টেকসই উন্নয়নে জৈবপ্রযুক্তি

ইফফাত তাইয়্যিবা

প্রতি বছর বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৭৫ মিলিয়নেরও বেশি। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা ৮.১ বিলিয়নে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই ঘটবে এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সমাজ, পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। বর্ধিত জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল ও নগরায়ণ নিশ্চিত করতে প্রতি বছর কৃষিজ জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। রাস্তা-ঘাট, মিল-কারখানা, অপরিকল্পিত বাড়িঘর ইত্যাদি অবকাঠামো তৈরিতে চাষযোগ্য জমি থেকে প্রতিদিন ২২০ হেক্টর হিসেবে প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য পাল্লা দিয়ে খাদ্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও কীটনাশকের ফলে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ, অপরদিকে রাসায়নিক যুক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে বেড়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, যা টেকসই উন্নয়নের অন্তরায়। টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে এমন একটি উন্নয়ন প্রক্রিয়া যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা পূরণের সক্ষমতার সঙ্গে আপোস না করে বর্তমানের চাহিদা পূরণ করে। টেকসই উন্নয়ন অর্জনের জন্য শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয় বরং সামাজিক ও পরিবেশগত প্রবৃদ্ধিও প্রয়োজন। জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলজির যথাযোগ্য ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন আনয়ন সম্ভব।

ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে জৈবপ্রযুক্তির বিকল্প নেই। জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জিএমও (জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম) ফসল উৎপন্ন করা হয়। এসব ফসল পোকামাকড় ও রোগবালাই প্রতিরোধী, অধিক ফলনশীল, লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতা সম্পন্ন, বন্যা-খরা-শৈত্যপ্রবাহ সহ্য ক্ষম। এ ছাড়া স্বল্প সময়ে লাখ লাখ চারা উৎপাদন, বড় আকৃতির ফলমূল, চাহিদামতো কাক্সিক্ষত জাতের ফসল, সবজি-মাছ-পশুপাখি উৎপাদন জৈবপ্রযুক্তি দ্বারাই সম্ভব। এসব ফসল টেকসই উন্নয়ন আনয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে। জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অধিক ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়ে তোলা সম্ভব। দারিদ্র দূরীকরণে সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হচ্ছে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করে তোলা। এক্ষেত্রে জৈবপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র শিল্প বা খামার (যেমন : হাঁস-মুরগি ও মাছের সমন্বিত চাষ, মাছ ও সবজির সমন্বিত চাষ, মাশরুম খামার প্রভৃতি) গড়ে তোলা।

এসব খামারের মাধ্যমে সল্প বিনিয়োগে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। গতানুগতিক কৃষি ব্যবস্থায়, কৃষি উৎপাদন থেকে নির্গমন বর্তমানে বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ১১ শতাংশ। জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহারে কার্বন নির্গমন, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাবহার হ্রাস পায়। এর ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী কীটনাশকের ব্যাবহার ৭৯০ মিলিয়ন পাউন্ড পর্যন্ত হ্রাস করা হয়েছে। ২০০৭ সালে, সম্মিলিত বায়োটেক ফসল সম্পর্কিত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন সঞ্চয় হ্রাস জ্বালানি ব্যাবহার এবং অতিরিক্ত মাটি কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশন বায়ুম-ল থেকে ৩১.২ বিলিয়ন পাউন্ড কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ করে যা এক বছরের জন্য রাস্তা থেকে প্রায় ৬.৩ মিলিয়ন গাড়ি অপসারণের সমান ছিল। ২০১৫ সালে যদি বায়োটেক ফসল না জন্মাত তাহলে অতিরিক্ত ২৬.৭ বিলিয়ন কিলোগ্রাম কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুম-লে নির্গত হতো, যা রাস্তায় ১১.৯ মিলিয়ন গাড়ি যোগ করার সমতুল্য। ফসলের রাসায়নিক সার বিশ্বজুড়ে পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। এর টেকসই বিকল্প হলো তাদের জীবন্ত অণুজীব দিয়ে প্রতিস্থাপন করা, যা ফসলের সঙ্গে তাদের বিকাশ এবং স্বাস্থ্যকে উজ্জীবিত করতে সহায়তা করে।

প্লাস্টিক দূষণ বর্তমানে আমাদের মুখোমুখি হওয়া অন্যতম প্রধান পরিবেশগত সমস্যা। প্রতিদিন ফেলে দেয়া হয় পেট্রোকেমিক্যাল প্লাস্টিক উৎপাদন কারখানার বর্জ্যসহ কয়েক টন অপচনশীল প্লাস্টিক, যা পরিবেশের জন্য বিশাল সমস্যা। নতুন প্রযুক্তি যা প্লাস্টিক উৎপাদনে জীববিজ্ঞানকে তা আরও টেকসই বিকল্প সরবরাহ করতে পারে। ফ্রান্সে, কার্বায়োস কোম্পানি মাইক্রোবিয়াল এনজাইম ব্যবহার করছে সাধারনভাবে প্লাস্টিকগুলো ভেঙে ফেলার এবং পুনর্ব্যবহারের জন্য। আমস্টারডামে, অ্যাভান্টিয়াম কৃষি এবং বনবর্জ্য থেকে ১০০% পুনর্ব্যবহারযোগ্য বায়োপ্লাস্টিক উৎপাদনের পদ্ধতি বিকাশ করছে- টেকসই বোতল এবং দইয়ের কাপ উৎপাদনের জন্য সংস্থাটি কোকাকোলা এবং ড্যানোনের মতো বড় ব্রান্ডগুলির সঙ্গে কাজ করছে। বায়োপ্লাস্টিকগুলো মূলত টেকসই উৎস থেকে উদ্ভূত প্লাস্টিক। এগুলো প্রাকৃতিকভাবে ভেঙে যায়, এভাবে প্লাস্টিকের নিষ্পত্তি করার চিরস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব এড়ায়।

জীবাশ্ম জ্বালানি বায়ুদূষণের পেছনে সবচেয়ে বড় অপরাধী, যা প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে বলে অনুমান করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ফসল থেকে উৎপাদিত জৈব জ্বালানি একটি ক্রমবর্ধমান সাধারণ বিকল্প হয়ে উঠেছে। যাইহোক, এই ফসল কৃষি জমির জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করছে, যা বন ধ্বংস এবং খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। বেশ কয়েকটি সংস্থা কিছু অণুজীবের প্রাকৃতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগাচ্ছে জ্বালানি উৎপাদনের জন্য কৃষি বা বনবর্জ্য ভেঙে ফেলার জন্য। এটি ফরাসিসংস্থা বায়োএনার্জিসের অন্যতম লক্ষ্য, যা অডির সঙ্গে গমের খড় এবং কাঠের চিপসের মতো টেকসই উৎস থেকে গ্যাসোলিন উৎপাদনের জন্য কাজ করছে। সুইস সংস্থা ক্লারিয়েন্ট এক্সনমোবিলের সহযোগিতায় কৃষি বর্জ্যকে বায়োডিজেলে পরিনত করার পদ্ধতিও তৈরি করছে। জার্মানির সোলাগা এবং স্পেনের অ্যালগাএনার্জির মতো অন্যান্য সংস্থাগুলি শৈবাল ব্যবহার করে সূর্যের আলো এবং কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে কীভাবে জ্বালানি উৎপাদন করা যায় তা নিয়ে গবেষণা করছে।

নৃতাত্বিক কার্যকলাপ বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক দশকে পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে । বায়োরিমেডিয়েশন হলো দূষিত পরিবেশ থেকে বিষাক্ত বর্জ্য অপসারণের জন্য একটি আকর্ষনীয় এবং সফল কৌশল। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যা পানি, মাটি এবং উপরিভাগের উপাদানসহ দূষিত মিডিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে অণুজীব অথবা গাছ ব্যবহার করে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন সাধন করা হয়। পরিবেশগত অবস্থার পরিবর্তন করে অণুজীবের বৃদ্ধি উদ্দীপিত করে এবং লক্ষ্য দূষণকারীকে হ্রাস করে। বায়োরিমেডিয়েশন নৃতাত্বিক ক্রিয়াকলাপ, যেমন শিল্পায়ন ও কৃষি প্রক্রিয়া থেকে তৈরি উপজাতগুলোর প্রভাব হ্রাস করতে ব্যবহৃত হয়।

চিকিৎসাক্ষেত্রে জৈবপ্রযুক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। আধুনিক জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যমান ওষুধগুলো আরও সস্তায় এবং সহজে উৎপাদন করা সম্ভব। ইনসুলিনের বিকাশ (রিকম্বিন্যান্ট ইনসুলিন), বৃদ্ধিসংক্রান্ত হরমোন, আনবিক পরিচয়, ডায়াগনস্টিক্স, জিন থেরাপি এবং ভ্যাকসিন (যেমন হেপাটাইটিস বি) জৈবপ্রযুক্তিরকিছু মাইলফলক।

অনেক নির্মান উপকরণ, যেমন কংক্রিট উৎপাদন একটি মরাত্মক পরিবেশ দূষণকারী প্রক্রিয়া। এতে বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়, এ ক্ষেত্রে শক্তি ও জলের বড় ভলিউম প্রয়োজন হতে পারে। প্রক্রিয়াটি উচ্চমাত্রার কার্বন নির্গমনও করে, যা বিশ্ব উষ্ণায়নে অবদান রাখে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। বেশ কয়েকটি সংস্থা দেখছে কীভাবে জীবিত প্রাণীরা আমাদের বিল্ডিং শিল্পকে আরও টেকসই করতে সহায়তা করতে পারে। লন্ডনে, বায়োহম নামে একটি স্টার্টআপ জৈব বর্জ্য থেকে নির্মাণ উপকরণ উৎপাদনের জন্য মাশরুম ব্যাবহারের দিকে নজর দিচ্ছে। নেদারল্যান্ডসে, গ্রিন বাসিলিস্ক কোম্পানি কংক্রিটের আয়ু বাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যাকটেরিয়া দিয়ে এটি এমবডে করে যা উপাদানটি মেরামত করে যখন এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মার্কিন ভিত্তিক বায়োম্যাসন কম কার্বন ফুটপ্রিন্টসহ সিমেন্ট টাইলস তৈরি করতে অনুরূপ অণুজীব ব্যবহার করে।

টেকসই উন্নয়নের একটি বড় বাধা হচ্ছে দ্রুত ফ্যাশনের পরিবর্তন। জৈবপ্রযুক্তি দূষিত রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো প্রতিস্থাপন করে ও টেক্সটাইল বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং জৈবপচনযোগ্য করে তার পরিবেশগত প্রভাব বন্ধ করতে পারে। কিছু এনজাইম পোশাক ধোয়া, ব্লিচ করা এবং উল সংকুচিত হওয়া থেকে প্রতিরোধ করতে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার বস্ত্র উৎপাদনে আমাদের কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য জৈবপ্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার এবং সুযোগ। পাশাপাশি এটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রশমিত করে। জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে এবং অনবায়নযোগ্য শক্তি যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। দেশের জনশক্তিকে দক্ষ করে তুলতে হবে এবং আধুনিক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে প্রত্যেকটি জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। জৈবপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব, যা সামাজিক উন্নয়ন আনয়নের মাধ্যমে দেশকে টেকসই উন্নয়নের দিকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। জৈবপ্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে; এর মাধ্যমে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন ঘটিয়ে সহজেই টেকসই উন্নয়ন অর্জন সম্ভব।

[লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়]

শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ২৬ ভাদ্র ১৪২৯ ১৩ সফর ১৪৪৪

টেকসই উন্নয়নে জৈবপ্রযুক্তি

ইফফাত তাইয়্যিবা

প্রতি বছর বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৭৫ মিলিয়নেরও বেশি। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা ৮.১ বিলিয়নে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই ঘটবে এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সমাজ, পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। বর্ধিত জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল ও নগরায়ণ নিশ্চিত করতে প্রতি বছর কৃষিজ জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। রাস্তা-ঘাট, মিল-কারখানা, অপরিকল্পিত বাড়িঘর ইত্যাদি অবকাঠামো তৈরিতে চাষযোগ্য জমি থেকে প্রতিদিন ২২০ হেক্টর হিসেবে প্রতি বছর হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য পাল্লা দিয়ে খাদ্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও কীটনাশকের ফলে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ, অপরদিকে রাসায়নিক যুক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে বেড়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, যা টেকসই উন্নয়নের অন্তরায়। টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে এমন একটি উন্নয়ন প্রক্রিয়া যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা পূরণের সক্ষমতার সঙ্গে আপোস না করে বর্তমানের চাহিদা পূরণ করে। টেকসই উন্নয়ন অর্জনের জন্য শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয় বরং সামাজিক ও পরিবেশগত প্রবৃদ্ধিও প্রয়োজন। জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলজির যথাযোগ্য ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন আনয়ন সম্ভব।

ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে জৈবপ্রযুক্তির বিকল্প নেই। জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জিএমও (জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম) ফসল উৎপন্ন করা হয়। এসব ফসল পোকামাকড় ও রোগবালাই প্রতিরোধী, অধিক ফলনশীল, লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতা সম্পন্ন, বন্যা-খরা-শৈত্যপ্রবাহ সহ্য ক্ষম। এ ছাড়া স্বল্প সময়ে লাখ লাখ চারা উৎপাদন, বড় আকৃতির ফলমূল, চাহিদামতো কাক্সিক্ষত জাতের ফসল, সবজি-মাছ-পশুপাখি উৎপাদন জৈবপ্রযুক্তি দ্বারাই সম্ভব। এসব ফসল টেকসই উন্নয়ন আনয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে। জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অধিক ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়ে তোলা সম্ভব। দারিদ্র দূরীকরণে সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হচ্ছে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করে তোলা। এক্ষেত্রে জৈবপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র শিল্প বা খামার (যেমন : হাঁস-মুরগি ও মাছের সমন্বিত চাষ, মাছ ও সবজির সমন্বিত চাষ, মাশরুম খামার প্রভৃতি) গড়ে তোলা।

এসব খামারের মাধ্যমে সল্প বিনিয়োগে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। গতানুগতিক কৃষি ব্যবস্থায়, কৃষি উৎপাদন থেকে নির্গমন বর্তমানে বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ১১ শতাংশ। জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহারে কার্বন নির্গমন, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাবহার হ্রাস পায়। এর ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী কীটনাশকের ব্যাবহার ৭৯০ মিলিয়ন পাউন্ড পর্যন্ত হ্রাস করা হয়েছে। ২০০৭ সালে, সম্মিলিত বায়োটেক ফসল সম্পর্কিত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন সঞ্চয় হ্রাস জ্বালানি ব্যাবহার এবং অতিরিক্ত মাটি কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশন বায়ুম-ল থেকে ৩১.২ বিলিয়ন পাউন্ড কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ করে যা এক বছরের জন্য রাস্তা থেকে প্রায় ৬.৩ মিলিয়ন গাড়ি অপসারণের সমান ছিল। ২০১৫ সালে যদি বায়োটেক ফসল না জন্মাত তাহলে অতিরিক্ত ২৬.৭ বিলিয়ন কিলোগ্রাম কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুম-লে নির্গত হতো, যা রাস্তায় ১১.৯ মিলিয়ন গাড়ি যোগ করার সমতুল্য। ফসলের রাসায়নিক সার বিশ্বজুড়ে পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। এর টেকসই বিকল্প হলো তাদের জীবন্ত অণুজীব দিয়ে প্রতিস্থাপন করা, যা ফসলের সঙ্গে তাদের বিকাশ এবং স্বাস্থ্যকে উজ্জীবিত করতে সহায়তা করে।

প্লাস্টিক দূষণ বর্তমানে আমাদের মুখোমুখি হওয়া অন্যতম প্রধান পরিবেশগত সমস্যা। প্রতিদিন ফেলে দেয়া হয় পেট্রোকেমিক্যাল প্লাস্টিক উৎপাদন কারখানার বর্জ্যসহ কয়েক টন অপচনশীল প্লাস্টিক, যা পরিবেশের জন্য বিশাল সমস্যা। নতুন প্রযুক্তি যা প্লাস্টিক উৎপাদনে জীববিজ্ঞানকে তা আরও টেকসই বিকল্প সরবরাহ করতে পারে। ফ্রান্সে, কার্বায়োস কোম্পানি মাইক্রোবিয়াল এনজাইম ব্যবহার করছে সাধারনভাবে প্লাস্টিকগুলো ভেঙে ফেলার এবং পুনর্ব্যবহারের জন্য। আমস্টারডামে, অ্যাভান্টিয়াম কৃষি এবং বনবর্জ্য থেকে ১০০% পুনর্ব্যবহারযোগ্য বায়োপ্লাস্টিক উৎপাদনের পদ্ধতি বিকাশ করছে- টেকসই বোতল এবং দইয়ের কাপ উৎপাদনের জন্য সংস্থাটি কোকাকোলা এবং ড্যানোনের মতো বড় ব্রান্ডগুলির সঙ্গে কাজ করছে। বায়োপ্লাস্টিকগুলো মূলত টেকসই উৎস থেকে উদ্ভূত প্লাস্টিক। এগুলো প্রাকৃতিকভাবে ভেঙে যায়, এভাবে প্লাস্টিকের নিষ্পত্তি করার চিরস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব এড়ায়।

জীবাশ্ম জ্বালানি বায়ুদূষণের পেছনে সবচেয়ে বড় অপরাধী, যা প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে বলে অনুমান করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ফসল থেকে উৎপাদিত জৈব জ্বালানি একটি ক্রমবর্ধমান সাধারণ বিকল্প হয়ে উঠেছে। যাইহোক, এই ফসল কৃষি জমির জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করছে, যা বন ধ্বংস এবং খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। বেশ কয়েকটি সংস্থা কিছু অণুজীবের প্রাকৃতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগাচ্ছে জ্বালানি উৎপাদনের জন্য কৃষি বা বনবর্জ্য ভেঙে ফেলার জন্য। এটি ফরাসিসংস্থা বায়োএনার্জিসের অন্যতম লক্ষ্য, যা অডির সঙ্গে গমের খড় এবং কাঠের চিপসের মতো টেকসই উৎস থেকে গ্যাসোলিন উৎপাদনের জন্য কাজ করছে। সুইস সংস্থা ক্লারিয়েন্ট এক্সনমোবিলের সহযোগিতায় কৃষি বর্জ্যকে বায়োডিজেলে পরিনত করার পদ্ধতিও তৈরি করছে। জার্মানির সোলাগা এবং স্পেনের অ্যালগাএনার্জির মতো অন্যান্য সংস্থাগুলি শৈবাল ব্যবহার করে সূর্যের আলো এবং কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে কীভাবে জ্বালানি উৎপাদন করা যায় তা নিয়ে গবেষণা করছে।

নৃতাত্বিক কার্যকলাপ বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক দশকে পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে । বায়োরিমেডিয়েশন হলো দূষিত পরিবেশ থেকে বিষাক্ত বর্জ্য অপসারণের জন্য একটি আকর্ষনীয় এবং সফল কৌশল। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যা পানি, মাটি এবং উপরিভাগের উপাদানসহ দূষিত মিডিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে অণুজীব অথবা গাছ ব্যবহার করে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন সাধন করা হয়। পরিবেশগত অবস্থার পরিবর্তন করে অণুজীবের বৃদ্ধি উদ্দীপিত করে এবং লক্ষ্য দূষণকারীকে হ্রাস করে। বায়োরিমেডিয়েশন নৃতাত্বিক ক্রিয়াকলাপ, যেমন শিল্পায়ন ও কৃষি প্রক্রিয়া থেকে তৈরি উপজাতগুলোর প্রভাব হ্রাস করতে ব্যবহৃত হয়।

চিকিৎসাক্ষেত্রে জৈবপ্রযুক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। আধুনিক জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যমান ওষুধগুলো আরও সস্তায় এবং সহজে উৎপাদন করা সম্ভব। ইনসুলিনের বিকাশ (রিকম্বিন্যান্ট ইনসুলিন), বৃদ্ধিসংক্রান্ত হরমোন, আনবিক পরিচয়, ডায়াগনস্টিক্স, জিন থেরাপি এবং ভ্যাকসিন (যেমন হেপাটাইটিস বি) জৈবপ্রযুক্তিরকিছু মাইলফলক।

অনেক নির্মান উপকরণ, যেমন কংক্রিট উৎপাদন একটি মরাত্মক পরিবেশ দূষণকারী প্রক্রিয়া। এতে বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়, এ ক্ষেত্রে শক্তি ও জলের বড় ভলিউম প্রয়োজন হতে পারে। প্রক্রিয়াটি উচ্চমাত্রার কার্বন নির্গমনও করে, যা বিশ্ব উষ্ণায়নে অবদান রাখে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। বেশ কয়েকটি সংস্থা দেখছে কীভাবে জীবিত প্রাণীরা আমাদের বিল্ডিং শিল্পকে আরও টেকসই করতে সহায়তা করতে পারে। লন্ডনে, বায়োহম নামে একটি স্টার্টআপ জৈব বর্জ্য থেকে নির্মাণ উপকরণ উৎপাদনের জন্য মাশরুম ব্যাবহারের দিকে নজর দিচ্ছে। নেদারল্যান্ডসে, গ্রিন বাসিলিস্ক কোম্পানি কংক্রিটের আয়ু বাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যাকটেরিয়া দিয়ে এটি এমবডে করে যা উপাদানটি মেরামত করে যখন এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মার্কিন ভিত্তিক বায়োম্যাসন কম কার্বন ফুটপ্রিন্টসহ সিমেন্ট টাইলস তৈরি করতে অনুরূপ অণুজীব ব্যবহার করে।

টেকসই উন্নয়নের একটি বড় বাধা হচ্ছে দ্রুত ফ্যাশনের পরিবর্তন। জৈবপ্রযুক্তি দূষিত রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো প্রতিস্থাপন করে ও টেক্সটাইল বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং জৈবপচনযোগ্য করে তার পরিবেশগত প্রভাব বন্ধ করতে পারে। কিছু এনজাইম পোশাক ধোয়া, ব্লিচ করা এবং উল সংকুচিত হওয়া থেকে প্রতিরোধ করতে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার বস্ত্র উৎপাদনে আমাদের কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য জৈবপ্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার এবং সুযোগ। পাশাপাশি এটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রশমিত করে। জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে এবং অনবায়নযোগ্য শক্তি যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। দেশের জনশক্তিকে দক্ষ করে তুলতে হবে এবং আধুনিক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে প্রত্যেকটি জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। জৈবপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব, যা সামাজিক উন্নয়ন আনয়নের মাধ্যমে দেশকে টেকসই উন্নয়নের দিকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। জৈবপ্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে; এর মাধ্যমে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন ঘটিয়ে সহজেই টেকসই উন্নয়ন অর্জন সম্ভব।

[লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়]