ঘটনা প্রকাশ না করার অনুরোধ

এম এ কবীর

বিআরটি প্রকল্পে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা গেছে। কিছুদিন আগে রড পড়ে ভেঙে গেছে একটি চলন্ত প্রাইভেটকার। আহত হয়েছেন গাড়িতে থাকা ৫ যাত্রী। উত্তরায় গার্ডারচাপায় ৫ জন নিহতের ৫ দিনের মাথায় এই দুর্ঘটনা। নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় টঙ্গীর কলেজগেট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার শিকার আবদুর রশিদ জানান, গাড়িতে তিনি, স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়েসহ ৫ জন ছিলেন। খবর পেয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন এসে দুঃখ প্রকাশ করে। গাড়িটি মেরামত করার জন্য তাকে ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়। তবে ঘটনা প্রকাশ না করার অনুরোধ করে।

গত বছরের ১৪ মার্চ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় বিআরটি প্রকল্পের একটি গার্ডার লঞ্চার ভেঙে তিন চীনা কর্মীসহ ৬ জন আহত হন। এরপর দুই মাসের বেশি সময় পড়ে থাকার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় ওই পথে চলাচলকারীদের। ওই বছরের ১৮ জুন ক্রেনটি মেরামত করে সচল করা হয়। গত ১৫ জুলাই গাজীপুরে বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের ‘লঞ্চিং গার্ডার’ চাপায় প্রকল্পটির এক নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন। ওই ঘটনায় আরেক শ্রমিক ও একজন পথচারী আহত হন।

২০১৭ সালের ১২ মার্চ রাতে ঢাকার মালিবাগ রেলগেট এলাকায় নির্মাণাধীন মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ৩৬ মিটার দীর্ঘ গার্ডার ভেঙে পড়ে। রেললাইনের উপরের ওই ঘটনায় একজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। একটি করে পা হারান আরও দুজন। এর আগেও বিআরটি প্রকল্পে নানা দুর্ঘটনা ঘটেছে।

১০ বছর আগে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ঘটে প্রথম গার্ডার দুর্ঘটনা। ২০১২ সালে দুই দফায় চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটের ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে পড়ে। প্রথমবার ওই বছরের ২৯ জুন। সেখানে ১৩০ ফুট দীর্ঘ কংক্রিটের গার্ডার ভেঙে পড়ে একজন রিকশাচালক আহত হন। এরপর ওই বছরের ২৪ নভেম্বর ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ভেঙে ২৯ জন নিহত হন। ওই ঘটনায় আহত হন আরও অনেকে। ওই সময় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী, নির্মাণকাজে জড়িত মীর আক্তার অ্যান্ড পারিশা ট্রেড সিস্টেমসের (যৌথ মালিকানা) কর্মকর্তাসহ মোট ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। ২৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ৩ অক্টোবর। মামলায় আসামি করা হয় ২৫ জনকে। তবে চার্জশিট দেয়া হয় ৮ জনের বিরুদ্ধে।

রাজধানীর উত্তরায় যে ঘটনা ঘটল, তার বিচার কী হবে এবং বিচারে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অপরাধ কতটা প্রমাণ করা যাবে এবং বিচারে তাদের কী শাস্তি হবে, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, যে পাঁচজন মানুষ প্রাণ হারালেন; যে সংসারটা তছনছ হয়ে গেলো, কোনো কিছুর বিনিময়ে কি তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া সম্ভব? দুর্ঘটনার শিকার ওই গাড়িতে থাকলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান নববধূ রিয়া। তার ভাষায়: ‘দুইটা টাকা লাভের জন্য নিরাপত্তা ছাড়াই ব্যস্ত রাস্তায় গার্ডার ঝুলিয়ে রেখেছে তারা। আমার তো সব শেষ হয়ে গেলো। তারা আমার এমন সর্বনাশ করল।’

মৃত্যুফাঁদ হয়ে ওঠা এই বিআরটি প্রকল্প আমাদের অদক্ষতার দলিল হয়ে মানুষকে ভোগাচ্ছে এবং হত্যা করছে গত ১০ বছর ধরে। ২০১২ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্প ২০১৭ সালে শেষ হওয়ার কথা। এরমধ্যে ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ৪ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। ৫ বছরের জায়গায় ১০ বছর পার হয়েছে, কিন্তু প্রকল্প শেষের নামগন্ধ নেই।

নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইট পড়ে মানুষ মারা যায়, দেয়াল ধসে মারা যায়, স্কুলের গেট ভেঙে শিশু মারা যায়। মৃত্যু যেন ডালভাত, বেঁচে থাকাই প্রতিদিনের আপোস, নিত্যদিনের লড়াই। প্রিয় শহরের পাড়ায়-পাড়ায়, মোড়ে-মোড়ে, রাস্তায় রাস্তায় মৃত্যুফাঁদ।

এদিকে আগস্ট মাসে দেশে ৪৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১৯ জন নিহত এবং ৯৬১ জন আহত হয়েছেন বলে জানায় রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। আরএসএফ সড়ক দুর্ঘটনার ক্রমবর্ধমান প্রবণতার পেছনে বেশ কয়েকটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি ও গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।

রাষ্ট্রের চোখের সামনেই উন্নয়নের নামে এ রকম আরও অজস্র্র সর্বনাশ হতে থাকে। উত্তরায় যেদিন এই ঘটনা ঘটে, সেদিনই, অর্থাৎ জাতীয় শোক দিবসেই পুরান ঢাকার চকবাজারে প্লাস্টিক কারখানায় আগুনে ছয়জন নিহত হন। তাদের সবাই স্থানীয় বরিশাল হোটেলের কর্মচারী। এই ছয় জনের মধ্যে যদি কেউ পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী ব্যক্তি হয়ে থাকেন, তাহলে ওই পরিবারটির কী হবে? এই ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা রাষ্ট্র তাদের কী ক্ষতিপূরণ দেবে? কিছু নগদ সহায়তা যদি দেয়াও হয়, তাতেও কি ওই মানুষদের ফিরে পাওয়া যাবে? এই ঘটনার জন্য কাকে দায়ী করা হবে? ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ, সবাই বলছে এখানে নিয়মনীতি মানা হয়নি। প্রশ্ন হলো, নিয়মনীতি মানানোর দায়িত্ব কার? পুরান ঢাকায় নিয়মনীতি মানাতে খোদ সিটি করপোরেশনও ব্যর্থ। অনেক সময় নীতিনির্ধারকরাও এই ব্যর্থতার দায় পরস্পরের ওপর চাপান।

গত ৫ জুন বিশ^ পরিবেশ দিবসে চট্টগ্রামের সীতাকু-ের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুনে ৪৩ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়। তবে দেশের ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয় ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যালের গোডাউনে লাগা আগুনে। নিহত হন ১২৪ জন। এই ঘটনার ৯ বছরের মাথায় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ আগুনে মারা যান প্রায় ৮০ জন। অথচ নিমতলীর ঘটনার পরেই আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন সরিয়ে ফেলার সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। সেই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। যার খেসারত দিতে হয় চকবাজারে। এরপর গত বছরের জুন মাসেও রাজধানীর মগবাজারে একটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়, সে ভবনেও কেমিক্যাল ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থ ছিল বলে ধারণা করা হয়। আবার এর এক মাস না যেতেই ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যান অর্ধশতাধিক শ্রমিক।

সীতাকু-ের ঘটনাটি কেন ঘটল কিংবা এর আগে নিমতলী, চুড়িহাট্টা, মগবাজার, রূপগঞ্জে কেন একইভাবে সাধারণ মানুষ পুড়ে মারা গেল? নিমতলীর ঘটনার পর যে কেমিক্যাল বা রাসায়নিক দ্রব্য মজুদের বিষয়টি আলোচনায় আসে, সেই একই আলোচনা ২০ বছর পরও কেন করতে হচ্ছে? এই ২০ বছরে রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কী করল? রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আমদানির পর যেসব জায়গায় কেমিক্যাল মজুদ করে রাখা হয়, সেগুলো কতটা নিরাপদ? ব্যবসায়ীরা কতটা নিয়মকানুন মানেন। এর জন্য কি কোন নীতিমালা আছে? কোথাও কি কোন জবাবদিহির ব্যবস্থা আছে?

উত্তরায় গার্ডার ধসে পাঁচজনের মৃত্যু নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া যতটা সোচ্চার, একই দিনে পুরান ঢাকায় ছয়জন শ্রমিকের দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর খবর নিয়ে মানুষ ততটা সোচ্চার নয়। সম্ভবত, মানুষ ধরেই নিয়েছে, পুরান ঢাকায় নিয়মিত বিরতিতে এ রকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে। রাষ্ট্র থেকে যখন ‘জবাবদিহি’ শব্দটা উধাও হয়ে যায়, তখন সব অন্যায় ও অপরাধের বিষয়ে মানুষ নির্লিপ্ত হয়ে যায়। তাদের গা সয়ে যায়।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি,

ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ২৬ ভাদ্র ১৪২৯ ১৩ সফর ১৪৪৪

ঘটনা প্রকাশ না করার অনুরোধ

এম এ কবীর

বিআরটি প্রকল্পে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা গেছে। কিছুদিন আগে রড পড়ে ভেঙে গেছে একটি চলন্ত প্রাইভেটকার। আহত হয়েছেন গাড়িতে থাকা ৫ যাত্রী। উত্তরায় গার্ডারচাপায় ৫ জন নিহতের ৫ দিনের মাথায় এই দুর্ঘটনা। নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় টঙ্গীর কলেজগেট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার শিকার আবদুর রশিদ জানান, গাড়িতে তিনি, স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়েসহ ৫ জন ছিলেন। খবর পেয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন এসে দুঃখ প্রকাশ করে। গাড়িটি মেরামত করার জন্য তাকে ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়। তবে ঘটনা প্রকাশ না করার অনুরোধ করে।

গত বছরের ১৪ মার্চ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় বিআরটি প্রকল্পের একটি গার্ডার লঞ্চার ভেঙে তিন চীনা কর্মীসহ ৬ জন আহত হন। এরপর দুই মাসের বেশি সময় পড়ে থাকার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় ওই পথে চলাচলকারীদের। ওই বছরের ১৮ জুন ক্রেনটি মেরামত করে সচল করা হয়। গত ১৫ জুলাই গাজীপুরে বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের ‘লঞ্চিং গার্ডার’ চাপায় প্রকল্পটির এক নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন। ওই ঘটনায় আরেক শ্রমিক ও একজন পথচারী আহত হন।

২০১৭ সালের ১২ মার্চ রাতে ঢাকার মালিবাগ রেলগেট এলাকায় নির্মাণাধীন মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ৩৬ মিটার দীর্ঘ গার্ডার ভেঙে পড়ে। রেললাইনের উপরের ওই ঘটনায় একজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। একটি করে পা হারান আরও দুজন। এর আগেও বিআরটি প্রকল্পে নানা দুর্ঘটনা ঘটেছে।

১০ বছর আগে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ঘটে প্রথম গার্ডার দুর্ঘটনা। ২০১২ সালে দুই দফায় চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটের ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে পড়ে। প্রথমবার ওই বছরের ২৯ জুন। সেখানে ১৩০ ফুট দীর্ঘ কংক্রিটের গার্ডার ভেঙে পড়ে একজন রিকশাচালক আহত হন। এরপর ওই বছরের ২৪ নভেম্বর ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ভেঙে ২৯ জন নিহত হন। ওই ঘটনায় আহত হন আরও অনেকে। ওই সময় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী, নির্মাণকাজে জড়িত মীর আক্তার অ্যান্ড পারিশা ট্রেড সিস্টেমসের (যৌথ মালিকানা) কর্মকর্তাসহ মোট ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। ২৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ৩ অক্টোবর। মামলায় আসামি করা হয় ২৫ জনকে। তবে চার্জশিট দেয়া হয় ৮ জনের বিরুদ্ধে।

রাজধানীর উত্তরায় যে ঘটনা ঘটল, তার বিচার কী হবে এবং বিচারে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অপরাধ কতটা প্রমাণ করা যাবে এবং বিচারে তাদের কী শাস্তি হবে, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, যে পাঁচজন মানুষ প্রাণ হারালেন; যে সংসারটা তছনছ হয়ে গেলো, কোনো কিছুর বিনিময়ে কি তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া সম্ভব? দুর্ঘটনার শিকার ওই গাড়িতে থাকলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান নববধূ রিয়া। তার ভাষায়: ‘দুইটা টাকা লাভের জন্য নিরাপত্তা ছাড়াই ব্যস্ত রাস্তায় গার্ডার ঝুলিয়ে রেখেছে তারা। আমার তো সব শেষ হয়ে গেলো। তারা আমার এমন সর্বনাশ করল।’

মৃত্যুফাঁদ হয়ে ওঠা এই বিআরটি প্রকল্প আমাদের অদক্ষতার দলিল হয়ে মানুষকে ভোগাচ্ছে এবং হত্যা করছে গত ১০ বছর ধরে। ২০১২ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্প ২০১৭ সালে শেষ হওয়ার কথা। এরমধ্যে ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ৪ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। ৫ বছরের জায়গায় ১০ বছর পার হয়েছে, কিন্তু প্রকল্প শেষের নামগন্ধ নেই।

নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইট পড়ে মানুষ মারা যায়, দেয়াল ধসে মারা যায়, স্কুলের গেট ভেঙে শিশু মারা যায়। মৃত্যু যেন ডালভাত, বেঁচে থাকাই প্রতিদিনের আপোস, নিত্যদিনের লড়াই। প্রিয় শহরের পাড়ায়-পাড়ায়, মোড়ে-মোড়ে, রাস্তায় রাস্তায় মৃত্যুফাঁদ।

এদিকে আগস্ট মাসে দেশে ৪৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১৯ জন নিহত এবং ৯৬১ জন আহত হয়েছেন বলে জানায় রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। আরএসএফ সড়ক দুর্ঘটনার ক্রমবর্ধমান প্রবণতার পেছনে বেশ কয়েকটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি ও গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।

রাষ্ট্রের চোখের সামনেই উন্নয়নের নামে এ রকম আরও অজস্র্র সর্বনাশ হতে থাকে। উত্তরায় যেদিন এই ঘটনা ঘটে, সেদিনই, অর্থাৎ জাতীয় শোক দিবসেই পুরান ঢাকার চকবাজারে প্লাস্টিক কারখানায় আগুনে ছয়জন নিহত হন। তাদের সবাই স্থানীয় বরিশাল হোটেলের কর্মচারী। এই ছয় জনের মধ্যে যদি কেউ পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী ব্যক্তি হয়ে থাকেন, তাহলে ওই পরিবারটির কী হবে? এই ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা রাষ্ট্র তাদের কী ক্ষতিপূরণ দেবে? কিছু নগদ সহায়তা যদি দেয়াও হয়, তাতেও কি ওই মানুষদের ফিরে পাওয়া যাবে? এই ঘটনার জন্য কাকে দায়ী করা হবে? ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ, সবাই বলছে এখানে নিয়মনীতি মানা হয়নি। প্রশ্ন হলো, নিয়মনীতি মানানোর দায়িত্ব কার? পুরান ঢাকায় নিয়মনীতি মানাতে খোদ সিটি করপোরেশনও ব্যর্থ। অনেক সময় নীতিনির্ধারকরাও এই ব্যর্থতার দায় পরস্পরের ওপর চাপান।

গত ৫ জুন বিশ^ পরিবেশ দিবসে চট্টগ্রামের সীতাকু-ের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুনে ৪৩ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়। তবে দেশের ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয় ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যালের গোডাউনে লাগা আগুনে। নিহত হন ১২৪ জন। এই ঘটনার ৯ বছরের মাথায় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ আগুনে মারা যান প্রায় ৮০ জন। অথচ নিমতলীর ঘটনার পরেই আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন সরিয়ে ফেলার সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। সেই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। যার খেসারত দিতে হয় চকবাজারে। এরপর গত বছরের জুন মাসেও রাজধানীর মগবাজারে একটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়, সে ভবনেও কেমিক্যাল ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থ ছিল বলে ধারণা করা হয়। আবার এর এক মাস না যেতেই ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যান অর্ধশতাধিক শ্রমিক।

সীতাকু-ের ঘটনাটি কেন ঘটল কিংবা এর আগে নিমতলী, চুড়িহাট্টা, মগবাজার, রূপগঞ্জে কেন একইভাবে সাধারণ মানুষ পুড়ে মারা গেল? নিমতলীর ঘটনার পর যে কেমিক্যাল বা রাসায়নিক দ্রব্য মজুদের বিষয়টি আলোচনায় আসে, সেই একই আলোচনা ২০ বছর পরও কেন করতে হচ্ছে? এই ২০ বছরে রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কী করল? রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আমদানির পর যেসব জায়গায় কেমিক্যাল মজুদ করে রাখা হয়, সেগুলো কতটা নিরাপদ? ব্যবসায়ীরা কতটা নিয়মকানুন মানেন। এর জন্য কি কোন নীতিমালা আছে? কোথাও কি কোন জবাবদিহির ব্যবস্থা আছে?

উত্তরায় গার্ডার ধসে পাঁচজনের মৃত্যু নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া যতটা সোচ্চার, একই দিনে পুরান ঢাকায় ছয়জন শ্রমিকের দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর খবর নিয়ে মানুষ ততটা সোচ্চার নয়। সম্ভবত, মানুষ ধরেই নিয়েছে, পুরান ঢাকায় নিয়মিত বিরতিতে এ রকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে। রাষ্ট্র থেকে যখন ‘জবাবদিহি’ শব্দটা উধাও হয়ে যায়, তখন সব অন্যায় ও অপরাধের বিষয়ে মানুষ নির্লিপ্ত হয়ে যায়। তাদের গা সয়ে যায়।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি,

ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]