পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা এখন কেমন

গৌতম রায়

ভারতে নিকৃষ্ট আইনশৃঙ্খলার দৃষ্টান্ত হিসেবে উত্তর প্রদেশ, বিহারÑ এসব রাজ্যগুলোর কথা বারবার উচ্চারণের একটা রেওয়াজ দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। এসব রাজ্যের কী শহর, কী গ্রাম, কোথাও প্রায় বুঝতে পারা যায় না, দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম রয়েছে। এসব রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই আইনশৃঙ্খলা থেকে সামাজিক বিধি-বিধান নিয়ন্ত্রিত হয় কার্যত ব্রিটিশ যুগের সামন্ততান্ত্রিক একটা রীতিনীতির ভেতর দিয়ে। ওই সব রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় দলিত সম্প্রদায়ের হিন্দু এবং সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর বর্ণহিন্দু সমাজের বিভৎস্য সামাজিক অত্যাচার, যে অত্যাচারের নেপথ্যে থাকে ওই সব রাজ্যগুলোর শাসক দল, সেসব দেখলে ভাবতে একটু অবাক লাগে যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হয়ে ভারত আজ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এই দেশে নির্বাচিত সংসদ আছে। বিধানসভা আছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত পুলিশ আছে। আইনশৃঙ্খলা ঘিরে শাসককে জবাবদিহি করতে হয়- এ সমস্ত বিষয়গুলো ভেবে।

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত ২০১১ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে প্রায় এক যুগ সময় অতিক্রান্ত। এ সময়কালে পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা, সামাজিক পরিকাঠামো এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে, উত্তর প্রদেশ-বিহারের সঙ্গেই কেবল এখন আর পশ্চিমবঙ্গের তুলনা করা চলে না, বরঞ্চ বলতে হয়; কোনো কোনো ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনাধীন পশ্চিমবঙ্গ উত্তর প্রদেশ- বিহারের সামাজিক বিশৃঙ্খলা, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জায়গায় শাসক নিয়ন্ত্রিত সামাজিক বিধি-বিধানের প্রশ্নে, এখন উত্তর প্রদেশ-বিহারকেও ছাপিয়ে নিজের জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে এখন কার্যত আইনের শাসন বলে বিষয়টি শুধু অনুপস্থিত নয়, কার্যত উবে গিয়েছে। শাসক নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আজ পশ্চিমবঙ্গের বুকে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে যার দরুন ধর্মীয় সংখ্যালঘু ,ভাষাভিত্তিক সংখ্যালঘু , লিঙ্গভিত্তিক সংখ্যালঘু কেউই যেমন আর আর্থ-সামাজিকভাবে নিরাপদ অবস্থানে নেই। তেমনিই বলতে হয়Ñ শাসকের দাপটে অতি সাধারণ মানুষ, এমনকি তার মধ্যে যদি শাসক সমর্থকও থাকে, কিন্তু গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের দাপটে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর প্রতি সেই শাসক সমর্থক হেলে পড়েননি, তবে সেই শাসক সমর্থকেরও কেবলমাত্র আর্থ-সামাজিক বিষয় নয়, তার বেঁচে থাকার অধিকারটি পর্যন্ত আজ পশ্চিমবঙ্গে কার্যত নেই বললেই চলে।

সম্প্রতি কলকাতা লাগোয়া বাগুইহাটিতে যে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে গেল, সে ঘটনা প্রমাণ করে, ভারতের হিন্দি বলয়ের সামন্ততান্ত্রিক, জমিদার সুলভ শাসক নিয়ন্ত্রিত সমান্তরাল পুলিশ প্রশাসন, যা শাসকের বকলমে চলে। সেই গোটা পরিকাঠামো এখন পশ্চিমবঙ্গের বুকে কী ভয়ংকর রকম দাপটের সঙ্গে রাজ করে চলেছে। আনিস খান থেকে শুরু করে বাগটুই, হাঁসখালি হয়ে বাগুইহাটি জোড়া খুনÑ কোনো জায়গাতেই পুলিশের ভূমিকা দেখে সাধারণ মানুষের মনে হবে না যে, পশ্চিমবঙ্গে কোন আইনের শাসন বলবৎ রয়েছে।

প্রত্যেকটি অপরাধ মূলক ঘটনার পেছনে শাসক দলের সংশ্লিষ্ট জায়গার ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর দাপট এবং সেই শাসকগোষ্ঠীকে আঙাল করতে পুলিশ প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের আদাজল খেয়ে নেমে পড়বার মানসিকতা একেবারে বিষাক্ত ঘায়ের মতো গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এখন দগ দগ করছে। শাসকের দৌলাতে, শাসকের ঘনিষ্ঠতায়, কখনো ব্যক্তি হত্যা, কখনো পরিবারগত খুন, কখনো বা গণহত্যাÑ এসব কিছু সংঘটিত হবার পরও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত দিতে রাজ্যের শাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার নারাজ। আক্রান্তের পরিবার শবদাহ পর্যন্ত ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে বা পারিবারিক আবেগকে বজায় রেখে করতে পারছেন না। শ্মশানে গিয়ে পর্যন্ত শাসকের পরিকল্পিত সন্ত্রাসের নিহত মানুষদের ঘনিষ্ঠ পরিবারবর্গের ওপরে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হুমকি শাসক দল এবং তার বশংবদ, তাঁবেদার পুলিশ বাহিনী, যাকে কার্যতো সুশৃঙ্খল গুন্ডাবাহিনী বলেই অভিহিত করতে হয়, তাদের হুমকি এখন গোটা পশ্চিমবঙ্গের একটা সামাজিক দস্তুরে পরিণত হয়েছে।

শাসকের সন্ত্রাসে পরিকল্পিত খুনের ঘটনা, তা সে আনিস খান হোক বা বগটুই গণহত্যাই হোকÑ হাঁসখালীর গণধর্ষিতা বঙ্গবালাই হোক কিংবা বাগুইহাটির জোড়া কিশোর- কোনো ক্ষেত্রেই রাজ্য প্রশাসন বা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এতোটুকু সদর্থক ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায় না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজের দলের সুশৃঙ্খল গুন্ডাবাহিনীকে প্রচ্ছন্ন মদদ প্রকাশ্য সভা থেকে দিয়ে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলার গোটা পরিকাঠামোকেই একেবারে কারবালার ময়দানের হাহাকারে পরিণত করেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের দৌলতে এসব সংগঠিত গণহত্যা, খুন, ধর্ষণ, বলাৎকারÑ শাসক নিয়ন্ত্রিত অপরাধে আক্রান্তদের পাশে বিরোধী বামপন্থিদের দাঁড়াবার জায়গাটুকু পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার পুলিশ প্রশাসন এবং দলের সুশৃঙ্খল গুন্ডাবাহিনীর দ্বারা আটকে দিতে চান। আনিস খানের পরিবারের পাশে যখন মোহাম্মদ সেলিমের নেতৃত্বে বামপন্থি মানুষজনেরা দাঁড়িয়েছেন, তখন নানাভাবে আনিস খানের পরিবারকে টাকার বিনিময় কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল ও প্রশাসন। পুলিশ নানাভাবে আনিস খানের পরিবারকে চাকরির টোপ অর্থের টোপ দিয়ে কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেছে।

বাগটুই গণহত্যা সংঘটিত হবার পর ঘটনাস্থলে যাতে সিপিআইর (এম) শীর্ষ নেতা মহম্মদ সেলিম না পৌঁছতে পারেন, তার জন্য প্রশাসনকে সর্বপ্রকারে কাজে লাগিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে, কার্যত গেরিলা কায়দায় সেদিন অকুস্থলে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন সেলিম।

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পেলাম বাগুইহাটিতে জোড়া কিশোর খুনের ঘটনার পর। সেখানে নিহতদের পরিবার, মহম্মদ সেলিম ও তার সহযোদ্ধাদের কাছে নিজেদের দুঃখ-যন্ত্রণা কথা বলতে উদগ্রীব, অথচ তাদের নানাভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে স্থানীয় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলোÑ আনন্দবাজার গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত বৈদ্যুতিন প্রচারমাধ্যম অসত্যভাবে প্রচার করেছে- নিহত কিশোরদের পরিবার বিজেপি নেতৃত্বকে যেমন তাদের বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি, তেমনিই বামপন্থি নেতৃত্বদেরকেও তাদের বাড়িতে ঢুকতে দেননি।

সংবাদমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে যে নিরপেক্ষতা দরকার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন লাগামহীন সরকারি বিজ্ঞাপন এবং তাঁবেদার সংবাদমাধ্যম বা বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের একটা বড় অংশের লোকজনদের কার্যত কিনে নিয়ে, পশ্চিমবঙ্গে কোন ধরনের নিরপেক্ষ খবর পরিবেশিত হতে দেন না। তাই মহম্মদ সেলিম, সুজন চক্রবর্তী প্রমুখ রাজ্যের বামপন্থি আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্ব, তৃণমূল কংগ্রেসের দ্বারা সংঘটিত বাগুইহাটি জোড়া খুনের নারকীয়তার প্রতিবাদ জানিয়ে যখন বাগুইহাটি থানার সামনে প্রতিবাদ সভায় নেতৃত্ব দেন, নিহতদের বাড়িতে গিয়ে শোকার্ত পরিবারের মানুষজনদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন এবং সেই পরিবারগুলো, সেলিমের কাছে নিজেদের যন্ত্রণার কথা বলেন, তখন ইচ্ছাকৃতভাবে আনন্দবাজার গোষ্ঠী, তাদের বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে প্রচার করতে থাকে যে, বিজেপি নেতৃত্বকে যেমন নিহতদের পরিবার তাদের বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি, তেমনি বামপন্থি নেতৃত্ব কেউ নিহতদের পরিবার তাদের বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি।

মহম্মদ সেলিম যখন নিহতদের পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তৃণমূলের স্থানীয় সমর্থকেরা নিহতদের বাড়ির সামনে চরম অসভ্যতার পরিচয় দেয়, সামাজিক গণমাধ্যমের দৌলতে সাধারণ মানুষ, শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের সেই সব অসভ্যতামির খবর জানতে পারলেও পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমের সিংহভাগ, যারা কার্যত শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এবং কেন্দ্রের শাসক বিজেপির পক্ষে প্রায় আড়াআড়িভাবে বিভক্ত হয়ে গিয়েছেন, তারা একটিও সত্য ঘটনা তুলে ধরবার মতো হিম্মত দেখাতে সক্ষম হয়নি।

বিহার, উত্তর প্রদেশে যখনই যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন থেকেছে, তারাই নিজেদের নিয়ন্ত্রিত দলীয় কর্মী-সমর্থক নামধারী একদল ঘোষিত সমাজ বিরোধীদের দ্বারা সংগঠিত খুন জখম, ধর্ষণ ইত্যাদির ঘটনাকে একদিকে আড়াল করে রেখেছে, অপরদিকে অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়ের মধ্যে রেখেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পশ্চিমবঙ্গে তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের দ্বারা সংঘটিত সামাজিক অপরাধ, আইনশৃঙ্খলাজনিত অপরাধ, আর্থিক অপরাধÑ সব ক্ষেত্রেই নিজের দলের অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন নিজের পুলিশ বাহিনীর দ্বারা। এখানেই থেমে থাকছেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গরু পাচার থেকে শুরু করে বহু আর্থিক বেনিয়াম, সমান্তরাল প্রশাসন চালানো ইত্যাদি অপরাধে অভিযুক্ত বীরভূম জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের দোর্দ-প্রতাপ নেতা অনুব্রত মণ্ডল, যিনি কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্তকারী সংস্থার দ্বারা গ্রেপ্তার হয়ে রয়েছেন, তাকে প্রকাশ্য মঞ্চ থেকে ঢালাও প্রশংসাপত্র দিয়ে একদিকে যেমন অপরাধীদের বরাভয় প্রদান করছেন মমতা, অপরদিকে তেমনি তদন্তকেও ব্যাপকভাবে তিনি প্রভাবিত করবার চেষ্টা করছেন। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো- গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে পরিচিত সংবাদমাধ্যম, তাদের একটা বড় অংশ, অপরাধীকে আড়াল করবার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সক্রিয় উদ্যোগকে সমালোচনা তো দূরের কথা, কার্যত সমর্থন করে চলেছেন।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ২৭ ভাদ্র ১৪২৯ ১৪ সফর ১৪৪৪

পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা এখন কেমন

গৌতম রায়

ভারতে নিকৃষ্ট আইনশৃঙ্খলার দৃষ্টান্ত হিসেবে উত্তর প্রদেশ, বিহারÑ এসব রাজ্যগুলোর কথা বারবার উচ্চারণের একটা রেওয়াজ দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। এসব রাজ্যের কী শহর, কী গ্রাম, কোথাও প্রায় বুঝতে পারা যায় না, দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম রয়েছে। এসব রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই আইনশৃঙ্খলা থেকে সামাজিক বিধি-বিধান নিয়ন্ত্রিত হয় কার্যত ব্রিটিশ যুগের সামন্ততান্ত্রিক একটা রীতিনীতির ভেতর দিয়ে। ওই সব রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় দলিত সম্প্রদায়ের হিন্দু এবং সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর বর্ণহিন্দু সমাজের বিভৎস্য সামাজিক অত্যাচার, যে অত্যাচারের নেপথ্যে থাকে ওই সব রাজ্যগুলোর শাসক দল, সেসব দেখলে ভাবতে একটু অবাক লাগে যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হয়ে ভারত আজ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এই দেশে নির্বাচিত সংসদ আছে। বিধানসভা আছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত পুলিশ আছে। আইনশৃঙ্খলা ঘিরে শাসককে জবাবদিহি করতে হয়- এ সমস্ত বিষয়গুলো ভেবে।

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত ২০১১ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে প্রায় এক যুগ সময় অতিক্রান্ত। এ সময়কালে পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা, সামাজিক পরিকাঠামো এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে, উত্তর প্রদেশ-বিহারের সঙ্গেই কেবল এখন আর পশ্চিমবঙ্গের তুলনা করা চলে না, বরঞ্চ বলতে হয়; কোনো কোনো ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনাধীন পশ্চিমবঙ্গ উত্তর প্রদেশ- বিহারের সামাজিক বিশৃঙ্খলা, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জায়গায় শাসক নিয়ন্ত্রিত সামাজিক বিধি-বিধানের প্রশ্নে, এখন উত্তর প্রদেশ-বিহারকেও ছাপিয়ে নিজের জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে এখন কার্যত আইনের শাসন বলে বিষয়টি শুধু অনুপস্থিত নয়, কার্যত উবে গিয়েছে। শাসক নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আজ পশ্চিমবঙ্গের বুকে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে যার দরুন ধর্মীয় সংখ্যালঘু ,ভাষাভিত্তিক সংখ্যালঘু , লিঙ্গভিত্তিক সংখ্যালঘু কেউই যেমন আর আর্থ-সামাজিকভাবে নিরাপদ অবস্থানে নেই। তেমনিই বলতে হয়Ñ শাসকের দাপটে অতি সাধারণ মানুষ, এমনকি তার মধ্যে যদি শাসক সমর্থকও থাকে, কিন্তু গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের দাপটে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর প্রতি সেই শাসক সমর্থক হেলে পড়েননি, তবে সেই শাসক সমর্থকেরও কেবলমাত্র আর্থ-সামাজিক বিষয় নয়, তার বেঁচে থাকার অধিকারটি পর্যন্ত আজ পশ্চিমবঙ্গে কার্যত নেই বললেই চলে।

সম্প্রতি কলকাতা লাগোয়া বাগুইহাটিতে যে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে গেল, সে ঘটনা প্রমাণ করে, ভারতের হিন্দি বলয়ের সামন্ততান্ত্রিক, জমিদার সুলভ শাসক নিয়ন্ত্রিত সমান্তরাল পুলিশ প্রশাসন, যা শাসকের বকলমে চলে। সেই গোটা পরিকাঠামো এখন পশ্চিমবঙ্গের বুকে কী ভয়ংকর রকম দাপটের সঙ্গে রাজ করে চলেছে। আনিস খান থেকে শুরু করে বাগটুই, হাঁসখালি হয়ে বাগুইহাটি জোড়া খুনÑ কোনো জায়গাতেই পুলিশের ভূমিকা দেখে সাধারণ মানুষের মনে হবে না যে, পশ্চিমবঙ্গে কোন আইনের শাসন বলবৎ রয়েছে।

প্রত্যেকটি অপরাধ মূলক ঘটনার পেছনে শাসক দলের সংশ্লিষ্ট জায়গার ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর দাপট এবং সেই শাসকগোষ্ঠীকে আঙাল করতে পুলিশ প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের আদাজল খেয়ে নেমে পড়বার মানসিকতা একেবারে বিষাক্ত ঘায়ের মতো গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এখন দগ দগ করছে। শাসকের দৌলাতে, শাসকের ঘনিষ্ঠতায়, কখনো ব্যক্তি হত্যা, কখনো পরিবারগত খুন, কখনো বা গণহত্যাÑ এসব কিছু সংঘটিত হবার পরও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত দিতে রাজ্যের শাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার নারাজ। আক্রান্তের পরিবার শবদাহ পর্যন্ত ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে বা পারিবারিক আবেগকে বজায় রেখে করতে পারছেন না। শ্মশানে গিয়ে পর্যন্ত শাসকের পরিকল্পিত সন্ত্রাসের নিহত মানুষদের ঘনিষ্ঠ পরিবারবর্গের ওপরে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হুমকি শাসক দল এবং তার বশংবদ, তাঁবেদার পুলিশ বাহিনী, যাকে কার্যতো সুশৃঙ্খল গুন্ডাবাহিনী বলেই অভিহিত করতে হয়, তাদের হুমকি এখন গোটা পশ্চিমবঙ্গের একটা সামাজিক দস্তুরে পরিণত হয়েছে।

শাসকের সন্ত্রাসে পরিকল্পিত খুনের ঘটনা, তা সে আনিস খান হোক বা বগটুই গণহত্যাই হোকÑ হাঁসখালীর গণধর্ষিতা বঙ্গবালাই হোক কিংবা বাগুইহাটির জোড়া কিশোর- কোনো ক্ষেত্রেই রাজ্য প্রশাসন বা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এতোটুকু সদর্থক ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায় না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজের দলের সুশৃঙ্খল গুন্ডাবাহিনীকে প্রচ্ছন্ন মদদ প্রকাশ্য সভা থেকে দিয়ে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলার গোটা পরিকাঠামোকেই একেবারে কারবালার ময়দানের হাহাকারে পরিণত করেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের দৌলতে এসব সংগঠিত গণহত্যা, খুন, ধর্ষণ, বলাৎকারÑ শাসক নিয়ন্ত্রিত অপরাধে আক্রান্তদের পাশে বিরোধী বামপন্থিদের দাঁড়াবার জায়গাটুকু পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার পুলিশ প্রশাসন এবং দলের সুশৃঙ্খল গুন্ডাবাহিনীর দ্বারা আটকে দিতে চান। আনিস খানের পরিবারের পাশে যখন মোহাম্মদ সেলিমের নেতৃত্বে বামপন্থি মানুষজনেরা দাঁড়িয়েছেন, তখন নানাভাবে আনিস খানের পরিবারকে টাকার বিনিময় কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল ও প্রশাসন। পুলিশ নানাভাবে আনিস খানের পরিবারকে চাকরির টোপ অর্থের টোপ দিয়ে কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেছে।

বাগটুই গণহত্যা সংঘটিত হবার পর ঘটনাস্থলে যাতে সিপিআইর (এম) শীর্ষ নেতা মহম্মদ সেলিম না পৌঁছতে পারেন, তার জন্য প্রশাসনকে সর্বপ্রকারে কাজে লাগিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে, কার্যত গেরিলা কায়দায় সেদিন অকুস্থলে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন সেলিম।

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পেলাম বাগুইহাটিতে জোড়া কিশোর খুনের ঘটনার পর। সেখানে নিহতদের পরিবার, মহম্মদ সেলিম ও তার সহযোদ্ধাদের কাছে নিজেদের দুঃখ-যন্ত্রণা কথা বলতে উদগ্রীব, অথচ তাদের নানাভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে স্থানীয় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলোÑ আনন্দবাজার গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত বৈদ্যুতিন প্রচারমাধ্যম অসত্যভাবে প্রচার করেছে- নিহত কিশোরদের পরিবার বিজেপি নেতৃত্বকে যেমন তাদের বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি, তেমনিই বামপন্থি নেতৃত্বদেরকেও তাদের বাড়িতে ঢুকতে দেননি।

সংবাদমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে যে নিরপেক্ষতা দরকার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন লাগামহীন সরকারি বিজ্ঞাপন এবং তাঁবেদার সংবাদমাধ্যম বা বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের একটা বড় অংশের লোকজনদের কার্যত কিনে নিয়ে, পশ্চিমবঙ্গে কোন ধরনের নিরপেক্ষ খবর পরিবেশিত হতে দেন না। তাই মহম্মদ সেলিম, সুজন চক্রবর্তী প্রমুখ রাজ্যের বামপন্থি আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্ব, তৃণমূল কংগ্রেসের দ্বারা সংঘটিত বাগুইহাটি জোড়া খুনের নারকীয়তার প্রতিবাদ জানিয়ে যখন বাগুইহাটি থানার সামনে প্রতিবাদ সভায় নেতৃত্ব দেন, নিহতদের বাড়িতে গিয়ে শোকার্ত পরিবারের মানুষজনদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন এবং সেই পরিবারগুলো, সেলিমের কাছে নিজেদের যন্ত্রণার কথা বলেন, তখন ইচ্ছাকৃতভাবে আনন্দবাজার গোষ্ঠী, তাদের বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে প্রচার করতে থাকে যে, বিজেপি নেতৃত্বকে যেমন নিহতদের পরিবার তাদের বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি, তেমনি বামপন্থি নেতৃত্ব কেউ নিহতদের পরিবার তাদের বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি।

মহম্মদ সেলিম যখন নিহতদের পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তৃণমূলের স্থানীয় সমর্থকেরা নিহতদের বাড়ির সামনে চরম অসভ্যতার পরিচয় দেয়, সামাজিক গণমাধ্যমের দৌলতে সাধারণ মানুষ, শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের সেই সব অসভ্যতামির খবর জানতে পারলেও পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমের সিংহভাগ, যারা কার্যত শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এবং কেন্দ্রের শাসক বিজেপির পক্ষে প্রায় আড়াআড়িভাবে বিভক্ত হয়ে গিয়েছেন, তারা একটিও সত্য ঘটনা তুলে ধরবার মতো হিম্মত দেখাতে সক্ষম হয়নি।

বিহার, উত্তর প্রদেশে যখনই যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন থেকেছে, তারাই নিজেদের নিয়ন্ত্রিত দলীয় কর্মী-সমর্থক নামধারী একদল ঘোষিত সমাজ বিরোধীদের দ্বারা সংগঠিত খুন জখম, ধর্ষণ ইত্যাদির ঘটনাকে একদিকে আড়াল করে রেখেছে, অপরদিকে অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়ের মধ্যে রেখেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পশ্চিমবঙ্গে তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের দ্বারা সংঘটিত সামাজিক অপরাধ, আইনশৃঙ্খলাজনিত অপরাধ, আর্থিক অপরাধÑ সব ক্ষেত্রেই নিজের দলের অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন নিজের পুলিশ বাহিনীর দ্বারা। এখানেই থেমে থাকছেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গরু পাচার থেকে শুরু করে বহু আর্থিক বেনিয়াম, সমান্তরাল প্রশাসন চালানো ইত্যাদি অপরাধে অভিযুক্ত বীরভূম জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের দোর্দ-প্রতাপ নেতা অনুব্রত মণ্ডল, যিনি কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্তকারী সংস্থার দ্বারা গ্রেপ্তার হয়ে রয়েছেন, তাকে প্রকাশ্য মঞ্চ থেকে ঢালাও প্রশংসাপত্র দিয়ে একদিকে যেমন অপরাধীদের বরাভয় প্রদান করছেন মমতা, অপরদিকে তেমনি তদন্তকেও ব্যাপকভাবে তিনি প্রভাবিত করবার চেষ্টা করছেন। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো- গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে পরিচিত সংবাদমাধ্যম, তাদের একটা বড় অংশ, অপরাধীকে আড়াল করবার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সক্রিয় উদ্যোগকে সমালোচনা তো দূরের কথা, কার্যত সমর্থন করে চলেছেন।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]