মৃত্যুদন্ডের বিধানে কি ধর্ষণ কমেছে

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

ধর্ষণ মহামারী আকারে দেখা দিলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাস করা হয়। মৃত্যুদ-ের বিধান ছিল না বলেই ধর্ষণে ধর্ষকেরা বেপরোয়া- এমন বিশ্বাস অনেকের ছিল। সবার ধারণা ছিল ধর্ষকদের মনে মৃত্যুদণ্ডের ভয় থাকলে এসিড সন্ত্রাসের মতো ধর্ষণের মহামারী হ্রাস পাবে।

কিন্তু সম্প্রতি সংঘটিত কয়েকটি ঘটনা জনগণের বিশ্বাসকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। পঞ্চগড়ে প্রতারক প্রেমিকের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে দশম শ্রেণির এক ছাত্রী। চলতি বছরের আগস্ট মাসের ৯ তারিখে এই ঘটনা ঘটেছে; প্রেমিক প্রেমিকাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়ে কাজী অফিসে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে নিয়ে যায় এক নির্জন জায়গায় এবং সেখানে তার এক বন্ধুসহ ধর্ষণ করতে থাকলে মেয়েটির চিৎকার শুনে পাঁচজন যুবক ছুটে আসে, প্রেমিক ও তার বন্ধু পালিয়ে যায়। মেয়েটি আশ্বস্ত হয়; কিন্তু পরক্ষণেই নবাগত পাঁচজন মেয়েটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারাও হায়েনার মতো মেয়েটিকে ছিন্নভিন্ন করে ধর্ষণ করে।

কিছুদিন আগে গাজীপুর জেলায় চলন্ত বাস থেকে স্বামীকে ফেলে দিয়ে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনে নওগাঁ থেকে গাজীপুর হয়ে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে গভীর রাতে তাকওয়া পরিবহনের একটি বাসে এই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। গাজীপুর থেকে ছাড়ার সময় নওগাঁ থেকে আসা স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও আরও দশ-বারোজন যাত্রী ছিল; যারা বিভিন্ন স্টপেজে নেমে গেলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের এমসি বাজারের কাছে বাসের কর্মীরা স্বামীকে মারধর করে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিয়ে তার স্ত্রীসহ বাস চালিয়ে চলে যায়। কিছুদূর গিয়ে বাসের চালক, হেলপারসহ অন্য আরেকটি বাসের আরও তিনজন পরিবহন শ্রমিক নারীর চোখ বেঁধে গণধর্ষণ করে রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তায় নামিয়ে দিলে টহল পুলিশ তাকে উদ্ধার করে শ্রীপুর থানায় নিয়ে যায়। এ ঘটনায় পাঁচজন পরিবহন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

দুই বছর আগে মুরারি চাঁদ বা এমসি কলেজের ফটকের সামনে নবদম্পতি বেড়াতে গেলে সেখান থেকে জোর করে তুলে নিয়ে কয়েকজন দুর্বৃত্ত স্ত্রীকে ধর্ষণ করে। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সাভার পৌরসভার পালপাড়া এলাকায় ভাইয়ের সঙ্গে রিকশায় করে হাসপাতালে যাওয়ার পথে নীলা রায়কে ছিনিয়ে নিয়ে বখাটে মিজানুর ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। ভিন্নধর্মের একটি মেয়ের ভালোলাগা, মন্দলাগার কোন প্রশ্ন নেই- মিজান চৌধুরীর পছন্দই ভালোবাসার একমাত্র পরিমাপক। স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে যে নারী ধর্ষিতা হন সেই নারীর নিরাপত্তা রাশিয়া বা আমেরিকার সর্বাধুনিক মিসাইল দিয়েও রক্ষা করা সম্ভব নয়। ভাইয়ের পাশ থেকে বোনকে ছিনিয়ে নেয়ার দুঃসাহস দুর্বৃত্তদের তখনই হয় যখন সমাজে চরম অরাজকতা বিরাজ করে।

দেশের প্রায় প্রতিটি মাদ্রাসা, মক্তব, এতিমখানার ছাত্রছাত্রীরা তাদেরই শিক্ষক দ্বারা অহরহ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। মাদ্রাসা, মক্তবে যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলোর বর্ণনা পড়লে মনে হয়, ধর্মীয় মূল্যবোধ সংশ্লিষ্ট মাওলানা, ইমামদের মধ্যে কোন রেখাপাত করতে পারেনি। এসব মাওলানা, ইমাম ও মুয়াজ্জিনের বলাৎকার ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে প্লে-গ্রুপের ছাত্রছাত্রীও। ধর্মের লেবাসধারী এই লোকগুলোর ধর্ষণের কাহিনী বিকৃত ও অভিনব- শিশুর মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে, হাত-পা বেঁধে ধর্ষণ ও বলাৎকার করা হয়; কোন কোন ক্ষেত্রে চকোলেট দিয়ে, কোন কোন ক্ষেত্রে গোসল বা গায়ে তেল মাখানোর ফজিলত বর্ণনা করতে করতে, কখনো কখনো সওয়াব কামানোর বাণী দিয়ে, আবার কখনো কখনো বেহেশত পাওয়ার আশ্বাসবাণী শুনিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। এমনও দেখা গেছে, নির্যাতিত শিশুর যন্ত্রণার চিৎকার শুনে ধর্ষক মাওলানারা বেশি বেশি যৌন উত্তেজনা অনুভব করেছেন। দোজখের আগুনে দগ্ধ হওয়ার ভীতিজনক শাস্তির ভয়ও তাদের কুৎসিত প্রবৃত্তি থেকে বিরত রাখতে পারে না।

বাসের ড্রাইভার, সুপারভাইজার, হেলপার, শিক্ষক, ইমাম, মুয়াজ্জিন, কিশোর সন্ত্রাসী- একেকটা মূর্তিমান ধর্ষক হয়ে উঠেছে। লালিত সামাজিক রীতিনীতি ছাড়াও অশিক্ষিত মোল্লা, মৌলভীদের নারীবিদ্বেষী ওয়াজ-মাহফিল শুনেও লম্পট পুরুষের পৌরষত্ব জেগে ওঠে। তাই লম্পট পুরুষগুলো নারীর সম্মতির তোয়াক্কা করে না; ঠিক আদিম যুগের মতো। যৌন হয়রানির শিকার নারীরা পুরুষের বিকৃত পৌরষত্বের বিরুদ্ধে বলতে সাহস করে না। কোন মেয়ে একটু সাহসী হলেই সমাজ থেকে রব উঠে- মেয়েরা ঘর থেকে বের হয় কেন? মেয়েরা হবে অসূর্যস্পর্শা, সূর্যের আলো গায়ে লাগানো তাদের জন্য অপরাধ। নারীদের শুধু ভোগের বস্তু মনে করা হয় বলেই দেখামাত্র ধর্ষণের উদগ্র বাসনা জাগে। মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত হওয়া সত্ত্বেও নারী দেখলেই সম্ভোগের বাসনা কেন জাগে তার ব্যাখ্যা কোন কপট ধার্মিকদের কাছে নেই।

আবেগ সংযত হবে বুদ্ধি দ্বারা। সংযম সাধনায় অসমর্থ ব্যক্তিরাই পোশাকের অজুহাত দিয়ে ধর্ষণের কারণ খোঁজে। আমাদের সমাজে শৈশব থেকেই ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক মেলামেশার ক্ষেত্রগুলোকে সংকুচিত করে রাখা হয়। ছেলেমেয়েদের একত্রে চলাফেরা করতে দেয়া হয় না, সহশিক্ষা নিষিদ্ধ, প্রেমিক-প্রেমিকা পার্কে বসলে শুধু মস্তান নয়, পুলিশও চাঁদা দাবি করে। এসব প্রতিবন্ধকতার কারণে মনের মধ্যে তৈরি হয় অজানা কৌতূহল, ক্রিয়াশীল থাকে অজানা আকর্ষণ, কিন্তু জাগে না পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ।

ছোটবেলা থেকে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সহজ বন্ধুত্ব গড়ে তোলা সম্ভব হলে পুরুষ বা নারী সম্পর্কে অনেকগুলো কৌতূহল আপনা আপনিই মিটে যায়। স্কুল, কলেজে যৌন বিষয়ক শিক্ষা দেয়া গেলে ছাত্রছাত্রীরা যৌনতার অপব্যবহার রোধে কিছুটা সচেতন হতে পারে এবং সচেতন হলে ভুলের মাত্রাও হ্রাস পাবে। নারীদেহকে তখন আর শুধু সেক্সচুয়াল অবজেক্ট মনে হবে না।

পৃথিবীর প্রতিটি দেশে যৌন নির্যাতন রয়েছে। সম্পূর্ণ ধর্ষণমুক্ত সমাজ কখনই ছিল না, এখনো নেই। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করে আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে কোন নারী পরিবার ও সমাজে সম্মানিত হয়নি। ধর্ষিতা মেয়েরা মায়ের কাছে অবহেলিত, বাবার কাছে অনাদৃত, ভাইবোনদের কাছে অস্পৃশ্য, সমাজের কাছে অপাঙ্কক্তেয় কোন অনুষ্ঠানে তাদের সঙ্গী করা হয় না, কেউ বেড়াতে এলে তাকে লুকিয়ে রাখা হয়। সমাজ তো নারীর মধ্যে শুধু অপরাধই খুঁজে বেড়ায়। নারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সমাজ পুরুষদের দায়ী করতে নারাজ। একাত্তরে পাকিস্তানিরা নির্বিচারে বাঙালি মহিলাদের ধর্ষণ করেছে। সম্প্রতি রোহিঙ্গা মহিলাদের ধর্ষণ করেছে মায়ানমারের বৌদ্ধ সেনারা, ভিয়েতনামী মহিলাদের ধর্ষণ করেছে আমেরিকান সেনাবাহিনী, কুয়েত দখল করে সেখানকার মেয়েদের ধর্ষণ করেছে ইরাকি সেনা, কোরিয়ার মেয়েদের ধর্ষণ করেছে জাপানি সেনারা। পৃথিবীর যেখানেই যুদ্ধ হয়েছে সেখানেই যুদ্ধরত সেনারা টার্গেট করেছে মেয়ে জাতিকে।

ধর্মপ্রবণ রক্ষণশীল দেশগুলোতে ধর্ষণের শিকার একজন নারীর পক্ষে ধর্ষণের বিচার চাওয়া, পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা কিংবা আদালতের শরণাপন্ন হওয়া একটি বিশাল ঝুঁকির কাজ। অধিকাংশ সময়ে ধর্ষিতাকেই নানাভাবে অপমান অপদস্থ করা হয়। শুধু সামাজিকভাবে নয়, পারিবারিকভাবেও ধর্ষিতাকে হেয় করা হয়। ধর্ষণের প্রমাণ দিতে দিতে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে জীবনও দিতে হয়। শরিয়া আইন অনুযায়ী চারজন পুরুষ সাক্ষী যোগাড় করা সম্ভব হয় না বিধায় ধর্ষিতা নারী চুপ করে থাকে এবং এ কারণেই মুসলিম দেশগুলোতে ধর্ষণের অফিসিয়াল রিপোর্টের সংখ্যা কম। ধর্ষণ কমবে সেদিন যেদিন পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছে কোন নারী ধর্ষিতা বলে নিগৃহীত হবে না।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ২৭ ভাদ্র ১৪২৯ ১৪ সফর ১৪৪৪

মৃত্যুদন্ডের বিধানে কি ধর্ষণ কমেছে

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

ধর্ষণ মহামারী আকারে দেখা দিলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাস করা হয়। মৃত্যুদ-ের বিধান ছিল না বলেই ধর্ষণে ধর্ষকেরা বেপরোয়া- এমন বিশ্বাস অনেকের ছিল। সবার ধারণা ছিল ধর্ষকদের মনে মৃত্যুদণ্ডের ভয় থাকলে এসিড সন্ত্রাসের মতো ধর্ষণের মহামারী হ্রাস পাবে।

কিন্তু সম্প্রতি সংঘটিত কয়েকটি ঘটনা জনগণের বিশ্বাসকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। পঞ্চগড়ে প্রতারক প্রেমিকের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে দশম শ্রেণির এক ছাত্রী। চলতি বছরের আগস্ট মাসের ৯ তারিখে এই ঘটনা ঘটেছে; প্রেমিক প্রেমিকাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়ে কাজী অফিসে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে নিয়ে যায় এক নির্জন জায়গায় এবং সেখানে তার এক বন্ধুসহ ধর্ষণ করতে থাকলে মেয়েটির চিৎকার শুনে পাঁচজন যুবক ছুটে আসে, প্রেমিক ও তার বন্ধু পালিয়ে যায়। মেয়েটি আশ্বস্ত হয়; কিন্তু পরক্ষণেই নবাগত পাঁচজন মেয়েটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারাও হায়েনার মতো মেয়েটিকে ছিন্নভিন্ন করে ধর্ষণ করে।

কিছুদিন আগে গাজীপুর জেলায় চলন্ত বাস থেকে স্বামীকে ফেলে দিয়ে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনে নওগাঁ থেকে গাজীপুর হয়ে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে গভীর রাতে তাকওয়া পরিবহনের একটি বাসে এই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। গাজীপুর থেকে ছাড়ার সময় নওগাঁ থেকে আসা স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও আরও দশ-বারোজন যাত্রী ছিল; যারা বিভিন্ন স্টপেজে নেমে গেলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের এমসি বাজারের কাছে বাসের কর্মীরা স্বামীকে মারধর করে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিয়ে তার স্ত্রীসহ বাস চালিয়ে চলে যায়। কিছুদূর গিয়ে বাসের চালক, হেলপারসহ অন্য আরেকটি বাসের আরও তিনজন পরিবহন শ্রমিক নারীর চোখ বেঁধে গণধর্ষণ করে রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তায় নামিয়ে দিলে টহল পুলিশ তাকে উদ্ধার করে শ্রীপুর থানায় নিয়ে যায়। এ ঘটনায় পাঁচজন পরিবহন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

দুই বছর আগে মুরারি চাঁদ বা এমসি কলেজের ফটকের সামনে নবদম্পতি বেড়াতে গেলে সেখান থেকে জোর করে তুলে নিয়ে কয়েকজন দুর্বৃত্ত স্ত্রীকে ধর্ষণ করে। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সাভার পৌরসভার পালপাড়া এলাকায় ভাইয়ের সঙ্গে রিকশায় করে হাসপাতালে যাওয়ার পথে নীলা রায়কে ছিনিয়ে নিয়ে বখাটে মিজানুর ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। ভিন্নধর্মের একটি মেয়ের ভালোলাগা, মন্দলাগার কোন প্রশ্ন নেই- মিজান চৌধুরীর পছন্দই ভালোবাসার একমাত্র পরিমাপক। স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে যে নারী ধর্ষিতা হন সেই নারীর নিরাপত্তা রাশিয়া বা আমেরিকার সর্বাধুনিক মিসাইল দিয়েও রক্ষা করা সম্ভব নয়। ভাইয়ের পাশ থেকে বোনকে ছিনিয়ে নেয়ার দুঃসাহস দুর্বৃত্তদের তখনই হয় যখন সমাজে চরম অরাজকতা বিরাজ করে।

দেশের প্রায় প্রতিটি মাদ্রাসা, মক্তব, এতিমখানার ছাত্রছাত্রীরা তাদেরই শিক্ষক দ্বারা অহরহ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। মাদ্রাসা, মক্তবে যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলোর বর্ণনা পড়লে মনে হয়, ধর্মীয় মূল্যবোধ সংশ্লিষ্ট মাওলানা, ইমামদের মধ্যে কোন রেখাপাত করতে পারেনি। এসব মাওলানা, ইমাম ও মুয়াজ্জিনের বলাৎকার ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে প্লে-গ্রুপের ছাত্রছাত্রীও। ধর্মের লেবাসধারী এই লোকগুলোর ধর্ষণের কাহিনী বিকৃত ও অভিনব- শিশুর মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে, হাত-পা বেঁধে ধর্ষণ ও বলাৎকার করা হয়; কোন কোন ক্ষেত্রে চকোলেট দিয়ে, কোন কোন ক্ষেত্রে গোসল বা গায়ে তেল মাখানোর ফজিলত বর্ণনা করতে করতে, কখনো কখনো সওয়াব কামানোর বাণী দিয়ে, আবার কখনো কখনো বেহেশত পাওয়ার আশ্বাসবাণী শুনিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। এমনও দেখা গেছে, নির্যাতিত শিশুর যন্ত্রণার চিৎকার শুনে ধর্ষক মাওলানারা বেশি বেশি যৌন উত্তেজনা অনুভব করেছেন। দোজখের আগুনে দগ্ধ হওয়ার ভীতিজনক শাস্তির ভয়ও তাদের কুৎসিত প্রবৃত্তি থেকে বিরত রাখতে পারে না।

বাসের ড্রাইভার, সুপারভাইজার, হেলপার, শিক্ষক, ইমাম, মুয়াজ্জিন, কিশোর সন্ত্রাসী- একেকটা মূর্তিমান ধর্ষক হয়ে উঠেছে। লালিত সামাজিক রীতিনীতি ছাড়াও অশিক্ষিত মোল্লা, মৌলভীদের নারীবিদ্বেষী ওয়াজ-মাহফিল শুনেও লম্পট পুরুষের পৌরষত্ব জেগে ওঠে। তাই লম্পট পুরুষগুলো নারীর সম্মতির তোয়াক্কা করে না; ঠিক আদিম যুগের মতো। যৌন হয়রানির শিকার নারীরা পুরুষের বিকৃত পৌরষত্বের বিরুদ্ধে বলতে সাহস করে না। কোন মেয়ে একটু সাহসী হলেই সমাজ থেকে রব উঠে- মেয়েরা ঘর থেকে বের হয় কেন? মেয়েরা হবে অসূর্যস্পর্শা, সূর্যের আলো গায়ে লাগানো তাদের জন্য অপরাধ। নারীদের শুধু ভোগের বস্তু মনে করা হয় বলেই দেখামাত্র ধর্ষণের উদগ্র বাসনা জাগে। মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত হওয়া সত্ত্বেও নারী দেখলেই সম্ভোগের বাসনা কেন জাগে তার ব্যাখ্যা কোন কপট ধার্মিকদের কাছে নেই।

আবেগ সংযত হবে বুদ্ধি দ্বারা। সংযম সাধনায় অসমর্থ ব্যক্তিরাই পোশাকের অজুহাত দিয়ে ধর্ষণের কারণ খোঁজে। আমাদের সমাজে শৈশব থেকেই ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক মেলামেশার ক্ষেত্রগুলোকে সংকুচিত করে রাখা হয়। ছেলেমেয়েদের একত্রে চলাফেরা করতে দেয়া হয় না, সহশিক্ষা নিষিদ্ধ, প্রেমিক-প্রেমিকা পার্কে বসলে শুধু মস্তান নয়, পুলিশও চাঁদা দাবি করে। এসব প্রতিবন্ধকতার কারণে মনের মধ্যে তৈরি হয় অজানা কৌতূহল, ক্রিয়াশীল থাকে অজানা আকর্ষণ, কিন্তু জাগে না পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ।

ছোটবেলা থেকে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সহজ বন্ধুত্ব গড়ে তোলা সম্ভব হলে পুরুষ বা নারী সম্পর্কে অনেকগুলো কৌতূহল আপনা আপনিই মিটে যায়। স্কুল, কলেজে যৌন বিষয়ক শিক্ষা দেয়া গেলে ছাত্রছাত্রীরা যৌনতার অপব্যবহার রোধে কিছুটা সচেতন হতে পারে এবং সচেতন হলে ভুলের মাত্রাও হ্রাস পাবে। নারীদেহকে তখন আর শুধু সেক্সচুয়াল অবজেক্ট মনে হবে না।

পৃথিবীর প্রতিটি দেশে যৌন নির্যাতন রয়েছে। সম্পূর্ণ ধর্ষণমুক্ত সমাজ কখনই ছিল না, এখনো নেই। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করে আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে কোন নারী পরিবার ও সমাজে সম্মানিত হয়নি। ধর্ষিতা মেয়েরা মায়ের কাছে অবহেলিত, বাবার কাছে অনাদৃত, ভাইবোনদের কাছে অস্পৃশ্য, সমাজের কাছে অপাঙ্কক্তেয় কোন অনুষ্ঠানে তাদের সঙ্গী করা হয় না, কেউ বেড়াতে এলে তাকে লুকিয়ে রাখা হয়। সমাজ তো নারীর মধ্যে শুধু অপরাধই খুঁজে বেড়ায়। নারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সমাজ পুরুষদের দায়ী করতে নারাজ। একাত্তরে পাকিস্তানিরা নির্বিচারে বাঙালি মহিলাদের ধর্ষণ করেছে। সম্প্রতি রোহিঙ্গা মহিলাদের ধর্ষণ করেছে মায়ানমারের বৌদ্ধ সেনারা, ভিয়েতনামী মহিলাদের ধর্ষণ করেছে আমেরিকান সেনাবাহিনী, কুয়েত দখল করে সেখানকার মেয়েদের ধর্ষণ করেছে ইরাকি সেনা, কোরিয়ার মেয়েদের ধর্ষণ করেছে জাপানি সেনারা। পৃথিবীর যেখানেই যুদ্ধ হয়েছে সেখানেই যুদ্ধরত সেনারা টার্গেট করেছে মেয়ে জাতিকে।

ধর্মপ্রবণ রক্ষণশীল দেশগুলোতে ধর্ষণের শিকার একজন নারীর পক্ষে ধর্ষণের বিচার চাওয়া, পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা কিংবা আদালতের শরণাপন্ন হওয়া একটি বিশাল ঝুঁকির কাজ। অধিকাংশ সময়ে ধর্ষিতাকেই নানাভাবে অপমান অপদস্থ করা হয়। শুধু সামাজিকভাবে নয়, পারিবারিকভাবেও ধর্ষিতাকে হেয় করা হয়। ধর্ষণের প্রমাণ দিতে দিতে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে জীবনও দিতে হয়। শরিয়া আইন অনুযায়ী চারজন পুরুষ সাক্ষী যোগাড় করা সম্ভব হয় না বিধায় ধর্ষিতা নারী চুপ করে থাকে এবং এ কারণেই মুসলিম দেশগুলোতে ধর্ষণের অফিসিয়াল রিপোর্টের সংখ্যা কম। ধর্ষণ কমবে সেদিন যেদিন পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছে কোন নারী ধর্ষিতা বলে নিগৃহীত হবে না।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]