যজন, অনগ্রসর, জনগণের কাছে অর্থাৎ পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে পূজনীয় ও শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠে ও স্মরণীয় হয়ে যায়। ভালো ও সুন্দর কাজ করার জন্য মানুষ মাত্রই তার কাছে অতি আপনজন। কেউ পর নয়। এমত পরিস্থিতিতে সমাজে সুখ আর শান্তির বন্ধন তৈরি হয়। এ অবস্থাকেই কবি স্বর্গ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

পক্ষান্তরে নরক হচ্ছে- মানুষ মৃত্যুর পর কুকর্মের দ্বারা প্রাপ্ত স্থান যথা- যন্ত্রণা ভোগের অগ্নিময় ভয়ংকর অশান্তির নামক জায়গাকে নরক বোঝানো হয়েছে। অন্যায় অত্যাচার বা অসৎ কাজ, মানুষ হয়ে মানুষকে ঘৃণা করা, অহংকারে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবা, লোভ-লালসা করা, শোষণ ও অশান্তির মতো কাজে জড়িত থাকা পাপাচারে লিপ্ত থাকা ঐক্য শৃঙ্খলা নষ্ট করা, হিংসা-বিদ্বেষের সমাজ তৈরি করার অর্থকেই নরকবাস বলা হয়েছে।

অক্ষয় দত্তের বইয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাংলার সমাজ সংস্কার, বলরাম হাঁড়ির একটি কাহিনী পাই তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কাহিনীটি হলো- একদিন বলরাম হাঁড়ি নদীতে স্নান করতে গিয়ে দেখল, কয়েকজন ব্রাহ্মণ তথায় পিতৃলোকের তর্পণ করছে। সেও তাদের ন্যায় অঙ্গভঙ্গি করে নদীকূলে জলসেচন করতে লাগলো। এটা দেখে একজন ব্রাহ্মণ তাকে জিজ্ঞাসা করলো- বলাই, তুই ও কী করছিস? সে উত্তর করলো- আমি শাকের ক্ষেতে জল দিচ্ছি। ব্রাহ্মণ কহিলো- এখানে শাকের ক্ষেত কোথায়?

বললাম হাঁড়ি উত্তর দিলো- আপনারা যে পিতৃলোকের তর্পণ করছেন, তারা কোথায়? যদি নদীর জল নদীতে নিক্ষেপ করলে পিতৃলোক প্রাপ্ত হন, তবে নদীর কূলে জলসেচন করলে শাকের ক্ষেতে জল না পাবে কেন? অর্থাৎ ‘যেমন কর্ম তেমন ফল।’

[লেখক : আইনজীবী, জজকোর্ট, জয়পুরহাট]

শুক্রবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ২৫ ভাদ্র ১৪২৯ ১২ সফর ১৪৪৪

‘যেমন কর্ম তেমন ফল’

বাবুল রবিদাস

সৃষ্টির প্রারম্ভিক স্তরে অসহায় মানুষ যখন হিংস্র প্রাণীর উপদ্রব ও বৈরী প্রকৃতির নির্মমতার হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য বুকফাটা আহাজারি শুরু করেছিল- সেই আহাজারির শব্দে তখন কোন দেবতা তাদের আহবানে সাড়া দেয়নি। চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে মানুষ চিন্তাভাবনা ও জ্ঞান-বুদ্ধি প্রয়োগ করে একে-অন্যের সাহাযার্থে এগিয়ে এসেছে এবং পরস্পরের সহযোগিতায় বৈরী প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে নিরলস সংগ্রাম করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। আজকে আমরা যা দেখছি, যেমন- টেলিভিশন, মোবাইল, কম্পিউটার, খাতা-কলম, বই-পুস্তক, কৃষি-কাজ, জামা-কাপড় ইত্যাদি তখন আবিষ্কার হয় নাই। পুরুষেরা শিকারে যখন যেত, তখন নারীরাই কৃষি-কাজের বিপ্লব ঘটিয়েছিল। এভাবেই আদিম প্রকৃতির মানুষেরা কঠোর পরিশ্রম ও দক্ষ কর্ম দিয়ে সুন্দর সুফলপ্রাপ্ত হয়েছিল। আমরা আজ তা আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাসে ব্যবহার করছি। কর্ম, পরিশ্রম ও বুদ্ধির জোরে সুফল পাওয়া যায়। এ কারণেই বলা হয় ‘যেমন কর্ম তেমন ফল।’

অথচ মানুষ পরিশ্রম ও কর্মকে প্রাধান্য না দিয়ে বলে ‘অদৃষ্টের ফল কে খন্ডাবে বলো।’ অদৃষ্ট সমস্ত কিছুর নিয়ন্তা এবং আমাদের অদৃষ্টের সমস্ত কিছুই আগে থেকে নির্ধারিত হয়েই রয়েছে বলে মনে করা হয়। তাহলে তো মানুষের সামনে সমস্যাই থাকে না। মানুষের করার জন্য কিছুই থাকে না। অদৃষ্টে বা ভাগ্যে যদি থাকে আমার সন্তান ডাক্তার হবে, তবে তা খন্ডাবে কে? আমার ছেলে পড়লেও ডাক্তার হবে, না পড়লেও ডাক্তার হবে। স্কুলে ভর্তির জন্য আগের রাতে লাইন দেওয়ার প্রয়োজন তো দেখি না। আবার আরেক দিক থেকে ভেবে দেখুন, অদৃষ্টে স্কুলে ভর্তির ফরম পাওয়ার থাকলে পাবই, যেখান থেকে হোক স্কুল ভর্তি ফরম নেচে-নেচে আমার কাছে আসবে- এমনকি হয় কখনো? উত্তর হচ্ছে- না।

এই পৃথিবীতে মানুষ সৎ কর্ম, সুকর্ম, অপরের উপকার, বৈষম্য ভেদাভেদ না করা, সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করা, ছোট-বড় মনে না করা, অস্পৃশ্যতা সমাজ থেকে দূর করা ইত্যাদির মাধ্যমে শ্রমিক, দিনমজুর, দলিত, উপজাতি, ব্রাত্যজন, অনগ্রসর, জনগণের কাছে অর্থাৎ পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে পূজনীয় ও শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠে ও স্মরণীয় হয়ে যায়। ভালো ও সুন্দর কাজ করার জন্য মানুষ মাত্রই তার কাছে অতি আপনজন। কেউ পর নয়। এমত পরিস্থিতিতে সমাজে সুখ আর শান্তির বন্ধন তৈরি হয়। এ অবস্থাকেই কবি স্বর্গ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

পক্ষান্তরে নরক হচ্ছে- মানুষ মৃত্যুর পর কুকর্মের দ্বারা প্রাপ্ত স্থান যথা- যন্ত্রণা ভোগের অগ্নিময় ভয়ংকর অশান্তির নামক জায়গাকে নরক বোঝানো হয়েছে। অন্যায় অত্যাচার বা অসৎ কাজ, মানুষ হয়ে মানুষকে ঘৃণা করা, অহংকারে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবা, লোভ-লালসা করা, শোষণ ও অশান্তির মতো কাজে জড়িত থাকা পাপাচারে লিপ্ত থাকা ঐক্য শৃঙ্খলা নষ্ট করা, হিংসা-বিদ্বেষের সমাজ তৈরি করার অর্থকেই নরকবাস বলা হয়েছে।

অক্ষয় দত্তের বইয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাংলার সমাজ সংস্কার, বলরাম হাঁড়ির একটি কাহিনী পাই তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কাহিনীটি হলো- একদিন বলরাম হাঁড়ি নদীতে স্নান করতে গিয়ে দেখল, কয়েকজন ব্রাহ্মণ তথায় পিতৃলোকের তর্পণ করছে। সেও তাদের ন্যায় অঙ্গভঙ্গি করে নদীকূলে জলসেচন করতে লাগলো। এটা দেখে একজন ব্রাহ্মণ তাকে জিজ্ঞাসা করলো- বলাই, তুই ও কী করছিস? সে উত্তর করলো- আমি শাকের ক্ষেতে জল দিচ্ছি। ব্রাহ্মণ কহিলো- এখানে শাকের ক্ষেত কোথায়?

বললাম হাঁড়ি উত্তর দিলো- আপনারা যে পিতৃলোকের তর্পণ করছেন, তারা কোথায়? যদি নদীর জল নদীতে নিক্ষেপ করলে পিতৃলোক প্রাপ্ত হন, তবে নদীর কূলে জলসেচন করলে শাকের ক্ষেতে জল না পাবে কেন? অর্থাৎ ‘যেমন কর্ম তেমন ফল।’

[লেখক : আইনজীবী, জজকোর্ট, জয়পুরহাট]