মায়ানমার সীমান্তে সারাদিনই গোলাগুলি, আতঙ্কে এলাকাবাসী

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মায়ানমারের অভ্যন্তরে গতকাল সারাদিনই মুহুর্মুহু গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। এ নিয়ে এপারে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে আতঙ্ক শেষ হচ্ছে না।

মায়ানমার সেনাবাহিনীর এই সামরিক অভিযানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রায় কয়েকশ’ কৃষি পরিবারসহ সাধারণ মানুষ। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ৩৪৭ হেক্টর পাহাড়ের ঢালুতে জমিতে চাষসহ আবাদ করা হয়েছে মৌসুমি জুমসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফসল। স্থানীয় বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম তুমব্রু সীমান্ত পয়েন্ট থেকে শুরু করে বাইশফাঁড়ি-রিজু আমতলী সীমান্ত এলাকায় কৃষি জমিতে মৌসুমি জুমসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফসল উৎপাদিত হয়। সীমান্ত এলাকা থেকে উৎপাদিত নানা প্রজাতির সবজি প্রতিদিনই পার্শ্ববর্তী জেলা কক্সবাজার ও দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারসহ শরণার্থী শিবিরগুলোর চাহিদা মেটানো হয়। সীমান্ত উত্তেজনার কারণে জীবনের নিরাপত্তা না থাকায় কৃষক ও জুমিয়া পরিবারের লোকজন জুমে ও খেত-খামারে যেতে না পারায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে খেতের ফসল। ফলে অনিশ্চয়তার মধ্যে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে দিন পার করছে সীমান্তের কৃষকরা। জুমচাষি ফয়েজুর রহমান জানান, সীমন্ত সংলগ্ন পাহাড়ে তিনি জুম চাষ করেছেন। কিন্তু গত এক মাস ধরে তার জুমে যাওয়া সম্ভব হয়নি গুলির আতঙ্কে। বর্তমানে তিনি পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ইতোমধ্যে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কৃষি কাজ বন্ধ রেখে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছেন জুম চাষিরা।

সীমান্তে টানা তিন সপ্তাহ ধরে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে রাখাইনদের সংগঠন আরাকান আর্মির অবস্থান লক্ষ্য করে মায়ানমার সেনাবাহিনী বোমাবর্ষণ করছে। সংঘাতের মধ্যে তুমব্রু সীমান্তে মায়ানমার থেকে দুটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে। সংঘর্ষের ছোড়া গুলি একেবারে জনবসতিতে এসে পড়েছে। এর ফলে তুমব্রু সীমান্তবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। টানা গোলাবর্ষণের কারণে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। জুমসহ ফসলের কোন ফলন ঘরে তুলতে বা বাজারজাত করতে পারছে না সীমান্ত ঘেঁষা প্রায় কয়েকশ’ কৃষি পরিবার। এতে অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পড়েছে এসব কৃষক পরিবারসহ সাধারণ মানুষ।

গতকাল ভোর থেকে ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাছাকাছি কয়েক কিলোমিটার এলাকায় সবসময় গুলির শব্দ শোনা যায় বলে জানান ইউপি সদস্য মো. আলম। ঘুমধুম ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের এই সদস্য বিকেলে জানান, ভোর ৫টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত গোলাগুলি চলেছে। তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার কোণাপাড়ায় যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা রয়েছে তার পূর্বদিক থেকে বেশি গুলির শব্দ শোনা গেছে।

৩টার পর গুলির শব্দ থেমেছে জানিয়ে ইউপি সদস্য বলেন, আজ কোন যুদ্ধবিমান ও ফাইটার হেলিকপ্টার দেখা যায়নি। সীমান্ত এলাকাজুড়ে বিজিবি ও পুলিশের সদস্যরা সবসময় সর্বোচ্চ সতর্কবাস্থায় রয়েছে। এক-দুইদিন পর পর দিনের কোন একটা সময় গুলির শব্দ আসে। মনে হয় তাদের ওইদিকে এভাবে আরও অনেক দিন চলবে। এপারে আমাদের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

মায়ানমারবিষয়ক সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে, বেশ কিছুদিন ধরেই রাখাইনদের সংগঠন আরাকান আর্মির অবস্থান লক্ষ্য করে মায়ানমার সেনাবাহিনী বোমাবর্ষণ করছে। সংঘাতের মধ্যে গত ২৮ আগস্ট বান্দরবানের ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে মায়ানমার থেকে দুটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে।

এরপর ৩১ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডু শহরতলীতে আরাকান আর্মির সদস্যরা একটি পুলিশ পোস্টে হামলা চালিয়ে ১৯ জনকে হত্যা করে বলে প্রকাশিত সংবাদে দাবি করা হয়। আরাকান আর্মির দখলে নেয়া পুলিশ ফাঁড়ি দখলে নিতে সেনাবাহিনী এগোচ্ছে।

এর মধ্যে গত ৩ সেপ্টেম্বর মায়ানমারের দুটি যুদ্ধবিমান ও দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টারের গোলা বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে এসে পড়ে। এসব ঘটনায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকে দুইবার ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানায় ঢাকা।

এদিকে ২০১৭ সালে মায়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি দল এখনও তুমব্রুর সীমান্তের শূন্যরেখায় আশ্রয়শিবিরে অবস্থান করছে। সেখানে ৬২১টি পরিবারের চার হাজার ২৮০ জন রোহিঙ্গা রয়েছেন বলে জানান কোণাপাড়া রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের মাঝি (দলনেতা) দিল মোহাম্মদ।

গতকাল বিকেলে এক রোহিঙ্গা সাংবাদিকদের বলেন, ভোর থেকে আমাদের কোণাপাড়া ক্যাম্প থেকে শুরু করে মায়ানমার অভ্যন্তরে কয়েকটি এলাকায় আনুমানিক এক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে অনেক গোলাগুলি চলে। একদম ভোরবেলা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত একটানা গুলি চলছিল। একদম সীমান্ত বরাবর হওয়ায় আমরা কোণাপাড়ার আশ্রয়শিবিরে সবসময় ভয় ও আতঙ্কে থাকি।

রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ২৭ ভাদ্র ১৪২৯ ১৪ সফর ১৪৪৪

মায়ানমার সীমান্তে সারাদিনই গোলাগুলি, আতঙ্কে এলাকাবাসী

প্রতিনিধি, বান্দরবান ও কক্সবাজার

image

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্ত

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মায়ানমারের অভ্যন্তরে গতকাল সারাদিনই মুহুর্মুহু গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। এ নিয়ে এপারে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে আতঙ্ক শেষ হচ্ছে না।

মায়ানমার সেনাবাহিনীর এই সামরিক অভিযানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রায় কয়েকশ’ কৃষি পরিবারসহ সাধারণ মানুষ। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ৩৪৭ হেক্টর পাহাড়ের ঢালুতে জমিতে চাষসহ আবাদ করা হয়েছে মৌসুমি জুমসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফসল। স্থানীয় বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম তুমব্রু সীমান্ত পয়েন্ট থেকে শুরু করে বাইশফাঁড়ি-রিজু আমতলী সীমান্ত এলাকায় কৃষি জমিতে মৌসুমি জুমসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফসল উৎপাদিত হয়। সীমান্ত এলাকা থেকে উৎপাদিত নানা প্রজাতির সবজি প্রতিদিনই পার্শ্ববর্তী জেলা কক্সবাজার ও দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারসহ শরণার্থী শিবিরগুলোর চাহিদা মেটানো হয়। সীমান্ত উত্তেজনার কারণে জীবনের নিরাপত্তা না থাকায় কৃষক ও জুমিয়া পরিবারের লোকজন জুমে ও খেত-খামারে যেতে না পারায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে খেতের ফসল। ফলে অনিশ্চয়তার মধ্যে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে দিন পার করছে সীমান্তের কৃষকরা। জুমচাষি ফয়েজুর রহমান জানান, সীমন্ত সংলগ্ন পাহাড়ে তিনি জুম চাষ করেছেন। কিন্তু গত এক মাস ধরে তার জুমে যাওয়া সম্ভব হয়নি গুলির আতঙ্কে। বর্তমানে তিনি পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ইতোমধ্যে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কৃষি কাজ বন্ধ রেখে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছেন জুম চাষিরা।

সীমান্তে টানা তিন সপ্তাহ ধরে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে রাখাইনদের সংগঠন আরাকান আর্মির অবস্থান লক্ষ্য করে মায়ানমার সেনাবাহিনী বোমাবর্ষণ করছে। সংঘাতের মধ্যে তুমব্রু সীমান্তে মায়ানমার থেকে দুটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে। সংঘর্ষের ছোড়া গুলি একেবারে জনবসতিতে এসে পড়েছে। এর ফলে তুমব্রু সীমান্তবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। টানা গোলাবর্ষণের কারণে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। জুমসহ ফসলের কোন ফলন ঘরে তুলতে বা বাজারজাত করতে পারছে না সীমান্ত ঘেঁষা প্রায় কয়েকশ’ কৃষি পরিবার। এতে অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পড়েছে এসব কৃষক পরিবারসহ সাধারণ মানুষ।

গতকাল ভোর থেকে ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাছাকাছি কয়েক কিলোমিটার এলাকায় সবসময় গুলির শব্দ শোনা যায় বলে জানান ইউপি সদস্য মো. আলম। ঘুমধুম ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের এই সদস্য বিকেলে জানান, ভোর ৫টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত গোলাগুলি চলেছে। তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখার কোণাপাড়ায় যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা রয়েছে তার পূর্বদিক থেকে বেশি গুলির শব্দ শোনা গেছে।

৩টার পর গুলির শব্দ থেমেছে জানিয়ে ইউপি সদস্য বলেন, আজ কোন যুদ্ধবিমান ও ফাইটার হেলিকপ্টার দেখা যায়নি। সীমান্ত এলাকাজুড়ে বিজিবি ও পুলিশের সদস্যরা সবসময় সর্বোচ্চ সতর্কবাস্থায় রয়েছে। এক-দুইদিন পর পর দিনের কোন একটা সময় গুলির শব্দ আসে। মনে হয় তাদের ওইদিকে এভাবে আরও অনেক দিন চলবে। এপারে আমাদের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

মায়ানমারবিষয়ক সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে, বেশ কিছুদিন ধরেই রাখাইনদের সংগঠন আরাকান আর্মির অবস্থান লক্ষ্য করে মায়ানমার সেনাবাহিনী বোমাবর্ষণ করছে। সংঘাতের মধ্যে গত ২৮ আগস্ট বান্দরবানের ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে মায়ানমার থেকে দুটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে।

এরপর ৩১ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডু শহরতলীতে আরাকান আর্মির সদস্যরা একটি পুলিশ পোস্টে হামলা চালিয়ে ১৯ জনকে হত্যা করে বলে প্রকাশিত সংবাদে দাবি করা হয়। আরাকান আর্মির দখলে নেয়া পুলিশ ফাঁড়ি দখলে নিতে সেনাবাহিনী এগোচ্ছে।

এর মধ্যে গত ৩ সেপ্টেম্বর মায়ানমারের দুটি যুদ্ধবিমান ও দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টারের গোলা বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে এসে পড়ে। এসব ঘটনায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকে দুইবার ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানায় ঢাকা।

এদিকে ২০১৭ সালে মায়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি দল এখনও তুমব্রুর সীমান্তের শূন্যরেখায় আশ্রয়শিবিরে অবস্থান করছে। সেখানে ৬২১টি পরিবারের চার হাজার ২৮০ জন রোহিঙ্গা রয়েছেন বলে জানান কোণাপাড়া রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের মাঝি (দলনেতা) দিল মোহাম্মদ।

গতকাল বিকেলে এক রোহিঙ্গা সাংবাদিকদের বলেন, ভোর থেকে আমাদের কোণাপাড়া ক্যাম্প থেকে শুরু করে মায়ানমার অভ্যন্তরে কয়েকটি এলাকায় আনুমানিক এক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে অনেক গোলাগুলি চলে। একদম ভোরবেলা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত একটানা গুলি চলছিল। একদম সীমান্ত বরাবর হওয়ায় আমরা কোণাপাড়ার আশ্রয়শিবিরে সবসময় ভয় ও আতঙ্কে থাকি।