আস্তানা ‘জেলখানা’, নির্যাতনের শিকার বন্দী নাহিদ

লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ থেকে সমাজ বিজ্ঞানে মাস্টর্স পাস করেছেন নাহিদ হোসাইন। পড়াশোনা শেষ করে একটি এনজিওতে ২৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন। বিয়েও করেছেন, তিন মেয়ে নিয়ে সংসার। দিন দিন তার সংসার খরচ বাড়ছে, কিন্তু আয় বাড়ছে না। এক সময় সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে বিদেশে চাকরি নেয়ার পরামর্শ দেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন।

বিদেশে চাকরি দেয়ার শর্তে লক্ষ্মীপুরের জাকির হোসেন টিপু ও দ্বীন মোহাম্মদ রাসেলের হাতে তুলে দেন ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। তারা তাকে কম্বোডিয়ায় পাঠানোর কথা দেন। কম্বোডিয়ায় তাকে বেতন দেয়া হবে মাসে এক হাজার ডলার (৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা)।

পরিবারের সদস্যরা নানাভাবে ধারকর্জ করে বিদেশ পাঠানোর টাকা জোগাড় করে। সাত দিনের মধ্যে কাগজপত্র রেডি করে বিদেশ পাঠানোর তারিখ চূড়ান্ত হয়। বিদেশ পাঠানোর দিন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার পর দালাল চক্রের মাধ্যমে তাকে ইমিগ্রেশন পার হতে হয়। তখনই তার সন্দেহ হয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।

এরপর কম্বোডিয়ায় যাওয়ার পর সে পড়ে আন্তর্জাতিক মানব পাচার দলের হাতে। তার সঙ্গে একই বিমানে কম্বোডিয়া যায় আরও কয়েকজন। পরিকল্পিতভাবে বিমানবন্দর থেকে দ্বীন মোহাম্মদ রাসেল নামে এক দালাল তাদের রিসিভ করে। এরপর তার কাছ থেকে পাসপোর্ট ও নগদ এক হাজার ডলার নিয়ে যায়। এ সময় তার সঙ্গে আল-আমিন নামে আরও এক বাংলাদেশি ছিল। দুটি গাড়িতে করে বিমানবন্দর থেকে তাদের (১৫ জন) অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে একটি প্রজেক্টে তাদের আটকে রাখে। দালালরা নাহিদের কাছ থেকে এক হাজার ডলার নিয়ে আরেক গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়। পরে তাদের একটি আস্তানায় আটকে রেখে শুরু হয় তার ওপর নির্যাতন। বিদেশে চাকরি করে জীবনের সচ্ছলতা দূরের কথা, তখন জীবন বাঁচানোই দায় হয়ে পড়ে।

সেখানে নাহিদকে জোর করে শেখানো হয় নানা জালিয়াতি, ভুয়া ক্লোন ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অন্যের টাকা আত্মসাৎ করার কৌশল, ভুয়া নম্বর থেকে ফোন দিয়ে বা চ্যাটিং করে স্বল্প সময়ে সুদে ঋণ দেয়ার কথা বলে কৌশলে ডিপোজিট থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া ইত্যাদি।

এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভয়েস কল ও ভিডিও কল রেকর্ডিং করে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করার কৌশল শেখানোর পর তাকে দিয়ে সাইবার অপরাধের মতো নানা অপরাধের সঙ্গে তাকে জড়ানো হয়।

জালিয়াতি করতে না পারলে নির্যাতন ও আস্তানার মতো ‘জেলখানা’য় বন্দী করে রাখা হয়। নাহিদ বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে জানতে পারে তার মতো ওই আস্তায় শুধু বাংলাদেশি ৬০০ থেকে ৭০০ যুবক আটক আছে। তারা কোনভাবেই সেই অস্তানা থেকে বের হতে পারে না, বাড়িতে খবর দেয়ারও কোন সুযোগ দেয়া হতো না।

সেখানে জেলখানার চেয়েও কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে। তাদের দিনের বেলায় ঘুমাতে বলে। রাত ১১টার দিকে তাদের ক্যাসিনো সাইবার হ্যাকার নামে একটি আস্তানায় নিয়ে কাজ করতে বলে। একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসার লোভ দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে ৬ লাখ ডলার হাতিয়ে নিতে বলে। এই ধরনের অপরাধ করতে নাহিদ রাজি হয়নি। তখন তাকে নির্যাতনের হুমকি দিয়ে প্রথমে মারপিট করে আটকে রেখে শরীরে বিদ্যুতের শক দেয়। এতেও রাজি না হওয়ায় পা উঁচু করে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। তার মতো অনেককে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হতো।

নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সেই আস্তানা থেকে পালানোর চেষ্টা শুরু করে নাহিদ। অন্য দালালদের সঙ্গে চুক্তি করে তাকে গোপনে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিতে। গত মার্চ মাসে নাহিদ দালালদের দেয়ার জন্য বাড়িতে তার স্ত্রীকে ৬০ হাজার টাকা পাঠাতে বলে। সেই টাকা পাঠানোর পর নাহিদকে সেই দালালরা কম্বোডিয়া থেকে থাইল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে সে অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই দালাল থ্যাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পরে থাইল্যান্ডে থেকে বাংলাদেশ দূতাবাস তাকে থাইল্যান্ড পুলিশের মাধ্যমে দেশে পাঠিয়ে দেয়। নাহিদ দেশের মাটিতে পা রাখে গত ১৩ জুলাই।

দেশে ফেরত আসার পর তার পরিবারের পক্ষ থেকে মানবাধিকার সংগঠন ও লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। জেলা পুলিশ বিষয়টি জানার পর মানব পাচারকারী চক্রকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা হয়।

গতকাল সংবাদের কাছে দেয়া এক স্বাক্ষাতে নাহিদ মুঠোফোনে বলেন, তার মতো ৬০০ থেকে ৭০০ বাংলাদেশি কম্বোডিয়ায় মানব পাচারকারীদের আস্তায় (ক্রীতদাস) হিসেবে আটকা আছে। তার মতে,সারাদেশে এই চক্রের সিন্ডিকেট রয়েছে।

র‌্যাব-৩ এর পুলিশ সুপার বীণা রানী দাস সংবাদকে জানান, কম্বোডিয়ায় মানব পাচারকারী চক্রের গ্রেপ্তারকৃত ৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আরও ৮ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের ধরতে চলছে গোয়েন্দা তৎপরতা।

রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ২৭ ভাদ্র ১৪২৯ ১৪ সফর ১৪৪৪

কম্বোডিয়ায় মানবপাচার

আস্তানা ‘জেলখানা’, নির্যাতনের শিকার বন্দী নাহিদ

বাকী বিল্লাহ

লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ থেকে সমাজ বিজ্ঞানে মাস্টর্স পাস করেছেন নাহিদ হোসাইন। পড়াশোনা শেষ করে একটি এনজিওতে ২৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন। বিয়েও করেছেন, তিন মেয়ে নিয়ে সংসার। দিন দিন তার সংসার খরচ বাড়ছে, কিন্তু আয় বাড়ছে না। এক সময় সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে বিদেশে চাকরি নেয়ার পরামর্শ দেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন।

বিদেশে চাকরি দেয়ার শর্তে লক্ষ্মীপুরের জাকির হোসেন টিপু ও দ্বীন মোহাম্মদ রাসেলের হাতে তুলে দেন ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। তারা তাকে কম্বোডিয়ায় পাঠানোর কথা দেন। কম্বোডিয়ায় তাকে বেতন দেয়া হবে মাসে এক হাজার ডলার (৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা)।

পরিবারের সদস্যরা নানাভাবে ধারকর্জ করে বিদেশ পাঠানোর টাকা জোগাড় করে। সাত দিনের মধ্যে কাগজপত্র রেডি করে বিদেশ পাঠানোর তারিখ চূড়ান্ত হয়। বিদেশ পাঠানোর দিন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার পর দালাল চক্রের মাধ্যমে তাকে ইমিগ্রেশন পার হতে হয়। তখনই তার সন্দেহ হয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।

এরপর কম্বোডিয়ায় যাওয়ার পর সে পড়ে আন্তর্জাতিক মানব পাচার দলের হাতে। তার সঙ্গে একই বিমানে কম্বোডিয়া যায় আরও কয়েকজন। পরিকল্পিতভাবে বিমানবন্দর থেকে দ্বীন মোহাম্মদ রাসেল নামে এক দালাল তাদের রিসিভ করে। এরপর তার কাছ থেকে পাসপোর্ট ও নগদ এক হাজার ডলার নিয়ে যায়। এ সময় তার সঙ্গে আল-আমিন নামে আরও এক বাংলাদেশি ছিল। দুটি গাড়িতে করে বিমানবন্দর থেকে তাদের (১৫ জন) অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে একটি প্রজেক্টে তাদের আটকে রাখে। দালালরা নাহিদের কাছ থেকে এক হাজার ডলার নিয়ে আরেক গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়। পরে তাদের একটি আস্তানায় আটকে রেখে শুরু হয় তার ওপর নির্যাতন। বিদেশে চাকরি করে জীবনের সচ্ছলতা দূরের কথা, তখন জীবন বাঁচানোই দায় হয়ে পড়ে।

সেখানে নাহিদকে জোর করে শেখানো হয় নানা জালিয়াতি, ভুয়া ক্লোন ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অন্যের টাকা আত্মসাৎ করার কৌশল, ভুয়া নম্বর থেকে ফোন দিয়ে বা চ্যাটিং করে স্বল্প সময়ে সুদে ঋণ দেয়ার কথা বলে কৌশলে ডিপোজিট থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া ইত্যাদি।

এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভয়েস কল ও ভিডিও কল রেকর্ডিং করে ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করার কৌশল শেখানোর পর তাকে দিয়ে সাইবার অপরাধের মতো নানা অপরাধের সঙ্গে তাকে জড়ানো হয়।

জালিয়াতি করতে না পারলে নির্যাতন ও আস্তানার মতো ‘জেলখানা’য় বন্দী করে রাখা হয়। নাহিদ বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে জানতে পারে তার মতো ওই আস্তায় শুধু বাংলাদেশি ৬০০ থেকে ৭০০ যুবক আটক আছে। তারা কোনভাবেই সেই অস্তানা থেকে বের হতে পারে না, বাড়িতে খবর দেয়ারও কোন সুযোগ দেয়া হতো না।

সেখানে জেলখানার চেয়েও কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে। তাদের দিনের বেলায় ঘুমাতে বলে। রাত ১১টার দিকে তাদের ক্যাসিনো সাইবার হ্যাকার নামে একটি আস্তানায় নিয়ে কাজ করতে বলে। একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসার লোভ দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে ৬ লাখ ডলার হাতিয়ে নিতে বলে। এই ধরনের অপরাধ করতে নাহিদ রাজি হয়নি। তখন তাকে নির্যাতনের হুমকি দিয়ে প্রথমে মারপিট করে আটকে রেখে শরীরে বিদ্যুতের শক দেয়। এতেও রাজি না হওয়ায় পা উঁচু করে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। তার মতো অনেককে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হতো।

নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সেই আস্তানা থেকে পালানোর চেষ্টা শুরু করে নাহিদ। অন্য দালালদের সঙ্গে চুক্তি করে তাকে গোপনে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিতে। গত মার্চ মাসে নাহিদ দালালদের দেয়ার জন্য বাড়িতে তার স্ত্রীকে ৬০ হাজার টাকা পাঠাতে বলে। সেই টাকা পাঠানোর পর নাহিদকে সেই দালালরা কম্বোডিয়া থেকে থাইল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে সে অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই দালাল থ্যাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পরে থাইল্যান্ডে থেকে বাংলাদেশ দূতাবাস তাকে থাইল্যান্ড পুলিশের মাধ্যমে দেশে পাঠিয়ে দেয়। নাহিদ দেশের মাটিতে পা রাখে গত ১৩ জুলাই।

দেশে ফেরত আসার পর তার পরিবারের পক্ষ থেকে মানবাধিকার সংগঠন ও লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। জেলা পুলিশ বিষয়টি জানার পর মানব পাচারকারী চক্রকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা হয়।

গতকাল সংবাদের কাছে দেয়া এক স্বাক্ষাতে নাহিদ মুঠোফোনে বলেন, তার মতো ৬০০ থেকে ৭০০ বাংলাদেশি কম্বোডিয়ায় মানব পাচারকারীদের আস্তায় (ক্রীতদাস) হিসেবে আটকা আছে। তার মতে,সারাদেশে এই চক্রের সিন্ডিকেট রয়েছে।

র‌্যাব-৩ এর পুলিশ সুপার বীণা রানী দাস সংবাদকে জানান, কম্বোডিয়ায় মানব পাচারকারী চক্রের গ্রেপ্তারকৃত ৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আরও ৮ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের ধরতে চলছে গোয়েন্দা তৎপরতা।